দোল নিয়ে প্রথম স্মৃতি যা আমার মনে আসে সেটা একটা পিতলের পিচকারি, আমার হাতে নয় কিন্তু কার হাতে সে আর মনে পড়ে না। তার পরের ছবি আমার উত্তর বঙ্গের জীবনের।
নতুন জায়গায় নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে আমি এক অতি এলেবেলে জীব। মার খাই নিজের ক্লাসের পড়ুয়াদের হাতে, খুবই স্বাভাবিক একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে – আমি নতুন, বহিরাগত। এই অভিজ্ঞতা আমার আগে ছিল না। মানিয়ে নিচ্ছিলাম, পাল্টা হাত-পা চালিয়ে। কিন্তু যিনি ক্লাস নিচ্ছেন, তিনি যখন পিট্টি লাগান, কিছু করার থাকে না। সেই শাস্তি আমার নিজের বিবেচনায় যতই অমূলক, অযৌক্তিক মনে হোক না কেন। অবশ্য পরে গোটা জীবন ধরে জানব যে শাস্তির ঐটিই দস্তুর, দুনিয়া জুড়ে, অনাদি কাল ধরে, ভবিষ্যতেও এর অন্যথা হবে – এখনও অবধি তেমন মনে হয়নি।
উত্তরবঙ্গের প্রথম বছরটিতেই প্রথম জানা হল শীতের তীব্র ঠান্ডা কাকে বলে। আর সেই সুবাদেই, আঁকার জন্য পাওয়া রঙের বাক্সের বাইরে, নানা রঙের সাথে পরিচয় হল - উলের সুতোয় আর মেলায় কেনা রঙিন গরম পোষাকে। কিন্তু রঙ নিয়ে যে মাখামাখি করা যায়, করাই স্বাভাবিক সেইটি একেবারে জাপটা-জাপটি করে অনুভব করা গেল দোলের সকালে। ঠাকুমা সেদিন ঘুম ভাঙ্গিয়ে জানাল – উইঠ্যা পড়, আইজ দোল, রঙ খেলবা কখন, আর বাবা আগের কোন একদিন কিনে আনা লাল আর গোলাপি/বেগুনি রঙের আবির আর সম্ভবতঃ লাল এবং সবুজ গুঁড়ো রঙ কাগজের ঠোঙা খুলে বার করল।
এই দিনটা আসার প্রস্তুতি অবশ্য কয়েক দিন আগে থেকেই চলছিল। প্রতিবেশিদের কারো কারো বাড়ির উঠানে বা চাষের জমিতে ছোট মাপে আর পাড়ার খেলার মাঠে বড় করে খড়-বাঁশ-গাছের ডালের কাঠামো বানানো হচ্ছিল। তারপর দোলের আগের দিন সেই কাঠামোয় আগুন ধরিয়ে দিয়ে তাকে ঘিরে ঘিরে হাত ধরাধরি করে গাওয়া – আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরিবোল। বাড়ি ফেরার পর বাবা ন্যাড়া পোড়ায় হোলিকা দহন, অশুভের বিনাশ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেছিল। সবটা বুঝিনি কিন্তু মনের মধ্যে কিছু অস্বস্তির জন্ম হয়েছিল। অমন রাক্ষসি কি আমাদের এখানে আছে? তাকেও কি পুড়িয়ে মারতে হবে? গুজিয়া আর কি কি যেন সব মিষ্টি এসে গিয়ে সেই সব সম্ভাব্য নৃশংসতার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছিল।
সেই দোলের সকালে ফুট দুই উচ্চতার মাঝারি মাপের দুই ধাতব বালতিতে লাল আর সবুজ রঙ অল্প অল্প জলে গুলে তারপর বেশি করে জল মিশিয়ে বাবা তাদের নিজের পছন্দ মত ঘনত্বে নিয়ে এল। আমাদের সেই সময়ের দিনযাত্রায় প্লাস্টিকের প্রবল আবির্ভাব ঘটেনি। বেশির ভাগই মাটি, কাপড়, কাঠ, কাগজ আর ধাতুর বানানো। সেই সকালে পরম বিষ্ময়ে কয়েকটি প্লাস্টিকের ছুঁচলো-মুখ ছিপি ওয়ালা কৌটো আমাদের তিন ভাইয়ের হৃদয় হরণ করে নিয়েছিল – তিনটি পিচকারি। পরবর্তীকালের হাল্কা, সহজে নষ্ট হয়ে যাওয়া খেলনা নয়, রীতিমত শক্ত সমর্থ কৌটো। দুই তালুতে বন্দি করে কৌটোর পেট চেপে ধরলে তীব্র স্রোতে রঙিন জল বেরিয়ে এসে কত দুর পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে, আর এত বড় অবাক কান্ড আমরা নিজেরা ঘটাচ্ছি!
পিচকারি হাতে বাড়ি থেকে বের হয়েই আমরা বুঝলাম রণক্ষেত্র কাকে বলে, আমাদের অস্ত্র অন্যদের হাতেও আছে আর সেগুলো আমাদের দিকে তাক করা এবং ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের সুবিধা ছিল, তিন ভাইয়ের সম্মিলিত দলবদ্ধ আক্রমণ। কিন্তু তারও সীমাবদ্ধতা আছে, রসদ ফুরিয়ে যায়, তখন দৌড়ে ফিরে এসে আবার জল ভরে নিয়ে যাওয়া। আর সেই ফিরতি পথে গায়ে মাথায় প্রতিপক্ষের জলের ধারা। খুব ভালো হয় যদি পিচকারি বেশ বড় মাপের হয়, অনেকটা জল ধরে আর অনেক দূর যায়, ঐ ওদের কারো কারো হাতে ধরা পিতলের পিচকারিগুলোর মতন। কিন্তু আমাদের ত অমন পিচকারি নেই। বাবা বলল দেশভাগের আগে তাদের বাড়িতে তার নিজেরও ঐ পিচকারি ছিল। কিন্তু তাতে আমাদের ত কোন উপকার হচ্ছে না!
এইবার বাবা তার কারিগরি দক্ষতার প্রকল্প চালু করল। লতানে গাছের জন্য মাচা বাঁধার খুঁটি বানাতে লাগবে বলে বেশ কিছু বাঁশের টুকরো রাখা ছিল। তারই একটাকে নিয়ে এসে দা, করাত, আর কি কি দিয়ে প্রয়োজনীয় কাটাকাটি করে একটা নল বানিয়ে ফেলা, তারপর সেটার যেদিক থেকে রঙ বের হবে সেদিকের দেয়ালে, তুরপুন দিয়ে ছ্যাঁদা করা ইত্যাদির পরে একটা লম্বা টুকরোর দুই প্রান্তে দুই কাপড়ের টুকরো জড়িয়ে একটা দিক হাতলের কাজে আর অন্য দিকটা বাঁশের খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে রঙ টানা আর বের করার পিস্টন বানিয়ে ফেলতেই পিচকারি তৈরি হয়ে গেল। আর আমাদের পায় কে! কিন্তু তিনজনের জন্য দুটো পিচকারি করা হয়েছিল, এইটাতে সুবিধা হয়েছিল না অসুবিধা সেইটা এখন আর নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। যেটা নিশ্চিত করে বলা যায় সেটা এই যে সমস্ত বাহুবলি সিনেমায় যেমন দেখায়, অস্ত্রশস্ত্র যতই ব্যবহার হোক, চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হাতাহাতি সম্মুখ সমরে। প্রয়োজনীয় রসদের অভাবে শক্তিশালি দলও হেরে যায়, আমারাও আমাদের সেই প্রথম বছরের যুদ্ধে মনে হয় না খুব সুবিধা করতে পেরেছিলাম। পরের বছর থেকে রসদ সংগ্রহের দায়িত্ব নিজেরা নিয়ে নিয়েছিলাম। হাতের তালুতে রঙ মেখে নিয়ে এগিয়ে চলো, যুদ্ধে হেরে যাওয়া কোন কাজের কথা না। মুস্কিল হল, এই রঙের যুদ্ধশেষে সবাই একই রকম হেরে বসে। সবাই রঙে রঙে রাঙা আজব প্রাণী।
খেলা তো হল। এরপর সেই ভয়ানক সময়। স্তরে স্তরে চেপে বসা রঙ তুলতে গিয়ে তিন ভাই, সাথে মায়ের জেরবার অবস্থা। কখনো তেল দিয়ে মোছা, তারপর অনন্ত কাল ধরে বারে বারে সাবান ঘষা আর হাতে পাম্প করে তোলা ঠান্ডা জলে সেই সাবান ধুতে ধুতে মায়ের হাতের তালু আর সমস্ত আঙ্গুলগুলো সিঁটিয়ে ওঠা।
উত্তরবঙ্গ ছেড়ে চলে আসার পর বড় হতে হতে অবশ্য দেখলাম রাঙিয়ে দেওয়ার শেষ পর্বটা বড়দের দখলে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পড়ে তারা বের হন, তারপর দু-এক বাড়ি ঘুরতে ঘুরতেই মাথার চুল থেকে পায়ের জুতো পর্যন্ত লাল আর অভ্রকুচি ঝিলিক দেওয়া গোলাপি/বেগুনি আবিরে মাখামাখি। আমাদের সময়ে সবুজ আবিরের তেমন একটা চল ছিল বলে মনে পড়ে না। বেলা বাড়ার সাথে আবিরের গুঁড়ো জায়গা ছেড়ে দেয় রঙের গুঁড়োকে। এই পর্ব বিভিন্ন বাড়ির, পাড়ার দস্তুর মেনে মৃদু অথবা উদ্দাম। অনেক সময় সেটা রঙ ফুরিয়ে কাদা গোলা জলে শেষ হত। মিশ্র ভাষাভাষীর পাড়ায় এমনও দেখেছি, প্রথম দিন রঙ্গিন জলে দোল আর দ্বিতীয় দিনে কাদা গোলা জলে হোলি।
খুব ভাল লাগত বাতাসে আবির ছুঁড়ে চারপাশ রাঙিয়ে দেওয়া। যে আবির থালায় ঢেলে নেওয়া হয়েছে তার উদ্বৃত্ত আর ঠোঙ্গায় ফিরবে না। তারা ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় দশদিক রাঙিয়ে দেবে। পরিমাণ কম থাকায় এই খেলাটা অল্পই খেলা যেত। এখন অবশ্য নানা উল্লাসে বিশেষ বিশেষ রঙের অঢেল আবিরে নানা সময় আকাশ-বাতাস রাঙা হয়ে ওঠে।
উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে আসার পর আমার বিশেষ প্রাপ্তি হয়েছিল একে একে ছয়টি খুড়তুত ভাইবোন, ফলে হামলাবাজির দল বেড়েছিল ভালোমতন। দোলের দিন-সপ্তাহ-মাস জুড়ে আরও কত টুকরো ছবি মনে পড়ে – কীর্তনের দল বের হত খোল-করতাল নিয়ে, ঠাকুমা হরিসভায় যেত, কাকি এক বছর দোলের বিকেলে পূজোর আয়োজন করেছিল আর তার পর থেকে সেটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয়ে গিয়েছিল। এই ছবিগুলোর কিছু আমার স্মৃতিতে কিছু আমার ভাই-বোনেদের স্মৃতিতে ঠাঁই করে নিয়েছে, গল্পে গল্পে ঊঠে আসে।
কয়েক বছর পার করার পরে আমাদের অনেকেরই রঙ খেলার ইচ্ছেটা চলে গিয়েছিল। বিশেষ করে ছোট ছোট কাঁচের শিশিতে ভরা চকচকে রঙগুলো বাজারে জাঁকিয়ে বসার পর। ওগুলো শরীর থেকে ধুয়ে-মুছে দূর করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ত। তবে সেই কারণের থেকেও যেই জন্য বেশি অপছন্দের হয়ে উঠেছিল সেটা আবেগের, অনুভূতির পার্থক্য ঘটে যাওয়ায়। রঙ মাখানো – রীতির নামে জোর খাটানোর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। খুব কম করে হলেও আমার খুশিকে আমি জোর করে এক জনের ইচ্ছে-অনিচ্ছের পরোয়া না করে তার উপর চাপিয়ে দিচ্ছি। এ তো অত্যাচার! তা বলে, স্বেচ্ছায় কি কেউ রঙ মাখে না? মাখে তো। রঙিন হয়ে ওঠার সেই আকাঙ্খা নিয়ে গান হয়, সাহিত্য হয়, শিল্প হয়। এম আর চুঘতাইয়ের একটি অপূর্ব ছবি আছে, কৃষ্ণ-রাধিকা সেখানে পরস্পরে আত্মহারা। অমন অবস্থায় ইচ্ছে হতেই পারে - প্রিয় মানুষের কাছ থেকে রঙ মাখার, ভালোবাসার রঙ, প্রেমের রঙ। সে দোল যাদের জীবনে এল তাদের পরম সৌভাগ্য। আর যারা মাখতে চায়নি সেই তাদের জন্য ও রঙ যন্ত্রণার, ঐ সকাল-দুপুর সরে থাকার, আড়ালে থাকার।
বাবা-মা দেশভাগে বাস্তুহারা হয়েছিলেন। আমার জীবনে উৎখাতের বেদনা এসেছিল বাবার বদলির চাকরির ফলে। জ্ঞান হওয়া ইস্তক যে বাড়ি, যে রাস্তা-ঘাট, যে পাড়া, যে দুনিয়া নিজের বলে জেনে এসেছি সেখান থেকে উপড়ে গিয়ে কোচবিহারের এক অচেনা বাড়িতে, অচেনা জগতে ঠাঁই হয়েছিল। যতদিন সেখানে ছিলাম প্রতিদিন ভাবতাম কবে আবার পুরনো দিনে ফিরব। তিন বছর বাদে সেখান থেকে চলে এসেছিলাম। কিন্তু পুরনো দিনে আর ফেরা হয়না, আমারও হয়নি।
তখন যেটা বুঝিনি, এর পর থেকে ঐ তিন বছরকে আমি খুঁজে ফিরব বাকি জীবন। এই খুঁজে ফেরার এক পর্যায়ে এসে আমার স্মৃতিচারণ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লিখে রাখতে শুরু করি। বিভিন্ন টুকিটাকি ঘটনাকে জুড়ে জুড়ে ক্যালিডোস্কোপে ছবি গড়ে তোলা। একটু ঘোরালেই অন্য ছবি। কয়েকটি পর্ব এইখানে গুরুচন্ডা৯তেও লিখেছি। এবার ইচ্ছে আছে অন্যত্র লেখা পর্বগুলিকেও এখানে নিয়ে আসার। এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ক্যালিডোস্কোপ ঘোরানোর আশা নিয়ে আজ এখানেই থামছি।