এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • নকশিকাঁথা (২৫)

    বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৮ জানুয়ারি ২০২২ | ১৭৪৩ বার পঠিত
  • নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়


    ১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।


    বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।

    ২৫


    বেলাসিও থিয়েটারে রুথ আর আক্রামের নাচের বাকি আর ক’টা দিন। সিলেটের জেলে আক্রাম, জাল দিয়ে মাছ ধরেছে। তারপর এসএস গোর্খায় লস্কর হয়ে আগুনে আঁচ বানিয়েছে। কিন্তু নাচ?

    দিনের পর দিন কসরত চলছে। বিছানায় নরম রুথ; নাচতে নেমে তেমনি শক্ত আর কাজপাগল। মুখ খারাপ করতেও ছাড়ে না। এর থেকে জাহাজের ফার্নেসে আগুন ঠেলা ঢের সহজ ছিল। সেসব ভুলেও যায়, যখন নাচ ঠিকঠাক হলে আক্রামের কোলে শুয়ে রুথ তার বাদামি চোখে বিদ্ধ করে দেয়। রুথের শাসনে বশ্যতা স্বীকার করাটা সহজ হয়ে যায়। এছাড়া এই বিদেশে তার উপায়ও খুব বেশি ছিল না।

    রুথ প্রথমে আক্রামকে শিখিয়েছে বিভিন্ন ধারার নাচের হরেক মারপ্যাঁচ। শেখা সহজ ছিল না, ধামাইল ছাড়া অন্য কোনো নাচে কখনো কি গিয়েছে আক্রাম? শিখছিল একটু একটু করে। রুথের সব নাচই খুব দ্রুতগতির, সারা জীবন নাচ করছে, নিপুণ। এই ক’দিনে আক্রাম অমন পারবে কেন? মুখে রাগ দেখালেও সেটা রুথ বোঝে, সেইভাবেই নাচের তর্জা হচ্ছিল। কিন্তু গানের সঙ্গে নাচের জন্য, গানটাও শুনে শুনে চলতে হবে। ওইখানে আক্রাম নেহাতই কাবু। জাহাজে সব দেশের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করতে করতে ইংরাজি দু’চার কথা বলে ফেলে, সেও অনেক হোঁচট খেয়ে। কষ্ট করে রোজদিনের কথা বুঝেও যায়। কিন্তু গানের সময় সেটা বড্ড কঠিন, শব্দগুলো এমন ঘুরপাক খায়, ধরার আগেই বাতাসে সাঁতরে বেরিয়ে যায়। যেমন গানের শুরুতে আছে –
    In the land of Hindustan
    There lived a Hin-doo fakir man...

    আক্রাম ফকির সেজে একেবারে মধ্যিখানে ধ্যানে বসেছে। রুথ তাকে ঘিরে একপাক নেচে পিছনপানে চলে যাচ্ছে। প্রথমে রুথের ডান পা একেবারে সোজা উপরে করে ফকিরের মাথার উপর দিয়ে যেন ভেসে আসছে। যেই না পরের লাইন দুটো হচ্ছে –
    And the tricks he displayed
    Had won a lit-tle Hindoo maid...

    ট্রিক শব্দটা হওয়ার সময়ে রুথ লাফ দিয়ে চলে যাবে আক্রামের মাথার উপর দিয়ে, ডান পা একেনারে সামনে ছড়ানো, বাঁ পা একদম পিছনে। সেই অবস্থায় ধ্যানস্থ ফকির তার দুই হাত মাথার উপরে তুলে শূন্যে ভাসমান মেয়েকে ধরে ফেলবে আর রুথ সেই অবস্থান থেকে আক্রামের কাঁধে নেমে দুই পা সামনে ঝুলিয়ে দেবে। আর যেই পরের লাইনে গাইবে,
    Ev’-ry night they’d sit and spoon
    Beneath the oriental moon...

    আক্রাম তড়াক করে দাঁড়িয়ে নিজে এক পাক দেবে আর তার কোমরে পা জড়িয়ে শূন্যে শরীর ভাসিয়ে নাচবে রুথ।

    এই নাচ আয়ত্ত করতে আক্রাম নেহাতই কাবু। সোজা নাকি? সবচেয়ে মুশকিল – ট্রিক শব্দটা যদি সময়মত বুঝে হাত উপরে তুলে পিছন থেকে আসা রুথকে না ধরে ফেলে, সে বেচারার জান যায় যায়! হয়েছিলও তাই।
    প্রথম প্রথম নাচের এই অভ্যাসের সময় আমান্ডা সামনে দাঁড়িয়ে হাতে তালি দিত, আর আক্রাম সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে রুথকে ধরে ফেলত। কিন্তু মঞ্চে কি আর সামনে আমান্ডা থাকবে? তাই তাকে ছুটি দিয়ে রুথ বলেছিল, ক্রাম, আমার জীবন তোমার হাতে, মনে থাকে যেন। কিন্তু শব্দটা ধরতে ধরতেই রুথ তার মাথা ছাড়িয়ে পেরিয়ে যায় আর কি। একেবারে শেষ মুহূর্তে আক্রাম ধরে ফেলেছিল, কিন্তু রুথ তার কাঁধে না এসে, পড়ল একেবারে কোলে। রুথের মুখে দুটো গালি শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিল আক্রাম। ব্যাথা লাগেনি নিশ্চয়, তা না হলে এমন খিলখিল করে হাসবে কেন। আসলে এ’রকম হতে পারে বুঝে নিজের শরীরকে প্রস্তুত রেখেছিল, বোকা মেয়ে সে নয়। তার লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে আক্রামের গালে ঠোনা মারল, ক্রাম, আমার হিন্দু ফকির, আমার শিরদাঁড়াটা কি ভাঙবেই ঠিক করেছ?
    আক্রামের মুখ কাঁচুমাচু। রাগ করলে রুথ? ইংরাজি গান তো, শব্দগুলো সময় মত ধরতে পারছি না মোটে।
    ট্রিক তো তুমি জানো ক্রাম, আমি রাগতে পারলাম কই! বলে দুই হাতে আক্রামের গলা জড়িয়ে নিজের নরম ঠোঁট আক্রামের দাড়ি-গোঁফের মাঝখানে দ্বীপের মত জেগে থাকা ঠোঁটের একদম কাছে নিয়ে এসে বলল, এবার গাও আমার সঙ্গে সঙ্গে।

    আক্রামের গলা নেই কোনো গানের, তাও আবার এই ইংরাজি গান। কথাগুলো শিখিয়েছে রুথ, সে গাইছিল ফিসফিস করে। রুথ চোখ পাকাল, নেহাত দু’চোখে আমোদের ফুলঝুরি বজায় ছিল। একদম গলা ছেড়ে আমার সঙ্গে গাও দেখি, তবেই শব্দগুলো মাথায় থাকবে। চোখে ঝিলিক দিল রুথের, এমন ভাবে মুখ খুলে গাইবে যেন ওঠাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার ঠোঁট আমার ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। বুঝলে হিন্দু ফকির। তর্জনী দিয়ে আক্রামের মাথায় ঠোকা মেরে খিলখিল করে হেসে উঠল।

    চকমকি পাথরে ঘষা খেলে আগুন জ্বলতে কতটা সময় লাগে আর? আক্রাম রুথকে দু’হাতে জড়িয়ে কাছে টানার চেষ্টা করতেই রুথ মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। উঁহু, ফকিরের এত তাড়াতাড়ি সাহস ভাল নয়, গানের লাইনটা মাথায় রাখো ক্রাম,
    Brim-full of glee she thought that
    He would – a pop the question soon
    But his courage quickly fled...

    বুঝলে হিন্দুম্যান, তুমি এখনো অতদূর এগোওনি যে। বলতে বলতেই রুথের কপালে ভাঁজ পড়ল আর মুখ হাসিতে ভরে উঠল। এই বেশ হয়েছে। নাচের এই জায়গায় আমি তোমার কোমরে দুই পা জড়িয়ে আমার মুখ তোমার একদম ঠোঁটের কাছে নিয়ে গাইব আর তুমি মাথাটা সরিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাবে। আমি বারবার সাপের মত দুলে দুলে মাথা এগিয়ে আনব, আর তুমি মাথা সরিয়ে নিতে থাকবে। আমি গাইব,
    So the maiden softly said
    My Hindoo man is a prize
    And he can hypnotize
    Resist those hypnotic eyes
    I never can...

    পারবে না?
    রুথের কাছে না পারা শব্দটা চলে না, সেটা এতদিনে আক্রাম জেনে গেছে। সুতরাং যা থাকে কপালে বলে চেষ্টা করতে লেগে গেল।

    এরপরে কোরাস –
    If he would just name the day
    And with me trip – trip away
    Why I’d say hip hip hur–ray
    My Hindoo man, my Hindoo man...

    এখানে আক্রামের জন্য শান্তি। সে আবার ফকির সেজে ধ্যানস্থ। রুথ একাই নাচছে, কিন্তু আগে অন্য মেয়েদের সঙ্গে যেমন নাচত, সে’রকম আর নয়। আক্রামের যদিও ধ্যানে চোখ বন্ধ করে রাখার কথা, রুথকে প্রায় হাওয়ায় ভেসে থাকতে দেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কোথাকার কোন গ্রামের ছেলে আক্রাম, আর কোথায় এই সুন্দরী নর্তকী রুথ। কি করে এসে পৌঁছাল সে? মাঝে মাঝে নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করে। এসব কি সত্যি হচ্ছে? এই যে মেয়েটা টানা টানা চোখের বাদামি তারায় ঝিকমিক, হাওয়ায় সোনালি চুল উড়ছে, মাজা পেতলের মত চকচকে শরীর, সে শূন্যে পাক মারতে মারতে তার পা উপরে তুলে দিয়েছে, চোখে রেখেছে তার চোখে। আক্রামের নসিবে এমন কী করে হল?

    প্রচণ্ড হাততালির মধ্যে রুথ তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল মাটিতে ছুঁইয়ে, বাঁ হাত এক কোমরে, ডান হাতের তর্জনী ফকিরের মাথায় রেখে, এক পাক ঘুরে সামনে এসে দাঁড়াল গানের সঙ্গে। যদিও চোখ দর্শকের দিকে আর সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুখে ব্যঙ্গের হাসি টেনে গাইল,
    Now this hindoo maiden
    Fair, she told the Hindoo fakir man
    There, ‘At your tricks,
    You’re great I know
    But as a lover you are slow…

    বেলাসিও থিয়েটারের এই শো-তে সেদিন মহা উত্তেজনা। দর্শকদের আর আটকে রাখা যাচ্ছে না। এর পরের দৃশ্যটাই মারাত্মক। বারলেস্ক থিয়েটারে এমন আমোদের নাচ এর আগে কোনোদিন হয়নি। কিন্তু এই অংশে নাচের জন্য আক্রামকে অনেকদিন কসরত করতে হয়েছিল। যেমন যেমন গানে কথা এগিয়েছে,
    Then the Hindoo man grew brave
    And swore that he would be her slave...

    আক্রাম রুথকে কোমরে ধারণ করেছে, রুথের একশ’ গজের স্কার্টের মেঘাবরণ থেকে বেরিয়ে নাচের বিভঙ্গে দুই পা ফকিরের কোমরে জড়ানো, আক্রামের আলখাল্লা উড়ছে বাতাসে, তার পেটানো শরীরের প্রশস্ত বুক, তার শিশ্নের উষ্ণতা রুথকে স্পর্শ করছে – তার আকাশপানে উঠিয়ে দেওয়া বাঁ পায়ের সমান দৃঢ়তায়।
    His arm he placed around her waist
    And a kiss to her he gave
    But he hadn’t had a slave
    And she told him to behave...

    পলক পড়তে পড়তে বস্ত্রাবরণে দু’জনে আবার ঢেকে গেল আর হাওয়ায় ভাসমান রুথের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আক্রাম দিল চর্কিপাক।

    বারলেস্ক থিয়েটার উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিল, থরথর করে কাঁপছিল প্রেক্ষাগৃহ, ছাদের থেকে ঝাড়লন্ঠন এই খুলে পড়ে বুঝি। বাতাসে উড়ছিল মাথার থেকে ছেড়ে দেওয়া টুপি, কারুর গুলি পাকিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া ডলারের নোট, সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়া উল্লাস। আক্রাম রুথকে হাওয়ায় ছুঁড়ে দিতেই, সে ডান পায়ের তর্জনীতে ভর করে মঞ্চে অবতরণ করে, তার প্রথাগত ভঙ্গিতে মঞ্চের সামনের ভাগে এসে পা তুলে দিল আকাশপানে, আর একই ঘূর্ণিটানে সবার চোখের দৃষ্টি টেনে নিয়ে ভেসে গেল মঞ্চের পিছনে। নাচের এই শেষ অংশে এসে দর্শককে সেই দুই মুশকো পাহারাদার আর আটকে রাখতে পারে না মোটে।
    My Hindoo man is a prize
    And he can hypnotize
    Resist those hypnotic eyes
    I never can
    If he would just name the day
    And with me trip trip away
    Why I’d say hip hip hur –ray
    My Hindoo man, my Hindoo man...

    আগে কোনোদিন নাচে এমন মাতোয়ারা হয়নি হে মার্কেটের দর্শক। হে মার্কেটে আসা যত মদ্যপ, নারীসঙ্গ-কামনায় উদ্বেল দর্শক – বারবার এই নাচ দেখার জন্য ভিড় করে এল।

    রুথ যেমন বলেছিল তাই হয়েছে। মঞ্চের বাইরে আসতেই আন্তোনিওর মুখে হাসি আর ধরে না। কেয়াবাত ক্রাম, বেশ নাচলে যা হোক। সবাই তো এই নাচ দেখার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে, একবার বেরিয়ে আবার টিকিট কাটতে ছুটেছে। সবুজ নোটে জেব ভারি হওয়ায় আন্তোনিওর আহ্লাদ হু হু করে বেড়ে গেছে।
    কেদারায় দুই পা ছড়িয়ে বসে রুথ দম নিচ্ছিল। ফোঁস করে উঠল এবার, তবে না বলেছিলে একটা উটকো লোক মঞ্চে ঘুরে বেড়াবে, লোক টানতে পারবে না।
    হেঁ হেঁ করে হাসল আন্তোনিও, নাচের ব্যাপারে রুথের থেকে ভাল কেই বা বোঝে। আমি তখনই জানতাম, তোমার মাথায় নিশ্চয় কিছু খেলেছে। না হলে নাম-না-জানা কোনো দেশের এক লস্করকে নিয়ে নাচতে নামবে কেন।

    চুপ কর বেলুজ্জে, ঘাটের মড়া। এখন মুখ দিয়ে ফুলঝুরি বেরোচ্ছে। ক্রাম আমার নাচের দলের পার্টনার, কোন সাহসে ক্রামকে লস্কর বলছিস! তোর জাতভাইরা কোন পথে এসেছিল এ’দেশে? মেয়েমানুষের ব্যবসা করে তবে খুলেছিস থিয়েটার, রুথ জানে না তোর হাঁড়ির খবর! ঝেঁঝে উঠল রুথ। এখন আন্তোনিও টাকা কামাচ্ছে, ওকে যা খুশি বলে মুখের সুখ করে নেওয়ার এমন সুযোগ কেন ছাড়বে?

    আন্তোনিও তেমনি ধুরন্ধর। অনেক লোক চরিয়ে খেতে হয় তাকে। রাগলে চলবে কেন? দুধ দেওয়া গরুর চাট খাওয়ার অভ্যেস যেমন আছে, আবার গরু বুড়ো হলে কসাইগিরি করতে ছাড়বে না। এখন টাকার গন্ধে বুঁদ, এ’সব কথা ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। মিঠে রসে কিড়কিড়ি গলায় বলল, আচ্ছা, আচ্ছা সব ঠিক আছে। লোকে হুড়হুড় করে ঢুকছে দেখ গে যাও। চারজনের নাচ চলছে, হলেই আবার হিন্দু ফকিরের নাচ। তোমরা দম নিয়ে নাও।

    আক্রাম কিছুই বলেনি; ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল। সে যে মঞ্চে রুথকে ফেলে না দিয়ে নাচ শেষ করতে পেরেছে, তাতেই খুশি। নাচ ভাল হয়েছে কি খারাপ, সেটা বোঝার মত অবস্থায় নেই। রুথের ভাল লাগলেই হল। রুথকে সেটা জিজ্ঞেস করতেই, বুড়ি আমান্ডা তড়বড় করে উঠল। সে পরের নাচের জন্য আবার রুথের প্রসাধন ঠিক করে দিচ্ছিল। আমান্ডার একটা দাঁত সোনা বাঁধানো, সেটা ঝিকমিক করে উঠল খুশিতে, এক্কেরে ঝামা ঘষে দিয়েছ ওই মিনসেটার মুখে। খুব বড় বড় কথা বলে, এখন কেমন ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল দেখলে না।

    রুথ কাপড় দিয়ে আক্রামের বুকের থেকে ঘাম মুছিয়ে দিল। তার মুখের হাসিই বুঝিয়ে দিচ্ছে সে খুশি। আক্রামের গালে হাত বুলিয়ে যখন বলল – খুব ভাল হয়েছে ক্রাম। আজ অনেকবার নাচতে হবে, যাও গিয়ে একটু বসে নাও। নাহলে পরের শোতে আর পারবে না – তার গলার স্বরে ভালবাসা ঝরে পড়ছিল। সে তখন সত্যি আক্রামের, নাচের পটুত্ব নিয়ে সবসময়ের খুঁতখুঁতে, নিজের নাচের কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত রুথ নয়।
    একদিনে এতবার নাচ, তবু পেরে গেছিল আক্রাম। শরীরটা তার শক্তপোক্ত, রক্তও নবীন। দুই-তিনটে শো হয়ে যাওয়ার পরে দর্শকের উত্তেজনাও উপভোগ করতে শুরু করেছিল। জাহাজের খোলে লোকের চোখের আড়ালে কাজ করেছে, ঘাম ঝরিয়েছে। সে ঘাম মোছানোর কেউ ছিল না, তার হাড়ভাঙা পরিশ্রমের জন্য হাততালিও দেয়নি কেউ। কিন্তু এই যে এত লোক তার সঙ্গে উঠছে পড়ছে, তার আর রুথের নাচ শ্বাসরোধ করে দেখছে, এর এক অদ্ভুত উন্মাদনা, আগে কোনোদিন পায়নি। শরীরের মধ্যে এক জোয়ার এসে যায়। সে তখন আর ছোটবেলায় সুরমা নদীতে জাল ফেলা আক্রাম নয়, জাহাজের চুল্লিতে আগুন ঠেলা নামহীন লস্কর নয়। সে বারলেস্ক থিয়েটারের নতুন তারকা ক্রাম।

    হিন্দু ফকিরের কথা মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। আন্তোনিওর মুখে হাসি আর ধরে না। নিজের থেকেই তড়িঘড়ি রুথের সঙ্গে কন্ট্র্যাক্টের টাকা বাড়িয়ে দিল। সেই টাকার থেকে কিছু রুথ যখন আক্রামের হাতে গুঁজে দিল, সে তার জাহাজে এক বছর কাজ করার টাকার থেকে বেশি ছাড়া কম নয়।
    মনের এত আনন্দ আর কাকে জানায় আক্রাম? বলল পাঁচকড়িদা-কে।
    পাঁচকড়িদাদায় কুনুদিন উঁকি দিয়া দেখছিলায় নি? দেখবার লাগি মন চায় না নি? টিকেট করি একটো দাদার লাগি?
    পাঁচকড়ির হাসি আর ধরে না। তাহলে আমার আলখাল্লা কাজে লেগেছে বল।
    এ এক জোব্বা বানাইছিলায় বটে পাঁচকড়িদাদা। চউখ জুড়াই যায়। কখনো আক্কা শরীর ঢাকিয়া আছে, কখনো খুলিয়া উবাই।

    বল কি? চোখ গোলগোল হয়ে গেল পাঁচকড়ির। আক্রামের ভাষা কিছু খটোমটো ঠ্যাকে পাঁচকড়ির কানে, তাও বাংলা তো। একটুক্ষণ বুঝি না বুঝি ভাবে তাকিয়ে থেকে বলল, কিছু নেই কেমন? উদলা গায়ে নাচো নাকি?
    ইতা মাত্র কয়ক্ষণের লাগি, নাচের কালে জোব্বা বাতাইসে ভাসি যায়।
    এত লোকের মাঝখানে শরম লাগে না? ঘন হয়ে বসে পাঁচকড়ি, এরা নয় এমন ধারা করচে ছোটকাল থিকে। তুমি পারচো?
    হা হা করে হাসে আক্রাম। সাতদিনে ছাপ্পান্নবার নেচে সে এখন মঞ্চে অভিজ্ঞ নর্তক। এমনি ভাইবতাম, লজ্জাশরম কিছু নাই নি? ইতা দেখবায় ওমনি মনে লয় পাঁচকড়িদাদা।

    আক্রাম বলে আর পাঁচকড়ি শোনে। নাচের সময় কি আক্রামের এত ভাবার কোনো সময় থাকে? তার উপর ইংরিজিতে গান, কান খাড়া করে রাখতে হয়, ওদিকে হাত-পায়ের ওঠাপড়া লেগেই আছে, সময় করে একেকটা জিনিস না হলেই তো রুথ উলটে পড়বে। কোনটা খুলছে আর কি ঢাকছে বোঝার সময় কোথায় তার? এইসব বারবার বলতে বড় ভাল লাগে আক্রামের, তাও আবার আরেকজন দেশের লোকের সামনে। এই তো সেদিন নিজে টিকিট কেটে দেখতে এসেছিল, এখন তাকেই লোকে টিকিট কেটে দেখতে আসছে। পাঁচকড়িরও শুনতে বেশ লাগে। যেন তার দেশের মাটির জয় হচ্ছে। হোক না সে টেন্ডারলয়েনের নাচের ঠেক, মদ, জুয়া আর মেয়ে মানুষের আড্ডা। কতদূর থেকে এই দেশে এসে এক ফিরিঙ্গি মেয়ের সঙ্গে আশনাই করছে, হে মার্কেটে নাম কিনেছে। পাঁচকড়ির ব্যবসাতেই লাভ হচ্ছে, এখন এমনি হিন্দু সাজার হিড়িক পড়ে যাচ্ছে আরও আরও নাচের আখড়ায়।

    তুমি একটা দেখালে ভায়া। আমরা সব এই দেশে এসে ছায়ার মত থাকি। এই বুঝি কেউ ধরে-বেঁধে আবার পাঠিয়ে দেবে আমার দেশে, ব্যবসাপত্তর সব চৌপাট করে ফেরার জাহাজে চাপতে হবে। তুমি জাহাজ পালিয়ে সবার নাকের ডগায় নেচে বেড়াচ্ছ।
    এই ভাবনাটা আক্রামের মাথায় যে আসেনি তেমন নয়। জাহাজ থেকে পালালে তিন বচ্ছর অবধি পরোয়ানা জারি থাকে। ধরতে পেলেই আবার জুতে দেবে জাহাজের চুল্লিতে। তিন বছর হতে এখনো অনেক দিন, সবে তো কয়েক মাস হল। হাসিটা ফিকে হয়ে গেল আক্রামের। সে একটা স্বপ্নের ঘোরে ছিল, পাঁচকড়ির কথা তাকে ঝটকা মেরে বের করে আনল।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৮ জানুয়ারি ২০২২ | ১৭৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • প্রতিভা | 2401:4900:1041:7e6a:0:2e:d16f:***:*** | ০৮ জানুয়ারি ২০২২ ২৩:০৫502557
  • অসাধারণ ! 
  • Ranjan Roy | ০৯ জানুয়ারি ২০২২ ২৩:১২502583
  •  অন্য এক অদেখা দুনিয়ার নিপুণ চিত্রণ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন