আগে যদি কোন ফিলিপিনো-র (ফিলিপিন্স দেশের লোকজন) সাথে আলাপ থাকত, তা হলে আর কলেজ বেলায় আমাদের মেদিনীপুরের বন্ধুদের ইয়ার্কির ছলেও তাদের ভাত খাওয়া নিয়ে কিস্যু বলতাম না। আমরা বন্ধুদের বলতাম, তোরা এত ভাত খাস যে পাতের উপর দিয়ে বেড়াল ডিঙোতে পারবে না! তো সেই হিসাবে ফিলিপিনো-দের ভাত খাওয়ার পরিমাণ দেখলে বলতে হয়, পাতের উপর দিয়ে বিড়াল তো কোন ছাড়, ঘোড়া পর্যন্ত ডিঙোতে পারবে না! আমি নিজে বর্ধমানের ছেলে – আমরাও ভাত খেতাম। কিন্তু মেদিনীপুর আমাদের টেক্কা দিত এই ব্যাপারে। বর্ধমান এগিয়ে মুড়ি খাওয়ায়!
তবে শুধু ফিলিপিন্স কেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশেরই মূল খাদ্য – ভাত। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া যাই হোক না কেন। এরা অনেকেই দিন রাত ভাত খায় – ব্রেকফাষ্টে ভাত, দুপুরে ভাত, রাতে ভাত – মানে ভাতই ভাত।
একসময় ফিলিপিন্সের বিখ্যাত রাইস-টেরাসের (ধানের সোপান) নাম শুনলাম। ওই যে পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে ধান চাষ করা যাকে বলে। ভারতেও নিশ্চয়ই আছে অনেক জায়গায়, বিশেষ করে আমাদের দেশের উত্তর দিকের গোটাটাই যেখানে পাহাড়! কিন্তু ভারতের রাইস-টেরাসের তেমন নাম ছড়িয়ে পড়েছে কোথায় সারা বিশ্বে যেমনটা পড়েছে ফিলিপিন্সের? ফিলিপিন্সের সেই রাইস টেরাস এখন ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট হয়ে গেছে। এবং দাবী করা হয় এই গুলো নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো রাইস টেরাস। এক প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদ তো দাবী করেছিলেন এগুল প্রায় ২০০০ বছরের বেশী পুরানো। পরে অবশ্য অন্য অনেক পন্ডিত বলেছেন, না এগুলো পুরানো হলেও, ওতো পুরানো নয়। তবে মোদ্দা কথা খুব খুব পুরানো।
চাষার ছেলে হবার জন্য জীবনে অনেকটা সময় রত্না, আই আর ৩৬, মিনিকিট, লাল স্বর্ণ ইত্যাদির মাঝে কেটেছে। তাই সেবার ভাবলাম দেখেই আসি ফিলিপিন্সের রাইস টেরাস – তা আজ প্রায় ছয় সাত বছর হয়ে গেল। দেখে এসে বলতে পারি - জায়গা খুব সুন্দর, তবে দেখার মন নিয়ে যেতে হবে। আমার নিজের বেড়াতে গিয়ে শুধু টুরিষ্ট স্পট ছাড়া স্থানীয় লোকেদের সাথে মিশে একটু তাদের সংস্কৃতির ছাপ গায়ে মাখিয়ে নিতে ভালো লাগে। তাই সেই হিসাবে আমাদের এই ফিলিপিন্স যাত্রাটা খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। রাইস টেরাস বাদে অন্য জায়গা নিয়ে পরে লিখব কোন এক সময়।
আজকাল তো এই ফিলিপিন্সের রাইস টেরাস এতই বিখ্যাত হয়ে গ্যাছে যে মার্ভেল কমিকস এর মত বড় সিনেমা নির্মাতারা এই রাইস টেরাস ব্যবহার করেছেন সিনেমায়। আপনারা যদি অ্যাভেঞ্জারস্ - ইনফিনিটি ওয়ার দেখেন, তাহলে একদম শেষের দিকে দৃশ্যে, ওই যে মেন ভিলেনটা, থ্যানোস যার নাম – সে পাহাড়ের গায়ের এক কুঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সামনের সবুজের দিকে তাকায়। তা সেই জায়গাটা ছিল, ফিলিপিন্সের রাইস টেরাস। এবং তার পরের সিনেমা ‘এন্ড-গেম’ – তেও প্রথম দিকে থ্যানোস মারা পরে গেল এই রাইস টেরাসেরই ব্যাকগ্রাউন্ডে।
ফিলিপিন্স দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত রাইস টেরাসটি আছে ‘বানাউ’ বলে এক জায়গায় সেখানকার পাহাড়ের গায়ে। ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলা শহর থেকে উত্তর দিকে প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ি রাস্তা হবার জন্য এই দূরত্ব যেতে প্রায় আট ঘন্টা লেগে যাবে গাড়িতে করে। তবে রাস্তার পাশের দৃশ্যও খুব সুন্দর বলে আপনি টের পাবেন না সময় কি ভাবে কেটে যাবে।
২০০০ বছরের পুরানো কিনা সেই নিয়ে দ্বিমত থাকলেও যেটায় সবাই একমত তা হল, এই ধানের সোপানের প্রায় পুরোটাই হাতে বানানো, খুব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১১০০ মিটারের কাছাকাছি। সোপানের ধারগুলোতে পাথার এবং মটির পাঁচিল দিয়ে ধান বোনার জমি তৈরী হয়েছে। আর ধান চাষের জন্য যে জল লাগে তা ওরা পায় পাহাড়ের উপরের বন-জঙ্গল (রেনফরেষ্ট) থেকে। সেই জল এবার খালের মত করে কেটে সুচতুর ভাবে সেচ ব্যবস্থা তৈরী করা এবং পাহাড়ের প্রতি ধাপে যাতে সেই জল পৌঁছয় তার ব্যবস্থা করা – সে এক কম বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ধারণার ব্যাপার নয়! ভাবতেই অবাক লাগে কত হাজার বছর আগে মানুষ এত সুন্দর কাজ করেছিল।
আর একটা ব্যাপার, এই পুরো রাইস টেরাস জেনেটিক্যালি মডিফায়েড খাদ্যের থেকে মুক্ত। মানে এখানে কোন জেনেটিক্যালী মডিফায়েড ধান বীজ চাষ করা হয় না। এটা কিন্তু একটা বিশাল ব্যাপার – এই বিশ্বায়নের যুগে নিজেদের কৌলিন্য এবং প্রাচীনত্ব বজায় রেখে পূর্বসূরীদের চাষ করা ধান এখনো চাষ করে যাওয়া। এরা শুধু এই জন্যই প্রশংসার দাবী রাখে।
আমাদের ভারতের নানা জায়গায় যেমন ধান উঠলে নতুন ধান নিয়ে নানা উৎসবের চালু আছে – সে নবান্ন, বা পোঙ্গল যাই বলা হোক না কেন জায়গাবিশেষে। তেমনি এই বানাউয়ের লোকেদেরও ধান কেন্দ্রিক উৎসবের চালু আছে সমাজে। নতুন ধান উঠলে সবাই মিলে একসাথে ধান থেকে তৈরী মদ (ধেনো যাকে বলি আমরা আর কি – বিদেশে বলে রাইস ওয়াইন), চাল থেকে তৈরী নানাবিধ খাবার (যেমন পিঠে জাতীয়) এই সব নিয়ে উৎসব করে।
পাহাড়ের থেকে ধীরে ধীরে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে উঠে এই সব রাইস টেরাসের মধ্যে দিয়ে ট্রেকিং বেশ জনপ্রিয়। এবং গ্রীষ্মপ্রধান দেশ বলে সেই এবড়োখেবড়ো ধানের সোপান দিয়ে নামা ওঠা বেশ শ্রম সাধ্যও বটে। আপনি ওখান থেকে লোকাল গাইড নিয়ে নিতে পারেন। তবে না নিলেও কেউ জোর করবে না। গাইড নিলে একটু আপনি লোকাল ইকনমি-কে সাহায্য করলেন – এই ভাবনা থেকেই নিলেন না হয়! আর আপনাকে সে যে গ্রামের ভিতরে ঘিরে দেখাবে, সেখানকার লোকেদের সংস্কৃতি একটু বুঝিয়ে দেবে – সেটা তো উপরি পাওনা।
তা আমরা গাইড নিয়ে সেই পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরলাম – পাহাড়ের পাদদেশে গ্রামে ঢুকলাম। এখন উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে গ্রামেতেও, অনেক টিনের চালের বাড়ি দেখতে পাবেন। কিন্তু তাদের আদি বাড়িগুলো বাঁশ এবং পাতা দিয়ে বানানো। এখনো অনেকেই বাস করে তেমন বাড়িতে। আমাদের দিকে যেমন বাঁশের মাচা বানানো হয়, তেমন বাঁশের মাচার মাথায় ছাউনি দিয়ে ঘর। মাটি থেকে বেশ উঁচুতে – মই দিয়ে উঠতে হয় ঘরে।
এদের সামাজিক জীবনেও এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে এমন ভাবে চাষবাস চালিয়ে নিয়ে যাবার। আজকের যুগের যুবক সমাজ ওখানেও শহরের দিকে চলে গিয়ে আরো বেশী আয় এবং আরো বেশী স্বাচ্ছন্দের মুখ দেখতে চাইছে। ফলে আজকাল প্রায় শতকরা তিরিশ ভাগ ধানের সোপানের জমি বিনা চাষে পরে আছে। এরা এখনো মেশিনের থেকে বেশী সেই হাতে কলমে ধান পেষাই করে চাল বের করে চলেছে। ধান ঝাড়ার বা কাটার মেশিন তো প্রায় দেখলামই না গ্রামে – সব কাজই এরা গায়ে গতরে করছে এখনো।
আমি নিজে গ্রামের ছেলে বলে অনেক অনেক ভালো লাগা নিয়ে এলাম। রাতে ছিলাম পাহাড়ের কোলে এক কাঠের বাংলোয়। ফাইভ স্টার হোটেলের মত লাক্সারি পাওয়া যাবে না ওখানে – কিন্তু খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রাতের দিকে কিছু টুরিষ্টিক ব্যাপারও হল – যেমন হয় আর কি। স্থানীয় লোকেদের নাচ ইত্যাদি, স্পেশাল ফিলিপিনো খাবার খাওয়া হল সেদিন রাতে।
দুই-দিন এই রাইস টেরাসে কাটিয়ে রওনা দিলাম অন্য জায়গায় দেখতে। সেই মাটির নীচে গুহা অভিযান (কেভিং যাকে বলে ইংরাজীতে) এবং পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত কফিনের গল্প অন্য সময় –
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।