এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শহরে একটি আকাশ চুরি গ্যাছে

    selim khan লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৪৭ বার পঠিত
  • “আমি কি কখনও আকাশ দেখব না। আকাশ কোথায়?”জানালা ধরে বিজবিজ করছে ছোট্ট এক শিশু। চোখে তার শুন্যতা। শুন্যতার রঙ কি নীল?নাকি রঙহীন। শিশুর চোখে কোন রঙ নেই। ধূসর বাদামী, যেন শহুরে শালিক, একটু সিঙারা-বনরুটির নষ্ট ময়দা খুঁজছে।

    ঢাকার যান্ত্রিক শহুরে ব্যস্ততার ভিড়ে, ধুলা–ধোঁয়ার স্তরে আটকে থাকা এক আকাশের নিচে জন্ম ছোট্ট জায়ানের। বয়স দেখতে দেখতে চার ছুঁয়ে ফেলেছে। বাবা–মা দুজনেই চাকরিজীবী; জীবনযুদ্ধে লড়ছে, একটু নিরাপত্তার আশায়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দৌড়াতে দৌড়াতে অফিস, রাত এগারোটায় শরীর জুড়ে ক্লান্তি নিয়ে ঘর — এই যাওয়া আসা যেন এক অলিখিত দৌড় প্রতিযোগিতা। জায়ানের সারাদিন কাটে কাজের বুয়া আকলিমার সাথে।

    আকলিমা — ইন্টার পাশ, মফস্বল থেকে আসা সরল মেয়ে। জায়ানের বাবার দূরসম্পর্কের খালাতো বোন। বাপটা বিছানায়। অসহায়ত্ব চোখে মুখে। শহরের অচেনা ভিড়ে আকলিমার নিঃশ্বাস আটকে আসে, সে খুঁজে বেড়ায় তার গ্রাম, বাঁধনের মা, আলিফের বোন, মেরিনা তার সব সখীদের, তার বুক ফেটে কান্না আসে। আবার এই ছোট্ট শিশুটির পাশে দাঁড়ালে সে অন্য একটা পৃথিবীতে চলে যায়। যে পৃথিবীতে কোন উৎকট শব্দ নেই, আছে শুধু পাখিদের গান, ধানের গন্ধ। যখন আনমনে অজান্তে এই শিশু তাকে মা বলে ডাকে, আকলিমার মধ্যে জেগে উঠে নতুন এক সত্তা ‘মা’। জায়ানও তাকে নিজের মতো করে আপন করে নিয়েছে। আধো আধো কন্ঠে কখনো “মা”, কখনো “আকলিমা” ডাকে। ডাকটার ভেতরে এক ধরনের মাদকতা, যেন মধ্যরাতে প্রার্থনা করছে কোনো মুমিন বান্দা।
    আকলিমার উপর জায়ানের বাবা–মায়ের ছিল কড়া নির্দেশ — “পরিবেশ পরিস্থিতি ভালো না, জায়ানকে বাসার বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। ”
    ঢাকার রাস্তাঘাট, লোকজন, ঝুঁকি, হেনতেন — সব মিলিয়ে জায়ানের পৃথিবী সীমাবদ্ধ একটা খোলসের মধ্যে, ঠিক খোলস না নিরাপদ ফ্ল্যাট।
    এই চার বছরে জায়ান কখনোই রাস্তায় হাঁটে নি। তার খেলার মাঠ ঘরের তিনখানা রুম; এক রুম থেকে আরেক রুমে দৌড়ানোই তার কাছে চাঁদের পাহাড়ে অভিযান। বাবা-মায়ের কিনে দেওয়া রঙিন বইগুলো সে উলটে পাল্টে দেখা, কখনো ছিঁড়ে ফেলা তার কাছে জঙ্গলে শিকার করার মতো। সে ছবিতে আকাশ দেখে, পাখি দেখে, বাঘ দেখে, ছাগল দেখে, গাছ দেখে আবার পাতাটা ছিঁড়ে নতুন কোনো খেলা বানায়।
    দমবন্ধ চার দেয়াল ফ্ল্যাটের একটা কোণ জায়ানের খুবই প্রিয় — যেখানে একটা জানালা আছে। জানালার পাশে দেখা যায় আরেকটা বিল্ডিং, তবুও খানিকটা আলো এসে ঝলকানি দেয়, ওখানে দাঁড়িয়ে জায়ান আকাশ দেখে। সামনে দেয়ালজোড়া অন্য এক ভবন — শহরের সেই চিরচেনা রুপ, যা ঢেকে দিয়েছে জায়ানের আকাশ।
    জায়ান দাঁড়িয়ে থাকে জানালায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ক্লান্ত হলেই চাঁদের পাহাড়ে একটু দৌড় ঝাপ করে আবার ওখানেই থিতু হয়। তার চোখে প্রশ্ন আর প্রশ্ন — ওপারে কী আছে? আলোটা কোথা থেকে আসে? আকাশটা দেখতে কেমন ?
    সে মাঝে মাঝে আকলিমাকে জিজ্ঞেস করে,
    — “মা, আকাশ কোথায়?”
    — “ওই তো… উপরে। ”
    কিন্তু “উপরে” দেখা যায় না। উপরে শুধু কংক্রিট, লোহা, জানালার কাচ, আর অচেনা ভবনের ছায়া।
    জায়ানের আরেকটা সঙ্গী — মোবাইল ফোন। তাতে সে রিল দেখে, কার্টুন দেখে, গেম খেলে। স্ক্রিনের ভেতরে রঙিন পৃথিবী আছে — খোলা মাঠ, নদী, পাহাড়, বিস্তৃত আকাশ। তার ইচ্ছে হয় সে আকাশ দেখবে, মাঠে খেলা করবে। আবার ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘরময় দৌড়ঝাপ করে।
    হয়তো জায়ানের মনের আবদার ওপরওয়ালা শুনতে পেয়েছিল, তার মনে জাগ্রত হয়েছিল একটু দয়া। বিকেলে জানালার ওপাশের আকাশে সূর্য ডোবার আগের নরম তুলতুলে একফালি আলো ঢুকে পড়ল। গোলাপি রঙের একটুখানি আভা, মিষ্টি আলো, ঘরের ভেতর ঠিকরে পড়ল।
    জায়ান বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল,
    — “মা, মা…আকলিমা, আকলিমা! আকাশ! আকাশ। আকাশ এসেছে।”
    আকলিমা একটু ভাত ঘুম দিয়েছিল, দৌড়ে ছুটে আসে।
    জানালার গ্রিলের ফাঁক ধরে জায়ান বলে,
    — “মা, আমাকে আকাশ দেখাবে? বড়ো আকাশ? নীল-নীল? যেখানে পাখি উড়ে? বইতে দেখেছিলাম যে আকাশ। ”
    আকলিমা চুপ। তার নিজের বুক কেঁপে ওঠে। আধো ঘুমে চেয়ে থাকে জায়ানের দিকে। সে বলতে পারে না এই শহরে কোন আকাশ নেই। দেখতে চাইলেও আকাশ দেখা যায় না। এই শহর সামান্য নিরাপত্তার অজুহতে জায়ানের আকাশ কেড়ে নিয়েছে।

    জায়ান আবার জিজ্ঞেস করে,
    — “মা বলতো… আকাশ কী?”
    আকলিমার দম বন্ধ হয়ে আসে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে বলে,
    — “আকাশ… খুব বড়ো। অনেক বড়ো। তোমার হাতের বাইরে। একদিন… তুমি দেখবে জায়ান। ”
    জায়ান সে কথায় বিশ্বাস করে আবার অবিশ্বাসও করে।
    সে আবার জানালার দিকে তাকায়— আকাশ খোঁজে।

    আকলিমার বুক কেঁপে উঠে, নিজের ভিতরে জাগ্রত হয় ক্ষোভ। দমবন্ধ হয়ে আসে। জায়ানের মা বাবার শত নিষেধ, চাকরি হারানোর ভয়, অসুস্থ বাবা, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তা সব চিন্তা ছেড়ে সে শিশুটিকে নিয়ে বিশতলার ছাদে রওনা দেয়। শিশুটির মুখে সামান্য কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তরের জন্য মানুষ পৃথিবীর পথে চলছে হাজার কোটি বছর ধরে, ”আমরা কোথায় যাচ্ছি মা?”

    আকলিমা একটা প্রশান্তির শ্বাস ছেড়ে, যে উত্তর গত কয়েক শতাব্দি ধরে কেউ এত সহজে দিতে পারেনি, নিরাপত্তার প্রশ্নে, সে সবকিছুকে ছুড়ে ফেলে এক নিশ্বাসে বলে, “আকাশ দেখতে।”
    ছাদে গিয়ে জায়ান চোখমেলে দিগন্ত দেখে। সে আকাশ খোঁজে। এপাশ থেকে অপাশে ছোটে। দেখতে থাকে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর মতো। আকাশ দিয়ে বিমান উড়ে যায়। আকাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে আকাশের নীল খুজতে থাকে। তার মনে হয় এটা আকাশ না, তার মনে হয় আকলিমা মিথ্যা বলছে। এইটা আকাশ হতেই পারে না। আকাশ হলে পাখি কোথায়?নানা প্রশ্ন তার মাথায় উকি দিতে থাকে, সে নীল আকাশ খুজতে থাকে।

    জায়ান দৌড় দেয়, দৌড়, দৌড় দৌড়… ছাদের বেলকনি ছাড়িয়ে, নো ম্যানস ল্যান্ডে পৌঁছে যায় সে। চোখে ভয় আবার আনন্দ। সে শুন্যে। জীবনের অঙ্ক শুন্য সবসময়, একদম ধ্রুব মান।
    আকলিমার চোখে তাকানোর সাহস করিনি।

    পরদিন সকালে আকাশ চোরদের দালাল পত্রিকার সস্তা শিরোনাম,
    "শহরে একটি আকাশ চুরি গ্যাছে, উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে প্রশাসন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই এর সুরাহা করা হবে।”
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন