[তিন]
আগস্টের ২৫ তারিখ, স্বর্ণালীর আজ জন্মদিন। আমাদের তেঘরিয়া থেকে সল্টলেক সিটি সেন্টার যাওয়ার কথা। সোনা আমাদের চাইনিজ খাওয়াবে। অভিষেক ওদের বাড়ির গাড়িটা এনেছে। অভিষেক ড্রাইভারের সিটে, ওর পাশে খোঁচা, পেছনের সিটে আমি। আমার পাশে স্বর্ণালীকে উঠিয়ে জানলার ধারে বসে পড়ল তৃষা।
আমাদের সেদিনের অভিযানের কথা স্বর্ণালীকে কিছু বলা হয়নি। আজকের যা আসল প্ল্যান সেটাও ও জানে না। আমাদের ইচ্ছা ছিল আরও একটু পরে বেরোব, সোনার তাড়ায় আগেই বেরোতে হচ্ছে। এ জন্য আবার প্ল্যানে একটু বদল আনতে হয়েছে। অন্ধকার হয়ে আসছে। সন্ধ্যা হয়েছে, আকাশেও মেঘ। গুমোট লাগছে।
"এসিটা চালানো যাবে অভিষেক?” বলল তৃষা।
"ইয়েস।” সবকটা জানলার কাঁচ উঠে যাওয়ায় বাইরেটা একটু আবছা হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এসির ঠান্ডা হাওয়া ছড়িয়ে পড়ল গাড়িতে।
"এইটুকু গরম সহ্য করতে পারিস না? রাস্তায় নেমে পলিটিক্স করবি কী করে?" বলল স্বর্ণালী।
তৃষা ছাত্র রাজনীতি করে, আর বেশ সিরিয়াসলিই করে। বলল, "যখন যেমন দরকার, আমি তখন তেমন।"
ভিআইপি রোডে পড়ে আমাদের গাড়ি বাঁদিকে ঘুরে ফ্লাইওভারে উঠল। সবাই চুপ। কিছু একটা বলা দরকার, যে কোনও কথা। একটা বিল্ডিং-এর মাথায় টাইগার স্রফের একটা সিনেমার হোর্ডিং দেখে কিছু একটা বলতে গেলাম। তার আগেই মুখ খুলেছে তৃষা।
"সোনা, আমাদের বিশ্বাস করিস, তাই তো?"
"মানে?”
"আমরা সিটি সেন্টার যাচ্ছি না, অন্য জায়গায় যাব। ডোন্ট ওয়ারি। মনে রাখিস তুই যে আমাদের সাথে বেরোবি সেটা আন্টি জানেন, আর আমার নম্বর আন্টির কাছে আছে।"
"হোয়াট ডু ইউ মিন?”
"বললাম তো কোথায় যাচ্ছি দেখতেই পাবি।”
"হোয়াট কাইন্ড অফ ড্রামা ইস দিস?"
"আরে বাবা বেশিক্ষণ না,” খোঁচা বলল, “এ ড্রামা চলবে খুব বেশি হলে এক থেকে দেড় ঘন্টা।"
"কী করতে চাইছিস?”
“মেয়ে পাচারের বিজনেস শুরু করেছি। তোকেই ফার্স্ট পাচার করব।” হাত বাড়িয়ে খোঁচার মাথায় চটাস করে মারল স্বর্ণালী। “মারছিস কেন? ভাল লোকের কাছেই বেচব তোকে। ভেরি রিচ, তোকে সোনায় মুড়ে রাখবে।”
এবার স্বর্ণালী খোঁচার চুল ধরে জোর টান দিল একটা। “এমন করলে কিন্তু কোনও গরীব লোকের কাছে বেচে দেব, তাতে যা লস হয় হবে,” বলল খোঁচা। অভিষেক হেসে উঠল।
"খোঁচা থাম... ভয় পাস না সোনা," বলল তৃষা।
একটু চুপ থেকে স্বর্ণালী বলল, "এই জন্যই অভিষেক গাড়ি এনেছে?"
"রাইট। নিজেদের গাড়ি নিয়ে যে কেউ ক্রাইম করে না, সেটা তুই নিশ্চয় জানিস," অভিষেক জানাল।
চুপ করে ছিলাম বলেই বোধ হয় স্বর্ণালী আমার দিকে তাকাল। ফিসফিস করে বললাম, "ভয় নেই রে।"
ফের কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল স্বর্ণালী, একবার কাশল। তারপর বলল, "ঠিক আছে।"
"গুড। অভিষেক, একটা গান টান চালা না," বলল খোঁচা। এফএম রেডিওয় মারজাওয়া ফিল্মের ‘তুম হি আনা’ গানটা বেজে উঠল।
আমাদের গাড়ি সিগনালে দাঁড়াল। এখান থেকে ডাইনে ঘুরে লেকটাউনে যেতে হয়।
"আমরা কি লেকটাউন যাচ্ছি?" স্বর্ণালী উদগ্রীব হল।
"দেখ না কোথায় যাই," বলল তৃষা।
ইউ-টার্ন নিয়ে আমাদের গাড়ি লেকটাউন না ঢুকে সোজা এগিয়ে চলল। পরের মোড়ে বাঁদিকে ঘুরতেই স্বর্ণালী সোজা হয়ে বসল। "সো ইট ইজ বাঙুর… এখানে কোথায়?"
কেউ উত্তর দিলাম না। কিছুটা এগিয়ে একটা গলিতে ঢুকে গাড়ি থামাল অভিষেক।
"সোনা," আস্তে করে ডাকল তৃষা।
"শুনতে পাচ্ছি।"
"এসে গেছি।"
"সেটা দেখতে পাচ্ছি। বাট হোয়াই?" জিজ্ঞেস করল বার্থডে গার্ল। এবারেও আমরা চুপ থাকলাম।
গাড়ি থেকে নেমে এগোলাম সবাই। ফুটপাথে একটা ছোট খাবারের দোকান, তবে ‘পিওর ভেজ’। ইসারায় দোকানটা দেখাল অভিষেক।
"এইখানে!" নাক সিঁটকালো স্বর্ণালী। "নো ওয়ে। তার ওপর ভেজ। তোরা এত ড্রামাবাজি করে এই ভাটের জায়গায় আমায় নিয়ে এলি!"
"এদের খাবার খুব ভাল,” বলল অভিষেক, "আপাতত কিছু খাই, পরে আবার দেখা যাবে”
ফুটপাথের ওপর রঙিন ছাতার তলায় দুটো টেবিল, আটটা চেয়ার। একটা টেবিলে দুটো ছেলে পাপড়ি চাট খাচ্ছে। ভেতরে আরও দুটো টেবিল, সেগুলো খালি।
“চল,” ভেতরে ঢুকে গেল খোঁচা, পেছন পেছন আমরাও।
অভিষেক পকোড়া আর কফির অর্ডার দিল। ওয়েটারটা আমাদের বয়সী হবে, একবার আড়চোখে তাকাল স্বর্ণালী আর তৃষার দিকে, তারপর ভেতরে চলে গেল।
"তোদের প্ল্যানটা কী বল তো?"
তৃষা স্বর্ণালীকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তবে তার আগেই ওর ফোন বেজে উঠল। আমরা উৎসুক হয়ে তাকালাম। “হ্যালো, হ্যাঁ প্রদীপ, বল।” আমাদের উৎসাহ নিভে গেল। শুনলাম তৃষা বলছে, “আমি পরশু বিক্রমদার সাথে দেখা করব। তার আগে কাগজপত্রগুলো আমার লাগবে। তুই কাল কলেজে ওগুলো নিয়ে আয়। … বিশুদার চায়ের দোকানে। একটা ক্যারিব্যাগে করে আনিস।... ঠিক আছে।”
ফোন রেখে তৃষা বলল, “এই প্রদীপ ছেলেটা রাজারহাটে থাকে। একটা মুদীর দোকানের কর্মচারী। ওর দিদি একজনের সাথে পালিয়েছিল, মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হতেই লোকটা কেটে পড়েছে। বেচারা বাড়ি ফিরে এসেছে, অ্যাবর্ট করেছে... ওদের অবস্থাটা ভাব। খুব সাধারণ ঘর, চার চারটে ভাইবোন।”
খোঁচা বলল, “তুই কি করছিস ওদের জন্য?”
“আপাততঃ একটা একটা কাজ খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করছি মেয়েটার জন্য। পার্টির এক জনের সাথে দেখা করবো পরশু। খুব দরকার ওদের বুঝলি।"
স্বর্ণালী বলল, “এভরিওয়ান গেটস হোয়াট হি ডিজার্ভস।”
“স্বপ্ন সবারই থাকে রে,” খোঁচা জানালো।
“ডোন্ট গিভ মি জ্ঞান খোঁচা। আমি ভুলভাল কাজ করলে আই হ্যাভ টু ফেস দ্য কনসিকোয়েন্স। এই লোকগুলো গাদা গাদা কাচ্চাবাচ্চার জন্ম দেবে। তারপর… বাবা ঠিকই বলে, ওভার পপুলেশন ইজ দ্য মাদার অফ অল দ্য প্রব্লেমস ইন দিস কানট্রি। দে শুড গো টু হেল।”
ওর মুখে এমন কথা নতুন নয়, আগেও শুনেছি।
“এ সব ফ্যামিলিতে বাচ্চা বেশি হয় কারণ দে ডোন্ট হ্যাভ এনি আদার মোড অফ এন্টারটেনমেন্ট। আর এদের কাছে একটা এক্সট্রা বাচ্চা মানে এক্সট্রা হ্যান্ডস ফর আর্নিং,” বলল খোঁচা।
“ফ্যানটাসটিক। এদের এন্টারটেনমেন্ট চলতে থাকুক, তুইও কাজফাজের ব্যাবস্থা করে দে, অ্যান্ড দে উইল নেভার লার্ন দ্যাট লাইফ ইজ নট আ বেড অফ রোজেস,” স্বর্ণালী বলল।
"সেটা ওরা এমনিতেই জানে। তুই ওদের কাছ থেকে দেখিসনি সোনা, আমি দেখেছি। যে টাকায় ওদের সারা মাস চলে সে টাকায় আমরা… যাকগে, আজকের দিনে এসব কথা থাক," বলল তৃষা।
"দু দিন পরে আমাদেরও চাকরি খুঁজতে হবে। তখন রিসোর্সফুল লোকের দরকার হতেই পারে," বলল অভিষেক।
আমায় অবশ্য চাকরি খুঁজতে হবে না। পারিবারিক শাড়ির দোকান আছে মানিকতলায়, সেটা মন্দ চলে না।
"ওই মেয়েটা পালানোর আগে দেখে নেয়নি কেন হাও দ্যাট ম্যান ইজ। এখন কেঁদে লাভ কি? বাবা অলওয়েজ সেজ - লুক বিফোর ইউ লিপ," বলল স্বর্ণালী।
আমার মনে পড়ল স্বর্ণালীকে প্রপোজ করেছিল ওদের কলেজের একটা ছেলে। ও কাটিয়ে দিয়েছিল।
“ভুল সবাই করে স্বর্ণালী, আমরাও করি… আয়, এবার খাওয়া যাক,” বলল খোঁচা।
পকোড়া আর গরম কফি দিয়ে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি পকোড়া তুলে মুখে দিলাম, দিয়েই কুকুরের মত হাঁ করে হা-হা করতে লাগলাম, বড্ড গরম। খোঁচা আর অভিষেক হাসতে লাগল।
তৃষা স্বর্ণালীকে বলল, "কি রে, কফি খা।"
স্বর্ণালী কফি তুলল না। চুপ করে বসে থাকল, আমরাও। কিছুক্ষন একটা অস্বস্তিকর নীরবতা, শুধু পকোড়া আর কফি খাওয়ার শব্দ।
"একটা সত্যি কথা বলবি?" স্বর্ণালী বলল, "এক্স্যাক্টলি হোয়াট আর উই ডুইং হিয়ার?"
"বলছি, তুই খা," বলল তৃষা।
"না, আগে বল," স্বর্ণালী গম্ভীর।
"একটা ফোনের অপেক্ষা করছি," বলল খোঁচা।
"ফোন? কার ফোন?" স্বর্ণালী ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই একটা মোবাইল বেজে উঠল। স্বর্ণালীর নিজের ফোনই বেজেছে।
"হেলো... থ্যাংকস রে... নাহ, জাস্ট ইটিং আউট... উইল টেল ইউ লেটার, বাই।" ফোন বন্ধ করল স্বর্ণালী। "নাও টেল মি, হোয়াটস দ্য ম্যাটার? কে ফোন----”
এবার তৃষার ফোন বেজে উঠল। শুধু "আসছি" বলে ফোন রেখে দিল সে। খোঁচা, অভিষেক আর ওর মধ্যে চোখে চোখে কিছু কথা হল। স্বর্ণালী অদ্ভুত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। খাবারের দাম মিটিয়ে দিল অভিষেক।
তৃষা দাঁড়ালো স্বর্ণালীর পাশে। "চল সোনা।"
"কোথায়?"
"চল না। ভাল করে খাব না বুঝি আমরা?"
উঠে পড়ল স্বর্ণালী। "দ্যাট ওয়জ মাই প্ল্যান। নো আইডিয়া অ্যাবাউট ইয়োর প্ল্যান।"
গাড়িতে কয়েক মিনিট গিয়ে সেদিনের পার্কটার কাছে থামলাম আমরা। বাইরে এসে সবাই এগোলাম রাস্তা ধরে।
"নো রেস্টুরেন্ট হিয়ার। কী চাস তোরা?" বলল স্বর্ণালী।
"চল না, সামনেই," খোঁচা বলল।
সাদা বাড়িটার সামনে এলাম আমরা, গ্যারাজের লাল রঙের গেটটা সেদিনের মতই সামান্য ফাঁক করা। খোঁচা এগিয়ে গেল গেটের দিকে, আমার মনে পড়ল সেদিন খুব লেগেছিল খোঁচার, মাথায় দু-দুটো আলু গজিয়ে গেছিল।
স্বর্ণালী বলল, "হোয়াট আর ইউ গাইস আপ টু? হুইচ প্লেস ইস দিস?"
তৃষা বলল, "আয় না।" (ক্রমশঃ)