এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  কাব্য  তর্জমা  শুক্রবার

  • ব্রেড অ্যান্ড রোজেস - ২

    ইরফানুর রহমান
    কাব্য | তর্জমা | ০৯ জুলাই ২০২১ | ৩৫১২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ইরফানুর রহমানের ‘‘ব্রেড অ্যান্ড রোজেস’’ সিরিজ থেকে অনুমতিক্রমে নেওয়া এক গুচ্ছ অনুবাদ কবিতা।



    ৮. আমি ফিরিয়ে নেই যা কিছু আমি বলেছিলাম
    ― নিকানোর পাররা (১৯১৪-২০১৮)


    চলে যাওয়ার আগে
    শেষ ইচ্ছা তো একটা বলাই লাগবেঃ
    সহৃদয় পাঠক এই বইটি পুড়িয়ে ফেলুন
    যা আমি বলতে চেয়েছিলাম এটি মোটেও তা নয়
    যদিও এটি লেখা হয়েছিলো রক্ত দিয়ে
    (তবু) আমি যা বলতে চেয়েছি এটি তা নয়।
    কোনো নসিবই নাই যা আমারটার চেয়ে খারাপ
    আমি পরাজিত হয়েছিলাম আমার নিজের ছায়ার কাছেঃ
    আমার সমূহ বাক্য আমার ওপর শোধ নিয়েছে।
    ক্ষমা করো আমাকে, পাঠক, প্রিয় পাঠক
    যদি আমি না পারি তোমাকে ছেড়ে যেতে
    উষ্ণ আলিঙ্গনের সাথে, আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি
    অনিচ্ছুক ও বিষাদমাখা হাসি সহকারে।
    হয়তো বা এই হচ্ছি আমি
    কিন্তু আমার শেষ বাক্যটা শোনোঃ
    আমি ফিরিয়ে নেই যা কিছু আমি বলেছিলাম
    দুনিয়ার তিক্ততম অনুভূতি নিয়ে
    আমি ফিরিয়ে নেই যা কিছু আমি বলেছিলাম।

    অনুবাদকের নোটঃ কবি নিকানোর পাররা ছিলেন বিশশতকের সমান বয়সী। এই ঘটনাবহুল শতাব্দীতে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেছে, পৃথিবী ফ্যাশিস্ত ইতালি, নাৎসি জার্মানি আর সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানপতন দেখেছে। পেশাগত জীবনে পাররা ছিলেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। কিন্তু কবি পরিচয়েই আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বেশি সমাদৃত। প্রতিকবিতা বা এন্টিপোয়েম রচনার জন্য বিখ্যাত পাররা, তাতে একদিকে যেমন বিপুল প্রশংসা পেয়েছেন, অন্যদিকে নিন্দাও কুড়িয়েছেন অঢেল। তার কবিতায় যৌন অনুভূতির অকপট প্রকাশ আছে, আছে এমনকি অ্যাবসার্ডিটিও, সর্বোপরি আছে জীবনকে চেখে দেখার দুর্দান্ত সাহস। এই কবিতাটি তিনবছর আগে অনুবাদ করেছিলাম আমি, পাররা স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি শেষ করতেন ‘আমি ফিরিয়ে নেই যা কিছু আমি বলেছিলাম’ বলে, যা এই কবিতাটিকে বিশেষত্ব প্রদান করেছে।

    ৯. সমাধান
    ― বার্টোল্ট ব্রেশট (১৮৯৮-১৯৫৬)


    ১৭ জুনের অভ্যুত্থানের পর
    লেখক ইউনিয়নের সেক্রেটারি
    স্তালিন-অ্যালেতে কিছু লিফলেট ছড়িয়ে দিলেন
    যাতে লেখা ছিলো
    জনগণ সরকারের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে
    আর তা ফিরে পেতে
    তাদের প্রয়োজন হবে
    দ্বিগুণ প্রয়াসের।
    সে-ক্ষেত্রে এটাই কি
    সহজ হতো না
    যদি সরকার এই
    জনগণকে বিলুপ্ত করে দিয়ে
    তার জায়গায় নির্বাচিত করতেন আরেকটা জনগণ?
    ১৯৫৩

    ১০. বৈরুত, বিশ্বের দয়িতা
    ― নিজার কাব্বানি


    বৈরুত, বিশ্বের দয়িতা
    এক আল্লাহর সামনে স্বীকার করে নিচ্ছি
    আমরা তোমার প্রতি ঈর্ষাতুর ছিলাম
    তোমার সৌন্দর্য আঘাত করতো আমাদের
    স্বীকার করে নিচ্ছি
    দুর্ব্যবহার করেছি তোমার সাথে, ভুল বুঝেছি তোমাকে
    আর আমাদের কোনো দয়ামায়া নেই, আমরা ক্ষমাহীন
    ফুলের বদলে ছুরিকাই ছিলো আমাদের হাতে
    স্বীকার করে নিচ্ছি পরম ন্যায়পরায়ণের সামনে
    তোমাকে আহত করেছি, আহ; বিরক্ত করেছি
    তোমাকে উত্যক্ত করেছি, কাঁদিয়েছি তোমাকে
    আর আমাদের বিদ্রোহগুলো চাপিয়ে দিয়েছি তোমার ওপর

    ও বৈরুত
    তুমি ছাড়া দুনিয়াটা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়
    তোমার শিকড় হৃদয়ে কতোটা ছড়িয়েছে, এখন বুঝি
    কতো না জুলুম আমরা করেছি, এখন বুঝি
    ধবংসস্তূপের নিচ থেকে জেগে ওঠো
    এপ্রিলে বাদামবৃক্ষে আসা ফুলের মতন
    কাটিয়ে ওঠো তোমার দুঃখ
    বিপ্লব তো দুঃখের ক্ষতেই বেড়ে ওঠে
    তোমার বনগুলোর সম্মানে জেগে ওঠো,
    তোমার নদীগুলোর সম্মানে জেগে ওঠো
    গোটা মানবজাতির সম্মানে জেগে ওঠো
    জেগে ওঠো, বৈরুত!

    অনুবাদকের নোটঃ লেবানন নিয়ে আমার আগ্রহের শুরুটা Incendies দেখে। মধ্যপ্রাচ্যের এক নামহীন দেশে নাওয়াল নামে এক ক্রিশ্চান আরব মেয়ে এক ফিলিস্তিনি রিফিউজির প্রেমে পড়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়। সহজেই অনুমেয় প্রেমিকটি মুসলিম ছিলো, এবং ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর প্রেমিকার পরিবারের হাতে খুন হয়ে গিয়েছিলো, মেয়েটিও আরেকটু হলে তার পরিবারের হাতে অনার কিলিংয়ের শিকার হয়ে যেতো।

    সে মূলত তার দাদীর কল্যাণে বেঁচে যায়, কিন্তু প্রসবের পরপরই, সন্তান ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যাওয়ার আগে নিহাদের পায়ে একটা চিহ্ন আঁকে, যাতে ভবিষ্যতে ছেলেকে শনাক্ত করা যায়। বহুবছর পর দেশটির গৃহযুদ্ধের সময় একে অপরকে না চেনা মা আর ছেলের দেখা হয়, কিন্তু তারপর যা হয়, সেই ভয়াবহ বাস্তবতার সম্মুখীন হওয়ার চেয়ে পৃথিবীর যে-কোনো মা বিষ খেয়ে মরে যাওয়াটা প্রেফার করবে।

    আমার চোখে সহজে পানি আসে না, কিন্তু এই সিনেমাটা দেখে এসেছিলো, আসা অস্বাভাবিক এমনটা মনে করি না।

    Incendiesএ একটা মন খারাপ করা দৃশ্য ছিলো। ইজরায়েল-ব্যাকড ক্রিশ্চান ন্যাশনালিস্ট মিলিশিয়া মুসলিম যাত্রীতে ভর্তি বাস থামিয়ে একটা ম্যাসাকার চালিয়েছিলো, ঘটনাচক্রে যে-বাসে উঠে পড়েছিলো নাওয়াল। এক সহযাত্রী মুসলিম মহিলার একটা কন্যাসন্তান ছিলো। নাওয়াল গলায় ঝোলানো ক্রুশচিহ্নের লকেট দেখালে ওকে ধর্মের বোন জেনে মিলিশিয়ারা খুশী হয়, সে প্রাণে বেঁচে যায়। সহযাত্রী মুসলিম মহিলাটির কন্যাসন্তানকে বাঁচাতে নাওয়াল নিজের কাছে টেনে নেয়, এতে মিলিশিয়ারা মনে করে মেয়েটি বুঝি ক্রিশ্চান। কিন্তু বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যখন ওরা ব্রাশফায়ার করছিলো, তখন মেয়েটি চিৎকার করতে করতে বাসের দিকে ছুটে যায়, পেছন থেকে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয় ওর ছোট্টো শরীরটাকে। যারা গুলি চালাচ্ছিলো, তাদের আগ্নেয়াস্ত্রে সেই মহিলার ছবি ঝোলানো ছিলো, যিনি নাওয়ালের মতোই কুমারী দশায় মা হয়েছিলেন।

    বাস্তবে এই নামহীন দেশটি আসলে লেবানন, দীর্ঘদিন ধরে যা ছিলো সেকটারিয়ান সহিংসতায় জর্জরিত। ক্রিশ্চান আর মুসলিমরা পরস্পরকে অবিশ্বাসের চোখে দেখতো, সৌহার্দ্য ছিলো না শিয়া আর সুন্নীদের ভেতর, বিভাজন ছিলো সর্বব্যাপক। সেই বিভাজন উসকে দিয়ে ফায়দা লুটেছে অন্যরা, বৈশ্বিক আর আঞ্চলিক মোড়লরা, কোনো কমিউনিটিরই কম রক্ত ঝরে নি।

    আজকে লেবাননে যা হচ্ছে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। সরকারবিরোধী এই আন্দোলনে কোনো সেকটারিয়ান বিভাজন নাই, ক্রিশ্চানরা যেমন আছে তেমনি আছে মুসলিমরা, আছে শিয়া সুন্নী সবাই। এই আন্দোলনের পেছনে চালিকা শক্তি নাগরিক অধিকারচেতনা।

    ১৯৭৮এ সিরিয়ান কবি নিজার কাব্বানি লেবাননে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন, দুনিয়ার সুখীতম হতাশাগ্রস্ত মানুষেরা যে-দেশে থাকে তার রাজধানীর উদ্দেশ্যে এই কবিতাটি লিখেছিলেন, আমি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করলাম। ― ২৮ অক্টোবর ২০১৯


    ১১. আমার বাবার স্যুটকেস
    ― ওরহান পামুক



    ...আমরা লেখকেরা প্রায়শই যে-প্রশ্নটার সম্মুখীন হই, প্রশ্নকর্তাদের প্রিয় প্রশ্ন এটা, সেটা হচ্ছেঃ আপনি কেন লেখেন? আমি লিখি কারণ আমি লেখার একটা সহজাত চাহিদা অনুভব করি। আমি লিখি কারণ আমি আর দশজন মানুষের মতো স্বাভাবিক কোনো কাজ করতে পারি না। আমি লিখি কারণ আমি সে-ধরণের বইই পড়তে চাই যে-ধরণের বই আমি লিখি। আমি লিখি কারণ আমি সবার ওপর রাগান্বিত। আমি লিখি কারণ সারাদিন একটা ঘরে বসে লেখালিখি করতে আমার ভালো লাগে। আমি লিখি কারণ আমি বাস্তব জীবনের শরিক হতে পারি শুধুমাত্র এটাকে পরিবর্তন করার মাধ্যমে। আমি লিখি কারণ আমি অন্যদেরকে, সারা দুনিয়াকে, জানাতে চাই, এই ইস্তানবুলে, এই তুরস্কে, আমরা কী ধরণের জীবন যাপন করে এসেছি, এবং এখনো করে চলেছি। আমি লিখি কারণ আমি কাগজ, কলম, আর কালির গন্ধ ভালোবাসি। আমি লিখি কারণ আমি সাহিত্যে বিশ্বাস করি। উপন্যাসের শিল্পে বিশ্বাস করি। আমি এসবে অন্য যে-কোনো কিছুর চেয়ে বেশি বিশ্বাস করি। আমি লিখি কারণ এটা একটা অভ্যাস, একটা নেশা। আমি লিখি কারণ আমার মধ্যে এই ভয় কাজ করে যে না লিখলে লোকে আমাকে ভুলে যাবে। আমি লিখি কারণ লেখালিখি যে গৌরব আর আগ্রহ বয়ে আনে আমার সেটা ভালো লাগে। আমি লিখি কারণ আমি একা হতে চাই। হয়তো আমি এই কারণেই লিখি যে আমি বুঝতে চাই কেন আমি সবার ওপর, প্রচণ্ড, প্রচণ্ড, রাগান্বিত। আমি লিখি কারণ মানুষ আমাকে পাঠ করছে এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে। আমি লিখি কারণ একবার আমি একটা উপন্যাস, একটা প্রবন্ধ, একটা পৃষ্ঠা লেখা শুরু করার পর আমার সেটা শেষ করতে ইচ্ছা করে। আমি লিখি কারণ সবাই চায় আমি যেন লিখি। আমি লিখি কারণ গ্রন্থাগারের অমরত্বে, আর বইয়ের তাকে আমার বইগুলো যেভাবে সাজানো থাকে, তাতে আমার একটা শিশুসুলভ বিশ্বাস আছে। আমি লিখি কারণ জীবনের সব সৌন্দর্য আর প্রাচুর্যকে শব্দে রূপান্তরিত করা একটা উত্তেজনাকর ব্যাপার। আমি গল্প বলতে চাই বলে লিখি না। আমি লিখি কারণ আমি গল্পটা লিখতে চাই। আমি লিখি কারণ আমি সেই পূর্বাভাস থেকে পালাতে চাই যা আমাকে বলে, — যেমনটা ঘটে স্বপ্নের ক্ষেত্রে —, এমন একটা জায়গা আছে যেখানে আমাকে যেতে হবে কিন্তু যেখানে আমি কখনোই পৌঁছাতে পারব না। আমি লিখি কারণ আমি কখনোই সুখী হতে পারি নি। আমি লিখি কারণ আমি সুখী হতে চাই।...

    অনুবাদকের নোটঃ ওরহান পামুক সমকালীন তুরস্কের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিকদের একজন। তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা İstanbul: Hatıralar ve Şehir থেকে জানা যায় পামুকের দাদীজান সিরকাশিয়ান ছিলেন, আরো জানা যায় দীর্ঘাকৃতি ও রূপের জন্য অটোমান হারেমে সিরকাশিয়ান নারীদের কদর ছিল। তবে শরীরে কিছুটা সিরকাশিয়ান রক্ত থাকলেও পামুক শুধু নাগরিকত্বেই নয়, মনে ও প্রাণে তুর্কি, এবং একইসাথে বিশ্বনাগরিক। ২০০৬এ ওরহান পামুক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এই লেখাটি তাঁর নোবেল বক্তৃতার অংশবিশেষের অনুবাদ। পামুক মূল বক্তৃতাটি প্রদান করেছেন তুর্কি ভাষায়, যা তাঁর মাতৃভাষা ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যম, মূল তুর্কি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মৌরিন ফ্রিলি। আমি ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছি।

    ১২. অ্যান স্পেন্সারের তিনটি কবিতা

    ধরিত্রি, ধন্যবাদ তোমাকে
    ~~~~

    ধরিত্রি, ধন্যবাদ তোমাকে
    তোমার ভাষার সুখের জন্য
    ভূমি থেকে
    বিশেষ্যের ভেতর দিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে
    অনুভব করতে করতে
    দেখতে দেখতে
    ঘ্রাণ নিতে নিতে
    ছুঁয়ে দিতে দিতে
    পুরোটা পথ পাড়ি দিয়ে
    এটাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে
    তোমার অনেক পরিশ্রম গেছে
    — সুচেতনা
    এই আমি এখানে!
    ---

    সে বলেছিল
    ~~~~

    “সন্ধ্যার সময় তোমার বাগানটা
    ভালোবাসার রুহে পরিণত হয়
    এর সৌন্দর্যে ঝাপসা হয়ে গিয়ে
    আর আলতোভাবে আদর করতে করতে;
    আমার এই, বিনম্র সাহসিকতার
    মধুরতম স্বীকারোক্তি,
    শোনো সন্ধ্যার সময়
    তোমার বাগানটা তোমার রুহ হয়ে যায়। প্রিয়তম।”
    ---

    রিকোয়েম
    ~~~~

    আহা, যে আমি চেয়েছিলাম কিছু মাটির মালিকানা
    খুব করে, তাকেই কিনা এখন গিলে ফেলছে মাটিঃ
    দরিয়ায় রক্ত
    জমিনে হাড়
    কবর করে শয্যাকে পুনরুদ্ধার
    আহা, যে আমি করেছি পান বসন্তের সুগন্ধী মৃত্তিকা
    থেকে, সেই এখন অন্যদের ফিরিয়ে দিচ্ছে তার মদঃ
    হাওয়ায় নিঃশ্বাস
    হৃদয়িত ঘাস
    আমার হৃদয় শূন্য হয়ে যাক – তারপর অবকাশ।

    অনুবাদকের নোটঃ অ্যান স্পেন্সারের জন্ম ১৮৮২র ৬ ফেব্রুয়ারিতে, ভার্জিনিয়ায়। বিশবছর ধরে ডানবার হাই স্কুলে গ্রন্থাগারিক ছিলেন। হার্লেম রেনেসাঁর কবি। বাগানী ছিলেন, প্রকৃতি তার কবিতায় ঘুরেফিরেই এসেছে। সিভিল রাইটস মুভমেন্টে পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছেন, ১৯১৯এ, দা ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দা অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালারড পিপলের (এনএএসিপি) লিঞ্চবার্গ চ্যাপ্টার প্রতিষ্ঠায়। ১৯৭৫এ, ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, ভার্জিনিয়াতেই।

    ১৩. আফ্রিকা
    ― ডেভিড দিওপ (১৯২৭-৬০)


    আফ্রিকা আমার আফ্রিকা
    পৈত্রিক সাভান্নার দর্পী যোদ্ধাদের আফ্রিকা
    আমার দাদীজানের ঘুমপাড়ানি গানের আফ্রিকা
    দূর নদী তীরের
    আমি জানিনি কখনো তোমাকে
    কিন্তু তোমার রক্ত বয়ে যাচ্ছে এই আমার শিরাউপশিরায়
    তোমার অপরূপ কালো রক্ত যা জমিতে জলসেচন করে
    তোমার ঘামের রক্ত
    তোমার কাজের ঘাম
    তোমার গোলামির কাজ
    আফ্রিকা, আফ্রিকা আমাকে বলো
    এটা কি তোমার পিঠ যা এতো বাঁকা
    যে-পিঠ অপমানের ভারে ভেঙে গেছে
    যে-পিঠ তার লাল ক্ষতগুলো সমেত থরথর করে কাঁপছে
    আর মধ্যাহ্ন সূর্যের নিচে নেমে আসা চাবুককে ফিরিয়ে দিচ্ছে
    কিন্তু একটা জলদগম্ভীর কণ্ঠে উত্তর এলো,
    অস্থিরচিত্ত শিশু অই যে দেখতে পাচ্ছ বৃক্ষটিকে, নবীন ও সতেজ
    অই যে ওখানে বৃক্ষটি
    শাদা ও বিবর্ণ সব ফুলমাঝারে নিঃসঙ্গ রাজসিকভাবে
    অই হলো তোমার আফ্রিকা যা জন্মাচ্ছে নতুন করে
    ধৈর্যের সাথে, আর বাধা দিতে দিতে, জন্মাচ্ছে
    যার ফল একটু একটু করে অর্জন করছে
    মুক্তির তেতো স্বাদ।

    অনুবাদকের নোটঃ ডেভিও দিওপের জন্ম ফ্রান্সে, বর্দো শহরে, ১৯২৭এ। তাঁর বাবা সেনেগালের মানুষ, আর মা ক্যামেরুনের। বেড়ে উঠেছেন ফ্রান্সে, জীবনের একটা বড়ো অংশ কাটিয়েছেন সেখানেই, কিন্তু আফ্রিকায় যাপন ও শিক্ষকতা সূত্রে ফরাশি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। দিওপ নেগ্রিচুড আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে বিবেচিত। সাহিত্যচর্চায় তিনি এমে সেজায়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার আগে একটাই কবিতার বই প্রকাশ করতে পেরেছিলেন, Coups de pilon, যা উপনিবেশবাদ আর গোলামির বিরুদ্ধে আগুনঝরানো প্রতিবাদে পরিপূর্ণ। সেনেগালের রাজধানি ডাকারে মৃত্যুবরণ করেন দিওপ, ১৯৬০এ।

    ১৪. রীতা আর আমার চোখের মাঝখানে একটা রাইফেল
    — মাহমুদ দারবিশ


    রীতা আর আমার চোখের মাঝখানে একটা রাইফেল আছে
    আর রীতাকে যারাই জানে তারা
    হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় বসে যায়
    সেই মধুরঙা চোখের অপারলীলায়
    আর আমি রীতাকে চুমু খেয়েছিলাম
    যখন সে কমবয়সী ছিল
    আর আমার মনে আছে সে কীভাবে এগোত
    আর কীভাবে আমার বাহু ঢেকে যেতো সুন্দরতম বিনুনিতে
    আর আমার রীতাকে মনে আছে
    যেভাবে চড়ুই তার জলপ্রবাহকে মনে রাখে

    আহ, রীতা

    আমাদের মাঝখানে দশ লক্ষ চড়ুই আর ছবি
    আর মিলনের অগণন স্থলে
    একটা রাইফেল গুলিবর্ষণ করে
    আমার মুখে রীতার নাম একটা ভোজসভা ছিল
    আমার রক্তে রীতার দেহ একটা বিবাহোৎসব ছিল
    আর আমি দু'বছরের জন্য রীতার মাঝে হারিয়েছিলাম
    আর রীতা দু'বছরের জন্য আমার বাহুতে ঘুমিয়েছিল
    আর আমরা পরস্পরকে কথা দিয়েছিলাম
    সবচেয়ে সুন্দর পানপাত্রগুলো সামনে রেখে
    আর আমরা নিজেদেরকে পুড়িয়ে ফেলেছিলাম আমাদের ঠোঁটের শরাবে
    আর আমাদের পুনর্জন্ম ঘটেছিল

    আহ, রীতা!

    অতীতে এ-রাইফেল তোমার থেকে আমার চোখ সরিয়ে
    দু'একবেলার ঘুম বা মধুরঙা মেঘ ছাড়া আর কই বা নিতে পারত?
    কোনো এক কালে
    ওহ, সন্ধ্যার নৈঃশব্দ
    সকালে আমার চাঁদ চলে গিয়েছিল দূর দেশে
    সেই মধুরঙা চোখগুলোর দিকে

    আর শহরটা তার সব গায়েনকে নিশ্চিহ্ন করেছিল
    আর রীতা
    রীতা আর আমার চোখের মাঝখানে — একটা রাইফেল

    অনুবাদকের নোটঃ বর্তমান উত্তর ইজরায়েল আর দক্ষিণ লেবাননের মধ্যবর্তী গালিলি অঞ্চলের আল-বিরওয়া গ্রামে, ১৯৪১এর ১৩ মার্চে, মাহমুদ দারবিশের জন্ম। ১৯৪৮এর জুনে জায়নবাদী রাষ্ট্রটির পত্তনের সময় ইজরায়েলি সেনারা গ্রামটিকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়, যাতে ভিটেমাটি হারানো মানুষগুলো আর কোনোদিন নবগঠিত ইহুদি রাষ্ট্রটিতে ফিরে আসতে না পারে, ফলে দারবিশ উদ্বাস্তু হয়ে সপরিবারে লেবাননে পালিয়ে যান। পরের বছর দারবিশের পরিবার ইজরায়েলে ফিরে আসে। তরুণ দারবিশ ইজরায়েলের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। সত্তরের দশকের শুরুতে উচ্চশিক্ষার্থে সোভিয়েত ইউনিয়নে যান, মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। ১৯৭৩এ দারবিশ প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনে (পিএলও) যোগ দিলে তাঁর ইজরায়েলে পুনঃপ্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, এর দুইদশক পরে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরস্থ শহর রামাল্লায় বসবাসের অধিকার পান তিনি। জীবিতাবস্থায় দারবিশ শেষবার ইজরায়েলে আসেন ২০০৭এ, মৃত্যু পরের বছর আগস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন রামাল্লায়।

    দারবিশকে ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি গণ্য করা হয়। ফিলিস্তিনি কবিদের মধ্যে তিনিই আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে পরিচিত। ১৯৯৩এ ফরাশি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাঁকে Chevalier dans l'Ordre des Arts et des Lettresএর সম্মানে ভূষিত করে।

    দারবিশের এই কবিতাটি দীর্ঘদিন রহস্যে আবৃত ছিল। রীতা বলে কি আসলেই কেউ কোনোদিন ছিল, নাকি এই নারী নিতান্তই কবির কল্পনা? ২০১৪য় ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্রকার ইবতিহাম মারা'আনা-মেনুহিন তাঁর ডকু ফিল্ম Write Down: I am an Arabএ এই প্রশ্নের জবাব নিয়ে হাজির হন। জানা যায় রীতা রক্তমাংসের মানুষ, তামার বেন-আমি তাঁর পুরো নাম, দারবিশ ভালোবাসতেন যাঁকে। একদা এক আরব যুবক এক ইহুদি মেয়ের প্রেমিক হয়েছিল, হিব্রুতে লিখেছিল তাঁকে অসংখ্য চিঠি, কিন্তু পায়নি মেয়েটিকে। এই কবিতা সেই না পাওয়ার নির্জন সাক্ষর।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • কাব্য | ০৯ জুলাই ২০২১ | ৩৫১২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ৩১ জুলাই ২০২১ ০৭:৫৪496224
  • "আফ্রিকা" কবিতাটি খুব শক্তিশালী, বার বার পড়তে হয়। 


    ব্রাভো ইরফানুর 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন