আরেকটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। রাত পোহালেই শুরু হয়ে যাবে নির্বাচন। আমার পরিচিত বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন অনেকেই নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত আছে। কেউ দায়িত্ব পেয়ে শঙ্কায় আছে কেউ আফসোস করছে দায়িত্ব না পেয়ে। নির্বাচন নিয়ে মূলত আমার চিন্তা এদেরকে নিয়েই, উনারা সবাই সুস্থ ভাবে ঘরে ফিরতে পারলেই আমি আপাতত খুশি। বড় বড় কথা, গুরু গম্ভীর আলোচনার থেকে এইটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।
কতজন ভোটার, কতগুলা ভোট কেন্দ্র এগুলা যে কেউ গুগল করলেই জানতে পারবে। তাই নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সময় এগুলা আর এখানে লিখলাম না। নির্বাচন কমিশন ১৫০০ কোটি টাকা বাজেট দিয়েছে এবারের নির্বাচনের জন্য, এবং সবারই ধারণা এইটা দিয়ে সম্ভব না, ২০০০ কোটি টাকা লাগবে এই নির্বাচন শেষ করতে। এবারই প্রথম নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দুইদিনের খরচ দেওয়া হবে, এর আগে শুধু নির্বাচনের দিনের জন্য টাকা দেওয়া হত সবাইকে।
কথা হচ্ছে অন্য জায়গায়। এই টাকা খরচ করে যা করা হচ্ছে তা পুরোটাই নিয়ম রক্ষার জন্য। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছাড়া আর কোন যুক্তিই নাই এই নির্বাচনের। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে আসে নাই। কাজেই নিজেদের ভিতরে কে কে সংসদে বসবে তাই ঠিক করার নির্বাচন হচ্ছে। বিএনপি কেন আসল না? বিএনপি না আসার পিছনে সব দায় আওয়ামীলীগের? এগুলা অনেক জটিল প্রশ্ন, আমি আমার ধারণার কথা লিখতে পারি শুধু।
আগেই বলে নেই এই ঢঙের নির্বাচন নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নাই। সুষ্ঠ নির্বাচন মানে সব দলের অংশ গ্রহণে নির্বাচন হলে কী যে ফল ধরত ডেউয়া গাছে তা আমার জানা আছে। বাংলাদেশের মানুষের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার যোগ্যতা নিয়ে আমার প্রশ্ন বরাবরই ছিল এখনও আছে। আমি চোখের সামনে দেখছি স্বীকৃত রাজাকারদের জাতীয় পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে ঘুরতে, দেখছি তাদের আস্ফালন। তো আমি সেই তখনই এই জনগণের কাছ থেকে সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার আশা বাদ দিয়েছি। ভোট দিয়ে দেশ পাকিস্তানদের সাথে যুক্ত করে দেওয়ার আয়োজন হলে এদের অনেকেই হয়ত আবার পাকিস্তানের সাথে আমাদেরকে যুক্ত করে দিতে চাইবে। এবং তখনও দেখা যাবে কেউ কেউ টেলিভিশনে খুব গম্ভীর হয়ে আলোচনা করবে কেন আমাদের উচিত পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়ে যাওয়া। আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে এইটা কত জরুরি এমন কলাম দেখা যাবে পত্রিকার পাতায়। এইটা হবে না হয়ত কিন্তু এইটা আমার আশঙ্কা। কারণ আমি নিজামির গাড়িতে, মুজাহিদের গাড়িতে পতাকা উড়তে দেখছি! আমি ভয় পাই তাই ওই জনগণকে যারা এদেরকে নির্বাচন করেছিল তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে। তাদের সংখ্যা কমছে ভাবার কোন কারণ নাই, বরং নানা পরিচর্যায় তাদের সংখ্যা বৃদ্ধিই পেয়েছে।
বিএনপি আসল না। আসবে কেন তাও আমি বুঝি নাই। এই পদ্ধতির মাধ্যমে গত নির্বাচনে তারা আসছিল, ফলাফল? সবাই জানে। একটা দলকে পুরোপুরি খেয়ে ফেলা এইটা গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর না। আওয়ামীলীগ তাই করল, একটুও ছাড় দিল না। ছাড় না দেওয়ার হাজারও যুক্তি আছে, বিশেষ করে ২১ আগস্টের পর থেকে এই দেশে একে অন্যকে শেষ করে দেওয়ার রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে যেহেতু। কিন্তু নিজেদের স্বার্থেও উচিত ছিল বিএনপিকে সংসদে রাখা। যে তরিকায়ই হোক বিএনপি গত নির্বাচনে ২০/৩০টা আসন পাইলে সুস্থ একটা রাজনৈতিক চর্চা দেখা যেত দেশে। এবং সেই উদাহরণ দিয়ে এবারেও বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে বাধ্য করা যেত। কিন্তু মনোপলি একবার মজা পেয়ে গেলে তা সম্ভবত আর ছাড়া যায় না। আওয়ামীলীগও ছাড়তে পারবে না, পারেও নাই।
এগুলা আওয়ামীলীগের দায়। বিএনপির দায় নাই? আছে, মূলত তাদেরই দায়টাই বেশি। তাদের নেতৃত্বের অসারতায় আজকের দিন এসে হাজির হয়েছে। বিএনপি নেতারা কী এইটা বুঝে? নেতৃত্বে দেউলিয়া হওয়ার ফলে যে তারা ক্ষমতার দুই তিনশ মাইলের মধ্যে আসতে পারছে না এইটা যদি এখনও না বুঝে তাহলে আর কবে বুঝবে? এই নেতৃত্ব বোমা মেরে শেখ হাসিনাকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে। বোমা মারা ছাড়াও এই নেতৃত্ব এমন একটা কাজ করেছে যা দেশের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের যে পদ্ধতি আমাদের এখানে মোটামুটি সফল ভাবে চলছিল সেই পদ্ধতিটাকে মেরে ফেলেছে। এই নেতৃত্বই দুই নাম্বারই করে নিজেদের পছন্দের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান আনার জন্য বিচারপতির চাকরির বয়স বৃদ্ধি করে এবং গণ্ডগোলের শুরু। সেই ল্যাজ ধরেই ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হওয়া, সেনা সমর্থিত দুই বছরের এক আধ্যাত্মিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন আর এরপরে আওয়ামীলীগ যুগের শুরু।
শুধু যে ওই ভুল তা না। এরপরেও তাদের নেতৃত্বরা ভুল করেই গেছে। পিছনে যাই হোক আমরা দেখছি আওয়ামীলীগ প্রধান চেষ্টা করে গেছেন আলোচনার। ফোন করেছেন, খালেদা জিয়ার ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি গেছেন সব ভুলে খালেদা জিয়ার বাড়িতে। অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে খালেদা জিয়া ফিরিয়ে দিয়েছে দরজা থেকে! মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট কথা মনে রেখেও সেদিন খালেদার জিয়ার বাড়িতে গিয়েছিল আর আপোষের, সমঝোতার, সুস্থ রাজনীতির সেই সুযোগ বিএনপি নষ্ট করেছে শেখ হাসিনাকে ঘরের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দিয়ে। এবং আমি যদি ভুল না করি এরপরেই শেখ হাসিনা ভিন্ন শেখ হাসিনা। এরপরে সম্ভবত আর আপোষ, আলোচনা, সমঝোতা কোন কিছুর চেষ্টা আওয়ামীলীগ বা শেখ হাসিনা করে নাই। এরপরে শুধুই পিষে ফেলার ইতিহাস। আওয়ামীলীগ দুধে ধোয়া তুলশী পাতা না, সে নিজের আখের গোছাবেই। বিএনপি নিজেদের ভুলে জনগণকে আওয়ামীলীগের দয়ার সামনে ফেলে দিয়েছে। জনগণের পক্ষে বলার মত কেউই নাই। বিএনপি নিজেরাও জানে না তারা কী চায়। ওরা ক্ষমতায় আসলে কী করবে তাও জানে না। খালি ভাবে অলৌকিক ভাবে কেউ তাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে!
কতখানি দেউলিয়া একটা দল তার প্রমাণ হচ্ছে সাত তারিখের নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া! জনগণকে ভোট দিতে যেতে না করছে, অনুরোধ করছে। বলছে সরকার কাওকে ভোট দিতে বাধ্য করতে পারে না কিন্তু সেই চেষ্টাই করছে, মানুষকে ভোট দানে বাধ্য করছে! শক্ত করে বলতেও পারছে না এই এই নির্বাচন মানি না, তামাশার নির্বাচন বন্ধ করেন। তারা অনুরোধ করছে জনগণকে যে তারা যেন ভোট দিতে না যায়! হাস্যকর সব কারবার এই দলের। আর করছে সবচেয়ে কুৎসিত কাজটা। মানুষের মনে আতঙ্ক আনার জন্য আগুন দিয়ে মানুষ মারছে। গত পাঁচ তারিখ রাতে রেলে আগুন দিয়ে যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটা ঘটাল এর দায় কীভাবে এড়াবে?
মানুষ কিন্তু নির্বাচন পছন্দ করে। কেন জানি মানুষের ধারণা যে ভোট দিতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এই যে একদলের নির্বাচন হচ্ছে, মানুষের এইটা নিয়ে কোন আগ্রহই থাকবে না, এমন হওয়ার কথা না? কিন্তু তা হচ্ছে না! আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাই বলেন আর যাই বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়ে এই নির্বাচন জমিয়ে দিয়েছে। শহরের মানুষ কিছু নাক উঁচু ভাব দেখাচ্ছে, ম্যালা তত্ত্ব কপাচাচ্ছে ( যেমন আমি নিজেই!) কিন্তু গ্রামের মানুষ, যেখানে সবচেয়ে বেশি ভোটার, তারা সবাই ভোট দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। যারা ভাবছেন যে ভোটার শূন্য নির্বাচন হতে যাচ্ছে তারা সম্ভবত ধোঁকা খেতে যাচ্ছেন। কালকে বিপুল পরিমাণ মানুষ ভোট দিবে এইটা আমি এখনই বলে দিতে পারছি। কারণ আমি সাধারণ মানুষের এই নির্বাচন নিয়ে যে উচ্ছ্বাস তা দেখেছি। মিথ্যা বলব না, এইটা আমাকে বিরক্ত করেছে। সব ফেলে এই নির্বাচনের জন্য এত আগ্রহ?
ফলাফল যেহেতু জানাই তাই এইটা নিয়া চিন্তা করে লাভ নাই। আমরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে গুটি গুটি পায়ে আগাচ্ছে। করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বমন্দা এর মধ্যেও আমাদের দারিদ্র্যতার হার কমেছে। ২০১৬ সালে মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ ছিল দারিদ্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী এখন ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র। একই সঙ্গে, দেশে অতি দারিদ্র্যের হারও কমেছে। ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে অতি দারিদ্র্যের হার এখন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে এই হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। আরও নানা সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়েছে। আমার কাছে এইটাই জরুরি।এগিয়ে যেতে হবে, গতির হেরফের হতে পারে কিন্তু থামা যাবে না, পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। আইনের শাসন, বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা কাটিয়ে উঠা এই সবই চাওয়া আমার নতুন সরকারের কাছে।
সকলকে জ্ঞান দাও প্রভু ক্ষমা কর। শুভ হোক, মঙ্গল হোক এই চাওয়া।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।