হ্যারল্ড ক্রিক এক সকালে জানতে পেরেছিল, যে, তার জীবনটা তার নিজের নয়—এক লেখিকার গল্পের সে মুখ্য চরিত্র। মহিলার আবার বদনাম আছে—নিজের সব মুখ্য চরিত্রকেই তিনি গল্পের শেষে টুক করে মেরে ফেলেন। সক্কাল সক্কাল নিজের জীবনের ধারাবিবরণী শুনতে শুরু করা হ্যারল্ডের সঙ্গে অবশেষে একদিন দেখা হয় তার জীবনের লেখিকার...
হ্যারল্ডের মত নেপথ্য-কথকের কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাইনে ঠিকই, কিন্তু কোনো কোনো ধূসর মুহূর্তে সকলেই নিশ্চয়ই ভেবে আকুল হয়েছি: নিজেদের জীবনের—যার ওপর মালিকানা ঘোষণা করতে আমাদের একটুও সমস্যা হয় না—তার কতটুকু আমার নিজের লেখা?
ইচ্ছে থাকে। লেখা হয় না। কারণ, কাগজ-কলমে কল্প-চরিত্রের গল্প লিখতে যত সময়, যত পরিশ্রম—নিজের জীবন লিখতে তার অযুত গুণ। ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহে নয়—মাস, বছর, দশকে লিখতে হয় সেই ওপাস। যত জীবন লিখি, জীবনও তত আমাদের লেখে। অরুন্ধতী রায়ের গল্পে ভেলুথা-র বর্ণনা ছিল এইরকম—
"... As she watched him she understood the quality of his beauty. How his labour had shaped him. How the wood he fashioned had fashioned him. Each plank he planed, each nail he drove, each thing he made, had moulded him. Had left its stamp on him...."
কেউ কেউ লেখে। নিজের গল্প, নিজেই। কেউ থ্রিলার, কেউ হরর, কেউ কেউ শুধুই চুটকির কালেকশন। হাতে গোনা কিছু মানুষকে শুধু দেখা যায়—জীবনটাকে কাব্যের চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করতে আর সেই চেষ্টায় ক্রমশ ক্ষয় পেতে। একসময় মিলিয়ে যায় তারা।
উপন্যাস লেখে না কেউ। খুব খাটুনি। ড্রামায় ছিন্নভিন্ন হও রে, আবেগে থরথর কাঁপো রে, শেষমেশ যদি বা সব পেরিয়ে একটু শান্তি পেলে, জীবনান্তের চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি তোমার জন্যে ওঁত পেতে বসে আছে। দর্শনের বই? সেই এক ডায়োজিনিসের পর আর তেমন লিখলো কোন খ্যাতনামা? আছেন নিশ্চয়ই অনেক। জানা যায় না। জীবনকে দর্শন বানালে, খ্যাতি আসবে কোথা থেকে?
যারা থ্রিলার লেখে? কাহিনী-অন্ত দুঃখের হলে? কেউ খবর রাখে না। পাড়ায়/সমাজে উদাহরণ হয়ে থাকে ক্ষণকাল, তারপর সেই দুঃখ ভুলতে লাগে বাকি জীবন।
আনন্দের গল্প হলে, তার শেষ হয় কোনো এক পোডিয়ামে, মালা গলায়—স্তবক হাতে।
তারপর চলে সে-এ-ই এক পদক ভাঙিয়ে খাওয়া, চর্বিত চর্বন। নইলে সিক্যুয়েল — রকি ২, ৩, ৪...
কী লেখেন লেখক? কবি?
পল সালোপেক তাঁর মিলনান্তক থ্রিলারের শেষটা দেখে ফেলেছিলেন সেই ১৯৯৮-এ। ১৯৮৫-তে, নিউ মেক্সিকোয়, নিজের খারাপ হওয়া মোটরসাইকেল সারানোর টাকা তুলতে সেই যে শুরু করেছিলেন শখের সাংবাদিকতা, তারপর আফ্রিকার পাহাড়ি গোরিলা থেকে শুরু করে অভিবাসন, শহুরে জীবন, জীববিজ্ঞান — কী নিয়ে লেখেননি ভদ্রলোক? অবশেষে, শিকাগো ট্রিবিউনে কাজ করতে করতে, ১৯৯৬–৯৭-এ লেখা, হিউম্যান জিনোম ডাইভার্সিটি প্রোজেক্ট নিয়ে কিছু নিবন্ধ-সংকলনের জন্যে ১৯৯৮-এ পেলেন পুলিৎজার পুরস্কার।
গল্পের বই হলে, এখানেই শেষ হত। আমার-আপনার জীবন হলে, ফ্রেমে বাঁধানো ওই দিন আর তার আগের গল্প শুনত নাতি-নাতনিরা।
জীবন লেখার অসুবিধে—জীবন চলতেই থাকে। খিদের মত। ক্ষণিক মেটে, আবার পায়। ভদ্রলোক সিক্যুয়েলের দিকে গেলেন এবার। ২০০১-এ আবার পুলিৎজার। আগেরবার ছিল "Explanatory Reporting" বিভাগে, এবার পেলেন 'International Affairs'-এ। কঙ্গো-র সশস্ত্র জঙ্গি-অধ্যুষিত জঙ্গলে ঘুরে, কখনো নদীতে canoe চালিয়ে, ঘোড়ার মুখের খবর দিলেন—এ মহাদেশে ছোঁয়াচে রোগ কীভাবে মহামারী হয়, তার সামাজিক-রাজনৈতিক আখ্যান।
সহজ? ঝুঁকি নেই? এক পাতা লিখে, না পোষালে ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলবেন—জীবন লেখা বুঝি অতই সোজা? এই মহা সমারোহের পিছনে লুকিয়ে থাকে প্রতিদিন ঝুঁকি নেওয়ার মরণকামড়। এত কিছুর পরও, এই লোক ২০০৬ সালে, সুদানে, গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে জেল খেটেছেন একমাস।
পাতা না-ই উলটোতে পারতো। ওখানেই শেষ হত বই।
আমাদের কপাল ভালো, হয়নি। সেইটেই আজ বলার জন্যে এত কথা বললাম।
পল সালোপেক শুধু থামেননি, শুধুই উত্তেজনাপূর্ণ এক জীবন বেঁচেছেন— তা নয়। নিজের জীবন এরপর উনি নিজেই লিখছেন।
সে এক অদ্ভুত আখ্যান।
সকলেই নিশ্চয়ই জানেন—জীববিজ্ঞানের যে শাখাটি বিবর্তনের আলোয়, মানব-ইতিহাস—বিশেষ করে গোটা পৃথিবী জুড়ে তার ছড়িয়ে পড়া নিয়ে চর্চা করে, তার আধুনিকতম মত হল, এক বিশেষ রাস্তায় হেঁটেছিল আমাদের পূর্বজ সেপিয়েন্সরা (এখানে সে নিয়ে আর গপ্পো ফাঁদছি না; বিশেষ না জানা থাকলে, আপনি ভাগ্যবান! 'early human migration' বলে সার্চিয়ে দেখবেন—চোয়াল মাটিতে ঝুলে যাবে)।
তা, এই গতি, তস্য গতির যুগে ভদ্রলোক ঠিক করেছেন, সেই আদি(এবং মহা)-পরিযানের প্রধান ও দীর্ঘতম রাস্তা-বরাবর তিনি হাঁটবেন। মোটের ওপর ২৪ হাজার কিলোমিটার।
ঠিক পড়েছেন। 'হাঁটবেন'। সেই আদিম রাস্তার কিছু অংশ এখন জলের তলায়, তাই সেটুকু বাদ দিলে, হাঁটবেন। হাঁটবেন আর লিখবেন। কী লিখবেন? যা দেখবেন, তা-ই।
কী যেন লেখেন লেখক, কবি?
শুধু কি ছাপা অক্ষরে? ছবি, ভিডিও, গল্প নিয়ে এ এক মহাকাব্যের শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে। এক দশক সময়ের আন্দাজ ছিল। মাঝে অতিমারী এসেছে, গেছে। পল আছেন। হাঁটছেন। কেমন লিখছেন? ও নিয়ে আমার বলা সাজে না। এই নিন, পড়ুন, সে গল্পের শুরুর কয়েক লাইন—
"Walking is falling forward.
Each step we take is an arrested plunge, a collapse averted, a disaster braked. In this way, to walk becomes an act of faith. We perform it daily: a two-beat miracle—an iambic teetering, a holding on and letting go. For the next seven years I will plummet across the world."
— To Walk the World, Paul Salopek [১]
প্রতি মুহূর্তের পতন সচেতনভাবে রোধ করার নামই চলা? স্থাবরের নয়, পতনের বিপরীত তবে জঙ্গম?
কারা যেন অনেকদিন আগে, নভেলের শুরুর কয়েক লাইন নিয়ে একখান গবেষণা-গোছের করেছিল। তার ফলাফল নিখুঁত মনে না থাকলেও, এটুকু মনে আছে—মহৎ সাহিত্যের জাত—সকালেই যায় চেনা। এ সাহিত্য নয়, জীবন। তবু, পড়েই যেতে ইচ্ছে করে।
অনেক কিছু জানা যাবে এই লেখা থেকে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের আশা, এই রাস্তা বরাবর বিশ্ব-উষ্ণায়ন, প্রযুক্তির বিবর্তন, গণ-পরিযান, আঞ্চলিক সংস্কৃতির বয়ান — সব হবে পলের লেখায়, শব্দে, ছবিতে। এই পথের বসবাসকারী মানুষের মুখে ভাষা দেবেন তিনি। [২]
খুবই ভালো কথা, সন্দেহ নেই, কিন্তু অন্তত আমার কাছে, এই পদব্রজে কাটানো বাকি জীবনের গল্পটুকুই সব। জীবন লেখার জোর জোগাড় করছি আপাতত পলের উদাহরণ থেকে। শব্দে না হলে ছবিতে, নইলে অন্য কোনোভাবে। হাঁটতে না পারি, জীবন লিখে যেতে আপত্তি কোথায়?
কী যেন বলেছেন কবি?
"লেখো আয়ু, লেখো আয়ু..."