মরশুমি পরিযায়ী পাখির মতো ওরা হল পরিযায়ী মৌমাছি। সুন্দরবনের অসংখ্য নদী-নালা-খাঁড়ির দুই পারে ম্যানগ্রোভের অরণ্যে বসন্তের আগমনে খলসি গাছেই আসে প্রথম ফুল। সাদা ও হলুদে মেশা হাল্কা রঙের ছোট ছোট ফুল। উতল বাতাসে ম ম করা তার সুমিষ্ট সৌরভে সুদূর হিমালয় থেকে প্রতি বছর ধেয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি। খলসি ফুল থেকে সংগ্রহ করে ঋতুর প্রথম মধু। খলসির মধু সুন্দরবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না এমন অমৃত সুধা। অমিত ওষধি গুণ সম্পন্ন এই ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ-রস বেদনা-নাশক এবং মধুমেহ বা ডায়াবিটিস প্রতিরোধকারী। তাই খলসির মধুও বিশেষ উপকারী। প্রতি বছর বন বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিয়ে মউলিরা সুন্দরবনের বিভিন্ন জঙ্গলে যায় মধু সংগ্রহে। তাদের নিয়ে আসা মধু পরিশোধন ও বোতলবন্দী করে নিজস্ব ব্র্যান্ড নেমে বিপণন করে রাজ্যের বন উন্নয়ন দপ্তর। দার্জিলিঙের চা, নদীয়া, হুগলি বা উত্তর চব্বিশ পরগণার হিমসাগর, উত্তর দিনাজপুর জেলার তুলাইপাঞ্জি বা বর্ধমান ও নদিয়ার গোবিন্দভোগ কিংবা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কনকচূড় ধানের মতোই খলসির মধুও একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার অভিনব উৎপাদন। সেই অঞ্চলের ভূ-জল, পরিবেশ, আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য চা, ধান, আম বা মধুর স্বাদ-গন্ধ ও খাদ্যগুণে অভিনবত্ব এনেছে। এই খলসি মধুর মেধাস্বত্ত্ব সুরক্ষিত করার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হচ্ছে বলে দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিকাল সায়েন্সেস (ডব্লিউ বি এন ইউ জে এস) সূত্রে জানা গেল।
বিশেষ পণ্যটির নাম বা জনপ্রিয়তা ভাঙিয়ে যাতে একই নাম ব্যবহার করে অন্য কোন খেলো জিনিস বাজারে বিক্রি না করা যায় সেজন্যে আসল জিনিসটির অনন্যতা বা মেধা সম্পদের অধিকার (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস সংক্ষেপে আই পি আর) সুরক্ষিত করা জরুরি। সেটি করা গেলে ওই পণ্যকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন (জি আই) লেবেল বা ভৌগোলিক নির্দেশিকার তকমা দেওয়া হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেধা সম্পদ সুরক্ষিত রাখার জন্যে ১৯৬৭ সালে গঠিত হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণাধীন স্ব-শাসিত সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউ আই পি ও)। আন্তর্জাতিক রীতি মেনে ভারত তার সদস্য হয়েছে ১৯৭৫ সালে। এই মুহূর্তে সংগঠনে রয়েছে ১৯৩ টি সদস্য দেশ। এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে অবাধ বাণিজ্যের জমানায় সুরক্ষিত মেধা সম্পদ এবং জি আই ট্যাগের গুরুত্ব বহু গুণ বেড়ে গেছে। নকল পণ্য রুখতে এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রীতিনীতিও অনেক কঠোর। অন্যদিকে ক্রেতা সচেতনতার প্রসার ঘটায় যে কোন শংসিত দ্রব্যের চাহিদা বেড়েছে। সচেতন ক্রেতা ন্যায্য মূল্যে খাঁটি জিনিস যাচাই করে কিনতে চান। 'সস্তার তিন অবস্থা' আপ্ত বাক্য স্মরণ করে কম দামে দিলেও নকল বা ভেজাল জিনিস প্রত্যাখ্যান করার প্রবণতা সমঝদার ক্রেতার মধ্যে বেড়েছে। জি আই লেবেল যুক্ত পণ্য সহজেই বিশ্বাস করে নেওয়া যায় কারণ তাতে সেই পণ্যের প্রকৃত উৎপাদন স্থল, তৈরির পদ্ধতি ইত্যাদির নির্দিষ্ট বিবরণ থাকে। কাজেই জি আই ট্যাগের কৌলিন্য থাকলে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করা যায় আর ওই গ্যারান্টির জোরে বাড়তি দামও মেলে। স্থানীয় উৎপাদকের রোজগার বাড়ায় ব্যবসার বহর যেমন বাড়ে তেমনই অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তবে নিজস্ব পণ্যের মেধাস্বত্ত্ব সুরক্ষিত করতে হলে প্রাথমিক ভাবে এগিয়ে আসতে হবে সংশ্লিষ্ট উৎপাদকদের। পণ্যের স্বকীয়তা প্রমাণের খুঁটিনাটি নথিভুক্ত করা, তার গুণমানের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তার প্রস্তুতি ও প্যাকেজিংয়ের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ত্বের অধিকার সুরক্ষিত রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছরই ২৬ এপ্রিল দিনটি পালন করা হয় বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস হিসেবে। সমাজ ও সভ্যতার যে কোন ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশে উৎসাহ জোগানোর পিছনে সুরক্ষিত মেধা সম্পদের ভূমিকা অসীম। মেধাস্বত্ত্বের সেই ভূমিকার কথা ফলাও করে প্রচার করাই বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবস পালনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আর সেই সঙ্গে সমাজ ও অর্থনীতিতে আবিষ্কর্তা, স্রষ্টা ও উদ্ভাবকের অবদানকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের সূচনা হয়েছিল ২০০০ সালে। তারপর থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তে দিনটি পালিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও আলোচনাচক্রের মাধ্যমে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সকলের খেয়াল করা উচিত হুগলির জনাইয়ের মনোহরা বা নিখুঁতি, আঁইয়া গ্রামের রাবড়ি, বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের মেচা সন্দেশ, মেদিনীপুরের ক্ষীরপাইয়ের বাবরশা, হুগলির বেগমপুরের হস্তচালিত তাঁতের শাড়ি, মেদিনীপুরের পিংলার পটচিত্র, বর্ধমানের নতুনগ্রামের প্যাঁচা সহ অন্যান্য কাঠের শিল্প, শান্তিনিকেতনের সরার ওপরে আল্পনা, চর্মশিল্প -- এই সবের সঙ্গেই জড়িত রয়েছে বাংলার একান্ত নিজস্ব ঐতিহ্য। সে খাবারই হোক বা শাড়ি কিংবা অন্য কোন শিল্প, প্রতিটি জিনিস সৃজনের পিছনে রয়েছে উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ এবং নিজস্ব মেধাস্বত্ত্ব। দার্জিলিং চা, জয়নগরের মোয়া, বাংলার রসগোল্লা, বর্ধমানের সীতাভোগ-মিহিদানা এবং গোবিন্দভোগ ও তুলাইপাঞ্জি চাল এখন পর্যন্ত জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন ট্যাগ অর্জন করলেও মেচা বা মনোহরার মতো মিষ্টি কিংবা কাঠের পুতুল, পটচিত্র বা তাঁতের শাড়ির বরাতে তেমন কৌলিন্যের তকমা জোটেনি। এই ব্যাপারে স্থানীয় শিল্পী, কারিগর ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে, নিজেদের দাবি দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরতে এবং জি আই ট্যাগ পাওয়ার শর্ত পালনের বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে সকলকে ওয়াকিবহাল করে তুলতে সল্টলেকে ন্যাশনাল ইউনভার্সিটি অব জুরিডিকাল সায়েন্সেসে ২৯ - ৩০ এপ্রিল দুদিনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই উদ্যোগ। সেখানে সংশ্লিষ্ট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা নিজেদের পণ্য এনে হাজির করেছিলেন। ছিল প্রায় ২০টি স্টল। বিশেষজ্ঞদের সামনে বিভিন্ন দ্রব্যের মান যাচাই যেমন চলল তেমনই ছিল ন্যায্য মূল্যে বিপণনের ব্যবস্থা। সস্তার নকল বা জাল জিনিসের ফাঁদে খাঁটি জিনিসটি যেন হারিয়ে না যায় সেই সচেতনতা বাড়াতে অনুষ্ঠানের প্রথম দিনেই মঞ্চস্থ হয়েছে একটি নাটকও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, গবেষক ও ইন্টার্নরা বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেন। মেধাস্বত্ত্বের মাধ্যমে নারীর ভূমিকা অন্তর্ভুক্তি ছিল বিশ্ব মেধাস্বত্ত্ব দিবসের চলতি বছরের ভাবনা। বেদনার বিষয় হল, পুরুষ-শাসিত সমাজে সৃজনশীল কাজে মহিলাদের যথেষ্ট অবদান থাকলেও তার প্রতিফলন ঘটে সামান্য ক্ষেত্রে। বিশ্ব মেধাস্বত্ত্ব সংস্থার হিসেবে অনুযায়ী দুনিয়ায় মাত্র ১৪ শতাংশ মহিলার অবদান স্বীকৃত। জুরিডিকাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ নির্মল কান্তি চক্রবর্তী বলেছেন, "অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাজকর্মে মহিলাদের ভূমিকাকে উৎসাহ জোগানো অত্যন্ত জরুরি।" সৃজনশীল কাজে -- তা আল্পনা দেওয়াই হোক বা কাঠের পুতুল রঙ করা অথবা বাটিক শাড়ি-জামা ছাপানো,গালার গয়না তৈরি বা পিঠে বানানো -- মহিলাদের সক্ষমতাকে সকলের চোখের সামনে তুলে ধরার প্রতি এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কাজেই সেই নাটকেও শিল্পের মান রক্ষায় এক গ্রামীণ নারীর সংগ্রামকেই অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আসল পটচিত্রের বিক্রেতা হিসেবে রোকেয়া বিবির ভূমিকায় নিজস্ব অধিকার রক্ষার চেষ্টায় মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের কন্যা আইনের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার্ন Pritikana Jana র সাবলীল অভিনয় সকলের বিশেষ প্রশংসা আদায় করে। নকল শিল্পদ্রব্যের খোঁজ পেলে যে আইনগত পরামর্শ নেওয়া জরুরি সেই বার্তাও তুলে ধরা হয় নাটকে। ছিল মঞ্চের ওপরেই বাদী ও বিবাদী পক্ষের উকিলের সওয়ালের আসল তরজা। দর্শকাসনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরাও। শিল্পী ও ব্যবসায়ীদের যুক্ত করে মেধাস্বত্ত্ব নিয়ে এমন সম্মেলন সারা দেশে প্রথম অনুষ্ঠিত হল কলকাতাতেই।
জুরিডিকাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের আই পি আর চেয়ার প্রফেসর এবং জাতীয় পর্যায়ে জি আই উদ্যোগের চেয়ারপার্সন ডঃ পিনাকী ঘোষ জানান, স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যাতে তার উপযুক্ত মর্যাদা পায় সেজন্যে প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রকৌশলী সহায়তা দেওয়ার জন্যে সংশ্লিষ্ট শিল্পী, কারিগর ও ব্যবসায়ীদের পাশে তাঁরা রয়েছেন। তিনি বলেন, খলসি মধুর মতো বিভিন্ন মিষ্টান্ন দ্রব্য এবং আরও কিছু শিল্পের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য যাতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির শিরোপা পায় সেজন্যে তাঁরা ইতিমধ্যেই সেগুলির নাম পেশ করেছেন। খুঁটিনাটি যাচাইয়ের পর দাবি অনুমোদিত হলে সেগুলি জি আই ট্যাগ পেতে পারে। ওই তালিকায় রয়েছে খলসি মধু, পুরুলিয়ার গালা শিল্প, কলকাতার গহনা, শান্তিনিকেতনের আল্পনা, বাটিক, বাউলগান ও একতারা। আছে বেগমপুরি তাঁত, মুর্শিদাবাদের রেশম, গড়গড়া পিঠে, বেলিয়াতোড়ের মেচা ও জনাইয়ের মনোহরা, নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল, শঙ্খ শিল্প, এমনকি আশাপুর ও নবাবগঞ্জের বেগুন। মালদহের আশাপুর ও নবাবগঞ্জ বিশেষ ধরণের বেগুনের ফলনের জন্যে বিখ্যাত। হালকা সাদা ও সবুজ রংয়ের এই বেগুন একসময় চাঁচোলের আশাপুরে চাষ হতো। পরে গাজোল, হরিশ্চন্দ্রপুর, রতুয়া, মানিকচক সহ বিভিন্ন ব্লকে চাষ শুরু হয়েছে। এইসব ব্লকে এই বিশেষ প্রজাতির বেগুন চাষের জন্য উর্বর মাটি রয়েছে। তাই আশাপুরের বেগুন চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা। এখন চাষিরা রীতিমতো জৈব পদ্ধতিতে বেগুন চাষ করছেন। রোগ পোকার সমস্যা এড়াতে রাজ্যের কৃষি বিভাগ থেকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাই চাষিরা এখন অনেক সচেতন। আবার নবাবগঞ্জের মাখন মোলায়েম বেগুন দেখতে একেবারে লাউয়ের মতোই বড়। একেকটি ওজনে দেড় থেকে দুই কিলো কিংবা তারও বেশি। চলতি ভাষায় এই বেগুন নবাবগঞ্জের বেগুন নামেই পরিচিত। তবে শীতের মরসুমে এই বেগুনের চাহিদা জেলা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিদেশেও। আশাপুর বা নবাবগঞ্জের বেগুন মালদহের ঐতিহ্য। তবে সেই বেগুন চাষের গুহ্য কথা চাষিরা ফাঁস করতে চান না। তাঁদের আশঙ্কা, জানাজানি হলে নিম্নমানের বীজ ব্যবহার করে সেই বেগুন ফলানোর চেষ্টা অন্যত্রও শুরু হবে। চলতি মরসুমে রতুয়া ২ ব্লকের রাজাপুর গ্রামের মাত্র চারজন চাষি এই বেগুন চাষ করেছেন। তাঁদেরই একজন ফটিক শেখ। তিনি জানান, ”বর্তমানে এই বেগুন আমাদের এখানেই হয়ে থাকে। এই চাষ সকলে করতে পারবেন না। তবে দীর্ঘদিনের ব্যবহারের পর এই বেগুনের বীজ শোধন করে উন্নতমানের করা প্রয়োজন। এখন প্রতিটি বেগুন দেড় থেকে দুই কিলো ওজনের হয়। আগে একেকটি বেগুনের ওজন অন্তত তিন কিলো হত। কিন্তু ওজন এত হলেও বেগুনে বিচি থাকত না। এখনও দু’কিলো ওজনের বেগুনে কোনও বিচি থাকে না।" গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই বেগুন জি আই ট্যাগ পেলে স্থানীয় চাষিরা নির্ভয়ে বেগুন চাষের প্রসার ঘটাতে পারবেন এবং বিশেষ ধরণের বীজের ওপরে তাঁদের নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। লাভজনক দামে সেই বীজ এবং বিশেষ ধরণের বেগুন তখন তাঁরা বিক্রি করতে পারবেন।
স্থানীয় কৃষিজ পণ্য বা ঐতিহ্য-সম্পন্ন খাদ্য বা শিল্পদ্রব্যের স্বীকৃতির জন্যে আন্তর্জাতিক সিলমোহর আদায়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, জি আই ট্যাগ সম্পর্কে জনচেতনার অভাব, বলছিলেন ডঃ ঘোষ। একই সঙ্গে রয়েছে আরও অনেক সমস্যা। যেমন জনাইয়ের মনোহরা বা মেচা সন্দেশ সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণের অভাব। দক্ষিণ এশিয়া ও নিম্নবর্গের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ গৌতম ভদ্র জানিয়েছিলেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয় পর্বে মিষ্টির বৈচিত্র্য বেড়েছিল। নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে সব জেলার রকমারি মিষ্টি খাইয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তরুণ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর গবেষণার জন্যে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। ওই সময়েই জনাই থেকে কলকাতায় এসে দোকান খুলেছিলেন ভীমনাগ। তখন মনোহরার খুব নামডাক। বোঝা যায়, সেই সময় প্রতি জেলাই একেকটি মিষ্টির জন্যে বিখ্যাত ছিল। কৃষ্ণনগরের সরভাজা ও সরপুরিয়া, বর্ধমানের সীতাভোগ ও মিহিদানার মতো খাগড়াই মুড়কি ও নৈহাটির গুঁফো সন্দেশ। উনিশ শতকের গোড়ায় মুড়কির মোয়াই সার্বজনীন মিষ্টির কাজ করত, মাহেশের মুকুন্দ খোয়ার নাম সারা বাংলায় চালু ছিল। ধনেখালির খইচুর কিছুদিন মুকুন্দকে টেক্কা দিয়েছিল। তখন মিষ্টি তৈরি হত প্রধানত গুড় দিয়ে। চিনির ব্যবহার বাড়লে জনাইতে শুরু হল রসকরা, নারকেলের পাকের সঙ্গে চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের মিশেলে ক্ষীরগুলি। তবে মিষ্টির আলোচনায় অবশ্যই স্মরণ করতে হয় দুই খন্ডে 'মিষ্টান্ন পাক' রচয়িতা বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়কে। তিনি লিখেছিলেন, "ইহা জানা আবশ্যক যে একই পাকের সন্দেশ, ভিন্ন ভিন্ন ছাঁচে ফেলিয়া, ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রস্তুত করা হইয়া থাকে।" মিষ্টির উৎকর্ষ রচনার ক্ষেত্রে মোক্ষম পর্যবেক্ষণ ছিল বিপ্রদাসের। তিনি জানিয়েছিলেন, "ছানা ও চিনির মিশেলে সন্দেশের পাক তৈরি করা ও জ্বালের সঙ্গে সঙ্গে তাড়ু (কাঠের বড় খুন্তি) চালানো ঠিক শিল্পীর কাজ। ওই কর্মটি না জানলে সব মাটি।" জি আই তকমার জন্যে দাবি পেশ করার সময় মিষ্টি তৈরির পদ্ধতি এমন নিপুণ ভাবে নথিভুক্ত করা দরকার যাতে সেই মিষ্টি কেন সেরার সেরা এবং কোথায় তার বৈশিষ্ট্য তার নিখুঁত বিবরণ থাকে। বিশেষ কারিগরি দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োজন খাঁটি কাঁচামাল ও সঠিক পরিমিতি বোধ। সমস্যা আরও অনেক। যেমন কোন পণ্যের গুণমান নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের অভাব। বহু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংগঠিত শিল্পের জন্যে সব বাধা পেরিয়ে বলিষ্ঠ ভাবে দাবি পেশ করা কঠিন। আবার নানা উপাদান এবং দ্রব্য আসল না নকল যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে যথেষ্ট সংখ্যক ল্যাবরেটরিও নেই। মেধাস্বত্ত্ব ও জি আই সম্পর্কে সচেতনতার প্রসার ঘটাতে হবে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত। কোন জেলার কোন গ্রামের কোন কোন জিনিস সেরা সেগুলি তো জানবেন সবচেয়ে ভালো সেখানকার জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনই। ডঃ ঘোষ যথার্থই বলেছেন, এই উদ্যোগে শামিল করতে হবে পঞ্চায়েত, সেলফ হেল্প গ্ৰুপ এবং ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসারদের। শিল্পী ও কারিগরদের নিয়ে নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করতে হবে এবং সেখানে গ্রামীণ মহিলা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগ (এম এস এম ই) এবং ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্টের (নাবার্ড) প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করতে হবে।
ডঃ ঘোষ জানান, যে সব ঐতিহ্য-সম্পন্ন দ্রব্যের প্রকৃত উৎস ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না সেগুলির জন্যে জি আই তকমা আদায় করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সেগুলিকে ইউনেসকোর কালচারাল হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালানো যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বছর দুয়েক আগে সেনেগালের একটি বিখ্যাত রান্না 'চেব জেন' (ceebu jën) ইউনেসকোর ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ তালিকায় স্থান পেয়েছে। মাছ, চালের ক্ষুদ, পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা, তেজপাতা, বাঁধাকপি, ঢেঁড়শ ও বেগুন সহযোগে তৈরি পদটি আদতে সেন্ট লুইস দ্বীপের মৎস্যজীবীদের মধ্যে প্রথমে প্রচলিত হলেও ক্রমে এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম আফ্রিকার দেশটির দেড় কোটিরও বেশি মানুষের মধ্যে। ঘরে-ঘরে, রেস্তোঁরায় বা রাস্তার খাবার হিসেবে এখন এটি সেনেগালের খাদ্য-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একই ভাবে হেইতির জুমু স্যুপও (joumou soup) এই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এই পদটি স্বাধীনতার সমার্থক। ঔপনিবেশিক ফরাসি শাসনের সময় এই স্যুপ তৈরির জন্যে সাদা চামড়ার নিপীড়কেরা আফ্রিকান ক্রীতদাসদের দিয়ে স্কোয়াশ চাষ করাত। আফ্রিকানদের কখনই এই স্যুপ খাওয়ার অধিকার ছিল না। এই স্যুপে প্রয়োজন হয় স্কোয়াশ, পেঁয়াজ বাটা দিয়ে মেখে রাখা বিফ, গোলমরিচ, হার্বস, পছন্দ মতো অন্যান্য সব্জি আর পাস্তা। ১৮০৪ সালের ১ জানুয়ারি হেইতি স্বাধীন হওয়ার পর আফ্রিকানরা বছরের প্রথম রবিবারের জলখাবারে এই স্যুপ দিয়েই সেলিব্রেট করে।
প্রশ্ন হল, সেনেগাল বা হেইতির মতো দেশও যখন তাদের বিশেষ রান্না ইউনেসকোর তালিকায় তুলে দিতে পেরেছে তখন বাঙালি ব্যঞ্জনের এত সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং বিপুল বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও সেগুলির কোনটিকেই কেন এখনও সেই তালিকায় ঢোকানো যায় নি? মাস্টারশেফ ২০২১ প্রতিযোগিতায় সেরার শিরোপা পেলেও নিদেন পক্ষে পান্তাভাতকেও তো ইউনেসকোর নেকনজরে আনা গেল না! আসলে এখানেই ভারতীয় বা বাঙালিদের দুর্বলতা। ইতিহাসচেতনায় খামতি বা ঐতিহ্য সংরক্ষণে আলস্য ও অনীহা। একুশ শতকের ডিজিটাল জমানায় যে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে যোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে সে ব্যাপারে এখনও আমাদের হুঁশ নেই। আমাদের নলেন গুড়, চিতল মাছের মুইঠ্যা, পাটিসাপটা, রসবড়া, গ্যারানি -- এই সব জিনিস কি পরম যত্নে সুরক্ষিত রাখা উচিত নয়? নানারকম হারিয়ে যাওয়া রন্ধনশৈলী কি অধরা ঐতিহ্য (ইনট্যাঞ্জিবল হেরিটেজ) নয়?
--