এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম – পঞ্চম পর্ব  -  দ্বিতীয় ভাগ 

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১৪৮৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • ৫.২.১ বেদান্ত দর্শন ও ব্রহ্ম
    উপনিষদ তথা বেদান্তে পরমপুরুষ ব্রহ্মের স্বরূপ কি, তার আভাস মেলে ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ত্রয়োদশ খণ্ডের দুটি শ্লোকে। ব্রহ্ম বিষয়ে এই আলোচনা করছেন ঋষি আরুণি ও তাঁর পুত্র শ্বেতকেতু[1]।  
    (পিতা) – “এই লবণ জলে ফেলে প্রাতঃকালে আমার কাছে এস”। শ্বেতকেতু তাই করলেন।
    পিতা তাঁকে বললেন, “বৎস, (গত) রাত্রে যে লবণ জলে ফেলেছিলে, সেটি নিয়ে এস”। তিনি (শ্বেতকেতু) লবণের অনুসন্ধান করেও পেলেন না, যদিও সেটি জলেই বিলীন হয়ে বিদ্যমান ছিল।
    (পিতা) – “বৎস, এই জলের উপরিভাগ থেকে আচমন কর; কেমন বোধ হচ্ছে?”। “লবণাক্ত”।
    “মধ্যভাগ থেকে আচমন কর; কেমন বোধ হচ্ছে?” “লবণাক্ত”।
    “অধোভাগ থেকে আচমন কর; কেমন বোধ হচ্ছে?” “লবণাক্ত”।
    “এই জল ফেলে দিয়ে আমার কাছে এসে বস”। শ্বেতকেতু তখন তাই করলেন, (এবং) “ওই লবণ সর্বদাই বিদ্যমান ছিল”, (এই কথা বলতে বলতে ফিরে এলেন)।
    পিতা তাঁকে বললেন, “এই জলের মধ্যে বিদ্যমান থাকলেও যেমন তুমি লবণকে দেখেতে পেলে না, তেমনি হে সৌম্য, এই দেহমধ্যেই সৎ (ব্রহ্ম) বিদ্যমান আছেন”। (ছান্দোগ্য/৬/১৩/১,২) [স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত উপনিষদ্‌ গ্রন্থাবলী – দ্বিতীয় খণ্ড (ছান্দোগ্যপনিষদ্‌) (উদ্বোধন কার্যালয়) থেকে সহজ বাংলায় অনুবাদ -লেখক।]

    এবার কেনোপনিষদ থেকে কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করা যাক। প্রথম খণ্ডের প্রথম শ্লোকে, গুরুদেবের কাছে কোন এক শিষ্য যেন ব্রহ্ম সম্বন্ধে আমাদের মনে আসা প্রশ্নগুলিরই উত্তর জানতে চেয়েছেন,-
    “কার ইচ্ছায় এবং নির্দেশে আমাদের মন চালিত হয়? কার আদেশে প্রধান প্রাণ নিজ কাজে নিযুক্ত হয়? কার ইচ্ছায় মানুষ এত কথা বলে, কোন জ্যোতির্ময় পুরুষই বা চোখ, কানকে নিয়ন্ত্রণ করেন?” ১/১
    (শিষ্যের প্রশ্নের উত্তরে গুরুদেব বলছেন,) “যাঁর শক্তিতে কান শুনতে পায়, মন চিন্তা করে, বাগেন্দ্রিয় কথা বলে, তাঁর শক্তিতেই প্রাণ উজ্জীবিত হয়, চোখ দেখতে পায়। তিনিই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের চালক, পণ্ডিতেরা এই তত্ত্ব জেনে আত্মবুদ্ধি ত্যাগ করে, সংসারের ঊর্ধ্বে অমৃতলোক অনুভব করেন। ১/২
    চোখ তাঁকে দেখতে পায় না, বাক্যে তাঁকে বর্ণনা করা যায় না, মনেও তাঁর কল্পনা করা যায় না। আমরা তাঁর স্বরূপ জানি না, অতএব কী ভাবে তাঁর কথা তোমাকে বলবো, তাও জানি না। ১/৩
    আমাদের জানা, এমনকি অজানা সকল বিষয় থেকেই তিনি ভিন্ন, আমাদের পূর্ববর্তী গুরুদের কাছে এমন ব্যাখ্যাই আমরা শুনেছি। ১/৪
    যাঁকে কথায় প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু আমাদের বাক্য যিনি প্রকাশিত করেন, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানবে – কিন্তু আমরা যাঁর উপাসনা করি, তিনি নন। ১/৫
    মন যাঁকে চিন্তা করতে পারে না, অথচ যিনি মনে চেতনার প্রকাশ ঘটান, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানবে – কিন্তু আমরা যাঁর উপাসনা করি, তিনি নন। ১/৬
    চোখ যাঁকে দেখতে পায় না, অথচ যিনি আমাদের দৃষ্টিতে আলো দিয়েছেন, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানবে – কিন্তু আমরা যাঁর উপাসনা করি, তিনি নন। ১/৭
    কান যাঁকে শুনতে পায় না, অথচ যিনি আমাদের শ্রবণে শব্দের বোধ সঞ্চার করেন, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানবে – কিন্তু আমরা যাঁর উপাসনা করি, তিনি নন। ১/৮
    এই প্রাণ যে প্রাণকে উপলব্ধি করতে পারে না, অথচ যিনি আমাদের প্রাণ সঞ্চার করেন, তুমি তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জানবে – কিন্তু আমরা যাঁর উপাসনা করি, তিনি নন।” ১/৯”
    (অনুবাদ – লেখক।)

    যেখানে উপনিষদের ঋষিগুরু তাঁর শিষ্যদের বলছেন, “আমরা তাঁর স্বরূপ জানি না, অতএব কী ভাবে তাঁর কথা তোমাকে বলবো, তাও জানি না”। বারবার বলছেন, “আমরা যাঁর উপাসনা করি, তিনি নন”। সেখানে আমাদের উপলব্ধিতে তিনি ধরা দেবেন, এমন সাহস করি কী করে?

    অতএব আমরা দেখতে পেলাম বেদান্ত দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলেন ব্রহ্ম, তিনি ভিন্ন অন্য কোন দেব ধারণা নেই। ব্রহ্মই এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশের একমাত্র কারণ। বেদান্ত দর্শনের সূত্রপাত সম্ভবতঃ খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীর কোন সময়ে ঘটেছিল। কিন্তু আচার্য শংকর (৭৮৮-৮২০ সি.ই.) সেই বেদান্ত দর্শনকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, আজ ভারতীয় দর্শন বলতে বেদান্ত দর্শনকেই বোঝায়। আচার্য শংকর যে বেদান্তের মত প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন – তার নাম অদ্বৈত-বেদান্ত। কিন্তু তাঁর পরেও বেদান্তের অনেকগুলি নতুন নতুন ব্যাখ্যা ও মত ভারতের বহু অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছিল। তাদের নাম উল্লেখ করার আগে, একটা কথা বলে রাখা ভাল, বেদান্তের শাখা ও মত যতগুলিই হোক না কেন, সবগুলিরই মূল কিন্তু ব্রহ্ম-ধারণা।

    ভাষ্যকারের নাম                 সময়কাল                             বেদান্ত মতবাদ
    শংকরাচার্য                       ৭৮৮-৮২০ সিই                          অদ্বৈত
    ভাষ্কর                           ৯৯৬-১০৬১ সিই                         ভেদাভেদ
    যাদবপ্রকাশ                      ১০০০ সিই                              ভেদাভেদ
    রামানুজ                         ১০১৭-১১২৭ সিই                        বিশিষ্টাদ্বৈত    
    মধ্বা                            ১২৩৮-১৩১৭ সিই                        দ্বৈত
    নিম্বার্ক                          ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধ             দ্বৈতাদ্বৈত
    শ্রীকান্থ                          ১২৭০ সিই                              শৈব-বিশিষ্টাদ্বৈত
    শ্রীপতি                          ১৪০০ সিই                           ভেদাভেদাত্মক – বিশিষ্টাদ্বৈত
    বল্লভ                            ১৪৭৯-১৫৪৪ সিই                        শুদ্ধাদ্বৈত
    শুক                             ১৫৫০ সিই                              ভেদাভেদ
    বিজ্ঞানভিক্ষু                      ১৫৫০ সিই                           আত্ম-ব্রহ্মকিয়-ভেদাভেদ
    বলদেব                          ১৭২৫ সিই                              অচিন্ত্য-ভেদাভেদ

    দর্শন কথার মূল অর্থ দৃষ্টি বা অন্তর্দৃষ্টি। আমরা এতক্ষণ যে ছয়টি দর্শনের আলোচনা করলাম, প্রত্যেকটি দর্শনই এই বিশ্বজগতের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ ও অস্তিত্বকে বুঝতে বা দেখতে শেখায়। তবে বেদান্ত এই জগতকে আমাদের অন্তর্দৃষ্টিতে শুধুমাত্র দেখতেই শেখায় না, আমাদের আধ্যত্মিক জীবনের পথও দেখায়। এই দর্শনের লক্ষ্য মানুষের সাধারণ-চৈতন্য সীমা ছাড়িয়ে, জাগতিক দুঃখ-কষ্ট পার করে, পূর্ণতা ও শান্তি লাভ। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ এবং স্বামী বিবেকানন্দর সর্বজন-সমন্বয়ের বেদান্ত ভাবনাই, বেদান্তকে ভারতীয় দর্শনের অন্যতম প্রধান মত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বেদান্তের অনেকগুলি প্রচলিত শাখার কথা আমি ওপরের সারণিতে দেখিয়েছি, সেগুলির মধ্যে আধুনিক হিন্দু বিবুধ-সমাজের প্রধান দর্শন অবশ্যই অদ্বৈত বেদান্ত।

    অদ্বৈত তত্ত্বের স্থূল অর্থ ব্রহ্মর দুটি সত্ত্বার অনস্তিত্ব, অথবা ব্রহ্মার দ্বৈতসত্ত্বার অনস্বীকার। সেক্ষেত্রে দ্বৈত ও অদ্বৈত তত্ত্বের পার্থক্যটা কোথায়? দুই তত্ত্বের প্রাথমিক পার্থক্য হল, দ্বৈত মতে মোক্ষ অবস্থাতেও মানুষের বাস্তব ব্যক্তিসত্ত্বার অস্তিত্ত্ব থাকে। কিন্তু অদ্বৈত মতে ব্যক্তিসত্ত্বাও অবাস্তব এবং মুক্তিতে ব্যক্তিসত্ত্বার কোন অস্তিত্ব থাকে না। [আমরা আবার সেই ৪.৩.২ অধ্যায়ের তথাগতর অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব – অর্থাৎ ভগবান বুদ্ধের “চতুষ্কটিকা” যুক্তিতেই যেন চলে এলাম!] আচার্য শংকর বলছেন, “আমরা যাকে জীব বলি, সেটি ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়। বরং জীব হল সেই ব্রহ্ম, যাঁর সঙ্গে বুদ্ধি, কর্তা এবং ভোক্তা অভিধা আরোপিত হয়। ব্যক্তি-সত্ত্বার সীমিত আধার অর্থাৎ তার শরীর বা দেহের জন্যেই তাকে পরম-সত্ত্বার থেকে পৃথক ধারণা হয়। বিচিত্র আকার ও নামের এই দেহ-রূপ ধারণার সৃষ্টি হয় অজ্ঞান বা অবিদ্যা থেকে। অদ্বৈত মতে এইটুকু ছাড়া দুই সত্ত্বার মধ্যে কোন প্রভেদ নেই।

    দ্বৈত মতে ব্রহ্মকে নয়, শুধুমাত্র ব্যক্তিসত্ত্বাকেই আত্মা বলা হয়। যখন এই আত্মা জীবের দেহ এবং মনে অধিষ্ঠিত হয় তখন তাকে “জীবাত্মা” বলে। মুক্তিতে জীবাত্মার অভিধা অদৃশ্য হয়, ব্রহ্মে বিলীন হয়, কিন্তু সেখানেও অতি নগণ্য হলেও কিছুটা পার্থক্য থেকে যায়। এই বিষয়টি পূর্ণের সঙ্গে তার ভগ্নাংশের সাযুজ্য হওয়ার মতোই তুলনীয় – এবং ব্যক্তিসত্ত্বা ও ব্রহ্মের এই প্রভেদকে দ্বৈত মতে “স্বগত-ভেদ” বলে।

    অদ্বৈত এই স্বগত-ভেদকে স্বীকার করে না। অদ্বৈতের মতে, মুক্তির পর্যায়ে, ব্রহ্ম ও আত্মা অভিন্ন হয়ে যায় এবং আত্মা ব্রহ্মই হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে জীব যখনই তার মন এবং দেহ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, তখনই আত্মা ও ব্রহ্মর পার্থক্য অবলুপ্ত হয়। এই কারণেই অদ্বৈত দর্শন ব্যক্তি সত্ত্বাকে জীবাত্মা এবং ব্রহ্মকে পরমাত্মা বলে থাকে।                   

    বেদান্ত তত্ত্বে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা দুই সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ সত্ত্বার – ব্রহ্ম এবং বাস্তব জগৎ - সঙ্গতি সাধন। আমরা আগেই জেনেছি ব্রহ্ম হলেন অসীম এক চেতনা, তিনি নির্গুণ, ব্রহ্ম কেমন সেকথা অবর্ণনীয়। উপনিষদ ব্রহ্মর সংজ্ঞায় বলেছেন, তিনি “সত্য, পরমজ্ঞান ও অসীম”, কিন্তু এ সবই তাঁর লক্ষণ, তাঁর বর্ণনা নয়, এবং এই লক্ষণগুলি থেকে তাঁর ধারণাও করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে, সীমিত ছকে বাঁধা কোন বোধ দিয়েই অসীম, অবিভাজ্য এবং নির্গুণ বিষয়ের কোন ধারণা করা যায় না।
     
    এই অধ্যায়ের শুরুতেই কেনোপনিষদ থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, এবার কেনোপনিষদের তৃতীয় খণ্ড এবং চতুর্থ খণ্ডের দুটি শ্লোক থেকে একটি আশ্চর্য গল্প শোনাবো, -
    “একবার ব্রহ্মই (দেবাসুর যুদ্ধে) দেবতাদের বিজয়ী করলেন। সেই ব্রহ্মের জন্যেই দেবতারা মহিমান্বিত হলেন। কিন্তু দেবতারা মনে করলেন, “এই বিজয় আমাদের, এই মহিমা আমাদেরই”। (৩/১)
    তাঁদের এই চিন্তার কথা ব্রহ্ম জানতে পারলেন, তিনি দেবতাদের মঙ্গলের জন্যে তাঁদের সামনে যক্ষ বেশে আবির্ভূত হলেন। কিন্তু দেবতারা জানতেও পারলেন না, কে এই যক্ষ। (৩/২)
    তাঁরা (দেবতারা) অগ্নিকে বললেন, “হে জাতবেদ, এই যে যক্ষ, যিনি এসেছেন, তিনি কে, জেনে এসো।” অগ্নিদেব বললেন, “তাই হোক”। (৩/৩)
    অগ্নি সেই যক্ষের সামনে গেলে, যক্ষ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে?” অগ্নি বললেন, “আমিই অগ্নি, আমি জাতবেদা নামেও বিখ্যাত”। (৩/৪)
    যক্ষবেশী ব্রহ্ম বললেন, “কোন ক্ষমতার জন্যে তুমি বিখ্যাত”? অগ্নি বললেন, “এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সে সব আমি দগ্ধ করতে পারি”। (৩/৫)
    “এটিকে দগ্ধ করো দেখি”, বলে যক্ষবেশী ব্রহ্ম অগ্নির সামনে একটি শুষ্ক তৃণ রাখলেন। সর্ব শক্তি দিয়েও অগ্নি সেই তৃণটিকে দগ্ধ করতে না পেরে ক্ষান্ত হলেন। দেবতাদের কাছে ফিরে বললেন, “এই পূজনীয় যক্ষ কে, জানতে পারলাম না”। (৩/৬) 
    এরপর দেবতারা বায়ুকে বললেন, “হে বায়ু, তুমি জেনে এসো তো, এই যক্ষ কে”? বায়ু বললেন, “তাই হোক”। (৩/৭)
    বায়ু তাঁর কাছে গেলে, যক্ষ জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে”? বায়ু বললেন, “আমাকে সবাই বায়ু বলে, মাতরিশ্বা নামেও আমি বিখ্যাত”। (৩/৮)
    যক্ষবেশী ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কোন দক্ষতার জন্যে তুমি বিখ্যাত”? বায়ু উত্তর দিলেন, “এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সে সব আমি উড়িয়ে নিতে পারি”। (৩/৯)
    “এই তৃণ গ্রহণ করো” বলে যক্ষবেশী ব্রহ্ম তাঁর সামনে একটি শুষ্ক তৃণ রাখলেন। সর্বশক্তি দিয়েও বায়ু সেই তৃণটিকে উড়িয়ে তুলতে সমর্থ হলেন না। তিনি ফিরে এসে বললেন, “এই যক্ষ যে কে, আমি জানতে পারলাম না”। (৩/১০)
    এরপর দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, “হে মঘবন্, আপনিই গিয়ে জেনে আসুন, এই যক্ষ কে”? ইন্দ্র বললেন, “তাই হোক”। ইন্দ্র সামনে যেতেই যক্ষ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। (৩/১১)
    তখন সেই আকাশেই বহু সোনার অলংকারে সজ্জিতা এক নারী, উমা হৈমবতী[2] আবির্ভূতা হলেন। ইন্দ্র তাঁকেই জিজ্ঞাসা করলেন, “এই যক্ষ কে?” (৩/১২)
    তিনি (উমা) বললেন, “ইনিই ব্রহ্ম, ব্রহ্মের বিজয়কে নিজেদের মনে করে তোমরা মহিমান্বিত মনে করছো”। এইভাবেই ইন্দ্র জানতে পারলেন ইনিই ব্রহ্ম”। (৪/১)
    যেহেতু অগ্নি, বায়ু এবং ইন্দ্র ব্রহ্মার নিকটে গিয়ে আলাপ করেছেন এবং প্রথমে এঁরাই ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছেন, সেহেতু অন্য দেবতাদের থেকে এঁনারা অধিক উৎকর্ষ লাভ করেছেন। (৪/২)” [বাংলা অনুবাদ – লেখক।]     

    এই কাহিনীতে আমরা দেখলাম, বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তিন প্রধান দেবতা ইন্দ্র, অগ্নি ও বায়ুর মহিমা পরমব্রহ্ম-র কাছে একান্তই অকিঞ্চিৎকর। এখানে রুদ্র বা বিষ্ণুর কোন উল্লেখই এল না। কিন্তু হিন্দু ধর্মের প্রধান দুই দেবতা বিষ্ণু ও শিব, ব্রহ্মর সমকক্ষ হয়ে ত্রিদেব হয়ে উঠেছেন। এমনকি অনেক গ্রন্থে তাঁদের ব্রহ্মর থেকেও বেশী ঐশ্বর্যবান দেখানো হয়েছে। আর যে স্বর্ণভূষিতা নারী[3] (কোন দেবীও নন?) ইন্দ্রকে ব্রহ্ম সম্বন্ধে অবহিত করলেন তিনি উমা। তিনিই আমাদের আদরের মাতৃরূপা-কন্যা, আশ্বিনে যাঁর আগমনের প্রতীক্ষায় আমরা প্রত্যেক বছর উদ্গ্রীব অপেক্ষায় থাকি। তিনিই আদ্যাশক্তি দুর্গা, হিন্দু ধর্মে তাঁর স্থান ত্রিদেবেরও ওপরে। ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতদের হিন্দু বা পৌরাণিক পণ্ডিত হয়ে উঠতে এতটাই বৈতসী বৃত্তি অবলম্বন করতে হয়েছিল! ভাবলে বিস্মিত হতে হয় বৈকি।               

    ষড়দর্শন প্রসঙ্গের উপসংহার টানার আগে আমাদের অত্যন্ত প্রিয় সাধককবি শ্রী রামপ্রসাদ সেনের একটি গান উল্লেখ করি -   
    “কে জানে কালী কেমন, ষড় দর্শনে না পায় দরশন।
    আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন,
    সে যে ঘটে ঘটে বিরাজ করে ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।
    কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড, প্রকাণ্ড তা বুঝ কেমন,
    যেমন শিব বুঝেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।
    মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন,
    কালী পদ্মবনে হংস সনে হংসী রূপে করে রমণ।
    প্রসাদ ভাষে, লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধু-তরণ,
    আমার মন বুঝেছে, প্রাণ বুঝে না; ধরবে শশী হয়ে বামন”।

    অতএব সাঁতরে সাগর পার হওয়া অথবা বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যাওয়া সম্ভব নয় বুঝেই, আমরা সাধারণ মানুষজন এই ষড়দর্শন এবং তার তত্ত্ব উপলব্ধি থেকে মুক্ত থাকার পথটাই বেছে নিয়েছি। আমাদের মধ্যে যারা নাস্তিক তারা এক কথায় এসব নস্যাৎ করে দিব্যি উন্নাসিক থাকতে পারল। কিন্তু আমাদের মতো যারা ধর্মভীরু আস্তিক তারাও ষড়দর্শন এবং পরমব্রহ্ম বিষয়ে খুব স্পষ্ট ধারণা করতে পারলাম না। কিন্তু এ বিষয়ে কতিপয় ধর্মগুরু এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতের দুর্বোধ্য সংস্কৃত শাস্ত্রবাক্যকে শিরোধার্য করে, নিজ-নিজ ভাষায় নিজ-নিজ গোষ্ঠীর দেবদেবীর চরণে নিজেদের ভক্তি ও বিশ্বাস নিবেদন করতে শুরু করলাম। অর্থাৎ আমরা সেই দিন থেকেই হিন্দু হয়ে উঠতে লাগলাম। এ কথা এই পর্বের প্রতিটি অধ্যায়েই ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হবে। 

    যাই হোক, ষড়দর্শন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনার এখানেই ইতি টানলাম। প্রসঙ্গতঃ বলি, এই ছয়টি দর্শনের মধ্যে প্রথম চারটি দর্শনের সৃষ্টি ব্রাহ্মণ্য যুগে এবং শেষ দুটি হিন্দু যুগে – অর্থাৎ সে সময়ে ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের হিন্দুধর্মে রূপান্তর প্রায় হয়ে এসেছে। এবার যে গ্রন্থের ওপর নির্ভর করে, আমি ধর্ম বিষয়ে পরবর্তী আলোচনা করব, সেটি হল মহাভারত। কারণ মহাভারত সম্পর্কে বলাই হয় – “যা নেই (মহা)ভারতে তা নেই ভারতে”।

    ৫.২.১ মহাভারতের ধর্ম এবং ধর্মবিশ্বাস
    বাস্তবিক আমাদের হিন্দুদের এমন কোন বিষয় – সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি ও দর্শন, সংস্কৃতি, ধর্ম বিশ্বাস এবং মানব চরিত্রের যাবতীয় প্রবৃত্তি - প্রেম, ঘৃণা, সারল্য, ক্রূরতা, নৃশংসতা, অহিংসতা, বিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা – নেই, যা মহাভারতে নেই। এছাড়া আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, একমাত্র মহাভারতেই ভারতীয় সমাজের প্রাচীন বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে গুপ্ত রাজত্বের সমসাময়িক কালের হিন্দু যুগ হয়ে ওঠার পর্যায়গুলির সুস্পষ্ট রূপরেখাটি খুঁজে পাওয়া যায়। অতএব মহাভারত যে হিন্দুধর্মের এনসাইক্লোপিডিয়া, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

    যদিও মহাভারতের আলোচনায় তিনটি কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে, প্রথমতঃ মহাভারতের সর্বশেষ পরিমার্জিত ও সংযোজিত সংস্করণ রচিত হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের মতে, গুপ্তযুগ বা তার কাছাকাছি সময়ে। যে মহাভারত আজ আমরা পড়ি। দ্বিতীয়তঃ ভারতীয় আর্য জাতিগোষ্ঠীগুলিকে নিয়ে, আর্য জাতিগোষ্ঠীর জন্যে, আর্য এবং পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ্য ঋষি এবং হিন্দু পণ্ডিতরা মহাভারত রচনা করেছিলেন। অতএব ভারতীয় প্রাচীন অনার্য গোষ্ঠীর মানুষেরা এই গ্রন্থে কদাচিৎ[4] তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা পেয়েছেন। তৃতীয়তঃ মহাভারতের যাবতীয় কাহিনী রাজা, রাজপরিবার এবং তাঁদের ঘিরে থাকা মুনি-ঋষি বা রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ মানুষের কাহিনী, সেখানে সাধারণ মানুষজনের কথা নেই বললেই চলে। এই তিনটি কথা মাথায় রেখে আমরা মহাভারত চর্চায় প্রবেশ করব।

    ব্রাহ্মণ্য ধর্মে মানব জীবনের সার্থকতার জন্যে তিনটি বর্গ বা লক্ষ্য, যাকে ত্রিবর্গ বলে, অনুসরণ করা আবশ্যিক ছিল। এই তিনটি বর্গ হল ধর্ম, অর্থ ও কাম। পরবর্তী কালে, অর্থাৎ মহাভারত সংকলনের সময় অথবা আরও স্পষ্ট করে বললে, হিন্দুধর্মে সেটিকে চতুর্বগ করে তোলা হল, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। অতএব হিন্দুধর্মের সার্থকতার লক্ষ্য হয়ে উঠল চতুর্বর্গ। 

    এই চতুর্বর্গ ধর্ম কি এবং কেমন হওয়া উচিৎ সেই ধর্মাচরণ, তার সারাংশ আমরা পাই বনপর্বের ৩১২ অধ্যায়ে - বকরূপী এক যক্ষের সঙ্গে রাজা যুধিষ্ঠিরের সুদীর্ঘ প্রশ্নোত্তর পর্ব থেকে, সেই আলোচনাতেই এখন চোখ রাখা যাক।

    দ্বাদশ বর্ষ বনবাসের শেষ পর্যায়ে পাণ্ডবেরা একবার বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে পরিশ্রান্ত ও পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিলেন। রাজা যুধিষ্ঠিরের আদেশে প্রথমে নকুল গেলেন কাছাকাছি এক সরোবর থেকে জল আনতে। বহু সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু তিনি জল নিয়ে ফিরলেন না। এরপর উদ্বিগ্ন রাজা যুধিষ্ঠিরের আদেশে একে একে সকলেই জল আনতে গেলেন, কিন্তু কেউই ফিরে এলেন না। তখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাজা যুধিষ্ঠির নিজেই গেলেন, ভাইদের সন্ধানে। সরোবরের সামনে গিয়ে দেখলেন, তাঁর অপরাজেয় ভাইয়েরা সকলেই, সরোবরের তীরের মাটিতে সংজ্ঞাহীন নিশ্চল শুয়ে আছে। বিস্মিত ও আতঙ্কিত রাজা যুধিষ্ঠির লক্ষ্য করলেন, সরোবরের পাড়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে এক বক। সেই বক বললেন, “হে কুন্তীপুত্র, আমি এই সরোবরের অধিকারী। আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর না দিলে, এই সরোবরের জল আমি কাউকে স্পর্শ করতে দিই না। তোমার ভাইয়েরা আমার কথা অবহেলা করে, জলস্পর্শ করতে গিয়েছিল বলেই, তাদের সকলকে আমি শমনসদনে পাঠিয়েছি। তোমাকেও বলছি, আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারলে, তোমারও একই দশা হবে”।

    বিস্মিত রাজা যুধিষ্ঠির বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই সাধারণ কোন বক নন। একটি পাখির পক্ষে আমার মহাবীর ভাইদের এভাবে পরাস্ত করা, কোন মতেই সম্ভব নয়। আপনি কে?” রাজা যুধিষ্ঠিরের কথায়, বক খুশি হলেন, বললেন, “তোমার মঙ্গল হোক, আমি সত্যিই কোন জলচর পক্ষি নই, আমি যক্ষ, আমিই তোমার পরাক্রমশালী ভাইদের নিহত করেছি”। যক্ষ এবার নিজমূর্তি ধারণ করাতে, রাজা যুধিষ্ঠির বললেন, “হে যক্ষ, আপনার কী প্রশ্ন আছে, জিজ্ঞাসা করুন, আমি যথাসাধ্য সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করব”।
     
    যক্ষ একের পর এক প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন, “কে আদিত্যকে উচ্চে প্রতিষ্ঠা করেন? কারা তাঁর চারদিকে থাকেন, কে বা তাঁকে বশীভূত করেন এবং তিনি কোথায় প্রতিষ্ঠিত আছেন?”
    রাজা যুধিষ্ঠির বললেন, “ব্রহ্ম আদিত্যকে উচ্চে প্রতিষ্ঠা করেন। দেবতারা তাঁর চারদিকে ঘুরে বেড়ান, ধর্ম তাঁকে বশীভূত করতে পারেন এবং তিনি সত্যে প্রতিষ্ঠিত আছেন”।
    “কী থেকে শ্রোত্রিয়[5] হওয়া যায়, কিসের থেকে মহত্ত্বলাভ হয়, কিসের থেকে পুত্রবান এবং কিসের থেকে বুদ্ধিমান হওয়া যায়?”
    “শ্রুতি থেকে শ্রোত্রিয় হওয়া যায়, তপস্যা থেকে মহত্ত্বলাভ হয়, যজ্ঞ থেকে পুত্রবান এবং বৃদ্ধসেবা থেকে বুদ্ধিমান হওয়া যায়”।
    “ব্রাহ্মণদের দেবত্ব কি? তাঁদের কোন ধর্ম সাধু ধর্ম? তাঁদের মনুষ্যভাব কি? তাঁদের অসাধু ভাবই বা কি?”
    “বেদপাঠ ব্রাহ্মণদের দেবত্ব, তপস্যা সাধুধর্ম, মৃত্যু মনুষ্যভাব। পরীবাদ[6] তাঁদের অসাধুভাব”।
    “ক্ষত্রিয়দের দেবভাব, সাধুভাব, মনুষ্যভাব এবং অসাধুভাব কি?”
    “ক্ষত্রিয়দের অস্ত্র-শস্ত্র দেবভাব, যজ্ঞ সাধুভাব, ভয় মনুষ্যভাব এবং যুদ্ধ পরিত্যাগ অসাধুভাব”।
    “যজ্ঞীয় সাম কি? যজ্ঞীয় যজুঃ কি? কে যজ্ঞ বরণ করে এবং কাকে সে অতিক্রম করে না?”
    “প্রাণ যজ্ঞীয় সাম; মন যজ্ঞীয় যজুঃ, ঋক যজ্ঞকে বরণ করে এবং যজ্ঞ ঋককে অতিক্রম করে না”।
    “আবপনকারী, নিবপনকারী, প্রতিষ্ঠমান এবং প্রসূতিকারী, এদের মধ্যে কি কি শ্রেষ্ঠ?”
    “আবপনকারীদের বৃষ্টি, নিবপনকারীদের বীজ, প্রতিষ্ঠমানদের[7] ধেনু এবং প্রসূতিকারীদের পুত্রই শ্রেষ্ঠ”।
    “কোন ব্যক্তি ইন্দ্রিয়সুখ অনুভবে সমর্থ, বুদ্ধিমান, সম্মানিত, তবু প্রাণীর মতো জীবন থাকতেও জীবিত নয়?”
    “যে ব্যক্তি দেবতা, অতিথি, ভৃত্য, পিতৃলোক ও আত্মাকে শ্রদ্ধা ও অর্চনা করে না, সে জীবন থাকতেও জীবিত নয়”।
    “পৃথিবীর থেকেও কে মহৎগুরু, আকাশের থেকেও কে উচ্চতর, বায়ুর থেকেও কে দ্রুতগামী, আর কার সংখ্যা তৃণের থেকেও বেশী?”
    “মাতা পৃথিবীর থেকেও মহৎগুরু, পিতা আকাশের থেকেও উচ্চতর, মন বায়ুর থেকেও দ্রুতগামী আর চিন্তা তৃণের থেকেও বহুতর”।
    “কে ঘুমিয়ে থাকলেও চোখ খোলা রাখে? জন্মানোর পরেও কার স্পন্দন হয় না, কার হৃদয় নেই এবং কে দ্রুত বেড়ে ওঠে?[8]
    “মাছ ঘুমোলেও চোখ খোলা রাখে, অণ্ড (ডিম) জন্মালেও তার স্পন্দন হয় না, পাষাণের হৃদয় নেই এবং নদী দ্রুত বেড়ে ওঠে”।
    “প্রবাসীর মিত্র কে, গৃহবাসীর মিত্র কে? আতুর ও মুমূর্ষু ব্যক্তির মিত্র কে?”
    “প্রবাসীর সঙ্গী সহযাত্রী, গৃহবাসীর ভার্যা, আতুরের চিকিৎসক ও মুমূর্ষু ব্যক্তির দানই মিত্র”।
    “কে সর্বভূতের অতিথি, সনাতন ধর্ম কি, অমৃত কি এবং সমুদয় জগৎ কি পদার্থ?”
    “অগ্নি সর্বভূতের অতিথি, জ্ঞানযোগ সনাতন ধর্ম, সলিল ও যজ্ঞশেষ অমৃত, বায়ু সমুদয় জগৎ”।
    “কে একা বিচরণ করেন, কে বার বার জন্ম নেয়, হিমের ঔষধ কি এবং কে প্রধান বপনক্ষেত্র?”
    “সূর্য একা বিচরণ করেন, চন্দ্রমা বার বার জন্ম নেয়, অগ্নি হিমের ঔষধ এবং পৃথ্বী প্রধান বপনক্ষেত্র”।
    “ধর্মের একমাত্র আশ্রয় কি, যশের একমাত্র আশ্রয় কি, স্বর্গ এবং সুখের একমাত্র আশ্রয় কি কি?”
    “দাক্ষ্য[9] ধর্মের, দান যশের, সত্য স্বর্গের এবং শীল (সদাচরণ) সুখের একমাত্র আশ্রয়”।
    “মানুষের আত্মা কে, দৈবকৃত সখা কে, উপজীবিকা কি এবং প্রধান আশ্রয়ই বা কি”?
    “পুত্র মানুষের আত্মা, ভার্যা দৈবকৃত সখা, মেঘ উপজীবিকা এবং দান প্রধান আশ্রয়”।
    “ধন্যে[10]র মধ্যে উত্তম কি, ধনের মধ্যে উত্তম কি, লাভের মধ্যে এবং সুখের মধ্যেই বা উত্তম কি কি?”
    “দাক্ষ্য ধন্যের মধ্যে, শাস্ত্র ধনের মধ্যে, আরোগ্য লাভের মধ্যে এবং সন্তোষই সুখের মধ্যে উত্তম”।
    “প্রধান ধর্ম কি, কোন ধর্ম সর্বদা ফলবান, কাকে সংযত করলে শোক থাকে না, আর কার সঙ্গে সন্ধি করলে সন্ধি ভেঙে যায় না”?
    “অনৃশংসতা প্রধান ধর্ম, বৈদিক ধর্ম সর্বদা ফলবান, মনকে সংযত করলে শোক থাকে না, আর সাধুর সঙ্গে সন্ধি করলে, সন্ধি ভঙ্গ হয় না”।
    “কী ত্যাগ করলে প্রিয় হয়, কী ত্যাগ করলে শোক হয় না, কী ত্যাগ করলে অর্থবান হয় এবং কী ত্যাগ করলে সুখী হয়?”
    “অভিমান ত্যাগ করলে প্রিয় হয়, ক্রোধ ত্যাগ করলে শোক হয় না, কামনা ত্যাগ করলে অর্থবান হয় এবং লোভ ত্যাগ করলে সুখী হয়”।
    “ব্রাহ্মণ, নট ও নর্তক, ভৃত্য এবং রাজাকে দান করার প্রয়োজনীয়তা কি?”
    “ধর্মের জন্য ব্রাহ্মণকে, যশের জন্যে নট ও নর্তককে, ভরণের জন্য ভৃত্যকে এবং ভয়ের কারণে রাজাকে দান করা প্রয়োজন”।
    “লোকেরা কিসে আবৃত থাকে, কিসে আচ্ছন্ন থাকে, মিত্রদের কেন পরিত্যাগ করে, আর কেনই বা স্বর্গে যেতে অসমর্থ হয়?”
    “লোকেরা অজ্ঞানে আবৃত, তমোগুণে আচ্ছন্ন থাকে। লোভের জন্যে মিত্রদের পরিত্যাগ করে এবং সঙ্গদোষে স্বর্গে যেতে পারে না”।
    “মৃত পুরুষ কে, মৃত রাষ্ট্র কি, মৃত শ্রাদ্ধ এবং মৃত যজ্ঞই বা কি?”
    “দরিদ্র পুরুষই মৃত, অরাজক রাষ্ট্র মৃত, শ্রোত্রিয়হীন শ্রাদ্ধ মৃত আর দক্ষিণাহীন যজ্ঞ মৃত”।
    “দিক কি, জল কি, অন্ন কি, বিষ কি এবং শ্রাদ্ধের কালই বা কি?”
    “সাধুরা (যে পথ দেখান, সেটাই) দিক, আকাশই জল, ধেনু অন্ন, অনুগ্রহ বিষ এবং ব্রাহ্মণই শ্রাদ্ধের কাল”।
    “তপ, দম, ক্ষমা ও লজ্জার লক্ষণ কী?”
    “নিজের ধর্মে আস্থাই তপ, মনের সংযম দম, দ্বন্দ্ব সহ্য করাই ক্ষমা, অনাচার থেকে নিবৃত্ত থাকাই লজ্জা”।
    “জ্ঞান, শম, দয়া ও আর্জব কাকে বলে?”
    “তত্ত্বের অর্থবোধকে জ্ঞান, মনের প্রশান্তি শম, সকলের সুখ ইচ্ছে করা দয়া, এবং সমদর্শীতাই আর্জব[11]”।
    “পুরুষের কোন শত্রু দুর্জয়, কোন ব্যাধি অনন্ত, কি রকম লোককে সাধু কিংবা অসাধু বলা যায়?”
    “ক্রোধ পুরুষের দুর্জয় শত্রু, লোভ অনন্ত ব্যাধি, সকল প্রাণীর মঙ্গলকারী ব্যক্তিই সাধু এবং নির্দয় ব্যক্তি অসাধু”।
    “মোহ, মান, আলস্য ও শোকের লক্ষণ কি?”
    “ধর্ম বিষয়ে অনভিজ্ঞতা মোহ, আত্ম-অহংকারই মান, ধর্ম আচরণ না করাই আলস্য এবং অজ্ঞানই শোক”।
    “ঋষিরা স্থৈর্য, ধৈর্য, স্নান ও দানের কী কী লক্ষণ বলেছেন?”
    “নিজ ধর্মে স্থিরতা স্থৈর্য, ইন্দ্রিয়ের সংযম ধৈর্য, মনের মালিন্য দূর করাই স্নান এবং প্রাণীদের রক্ষা করাই দান”।
    “পণ্ডিত কে, নাস্তিক কে? মূর্খ কে, কাম কি, ঈর্ষা কি?”
    “ধর্মজ্ঞই পণ্ডিত, নাস্তিকেরা মূর্খ এবং মূর্খরাই নাস্তিক। সংসারে আসক্তি কাম এবং প্রবল বাসনাই ঈর্ষা”।
    “অহংকার, দম্ভ, দৈব এবং পৈশুন্য (খলতা, ক্রূরতা) কি?”
    “অজ্ঞানতা অহংকার, নিজেকে ধার্মিক বলে প্রচার করাই দম্ভ, দানের ফল দৈব, এবং অন্যকে দোষারোপ পৈশুন্য”।
    “ধর্ম, অর্থ ও কাম – এরা তো পরষ্পরবিরোধী; তাহলে ত্রিবর্গে এদের সমাবেশ কিভাবে হয়?”
    “যখন ধর্ম ও ভার্যা, পরষ্পরের বশীভূত হয়, তখনই ধর্ম, অর্থ ও কামের সমাবেশ ঘটে”।
    “হে রাজন, কোন কর্ম করলে অক্ষয় নরকে যেতে হয়?”
    “যে ব্যক্তি প্রার্থী দরিদ্র ব্রাহ্মণকে দান করার জন্যে নিজেই ডেকে এনে, পরে “নেই” বলে বিদায় করে, যে ব্যক্তি বেদ, ধর্মশাস্ত্র, দ্বিজ, দেবতা ও পৈতৃক ধর্মকে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করে, যে ধনবান ব্যক্তি “নেই” বলে অর্থাৎ কার্পণ্যবশতঃ, দান ও ভোগ না করে, তাদেরই অক্ষয় নরকে যেতে হয়”।
    “হে রাজন, কুল, বৃত্ত (আচরণ, চরিত্র), স্বাধ্যায় এবং শ্রুত এর মধ্যে কোনটি ব্রাহ্মণত্বের কারণ, নিশ্চিত করে বল”।
    “হে যক্ষ, কুল, স্বাধ্যায় বা শ্রুত কিছুতেই ব্রাহ্মণত্ব জন্মায় না। একমাত্র বৃত্তই ব্রাহ্মণত্বের কারণ। যাঁরা শুধুমাত্র অধ্যয়ন, অধ্যাপন বা শাস্ত্রচিন্তা করেন, তাঁরা সকলেই মূর্খ এবং শাস্ত্রজীবি। কিন্তু যিনি বিধিমতো নিত্য ধর্ম আচরণ করেন, তিনিই বৃত্ত, তিনিই যথার্থ ব্রাহ্মণ”।
    “প্রিয়বাক্য বললে কী লাভ হয়, বিবেচনা করে কাজ করলে, বহুমিত্র হলে কিংবা ধর্মে অনুরাগী হলেই বা কী কী লাভ হয়?”
    “প্রিয়বাদী সকলের প্রিয় হয়, বিবেচনা করে কাজ করলে ব্যক্তি অনেকবেশী লাভ করতে পারে, বহুমিত্র হলে, ব্যক্তি সতত আনন্দে থাকে এবং ধর্মানুরাগী হলে সদ্গতি লাভ হয়”।
    “সুখী কে? আশ্চর্য কী? পথ এবং বার্তাই বা কী? এই চার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলে, তোমার ভাইয়েরা আবার বেঁচে উঠতে পারেন”।
    যুধিষ্ঠির বললেন, “যিনি অঋণী ও অপ্রবাসী হয়ে, দিনের পঞ্চম বা ষষ্ঠভাগে, নিজের গৃহে শাক-অন্ন আহার করেন তিনিই সুখী। প্রাণীগণকে প্রতিদিন মারা যেতে দেখেও, জীবিত ব্যক্তিরা নিজেদের চিরজীবন আশা করে, এর থেকে আশ্চর্য আর কী হতে পারে? তর্কের সীমা নেই, বেদ ও স্মৃতির মত বিভিন্ন। মুনি একজন নয়, যে তাঁর মতই একমাত্র, আর ধর্মের অজস্র তত্ত্ব জ্ঞানের গুহায় মিলিয়ে যায়। অতএব মহাজনেরা যে পথে গমন করেছেন, সেই পথই পথ। সূর্যরূপ কাল (সময়)-এর আগুনে, দিন-রাত্রিস্বরূপ ইন্ধন জ্বালিয়ে, মহামায়ার কড়াইতে ঋতু ও মাস-স্বরূপ হাতা দিয়ে নেড়েচেড়ে, প্রাণিদের যে সর্বদা রন্ধন করা হয়, সেটাই হল বার্তা”।
    যক্ষ বললেন, “হে রাজন, এখনও পর্যন্ত তুমি আমার সকল প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিয়েছ। এখন বল, পুরুষ কে এবং সকলের মধ্যে ধনী কে?”
    “পুণ্যকর্ম দিয়ে যখন স্বর্গ স্পর্শ করা যায়, তখনি মানুষের যশ এই পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, সেই যশ যতদিন থাকে, ততদিন সেই পুণ্যকর্মা ব্যক্তিকে পুরুষ বলে বিবেচনা করা হয়। যে ব্যক্তি অতীত বা ভবিষ্যতের সুখ-দুঃখ ও প্রিয়-অপ্রিয়কে সমান মনে করেন, তিনিই সকলের মধ্যে ধনী”।
    যক্ষ এবার বললেন, “হে রাজন, এখন আমি তোমার ইচ্ছামতো তোমার একজন ভাইকে জীবিত করব, বল সে কোন ভাই?”
    যুধিষ্ঠির বললেন, “হে যক্ষ, ওই শ্যামকলেবর, লোহিত-লোচন, বিশালবক্ষ, মহাবাহু নকুল জীবিত হয়ে উঠুক”।
    যক্ষ আশ্চর্য হয়ে বললেন, “হে রাজন, তুমি দশ-হাজার হাতির তুল্য বলশালী প্রিয় ভীম কিংবা পাণ্ডবদের প্রধান আশ্রয় ধনঞ্জয়কে ছেড়ে, বিমাতার পুত্র নকুলের কথা কেন বললে?”
    যুধিষ্ঠির বললেন, “ধর্মকে নষ্ট করলে, ধর্মও আমাদের নষ্ট করবেন এবং তাঁকে রক্ষা করলে, তিনিও আমাদের রক্ষা করবেন। অতএব আমি কখনও ধর্ম পরিত্যাগ করব না, ধর্মও আমাকে যেন কখনো পরিত্যাগ না করেন। হে যক্ষ, আনৃশংস্য[12]ই পরমধর্ম, আমি সর্বদাই আনৃশংস্য অবলম্বন করতে চাই। সকলে আমাকে ধর্মশীল বলে জানেন, অতএব আমি কোনক্রমেই স্বধর্ম ত্যাগ করতে পারব না। কুন্তী ও মাদ্রী দুজনেই আমার জননী। উভয়েই পুত্রবতী হয়ে থাকুন, এই আমার অভিলাষ। আমার পক্ষে দুজনেই সমান, অতএব আপনি নকুলকে জীবিত করে, দুজনকেই পুত্রবতী রাখুন”।

    যক্ষ বললেন, “হে রাজন, আপনি অর্থতঃ এবং কামতঃ আনৃশংস্যপরায়ণ, এই কারণে আপনার সকল ভাইই আবার জীবিত হোক”। যক্ষের কথা অনুযায়ী, পাণ্ডবদের সকলেই গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতো উঠে বসলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির যক্ষকে বললেন, “আপনাকে যক্ষ বলেও মনে হয় না, আপনি কোন মহাপুরুষ হবেন। আপনি বসু, রুদ্র কিংবা মরুৎগণের মধ্যে প্রধান কেউ, অথবা দেবরাজ ইন্দ্র হবেন। নচেৎ এমন ঘটনা অসম্ভব। এই ভূমণ্ডলে এমন যোদ্ধা নেই, যে আমার এই রণকুশল ভাইদের পরাভূত করতে পারে। তাছাড়া ভাইয়েরা যেভাবে সুস্থ এবং স্বচ্ছন্দে জেগে উঠেছে, তাতে তাদের কোনরকম চোট বা আঘাতের লক্ষণ নেই। আমার মনে হয় আপনি আমাদের সুহৃৎ, আমাদের পিতৃসম”।

    যক্ষ এবার স্মিতমুখে বললেন, “বৎস, আমিই তোমার পিতা, ভীমপরাক্রম ধর্ম, তোমাকে দেখতে এসেছিলাম। হে যুধিষ্ঠির, তুমি আমার অত্যন্ত স্নেহের পাত্র, তুমি পঞ্চযজ্ঞে[13] একান্ত অনুরক্ত হয়েছ এবং সকল পাপের কারণ, কাম, ক্রোধ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে পরাজিত করেছ। আমি তোমাকে পরীক্ষা করার জন্যেই এখানে এসেছিলাম, এখন তোমার ধর্মজ্ঞানে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। তোমার মঙ্গল হোক, এখন আমি তোমাকে বর দিতে চাই”।
    এরপর রাজা যুধিষ্ঠির যেমন যেমন বর চেয়েছিলেন, তাঁর পিতা যক্ষরূপী ধর্মদেব সবগুলিই অনুমোদন করলেন, তারপর সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

    ওপরে স্বয়ং ধর্মদেব এবং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের আলোচনায় ধর্ম বলতে প্রচুর ঘৃতাহুতি ও বেদোচ্চারণ করে বিশাল যজ্ঞের অনুষ্ঠান এবং তারপর বিপুল দান-টান করে স্বর্গবাস সুনিশ্চিত করার প্রকরণ বলে মনে হল না। যজ্ঞ-টজ্ঞ নিয়ে দু চার কথা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা গৌণ, মুখ্যতঃ ধর্ম বলতে যা বুঝলাম, সংসার, সমাজ, প্রতিবেশী, গুরুজন, স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সকলের সঙ্গে সদাচরণ, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে সদ্ভাব বজায় রেখে চলা। একথা ভগবান বুদ্ধ, সম্রাট অশোকও বলেছিলেন, তাঁদের আমরা “বুদ্ধু” বলেছি, বলেছি “নির্বোধ”। কারণ এই ধর্ম আচরণে সমাজের পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ শ্রেণীর স্বার্থ সিদ্ধি হয় না। তাঁদের স্বার্থসিদ্ধির প্ররোচনায়, আমরাই “বুদ্ধু” এবং “নির্বোধ”-এর মত, ধর্ম নিয়ে প্রতিবেশী, সমাজ, বন্ধুজনের প্রতি আনৃশংস্যতার পরিবর্তে নৃশংস হয়ে উঠেছি বহুকাল। ধর্মের নামে আমরা কবেই খুইয়ে বসেছি আমাদের মানবধর্ম।          

    ৫.২.২ বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবী
    বৈদিক দেব-দেবীদের কথা আগে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। এখন আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

    ঋগ্বেদে প্রাক-বৈদিক দেবতাদের আবির্ভাব বা অভ্যুদয়ের পর্যায়গুলি ভীষণ সুন্দর ও মানবিক। আর্য ঋষিরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করে, এই দেশের অপরূপ মহিমা ও সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। উত্তরে সুউচ্চ তুষারাবৃত মৌন গম্ভীর হিমালয়ের পর্বত শ্রেণী। স্রোতস্বীনি অজস্র নদী ও আশ্চর্য তাদের বিস্তার। নদীগুলির অববাহিকায় চিরহরিৎ অরণ্য এবং কিছু কিছু অঞ্চলে অনার্যদের সবুজ বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্র। রুক্ষ, দুর্গম, সুদীর্ঘ পার্বত্য পথ পার হয়ে, এমন এক প্রাকৃতিক পরিবেশে পৌঁছে, তাঁরা শুধু অভিভূতই হলেন না, মনের মধ্যে অনুভব করলেন, আশ্চর্য প্রশান্তি, স্নিগ্ধ পূর্ণতা এবং অভূতপূর্ব মুগ্ধতা। তাঁরা একদিকে যেমন অসাধারণ কাব্যিক শ্লোক রচনা করেছিলেন, তেমনই প্রকৃতির এই অদ্ভূত ঐশ্বর্যের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিস্ময়ে তাঁরা মগ্ন হলেন দেবত্বের কল্পনায়।  ঊর্ধের আকাশ – দ্যু, পায়ের নীচের পৃথিবী –পৃথ্বী। দিনের আকাশের দেবতা উজ্জ্বল সূর্য, তিনি জগতের প্রাণ, তিনি মিত্র। আর নৈশ বা নীল আকাশের দেবতা বরুণ। প্রাচীন বৈদিক দেবতার ধারণায় মাত্র এই কয়েকজনই ছিলেন, তাঁদের পূজার রীতি সহজ সরল, সঙ্গীতময় কিছু মন্ত্রের উচ্চারণ।

    এর পর বৈদিক ঋষিরা অনুভব করলেন, অনন্ত এবং অসীমের ধারণা, যার প্রকাশ দ্যু ও পৃথ্বী রূপে। এই অসীম হলেন অদিতি, যিনি সকল দেবতাদের মাতা, তাঁর পুত্রেরাই আদিত্য। অদিতি শব্দের মূল অর্থ অবিচ্ছিন্ন, অবিভাজ্য এবং অসীম। এই অসীম দৃশ্যতঃ অসীম, যতদূর চোখ যায় অসীম আকাশ, হিমালয়ের অসীম বিস্তার, অসীম অরণ্য ও তৃণক্ষেত্র। অসীমের এই সংজ্ঞা থেকে, মহাবিশ্বকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে, ঊর্ধতম স্তরের নাম দ্যুলোক, নিম্নতম স্তরের নাম ভূর্লোক এবং এই দুই লোকের মাঝখানে রয়েছে অন্তরীক্ষলোক। এই তিন লোকের প্রধান দেবতারা হলেন, সবিতৃ বা সূর্য দ্যুলোকের, ইন্দ্র বা বায়ু অন্তরীক্ষলোকের এবং অগ্নি হলেন ভূর্লোকের দেবতা। এই তিনদেবতাকে আবার তেত্রিশজন দেবতায় ভাগ করা হয়েছিল। অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, দ্যু এবং পৃথ্বী।
     ক) দ্বাদশ আদিত্য – দ্যুলোকের দেবতা
    ঋগ্বেদে আদিত্য ছজন, মিত্র, অর্যমা, ভগ, বরুণ, দক্ষ, অংশ। 
    অথর্ব বেদে ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে এঁরা আটজন– মিত্র, বরুণ, অর্যমা, অংশ, ভগ, ধাতা, ইন্দ্র ও বিবস্বান। 
    শতপথ ব্রাহ্মণের মতে দ্বাদশ আদিত্য হলেন, ধাতৃ, মিত্র, অর্যমান, রুদ্র, বরুণ, সূর্য, ভগ, বিবস্বত, পূষণ, সবিতৃ, ত্বষ্টা এবং বিষ্ণু।  শতপথ ব্রাহ্মণে এই বারো জন আদিত্য, বারোমাসের দেবতা।
    হরিবংশ পুরাণে আদিত্যের বর্ণনা একটু আলাদা রকম, - ঋষি ত্বষ্টার কন্যা সংজ্ঞা, সূর্যের প্রচণ্ড তেজ সহ্য করতে না পারায়, কন্যার প্রতি স্নেহবশতঃ, ত্বষ্টা সূর্যকে বারোটি খণ্ডে বিভক্ত করেন, বারো মাসে বারোটি আদিত্য-সূর্যের উদয় হয়, যেমন মাঘে অরুণ, ফাল্গুনে সূর্য, চৈত্রে বেদজ্ঞ, বৈশাখে তপন, জৈষ্ঠে ইন্দ্র, আষাঢ়ে রবি, শ্রাবণে গভস্তি, ভাদ্রে যম, আশ্বিনে হিরণ্যরেতাঃ, কার্তিকে দিবাকর, অঘ্রাণে চিত্র (বা মিত্র) ও পৌষে বিষ্ণু।
    খ) অষ্টবসু – অন্তরীক্ষ দেবতা।
    বৈদিক মতে আটজন বসু হলেন, ধব, ধ্রুব, সোম, আপ, অনিল, অনল, প্রত্যূষ ও প্রভাস।
    মহাভারতের (আদি/৬৬ ) অষ্টবসু হলেন, ধব, ধ্রুব, সোম, অহঃ, অনিল, অনল, প্রত্যূষ ও প্রভাস।
    অন্তরীক্ষ স্তরের প্রধান দেবতা হলেন ইন্দ্র বা বায়ু, তাঁর অন্যান্য রূপ হল মরুৎ এবং মাতরিশ্ব। নিরুক্ত মতে, এই স্তরের দেবতারা হলেন, ইন্দ্র, বায়ু, অষ্টবসু, যম ও যমী, অশ্বিনীকুমার যুগল। এ ছাড়াও এই স্তরের দেবতা হলেন বিশ্বদেব – যিনি বৃষ্টির দেবতা। দেবী ঊষস (ভোর) দ্যুলোক ও অন্তরীক্ষের মধ্যে সংযোগরক্ষা করতেন। ঋভুরা আগে মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাদের সুকীর্তির জন্যে তাঁরা দেবতা হয়ে এই স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
    গ) একাদশ রুদ্র – ভূর্লোকের দেবতা
    বেদে একদশ রুদ্রের নাম খুব স্পষ্ট করে পাওয়া যায় না। মহাভারতের (আদি/৬৬) একাদশ রুদ্র হলেন, মৃগব্যাধ, সর্প, নির্‌ঋতি, অজৈকপাদ, অহি, বুধ্ন, পিনাকী, দহন, কপালী, স্থাণু ও ভর্গ। ভূর্লোক বা পৃথ্বীলোকের প্রধান দেবতা ছিলেন, অগ্নি। বেদে ইন্দ্রের পরেই অগ্নির প্রধান স্থান। ঋগ্বেদের শুরুই হয়েছে, অগ্নির উপাসনার শ্লোক দিয়ে, যার উল্লেখ দ্বিতীয় পর্বে করেছি। অগ্নির আরেক নাম রুদ্র, এই রুদ্রেরই একাদশ রূপে প্রকাশ ঘটেছে।

    এতগুলি দেবতার নাম থাকলেও ঋগ্বেদের ছেচল্লিশতম মন্ত্রে, ঋষি দীর্ঘতমস বলেছেন, “একম্‌ সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি” – অর্থাৎ সত্য একটাই – কিন্তু ঋষিরা নানা নামে বলেন”। নিরুক্তকার যাস্কও একই কথা বলেছেন, ঈশ্বর এক - তিনিই পৃথ্বীস্থানে অগ্নি, অন্তরীক্ষস্থানে ইন্দ্র এবং দ্যুস্থানে তিনিই সবিতৃ। এই একমাত্র দেবতা বা ঈশ্বরকে বলা হয়েছে – হিরণ্যগর্ভ।

    এ ছাড়াও আরও কিছু দেবতার নাম পাওয়া যায়, যেমন সোম, মধু, অশ্বিন প্রমুখ।

    সোম দেবতাকে চন্দ্র এবং সোম[14]রস দু ভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। সোম যখন চন্দ্রদেব, তিনি দুই হাতেই অস্ত্র চালনা করতে পারতেন এবং যুদ্ধের সময় তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের সারথি হতেন। কিন্তু সোম দেবতা যখন সোমরস তখন ব্যাপারটা অত্যন্ত রসসিক্ত হয়ে উঠত।

    খুব নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও, এক ধরনের লতানে উদ্ভিদ থেকে সোমরস বানানো হত এবং বিশেষ ওই লতাকেই বলা হত সোমলতা। যজ্ঞের সময় এবং যজ্ঞ সমাপ্তিতে এই পবিত্র রস পান অবশ্য কর্তব্য ছিল। এবং এই রস পান করে যে আশ্চর্য অনুভূতি মিলত, তার আভাস ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১১৯ সূক্তে দেবরাজ ইন্দ্রর কথায় আমরা বুঝতে পারি। আমরা কলির মানুষরা পবিত্র সোমরসে বঞ্চিত, কিন্তু ভাঙ বা সিদ্ধির শরবতেও এমন অভিজ্ঞতার আমেজ অনুভব করা যায় বৈকি, যেমন,   
    “দমকা বায়ু যেমন গাছকে দোলায়, সোমরস পান করে আমিও তেমন দুলছি, আমি বড্ডো সোম পান করেছি”। (১০/১১৯/২)
    “দামাল ঘোড়া যেমন রথকে ওড়ায়, আমিও তেমন উড়ছি, আমি বড্ডো সোম পান করেছি”।  (১০/১১৯/৩)
    “আমার এমনই ক্ষমতা, যদি বল, এই পৃথিবীকে এক স্থান থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে পারি, আমি বড্ডো সোম পান করেছি”। (১০/১১৯/৯)
    “এই পৃথিবীকে আমি দগ্ধ করতে পারি, যে স্থান বল সে স্থান ধ্বংস করতে পারি, আমি বড্ডো সোম পান করেছি”। (১০/১১৯/১০)
    “আমার একপাশ আছে আকাশে, আরেক পাশ পৃথিবীতে, আমি বড্ডো সোম পান করেছি”। (১০/১১৯/১১)
    “আমি মহতেরও মহৎ, আমি আকাশ ঠেলে উঠেছি, আমি বড্ডো সোম পান করেছি”। (১০/১১৯/১২)[15]
      
    অশ্বিন নামের যুগল দেবতার নাম পাওয়া যায়, যাঁর সম্বন্ধে খুব স্পষ্ট জানা যায় না। তবে যজ্ঞ অনুষ্ঠানে রীতি ও প্রথা প্রকরণ থেকে জানা যায়, অগ্নি সকল দেবতার মুখ, তিনিই যজ্ঞের হবি গ্রহণ করে, সকল “হবির্ভাজ” অর্থাৎ যজ্ঞভাগ দেবতাদের পৌঁছে দেন। সোম এই যজ্ঞ প্রথার দেবতা, মধু জ্ঞানের দেবতা, অশ্বিন মধুর সঙ্গে যুক্ত এবং ইন্দ্র যুক্ত সোমের সঙ্গে।

    চলবে...
    পঞ্চম পর্বের তৃতীয় অধ্যায় আসবে ৩০/০৮/২২ তারিখে।

    গ্রন্থ ঋণঃ
    ১. স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত উপনিষদ্‌ গ্রন্থাবলী – দ্বিতীয় খণ্ড (ছান্দোগ্যপনিষদ্‌) (উদ্বোধন কার্যালয়)।
    ২. স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত উপনিষদ্‌ গ্রন্থাবলী – প্রথম খণ্ড (কেনোপনিষদ্‌) (উদ্বোধন কার্যালয়) – সরল বাংলা অনুবাদ লেখক।
    ৩. শ্রীযুক্ত রমেশ চন্দ্র দত্ত কৃত ঋগ্বেদের বাংলা অনুবাদের সরল রূপান্তর - লেখক । 

    [1] এই শ্বেতকেতু ও তাঁর পিতা  আরুণি বা উদ্দালকের কথা আমরা আগেই জেনেছি ২.৫.৩ অধ্যায়ে – এই শ্বেতকেতুই আর্য সমাজে নারীপুরুষের যথেচ্ছ মিলনের অবসান ঘটিয়ে, বিবাহ প্রথার প্রচলন করেছিলেন।  

    [2] হৈমবতী শব্দের দুটি অর্থই সম্ভব – প্রথমটির উৎস হেম অর্থা সোনা – অতএব স্বর্ণালংকার ভূষিতা। আবার হিম মানে তুষার – অর্থাৎ হিমালয় কন্যা হিসেবেও হৈমবতী শব্দ নিষ্পন্ন হতে পারে।  

    [3] এখানে সংস্কৃত শ্লোকটি তুলে দিই, যার থেকে উমাকে উপনিষদের ঋষি ঠিক কী ভাবে বর্ণনা করেছেন, বোঝা যাবে, “স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়মাজগাম বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীম্। তাং হোবাচ কিমেতদ্ যক্ষমিতি”। সন্ধি বিচ্ছেদ করলে, কিছুটা সহজ হবে – সঃ তস্মিন্‌ এব আকাশে স্ত্রিয়ম্‌ আজগাম বহু শোভমানাম্‌ উমাম্‌ হৈমবতীম্‌।

    [4] উদাহরণে বলা যায়, নিষাদ রাজপুত্র একলব্যের ঘটনাটির বিবরণ মহাভারতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।     

    [5] শ্রোত্রিয় - বেদজ্ঞ।

    [6] পরীবাদ বা পরিবাদ – পরনিন্দা, অপবাদ (শব্দকোষ)।

    [7] আবপনকারী–দেবতর্পণকারী, নিবপনকারী - পিতৃতর্পণকারী, প্রতিষ্ঠমান–যশ বা প্রতিপত্তি লোভী। (শব্দকোষ)।

    [8] এই প্রশ্নগুলি ধর্ম সম্পর্কে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক – কিছুটা কুইজ কনটেস্ট ধরনের – অতএব অনুমান করা যায় অবান্তর এই প্রশ্নগুলি প্রক্ষিপ্ত।  

    [9] দাক্ষ্য – ১. দক্ষভাব, কৌশল, পটুতা; ২. কর্মোৎসাহ, উৎসাহ। (শব্দকোষ) এক্ষেত্রে কর্মোৎসাহ, উৎসাহ অর্থই যুক্তিযুক্ত।

    [10]ধন্য – ধনবান বা ধনলাভকারী; সুকৃতী, পুণ্যবান। (শব্দকোষ)

    [11] আর্জব – ১. ঋজুভাব, অবক্রতা; ২. সরলতা, অকপটতা, প্রতারণারাহিত্য; ৩. বিনয়গ্রাহিতা, বিনীতভাব। (শব্দকোষ)। এক্ষেত্রে অকপটতা ও প্রতারণারাহিত্য অর্থটিই মনে হয় উপযুক্ত।

    [12] আনৃশংস্য–অনৃশংসভাব, অহিংস্রতা; পরের দুঃখে দুঃখিত, অনুকম্পা। (শব্দকোষ)

    [13] জন্ম থেকেই প্রতিটি মানুষ পঞ্চঋণে ঋণী – পাঁচটি ঋণ হল দেবঋণ, ঋষিঋণ, পিতৃঋণ, নৃঋণ ও ভূতঋণ। এই পাঁচটি ঋণ থেকে মুক্তির উপায় জীবনে পঞ্চযজ্ঞের আচরণ ও অনুষ্ঠান।     

    [14] সোমরস – সোমলতার রস, উৎকৃষ্ট মাদক - উত্তর ভারতের হিমালয়ের বনভূমিতে এককালে পাওয়া যেত, এখন অবলুপ্ত।

    [15] ঋগ্বেদের বাংলা অনুবাদ – শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত (আধুনিক বাংলায় রূপান্তর - লেখক)।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১৪৮৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীপ | 42.***.*** | ২৪ আগস্ট ২০২২ ১১:১১511309
  • উফ, আবার গুলিয়েছেন। ব্রহ্ম আর ব্রহ্মা এক নয়! 
    ব্রহ্ম অনির্বচনীয়। এই ব্রহ্মের যখন প্রকাশিত হবার ইচ্ছা হয়, তখন তিনি হিরণ্যগর্ভ। এই সগুণ ব্রহ্মের সৃজনীশক্তি ব্রহ্মা, স্থিতিশক্তি বিষ্ণু, সংহারশক্তি রুদ্র।
    আর ব্রহ্ম‌ই তো পরম সত্য,  ব্রহ্মের শক্তিতেই তো ইন্দ্র, বায়ু, অগ্নি প্রভৃতি দেবকুল শক্তিমান। এই কাহিনীর মধ্য দিয়ে এই দার্শনিক তত্ত্ব‌ই প্রকাশিত হয়েছে।
  • দীপ | 42.***.*** | ২৪ আগস্ট ২০২২ ১১:৩৩511310
  • এরপর ভারতীয় দর্শন আরো বিবর্তিত হয়েছে। বৈষ্ণবরা পরম সত্য কে বিষ্ণু/কৃষ্ণ রূপে গ্রহণ করেছেন, শৈবরা শিবরূপে উল্লেখ করে উপাসনা করছেন। এইভাবে ভারতীয় দর্শনের সগুণ ব্রহ্মের উপাসনার ভিন্ন ভিন্ন শাখা সৃষ্টি হয়েছে।
  • দীপ | 42.***.*** | ২৪ আগস্ট ২০২২ ১১:৪০511311
  • আচ্ছা, বুদ্ধ বা অশোককে কে বুদ্ধু বলেছ? জানতে বড়োই ব্যাকুল হয়েছি।
  • দীপ | 42.***.*** | ২৪ আগস্ট ২০২২ ১১:৪৭511312
  • আর কেনেপোনিষদের এই কাহিনী শক্তিবাদের অন্যতম আদিম প্রকাশ। উমা ব্রহ্মবিদ্যাস্বরূপিণী, অর্থাৎ উমাই ব্রহ্ম। অব্য‌ক্ত ব্রহ্ম উমার দ্বারাই প্রকাশিত হয়। উমাই এই অব্যক্ত সত্যের ব্যক্ত রূপ। 
    শক্তিবাদের মূল সত্য এই কাহিনীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। 
  • Kishore Ghosal | ২৪ আগস্ট ২০২২ ১৯:৩৮511318
  • দীপবাবু, পড়ে মন্তব্য দেওয়ার জন্যে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। 
  • Sara Man | ২৭ আগস্ট ২০২২ ০৭:৩১511391
  • কিশোরবাবু, আপনি একদম ঠিক কথাই বলেছেন যে মহাভারতে অনার্য জাতিরা প্রাপ‍্য সম্মান পায়নি। হিড়িম্বা, ঘটোৎকচ, উলুপী, চিত্রাঙ্গদা এর উদাহরণ। কিন্তু আমার মনে দুটি প্রশ্ন আছে। নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি যে অবহেলার পরম্পরা আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি, তা কি কিছুটা হলেও মহাভারতের উত্তরাধিকার? 
    দ্বিতীয় হল, রামায়ণে তো নিষাদরাজ গুহক, বানর রাজ‍্য গুরুত্ব পেয়েছে, যদিও তাদের ভূমিকা আর্য অনুগামী ভক্তের। তবে ওখানে রাবণ চরিত্রটিও নানা রঙে বর্ণিল। 
    আর মহাভারতে আমার মনে হয় নগর কেন্দ্রিকতা খুব স্পষ্ট। রামায়ণে মহাভারতের মতো অত তীব্র নয়। দুই মহাকাব্যে দৃষ্টিভঙ্গির এমন তফাৎ কেন হল, আমি জানতে চাই। 
  • Sara Man | ২৭ আগস্ট ২০২২ ০৮:১২511392
  • রামায়ণ দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত অনার্য কে হারিয়ে আর্যের জয়ের আখ‍্যান আর মহাভারতের যুগে অনার্য অলরেডি পায়ের তলায়, এবারে আর্যদের গোষ্ঠীদন্দ্ব আর আধিপত্য বিস্তারের লড়াই হচ্ছে - ব‍্যাপারটা কি এতটাই সরল? নাকি এর মধ‍্যে আরও কিছু আছে, সেটা আমি বুঝতে চাইছি। 
     
    মনোজ মিত্রের একটি নাটক হয়েছিল - শূদ্রায়ণ, যেখানে দেখানো হয়েছিল - আর্যরা কীভাবে শক্তিশালী ও স্বাধীন অনার্যদের শূদ্র নাম দিয়ে নিজেদের সমাজভুক্ত করছে এবং  অধিকারহীন ভৃত‍্যে পরিণত করছে। এই কনসেপ্ট যদি সত‍্যি হয়, তবে অনার্য হনুমানকে বায়ু দেবতার সঙ্গে জুড়ে দেবতা তৈরি করতে হল কেন? 
    আর একটা কথা হল, তেত্রিশ দেবতা তেত্রিশ কোটিতে পরিণত হল, আর ধীরে ধীরে দেবীরা প্রধান হয়ে উঠতে লাগলেন, আবার এক এক ভৌগোলিক এলাকায় এক এক দেবতার দাপট এটারই বা কারণ কী? 
  • Sara Man | ২৭ আগস্ট ২০২২ ০৮:৪৭511393
  • দুঃখিত একটু ভুল হয়েছে মনোজ মিত্র করেছিলেন 'যা নেই ভারতে' আর শূদ্রায়ণ সম্ভবত সংলাপের। 
  • Sara Man | ২৭ আগস্ট ২০২২ ০৮:৪৯511394
  • ... কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের। টাইপ ঠিক করা যাচ্ছে না। 
  • Kishore Ghosal | ২৭ আগস্ট ২০২২ ১২:৩৮511396
  • @ শারদা ম্যাম, 
    " নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি যে অবহেলার পরম্পরা আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি, তা কি কিছুটা হলেও মহাভারতের উত্তরাধিকার"? কিছুটা কেন, পুরোটাই। তবে একা মহাভারতকে দোষ দিয়ে লাভ কি? এটা আমাদের উচ্চবর্ণীয়দের স্বাভাবিক চরিত্র - অথবা বলা ভালো মানুষের স্বভাব। আজকাল নিম্নবর্ণের মানুষরাও উচ্চপদে আসীন বা  ধনাঢ্য হলে মানসিকতা আমূল বদলে যায় - তারা নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে একই ভাবে অবহেলা ও বঞ্চনা করে - গালাগাল দেয়। এ আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখা। 
     
    রামায়ণের দক্ষিণ-সমুদ্র পর্যন্ত বিজয়াভিযান নিয়ে কোন মন্তব্য করব না। আর "মহাভারতের যুগে অনার্য অলরেডি পায়ের তলায়", - একথা ঠিক, তবে শুধুমাত্র  আর্যাবর্তের অনার্যরা,  সমগ্র ভারতভূমির নয়।  মহাভারতের কয়েকশ বছর পর থেকেই অনার্যদের উত্থান শুরু এবং তখন থেকেই ব্রাহ্মণ্য এবং পৌরাণিক গ্রন্থগুলির মতে কলিযুগেরও শুরু অর্থাৎ তাঁদের মতে সামাজিক অধঃপতনেরও শুরু।  
     
    পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে বিষয়গুলি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।    
     
  • Kishore Ghosal | ২৭ আগস্ট ২০২২ ১২:৪৪511397
  • শারদা ম্যাম, 
    একটু অন্য প্রসঙ্গ - "... কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের। টাইপ ঠিক করা যাচ্ছে না" লিখেছেন। কুন্তলবাবু কি গুরুচণ্ডা৯-টিমের পরিচালক? 
     
    আসলে গুরুচণ্ডা৯-টিমের কারোর সঙ্গেই আমার সঙ্গে পরিচয় নেই। ওঁদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং আমার একটি অনুরোধ নিয়ে একটা মেল পাঠিয়েছিলাম, দিন দশেক হল। তার কোন উত্তর পাইনি। তাই এই জিজ্ঞাসা। 
  • Sara Man | ২৭ আগস্ট ২০২২ ১৬:২৭511399
  • না না শূদ্রায়ণ কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের লেখা। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন