সেদিন সকালে তেতলার পিসিমার ঘরে বসে এক মনে ড্রয়ার ঘাঁটছিল ছেনু। ওটা আসলে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের রত্ন ভান্ডার। যত রাজ্যের উদ্ভট জিনিসের ভিড় থেকে মনমতো জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে একটা বল্টু লাগানো লম্বা স্ক্রু ভারি পছন্দ হয়েছে, বল্টুটা খুলতে যাবে, ঠিক এমন সময় দোতলা থেকে হইচই কানে এল। শেয়ালদার মতো ব্যস্ত এলাকায় হট্টগোল তো সর্বক্ষণ লেগেই আছে, কিন্তু এই হইচই এর শব্দটা ভারি মিঠে, আর তার মধ্যে একটা চেনা চেনা গলাও উঁকি দিচ্ছে, তাই ছেনু আর থাকতে পারলো না, স্ক্রুটা ফেলে রেখে সিঁড়ি দিয়ে এক দৌড়ে নিচে নেমে এল। এসে দেখে যা ভেবেছে ঠিক তাই, দিম্মা এসেছে! সাথে এসেছে মামা, হাতে দইয়ের হাঁড়ি আর বাক্স-প্যাঁটরা। ছোড়দা আজ কলেজ যায়নি, সব জিনিসপত্র ধরে টরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। মামা ঘরে ঢুকেই বলে দিল, আমার কিন্তু দুপুরেই ট্রেন। শুনেই মা শিগগির গিয়ে রান্না চাপালো। মামা কিছুদিনের জন্য কৃষ্ণনগর ফিরেছিল, আবার এখান থেকে চলে যাবে সেইই বিলাসপুর। কলকাতায় তো আসতেই হবে ট্রেন ধরতে, তাই দিম্মাও বলেছে চল ক'দিন ঘুরে আসি কলকাতা থেকে। দিম্মাকে পেয়ে ছেনুর আনন্দ আর দেখে কে! এবার অনেকদিন পর এসেছে। ছেনু বলে, মামা আবার না ফেরা পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে। দিম্মা হেসে ফেলেছে, সে কবে ফিরবে তার ঠিক আছে? তার আগেই আবার যে অন্য ব্যাপার আছে।
- কী ব্যাপার? বলো না!
- সে বলব'খন, বলা কি পালিয়ে যাচ্ছে!
দুপুরে তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে মামা ছুটলো ট্রেন ধরতে, ছোড়দা সাথে মালপত্র নিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু মামা তাকেও এক ধমক লাগিয়েছে, শেয়ালদা থেকে ট্রেন হলে কথা ছিল, এইটা হাওড়া থেকে, তোমায় অদ্দুর ছুটতে হবেনা। তাই শুধু বাসে তুলে দিতে গেছে।
খাওয়াদাওয়ার পর খাটে শুয়ে মা, দিদিমা আর বড়দি মিলে নানান গপ্পে মেতেছিল। ছেনু শুধু থেকে থেকেই ভাবছে ওই সেই ব্যাপারটা কী, দিম্মা যেটার কথা বলবে বলছিল পরে। চুপিচুপি দইয়ের হাঁড়িটা থেকে চামচ দিয়ে কিছুটা দই খাওয়ার পর ছেনু প্রথমে ঠিক করল, বদ্দি এখন শুয়ে, এই সুযোগে ওর আঁকার পেনসিলগুলো নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক, তারপর আর থাকতে না পেরে দিম্মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, বলো না, সকালে কী বলবে বলছিলে। কি একটা ব্যাপার যেন। দিম্মা হেসে বলে ও আচ্ছা আচ্ছা, বলছি, শোও এখেনে। মেয়েকে বলেন, শোন, তোদের সব্বাইকে কিন্তু কৃষ্ণনগর যেতে হবে, মানকের ছেলের বিয়ে।
মা বলেন, মানিক কাকা, আমাদের পাশের বাড়ির?
- হ্যাঁ রে বাবা, এই বিষ্যুদবারের পরের বিষ্যুদবার। মানকে নিজেই আসতো নেমন্তন্ন করতে, আমি বললাম, আমি তো যাচ্ছিই, ওদের কার্ডটাও আমার হাতে দিয়ে দে। তোদের সবাইকে যেতে বলেছে কিন্তু।
- সবার তো আপিস কাছারি, ইস্কুল, কলেজ রয়েছে। এদের ফেলে কী করে যাব বলো তো! তুমি একাই যেও বরং।
- সে কী! তোরা না গেলে আমি যাব কী করে? তোরা কেউ যাবি না? আচ্ছা ছোট্টুকে নিয়ে যাবো? (ছেনুকে) কি গো, তুমি পারবেনা আমায় নিয়ে যেতে?
- মা, ও তো ছোটো, ও কি করে পারবে?
কৃষ্ণনগর তো দূর, ছেনু আজ অব্দি উল্টোডাঙ্গা পর্যন্তও একা একা বেড়াতে যায়নি। এই সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়! ছেনু ছুট্টে গিয়ে আলনা থেকে বড়দার একটা ফুলপ্যান্ট বের করে, পায়া গুটিয়ে পরে চলে এল, কোমরটা ঢলঢলে, তাই এক হাতে ধরে চোখ বড় বড় করে বলল, আমি ছোটো? এই দ্যাখো এখন আমি ফুলপ্যান পরি। আমি ঠিক তোমায় নিয়ে যেতে পারবো।
কীভাবে দিম্মা সেদিন মাকে রাজি করিয়েছিল কে জানে, তবে ছেনুর উৎসাহে আর দিম্মার আশ্বাসে শেষ অব্দি ঠিক হলো ছেনু আর দিম্মা মিলে ট্রেনে চেপে কৃষ্ণনগরে যাওয়া হবে।
উৎসাহের চোটে এর পরের দিনগুলো কিভাবে ফাস্ট ফরোয়ার্ড হয়ে গেল, কেউ আর টের পায়নি। যাইহোক আমরা একেবারে যাওয়ার দিনে গিয়েই দেখি কী কান্ড চলছে! সকালবেলার ট্রেন, বাড়ির কাছেই শেয়ালদা থেকে ছাড়বে, ছেনু ও তার দিদিমাকে ট্রেনে তুলতে সবাই মিলে হাজির হয়েছে। ওঠার আগে মহারাজ একবার শাঁ করে ছুটে ইঞ্জিন অব্দি দেখে এলেন। বাড়ির কাছেই স্টেশন হওয়ার দৌলতে ট্রেন ব্যাপারটা একেবারে অচেনা বস্তু নয়, একবার দুবার চেপে দেখাও হয়েছে। হঠাৎ হাপিস হয়ে যাওয়ায় মা কষে বকুনি লাগালো, সবসময় দিম্মার হাত ধরে থাকবি, একদম কাছছাড়া হবি না, ওখানে গিয়ে দিম্মার কথা শুনে চলবি, ইত্যাদি নানান ভাষণ। ছোড়দা পাশ থেকে বলে উঠল ওখানকার মহারাজ কিন্তু ভীষন কড়া, দুষ্টুমি দেখলেই ধরে শূলে চড়িয়ে দেয়! ছেনুর উত্তরও সাথে সাথে তৈরি, কেন গোপাল ভাঁড় আছে না, ঠিক বাঁচিয়ে নেবে আমায়। এরকম নানা হাসি মজা, ট্রেনে উঠে সাথে বেঁধে দেওয়া চিড়ে, মুড়ির সদগতিকরণের ও কোনো স্টেশনে না নামার উপদেশ দেওয়া, শেষ মুহূর্তের প্রণাম টনাম ইত্যাদির শেষে সিটে বসতেই ভোঁ বাজিয়ে ট্রেনটা হুশ করে ছেড়ে দিল।
ট্রেনে যেতে যেতে বেশ ভালোই লাগছিল, জানলার ধার দেখে ওরা বসেছে, হু হু করে হাওয়া লাগছে মুখে। বাইরের দৃশ্য ক্রমশ বদলে বদলে যাচ্ছে, তখন কলকাতার আশপাশ একটু পেরোলেই বেশ দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্ষেত, গাছপালা চোখে পড়ত। ছেনু সেসব মুগ্ধ হয়ে দেখে চলেছে, হঠাৎ হুঁশ ফিরল একটু দূর থেকে আসা ঝালমুড়িওলার ডাকে। দিদিমার হাত ধরে বায়না করা শুরু, ঝালমুড়ি খাবে? দিদিমা প্রাজ্ঞ মহিলা, তিনি বুঝলেন ট্রেনে চেপে গেলে স্টেশন ও ফেরিওয়ালা পরপর আসতেই থাকবে, সাথে ছেনুর বায়না, তাই যা করার শুরুতেই করতে হবে। তিনি ফিসফিস করে বললেন, ছোট্টুবাবু, তুমি তো জানো না, ট্রেনের খাবার একদম খেতে নেই। ওই খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশানো থাকে, খেয়ে যেই কোনো ছোট বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়ে, ওমনি তাদের ধরে বস্তায় করে আরবে না কোথায় পাঠিয়ে, সেখানে উটের দৌড় করায়। তাতে না জিততে পারলে আর খাবার দেয়না। তুমি কি উটের দৌড়ে যাবে? উটের দৌড় ব্যাপারটা মন্দ না লাগলেও, না খাইয়ে রাখাটা মহারাজের ঠিক মনঃপূত হলো না। তাই আর বাকি রাস্তা তেমন বায়না টায়না ধরলেন না। সঙ্গে আনা মুড়ি-চিঁড়েরই সদ্ব্যবহার করা হল।
মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটেই ট্রেন কৃষ্ণনগর পৌঁছল।
স্টেশনে নেমেই ছেনুর কি আনন্দ, দ্যাখো ঠিক তোমায় একা একা নিয়ে চলে এলুম!
স্টেশনের ধার থেকে রিকশা চেপে বাড়ি পৌঁছুনো গেল। ওখানকার লোকেরা কেউ ছেনুকে আগে দেখেনি। মহারাজের বেশ ভালোই খাতিরদারি জুটল। তবে বাড়ির ছেলের বিয়ে ছিল আগের দিন, আজ বউ নিয়ে ফিরবে বলে সবাই সারাক্ষণই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে রয়েছে। তার মধ্যেই আশেপাশের কয়েকটা নতুন দাদা আর দিদির সাথে ছেনুর আলাপ জমেছে। ওদের সাথে সাথে এবাড়ি ওবাড়ি ছোটাছুটি করছে, লুকোচুরি খেলা চলছে। মাঝে এক ফাঁকে এসে দিম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখানে গোপাল ভাঁড়ের বাড়িটা কোথায় গো ? আমায় নিয়ে যাবে একবার? দিম্মা কি আর করে, বলল, এখান থেকে বেশ দূর তো, পরে নিয়ে যাব'খন।
এমনি সময় হঠাৎ হইচই বেঁধে গেল, বউ আসছে, বউ আসছে! যারা বরণ করবে, সবাই তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বরণডালা হাতে। প্রথমে উলু দিয়ে, তারপর হরেক কলাকৌশল পার করে বউকে নিয়ে বর মহাশয় ভিতরে ঢোকার সুযোগ পেলেন। ছেনু অবাক হয়ে বর-বউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। বাড়ির ভিতরে ঢুকেও তাদের নিস্তার নেই! আবার কি একটা পুজো গোছের হলো। পুজো শেষে নিয়ম ছিল, একটা বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে মিষ্টি খাওয়াতে হয়। বাড়ির সমস্ত বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো হওয়ার সুবাদে ছেনুরই কপাল খুলল। নতুন বউ কোলে বসিয়ে ছেনুকে একটা মিষ্টি খাইয়ে হাতেও নাড়ু, মিষ্টি, ফল, টল গুঁজে দিল। তখনই আরেকটা পুঁচকে দিদি (ছেনুর থেকে বয়সে খুব বেশি না, বছর তিনেক বড় হবে হয়তো) এসে বলল, দাও দাও আমার কোলে দাও ওকে একটু ঘুরিয়ে আনি। ছেনু হেঁটে হেঁটেই ঘুরে অভ্যস্ত। হঠাৎ তাকে আজ সবাই কোলে নিচ্ছে, ও একটু অবাক! পুঁচকে দিদিটা বাইরে নিয়ে গিয়েই ওকে কোল থেকে নামিয়ে বলল, এইনে, তুই ফলটা খা কেমন, বলে নাড়ু আর মিষ্টিগুলো হস্তগত করে হাওয়া। আচমকা এই ছিনতাইয়ে ছনেন্দ্রনাথ হতচকিত!
পরদিন রাতে বৌভাত। পাশের বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল করে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। পাশের বাড়ির লোক হয়ে তো আর শুরুর ব্যাচেই বসে পড়া যায় না। দিদিমা একটু রাতের দিকেই খেতে গেলেন ছেনুর হাত ধরে। দিদিমা শুধুই লুচি মিষ্টি খাবেন, পাত পেড়ে বসবেন না। সারাদিনের এত খেলাধুলো, দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত ছেনুর চোখ জুড়ে তখন খালি ঘুম নেমে আসছে। খেতে বসেই মাঝে মাঝে ঢুলে পড়ছে। ছেনুর পাশেই বসেছেন এক মাস্টারমশাই (মাস্টার মশাই আরেকটু দিই আরেকটু দিই ডাক থেকে ছেনুর অনুমান)। ছেনু লুচি-বেগুনভাজা খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়লে, সেই মাস্টারমশাই মাঝে মাঝে বাঁহাতের ঠেলায় জাগিয়ে দিচ্ছেন, ও খোকা খাও! ভাত ভাঙো। আবার ছেনু ঘুমচোখে জেগে উঠে দেখে পাতে আরো কি কি সব দিয়ে গেছে। সেদিন শেষমেষ ঘুমচোখ আর মাস্টার মশাইয়ের ক্রমাগত উৎসাহের ঠেলায় ছেনু যে কী কী খেয়েছিল, পরদিন সকালে আর তেমন মনে টনে ছিল না।
পরদিনটাও সকাল থেকে বেশ আনন্দেই কাটছিল। ওদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ছেনু চুপটি করে দিম্মার পাশে শুয়েছিল। মাঝে একবার বাথরুম পেয়েছে, বাথরুম সেরে এসে আবার শুয়ে পড়ল। এরপর একটা আজব কান্ড! মাঝে মাঝেই ছেনুর বাথরুম পাওয়া শুরু হল। মানে ছেনু ফিরছে আর দিম্মা জিজ্ঞেস করছে, কই গেছিলি। ছেনু বারবার বলে বাথরুমে। দিম্মা অবাক, অনেকটা জল খেয়ে নিয়েছিলি বুঝি! ছেনু তাতেই দুষ্টু হেসে মাথা নাড়ে। এরকম বার পাঁচেক হওয়ার পর দিদিমাও পিছু পিছু গিয়ে দেখেন, বাথরুম টাথরুম কিচ্ছু না! ছেনু একবার করে উঠছে আর কৌটো থেকে দুটো করে বিস্কুট বের করে মুখে পুরছে। দিম্মা ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলে, এইবার বুঝেছি, এতবার বাথরুম পায় কী করে! আসলে চট করে উড়ে যাওয়ার ভয়ে, শেয়ালদায় বিস্কুটের টিন ছেনুর হাতের নাগালের বাইরে রাখা থাকে, আর এখানে একেবারে টেবিলের ওপরেই রাখা, আর কি জানি কেন, তাই দেখে ছেনুর খিদেটাও আজ মোক্ষম চাগিয়ে উঠছিল।
বিকেলের দিকে পাশের বাড়ির একটা দাদা এসে দিম্মাকে বলল, ও জেঠি, মাঠে খেলা হচ্ছে, ছেনুকে নিয়ে যাব? দিম্মা বলল, হ্যাঁ যা, কিন্তু ছোট্টুকে চোখে চোখে রাখবি, আর ফেরার সময় সাবধানে নিয়ে আসবি। দাদাটা ঘাড় নেড়ে ছেনুকে সাইকেলে চাপিয়ে রওনা দিল। ক্যারিয়ারে বসে আশপাশ দেখতে দেখতে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে মাঠে পৌঁছে ছেনু দেখল, বিশাল বড়ো মাঠ। যেসব দাদারা ফুটবল খেলছে, তারা অনেক বড়। বেশির ভাগই ছোড়দার মতো ঢ্যাঙা, কি জোরে জোরে দৌড়াচ্ছে! অনেকেই মাঠের পাশে বসে খেলা দেখছে। দাদাটা ছেনুকে মাঠের ধারে বসিয়ে বলল, এখানে বসে খেলা দ্যাখ, বাড়ির ফেরার সময় আবার একসাথে সাইকেলে করে ফিরব, অন্য কোথাও যাবি না কিন্তু! এই বলে দাদা সাইকেল এক কোণে রেখে ওর বন্ধুদের দলে মিশে গেল। ছেনু মন দিয়ে খেলা দেখছে, সবাই শাঁই শাঁই করে ছুটছে, দমাস দমাস করে শট মারছে গোলে। ছেনুদের গলির ফুটবলের সাথে এর বিস্তর তফাৎ। এদের খেলা দেখে ছেনু মনে মনে ঠিক করল, খেললে এদের মতোই খেলতে হবে, বড়ো বড়ো গোলপোস্ট, বড় ফুটবল নিয়ে। ম্যাচ বেশ জমে গেছে, পর পর গোল হচ্ছে। দু'দলের গোলকিপারই বেশ কাঁচা, ওদের দেখে ছেনুর ইচ্ছে করছিল, যদি দাদাদের মতো লম্বা হওয়া যেত চট করে, তাহলে ও-ই লাফিয়ে লাফিয়ে গোলগুলো বাঁচিয়ে দিত।
ধীরে ধীরে এক সময়ে খেলা থিতিয়ে ম্যাচ শেষ। আলো কমে আসছে, প্রায় সন্ধে নামে নামে। মাঠও প্রায় ফাঁকা হয়ে আসছে, যারা ধারে বসে খেলা দেখছিল, তারাও একে একে বাড়ির পথ ধরেছে। ছেনুর সম্বিৎ ফিরতে আশেপাশে তাকিয়ে সেই দাদাকে খোঁজে, তাকে আর দেখা যাচ্ছে না! যেখানে সাইকেলটা রেখেছিল, সেখানে গিয়ে দেখে সাইকেলটাও নেই। পাশে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, আমার দাদাকে দেখেছো? সে কার একটা সাথে কথা বলছিল, ছেনুকে খেয়াল না করেই আলগোছে উত্তর দিল, দ্যাখো না কাছাকাছিই আছে কোথাও। এবার মহারাজ একটু সাহস পেয়ে ভাবলেন, ঠিকই তো, আশেপাশেই আছে নিশ্চই। আমি হাঁটা লাগাই, কতো আর বড় জায়গা হবে এই কৃষ্ণনগর, রাস্তায় ঠিকই দেখতে পেয়ে যাব। তখন সাইকেলে উঠে বসলেই হবে।
ও আঁতি পাতি করে মাঠের চারধারে খুঁজে আসলো, কোথাও দাদার দেখা নেই! বুকে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে এবার রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করল, বাড়ির পর বাড়ি, রাস্তার পর রাস্তা, দোকানের পর দোকান, সব পার করে ছেনু বুঝতে পারল, দাদাটা নির্ঘাৎ ওকে ফেলে রেখে বাড়ি চলে গেছে, তাই সেই দাদাকে আর না খুঁজে একা একা বাড়িতে ফিরে যাওয়াই মনস্থির করে ফেলল। সাইকেলে চেপে আসার সময় যে রাস্তা দিয়ে এসেছে, সেটা কি আর চিনতে পারবে না! বাড়ি ফেরা আর কতই বা কঠিন হবে! যে রাস্তা ধরে এলাম, সে রাস্তা ধরে সোজা গেলেই হলো। কিন্তু হায়, এ তো আর শিয়ালদার বৈঠকখানা নয়, কৃষ্ণনগর! ছেনু চেনা ভেবে যে গলিতেই ঢুকতে যায়, গিয়ে দেখে এটা তো নয়, তবে ওই যে আরেকটা গলি দেখা যাচ্ছে, ওটাই হয়তো হবে। এভাবে গোটা ছয়েক রাস্তা, গোটা সতেরো গলি ও সাথে খান সাতেক কানা গলি ঘুরে ছেনু উপলদ্ধি করল, ভুলভুলাইয়া কাকে বলে! ছোড়দা যে মাঝে মাঝে ভয় দেখাতো, লখনৌর ভুলভুলাইয়ায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবে, সেটা যে কৃষ্ণনগরেই আছে এটা তার জানার বাইরে ছিল। যতটা সাহসের পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, নতুন এক একটা গলিতে ঢোকার সাথে সাথে সেই পুঁজিটা ক্রমশ কমে কমে আসছে। পা'ও ব্যথা করছে। এক সময় মনে হল, আর পারা যাচ্ছে না, ডাক ছেড়ে কেঁদেই ফেলবে বুঝি। কিন্তু হাজার হোক মহারাজ তো, আরেক মহারাজের ডেরায় এসে কেঁদে ফেলা কি উচিত হবে!
এমনি সময় একটা ফাঁকা গলিতে হঠাৎ পেছন থেকে সাইকেলের হর্ন শুনে ছেনু ফিরে তাকালো। নাঃ, দাদা তো নয়, একটা কাকু সাইকেল চালিয়ে আসছে। কাকুটা ওকে কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাইকেল থেকে নেমে এসে বলল, খোকা তোমার বাড়ি কোথায়? অন্য সময় হলে 'খোকা' ডাকে ছেনু খুব চটে যেত, কিন্তু এখন তারই বিপদ, কী করা যাবে! ছেনু বলল, শেয়ালদা। কাকু তো সেই শুনে অবাক, সে কী! তুমি এখানে এলে কী করে? ছেনু বলে, দিম্মার সঙ্গে এসেছিলাম, এখানে আমার দিম্মার বাড়ি।
- তাই বলো। তুমি কি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছ? ছেনু হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়তে কাকু বললেন, তোমার দিম্মা কোথায় থাকে বলো, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।
ছেনু যেন চোখের সামনে স্বয়ং দেবদূতকে দেখতে পেল। ওর চোখদুটো আনন্দে হেসে ওঠে, মাথা চুলকে বলল, ওই তো কাছেই দিম্মার বাড়ি, মানে, ওই যে বিয়েবাড়িটার পাশে। বলার পরেই ছেনু বুঝতে পারল, দিদিমার বাড়িটা নিশ্চই চেনা, কিন্তু বাড়িটা যে আসলে কোথায় সেটা সে একদমই জানে না! আসলে পুরো কৃষ্ণনগর শহরটাই তো তার কাছে এক্কেবারে নতুন।
বুঝতে না পেরে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, কাদের বাড়ির বিয়ে বলোতো? তোমার দিদিমার নাম কি? আর কে থাকে সাথে?
- নাম তো জানি না, সাথে মামা থাকে, কিন্তু মামা তো এখন বাইরে।
- মামার নাম কী?
- মামা? (কি যেন নামটা! ছেনুর কিছুতেই মনে পড়ে না)
- বুঝেছি, সাইকেলে ওঠো, দেখি তোমার দিদিমার বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।
ছেনুর বুকটা একটু ঢিপ ঢিপ করছিল। লোকটাকে চেনেনা, জানেনা, বিদেশ বিভুঁই জায়গা, সাইকেলে ওঠা কি ঠিক হবে! তাও, যা থাকে কপালে, ছেনু ক্যারিয়ারে চেপে বসল।কাকু এতক্ষণ ঘুরে আসা রাস্তা গুলো আবার খানিকটা পাক মেরে, অন্য রাস্তায় এসে, ছেনুকে জিজ্ঞেস করল, এখানে কিছু চেনা লাগছে? ছেনু মাথা নাড়ে।
-জোরে বলো, আমি তো দেখতে পাচ্ছি না তোমায়।
- এখানে নয়।
আরও নানান রাস্তা ঘোরার পরেও ছেনুর উত্তর একই দাঁড়ালো। শেষে হতাশ হয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ ছেনুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আচ্ছা কাকু, তুমি এখানকার রাজবাড়িটা চেনো ?
কাকুও হঠাৎ রাজবাড়ির কথা শুনে উৎসাহিত হলেন, ওদিকেই তোমার দিদিমার বাড়ি বুঝি?
-না দিম্মার বাড়ি তো ওখানে নয়, কিন্তু, ওখানে গেলে তো গোপাল ভাঁড়কে পাওয়া যাবে, ও নিশ্চয়ই একটা বুদ্ধি বের করবে!
কাকু এবার ভয়ানক রেগে গেলেন, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি তোমার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে আর এদিকে তুমি ইয়ার্কি মারছ! গোপাল ভাঁড় আষাঢ়ে গপ্পের লোক, তাকে খুঁজে তুমি বুদ্ধি নেবে? একদম চুপটি করে বসে থাকো, তোমায় এমন জায়গায় নিয়ে যাব, সব ইয়ার্কি বেরিয়ে যাবে! (বোঝা যাচ্ছে গল্প কাহিনীর চরিত্রকে বাস্তব ঠাউড়ানোর বিপদ চিরকালই ছিল, তা ছনেন্দ্রনাথকে নয় ছোটো বলে মাফ করে দেওয়া যায়)
এই না বলে কাকু শাঁ শাঁ করে স্পিড তুলতে শুরু করেছে সাইকেলে। ছেনুর এবার ভীষণ ভয় লাগছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রে বাবা, সেই আরব না কোথায় পাঠিয়ে দেবে না তো! উটের পিঠে বসিয়ে দৌড় করাবে, না খাইয়ে রেখে দেবে? তাহলে তো আর কোনো দিনই ফেরা হবে না শেয়ালদায়! পড়ে রইল মা, দাদা, দিদিরা, পড়ে রইল তেতলার রাজত্ব। আহা, ছোড়দার সেই মোক্ষম গাঁট্টাগুলোও যেন এখন মিষ্টি মনে হচ্ছে। ছেনু তবু নিজেকে মনে মনে সান্তনা দেয়, যাক আর কিছু না হোক একবার উটের পিঠে তো অন্তত চাপা হবে। তাই সই। মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ এবার থেকে শুধুই এক উট চালানেওয়ালা। মুখ গোঁজ করে ক্যারিয়ারে চুপ করে বসে থাকে। হাওয়া এসে কানে ঝাপটা মারছে। নোনতা জলের ধারা টোবলা গালদুটো বেয়ে নেমে আসে।
"অ্যাইইই! আমার নাতিটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ওরে তোরা দেখ রে, ছোট্টুকে কোথায় নিয়ে চলে গেল!"
হঠাৎ চেনা গলা কানে আসতেই, ছেনু সাহস ফিরে পেয়ে লোকটার পিঠে জোরসে খিমচে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়ে কাকু দুম করে ব্রেক মারতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে ভূপতিত! ছেনু সেই সুযোগে সাইকেল থেকে নেমে কাঁদতে কাঁদতে দিম্মার দিকে দৌড় মারে।
"ও দিম্মা গো, আমি উটে চাপবো না দিম্মা, আমাকে বাঁচাও!" ছেনু দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।
দিদিমা তখন বাড়ির কাছের মিষ্টির দোকান থেকে নাতির জন্যই একটু কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরপুরিয়া কিনে ফিরছিলেন। হঠাৎ কোন একটা অচেনা লোকের সাইকেলে চেপে নাতি কোথায় চলে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে হইহই করে ওঠেন। দিদিমার চিত্কারে সবাই মিলে সেই ভূপতিত সাইকেল সওয়ারকে ঘিরে ধরলে জানা যায় সে নাকি একটি হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল বাড়ি ফেরানোর জন্য, পথে এই কান্ড!
শেষমেশ সেই কাকুকে মাটি থেকে তুলে জল টল দিয়ে একটা বাড়ির রোয়াকে নিয়ে গিয়ে বসানো হল, অল্প সরপুরিয়াও দেওয়া হল। কাকু সেইসব খেয়ে টেয়ে, আর কখনো একা একা ঘুরবে না, সাবধানে থাকবে, এসব উপদেশ টুপদেশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর ডাক পড়ল সেই পাশের বাড়ির দাদার। সে যতই বলে বন্ধুদের সাথে গল্পে মেতে প্রথমে ছেনুকে আনার কথা ভুলে গেলেও, পরে সে আবার মাঠে ফিরে গিয়েছিল ছেনুর খোঁজে, কিন্তু অনেক খুঁজেও তখন আর মাঠে তাকে দেখতে পায় নি -তার সেই সব অজুহাত সমবেত বকুনির সামনে কল্কে পেলে তবে তো!
আর ছেনু তখন কী করছে? এক কোনে বসে চোখ মুছতে মুছতে একটু একটু করে সরপুরিয়া খাচ্ছে আর ভাবছে এখন যদি দিম্মা সরপুরিয়ার বদলে শুকনো চিঁড়েও খেতে দিত, তাহলেও সে সোনামুখ করে খেয়ে নিত, বাড়ি ফেরার এমনই আনন্দ! ফিক করে একফালি হাসিও বেরিয়ে আসে, যাক, এ যাত্রা তার রাজত্বটা তো বেঁচে গেল!