ধন্যবাদ দেওয়া শুরু করতে চাইলে গাজীর গানের বন্দনার মত করে হিমালয় থেকে শুরু করতে হবে। লেখালেখি করি এইটা তো বেশি দিন ধরে না। কিন্তু আমি লেখব এইটা আমার মাথায় ছিল। কেন তাও জানি না। আমি যখন লেখার চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতাম তখন ফেসবুক ছিল না, ইন্টারনেট ঠিক কী জিনিস তাও বুঝতাম না। আমার একটা পিচ্চি ডাইরি ছিল ওইটাতে হাবিজাবি লেখতাম। ওই পর্যন্তই। কিন্তু পড়তাম, গাছে মাছে, আকাশ পাতাল এক করে পড়তাম। হুদাই পড়তাম, বুঝতাম না পড়তাম। আমাদের স্কুলের একটা লাইব্রেরি ছিল। স্কুলে থাকতে হয় তাই আছে এমন আর কি! আমি একদিন হাজির হয়েছিলাম। স্যারকে বলল পড়ব! লাইব্রেরিতে কেউ পড়তে আসছে এইটা একটা আশ্চর্য কাণ্ড হয়ে দাঁড়াবে আমি জানতাম না। স্যার আমাকে বলল স্কুল ছুটির পরে আসতে হবে পড়তে চাইলে। আমাকে আটকানোর বাও! আমি হাজির হয়ে গেলাম, কেউ নাই বিমর্ষ মুখে স্যার বসে আছে আর আমি আছি। স্যার এরপরে আমাকে বই নিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। যাই হোক, পড়তাম খুব এইটাই হচ্ছে কথা। আমার সম বয়সই যে কারো থেকে বেশি পড়ছি এইটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। ( আগে কখনও এইটা বলি নাই, এখন যেহেতু... বুঝেনই তো! তাই একটু সাহস করে বলেই ফেললাম!) এরপরেই বুঝতাম আমি লিখতে পারব। কিন্তু তখনও আমি কিছুই লেখি নাই। বেশ কিছু সময় পরে রনি একদিন একটা রোল টানা খাতা আর একটা সবুজ কালীর কলম কিনে দিয়ে বলল লেখ! প্ল্যান ছিল আমি একবারেই শিশুতোষ কিছু লেখব। রনি ওইটাকে কমিকের মত করে বানাবে। দুইজনে নানা প্লট নিয়া ভাবলাম, কথা বললাম। কিন্তু ওই পর্যন্তই, আমি এক লাইনও লেখলাম না। খাতা অমনই রয়ে গেল!
আমি লেখলাম রনি চলে যাওয়ার পরে। রনিকে নিয়েই লেখা শুরু করলাম। এবং বুঝালাম খুব উঁচু মানের কিছু না হলেও আমি পারি। আমার থেকে জানে বুঝে এমন আমার চোখের সামনেই অনেকে আছে কিন্তু বোম মারলেও তারা লিখতে পারে না। আমি ভাবছি এরা মনে হয় আইলসামি করে, পরে বুঝছি যে আসলে এইটা সবার কম্ম না! ( আবার নিজেরে একটু পাম্প দিলাম?) যাই হোক, এই জন্যই প্রথম ধন্যবাদটা রনিকেই দিতে হবে। রনি আমার আগেই জানত আমি লিখতে পারব। এর আগ পর্যন্ত আমিও পরিষ্কার জানতাম না যে আমি লিখব। যা ছিল আমার কল্পনায়। রনিই প্রথম দ্বিতীয় কেউ মানে আমি বাদে দ্বিতীয় কেউ যে আমাকে বলছিল লেখতে পারব আমি।
এরপরের সব কৃতিত্ব গুরুচণ্ডালীর। নতুন নতুন ফেসবুকিং করি। দেখলাম বাহ! পাশের দেশের একটা গ্রুপ যেখানে নানা বিষয় নিয়ে নানা আলোচনা হয়। আমি এখন পর্যন্ত গুরুচণ্ডালীর মত ফেসবুক গ্রুপ আমাদের এখানে দেখি নাই। যদিও গুরুচণ্ডালী আগে যেমন ছিল এখন মনে হয় না তেমন আছে। ওইখানে লেখা শুরু করতেই ভাল খারাপ নানা ধরণের অভিজ্ঞতা হতে থাকল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম ওইপাশের অনেকেই এদিকের কথা শুনতে চায়। আবার কেউ এদিকের লোকজনকে গালিও দিতে চায়। তখন ধৈর্য কম অঢেল সময় আমার। রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়তাম। যেন তাঁকে স্বীকার করাইতে পারলেই শান্তি আমার, এর মধ্যেই বাংলাদেশের মান সম্মান সব নির্ভর করছে।
এই সময়েই ইপ্সিতা দিদি যেন হাত ধরে আমাকে ব্লগের জগতে নিয়ে গেলেন। এর আগে সামুতে খুঁট খুঁট করছি, তেমন বিশেষ কিছু না। ইপ্সিতা দি আমাকে প্রায় সময়ই ফেসবুকে একটু বড় লেখা হলেই বলত এইটা গুরুর ব্লগে দেওয়া যায়? আমি দিতাম। আমার ইচ্ছায় তখন একটা লেখাও মনে হয় দেই নাই। কিন্তু এই মহিলা লেগেই থাকত! নানা বিষয়ে লেখা চাইত। আমি লেখতাম। কারণ এই কাজে কখনই আলস্য আসে নাই আমার। ভাল খারাপ জানি না কিন্তু আমি লিখতে পিছপা কখনই হই নাই।মনে আছে তখন আমি এআরএ ইন্টারন্যাশনালে চাকরি করি। অফিসের কাজের ফাঁকে, কাজের শেষে বা কাজের মধ্যেই আমি গুরুর জন্য লেখে গেছি! কারণ তখন আমার নিজের কোন কম্পিউটার ছিল না। এইটা যতদিন না আমি নিজের ল্যাপটপ না কিনেছি ততদিনই এই গল্প ছিল। সংখালঘু নামে একটা সংকলনে আমার একটা লেখা প্রথম ছাপায় গুরু থেকে। আর এরপরের গল্পই হচ্ছে বাঙালের রোমানিয়া গমন। গুরুর ব্লগে লেখা শুরু না করলে এই জিনিস কোনদিন বের হত না এইটা নিশ্চিত। গুরুচণ্ডালীকে ধন্যবাদ আর অশেষ ধন্যবাদ ইপ্সিতা পাল দিদিকে। দিদি আপনে জানেন না আমি এখন যতখানি লেখি তার অনেকখানি কৃতিত্বই আপনার।
এরপরের গল্প হচ্ছে রোমানিয়া। আমি যাদের সাথে ছিলাম। ভাল খারাপ নানা মতের মানুষ ছিল। দুঃস্বপ্নের মত পরিবেশ ছিল। কিন্তু আমার জন্য স্বপ্নের মত ছিল। আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। কিন্তু অবিশ্বাস্য রকম এক কাণ্ডে আমি আবার দেশে! এই সমস্ত কিছুর ফলাফল বাঙালের রোমানিয়া গমন। প্রবাসী শ্রমিকদের ভিতর থেকে দেখে লেখা এইটা একটা আলাদা ব্যাপার। আমি কয়েকজনকে প্রচ্ছদ পাঠিয়েছি। সবার উল্লাস যেন শুনতে পেলাম আমি। আমার মনে আছে আমি ডিউটি করে এসে আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিখতেছি, মানুষ ভিড় করে ঘিরে ধরত আমাকে। এমন আশ্চর্য কাণ্ড দেখে নাই ওরা। ভাই কি ফ্রিলেন্সিং করেন? না, তাইলে কী করেন? লেখি! কেন? লেখেন কেন? আমি মাঝে মধ্যেই বিরক্ত হতাম। মাঝে মধ্যে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাইতাম। এক পিচ্চি গেম দিয়ে ইতালি চলে গেল। ও আমার কাছে এসে একদিন বলল ভাই আমাকে পড়তে দিবেন আপনে কী লেখন? আমি গুরুর ব্লগের লিংক দিলাম ওকে। কেউ একজন পড়তে চাইছে এইটা আমার কাছে দারুণ লাগছিল। এই ছেলে ইতালি যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিয়েছে, আমি ফোন ধরতেই ওর উল্লাস, ভাই আপনে তো আমাদের কথাই লেখছেন! ওর গলার স্বর আমার কানে বাজছে এখনও।
ওই বোকাসোকা, সহজ সরল মানুষ গুলা, অল্প বয়স্ক ছেলে গুলাকে ধন্যবাদ না দিলে চলবেই না। এরা এখনও আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাস করে ভাই আহমেদকে কি বেতনের কথা বলব? না কি এমনেই করে যাব কাজ? কেউ বলে হাতে ব্যথা করে, কোন জায়গায় ডাক্তার দেখাব? আরেকজন জিজ্ঞাস করে ভাই এনওসি দিব না এখন?
আমি জানি না এরা এই সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত কীভাবে টিকবে। প্রায়ই মনে হয় আমার যে এদের কথা গুলো বলার জন্যই মনে হয় আমি লেখছি, আর কিছু না!
গুরুচণ্ডালী ব্লগের কল্যাণে বেশ কিছু সহৃদয় মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি। অনেকেই ফেসবুকে নাই। যোষিতা দিদি আমার প্রতিটা লেখায় যে উৎসাহ দিয়েছেন তা বলে বুঝানো সম্ভব না। আমি ফিরে চলে আসছি এইটা অনেকের কাছেই কষ্টের ছিল বলে মনে হয়েছে আমার। যোষিতা দিদিকে আমি চিনিও না জানিও না। তবুও উনি যেভাবে মন্তব্য করেছেন তা অবিশ্বাস্য। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে এমন যে ধন্যবাদ দিলেই বরং ব্যাপারটা জানি কেমন হয়ে যাবে! আমি কৃতজ্ঞ যোষিতা দিদি।
এবং হীরেন সিংহ রয়! এই ভদ্রলোক আমার মত অপরিচত একজনের জন্য যা করেছে তা কী দিয়ে ব্যাখ্যা করব? আমি যখন পায়ের ব্যাথায় কাহিল। রোমানিয়ার সরকারি হাসপাতালে দুই মাস পরের সিরিয়াল দিয়েছে আমাকে দেখার জন্য তখন তিনি উনার নিজস্ব চ্যানেলে ফোন টোন দিয়ে একজন ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করে দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও মাঝে মধ্যেই ফোন দিয়ে খোঁজ নিছেন! ভিনদেশে এইটা আমাকে যে কী পরিমাণ সাহস দিত তা লিখে বলার উপায় নাই। অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।
অরণ্য দা। এই লোক একটা আতঙ্ক আমার জন্য। উনি এমন প্রশংসা করেন আমার যে আমি ভয় পাই সব সময়। মনে হয় আল্লা কবে জানি উনি বুঝে যায় যে আরে এই ছেলে তো আসলে ভুয়া! অতখানির যোগ যে আমি না এইটা এই লোককে বুঝানোর ক্ষমতা আমার নাই। প্রশংসার বেলায় দশে পনেরো দিয়ে বসে থাকেন উনি। আমি দেশ ছাড়ছি, রোমানিয়া গেছি উনি খুশি! আমি আবার চার মাসের মধ্যে দেশে ফিরে চলে আসছি উনি তাও খুশি, তোমাকে দেশের দরকার আছে! ভাল মানুষ না? আমি জানি না, আমার মাথায় নাই কিছু যা দিয়ে এই লোককে ধন্যবাদ জানাই!
গুরুর কল্যাণে সায়ন দা উনার মা ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল। আমার জীবনের অন্যতম সেরা ঘটনা এইটা। সায়ন দা প্রচ্ছদ করেছে এই বইয়ের। অশেষ ধন্যবাদ সায়ন দাকে।
আরও যারা মন্তব্য করেছে তাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ। আমি আসলেই এর যোগ্য কি না জানি না। আমি কৃতজ্ঞ এইটাই বলার আছে শুধু।
বাকি থাকল আমার ভাই বোনেরা। বন্ধুরা। আমার ভাই বোনেরা আমাকে যে সহ্য করছে এবং করে যাচ্ছে এখনও এইটার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ প্রত্যেককে। এই লোক গুলা না থাকলে বহু আগেই এইগুলা তাল্টিবাল্টি বন্ধ করে কোথাও না কোথাও কামলা দিতাম আমি।
বন্ধু ভাগ্য আমার বরাবরই ভাল। আমার দুঃসময়ে যারা পাশে থেকেছে তাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ।
শেষ করি। প্রচ্ছদটা দেখার পরের অনুভূতি অনেকেই জানতে চাইছে। কোন অনুভূতি নাই। আমার চোখের সামনে আব্বার মুখটা ভাসছে শুধু। আব্বা খুশিতে হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বের করে ফেলছে! কলকাতা থেকে তোমার বই বের হচ্ছে? আরে সাবাস! হাসি!
আর কিছু না এইটাই মনে হইছে আমার।
( রোমানিয়া শেঙ্গেনে ঢুকে যাচ্ছে মার্চ মাসে। এখন প্রতিনিয়ত আমাকে শুনতে হয় যে আমি কেন ফিরে যাচ্ছি না! আমি যে সমস্যায় পড়ে ফিরে এসেছি তার কোন সমাধান হয়নি। তাই ফিরে যাওয়ার আশা করা দুরাশা আমার জন্য। আমার খালাত বোন যে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, সে আমাকে বিসিবির যে প্রধান ডাক্তার ডাক্তার দেবাশিষের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি এই সব ব্যাপারে সেরা ডাক্তারের মধ্যে একজন। জ্যোতির সাহায্য ছাড়া উনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাইতে অন্তত দুই মাস অপেক্ষা করতে হত আমার। তিনি আমাকে অনেকখন সময় নিয়ে দেখছেন। একটা থেরাপি দিয়েছিলেন। তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। এবং তিনি আমাকে শেষ কথা বলে দিয়েছেন যে আমার পক্ষে লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকা হার্ড ওয়ার্ক ইত্যাদি কাজ আর করা সম্ভব না। পায়ের অবস্থা তিনি দেখে চমকে গিয়েছিলেন। উনি স্টেরয়েড দিতে চেয়েছেন কিন্তু আমি এখনও ওইটা দিব কি না সিদ্ধান্ত নেই নি। বাড়িতে থেকে ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে, যার কারণে পায়ের ব্যথাও বেড়েছে! ব্যায়াম দিয়েছি কিছু, ওইটা করলেই একটু আরাম হয়, কুশন দেওয়া জুতা পরতে হচ্ছে। এই ভাবেই চলতে হবে আমাকে। আমি অপারেশনের কথা বলে ছিলাম। তিনি এক বাক্যে না করে দিয়েছেন। এই না আমাকে রোমানিয়ান ডাক্তারও করে দিয়েছিল। আমি দেশে চিকিৎসার জন্য চলে আসব শুনে উনি বলেছিলেন যে আমি জানি না তোমার দেশের চিকিৎসার অবস্থা কেমন, কিন্তু আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি যে কোনমতেই তুমি অপারেশনের দিকে যেয়ও না। আর আমি আসলে দেশে অপারেশনের জন্যই আসছিলাম। মনে করছিলাম বিদেশিরা এগুলা করতে ভয় পায়, আমাদের এখানে ঠিকই করে ফেলবে কিছু একটা। তো, এই হল আমার সর্বশেষ অবস্থা। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেকেই আমার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, তাদেরকে এই সুযোগে জানিয়ে দিলাম আমার অবস্থা।)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।