বাংলাদেশের সিনেমা নতুন এক মাইল ফলক স্পর্শ করেছে। বহুদিন ধরেই অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের সিনেমা। হয়েও হয়ে উঠছে না আমাদের। দুনিয়ার সিনেমা জগতের কুলীন মর্যাদা পাওয়া হচ্ছিল না। ভিনদেশি কিছু চলচিত্র উৎসবে কয়েকটা সিনেমা জায়গা করে নিতে পারলেও সিনেমার সবচেয়ে মর্যাদা পূর্ণ কোন উৎসবে তেমন কোন সাফল্য নেই বাংলাদেশের কিংবা যদি একটু বাড়িয়ে বলি বাংলা সিনেমার। ফারুকি সহ কয়েকজন নির্মাতা চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অধরাই থেকে যাচ্ছিল বলার মত সাফল্য। এতদিন পরে, সেই মাটির ময়নার পরে প্রায় অচেনা এক নির্মাতা, আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের রেহানা মরিয়ম নূর নামের সিনেমাটি কান চলচিত্র উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশনের ‘আঁ সাহত রিগা’ বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে। এই সাফল্য কোন মাপের বলে বুঝানো মুশকিল। বাংলাদেশের কোন সিনেমা আজ পর্যন্ত কানের অফিসিয়াল সিলেকশন পায়নি! এতে কিছুটা হয়ত বুঝা গেল এই অর্জনের মাপ সম্পর্কে।
কানে বাঙালির অর্জনই নিকট অতীতে দেখা যায় নাই। গৌতম ঘোষ তার অন্তর্জলী যাত্রা, গুড়িয়া নিয়ে সর্বশেষ কান যাত্রা করেন। এর আগে সত্যজিৎ প্রায় নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন কানে। সত্যজিতের পরে, মৃণাল সেন কানে জিতেন পুরস্কার। এরপরে আর কেউ কানে অফিসিয়াল আমন্ত্রণ পাননি। গৌতম ঘোষের গুড়িয়াই সর্বশেষ। তারেক মাসুদের মাটির ময়না, যা আমাদের দেশের একমাত্র অর্জন, সেই মাটির ময়না অফিসিয়াল সিলেকশন ছিল না। ছিল সমান্তরাল শাখা- ডিরেক্টরস ফর্টনাইট। সেখান থেকে অভাবনীয় অর্জন করেন তারেক মাসুদ, ফিপ্রেসকি পুরস্কার জেতে 'মাটির ময়না'। কানে প্রথম নাম উঠে বাংলাদেশের। এই কাণ্ড হয়েছে ২০০২ সালে! এত বছর পরে এবার আসল অফিসিয়াল আমন্ত্রণ।
মুশকিল হচ্ছে যিনি এই দুর্দান্ত সাফল্য, অভূতপূর্ব অর্জন এনে দিল তার সম্পর্কে বেশি কিছু বলার উপায় নাই। নিভৃতচারী মানুষ সাদ। ফেসবুকে একজন মজা করে লিখেছে গুহাবাসী! উনার নাই কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের কোন একাউন্ট! এর আগে সিনেমা তৈরি করেছেন একটা, সেই সিনেমাও আলোড়ন তুলেছিল। লাইভ ফ্রম ঢাকা (২০১৬) নামের সেই সিনেমা সিঙ্গাপুর চলচিত্র উৎসবে সেরা সিনেমার পুরস্কার জিতে, সেই সিনেমায় অভিনয় করে মোস্তফা মনোয়ার জিতেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার। সেই ছবি আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ঢাকায় চলেছে, আমরা ঢাকার বাহিরে থাকার কারণে শুধু শুনে গেছি দারুণ একটা সিনেমা বানিয়েছে একদম নতুন এক পরিচালক। ব্যস, এরপরেই আবার হারিয়ে গেছেন আব্দুল্লাহ সাদ। তাকে দেখা যায়নি কোন সাক্ষাৎকার দিতে, দেখা যায়নি কোন টকশোতে। এমন কী এই ইন্টারনেটের যুগে ঘুরেফিরে দুই একটা ছবি ছাড়া তার কোন ছবিও নেই কথাও! একটা সিনেমার কাজ শেষ করে যেন হারিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু আসলে হারিয়ে যাননি, সবার অলক্ষ্যে, নীরবে নিজের দ্বিতীয় সিনেমার কাজ করে গেছেন। আর সেই সিনেমা কানের অফিসিয়াল সিলেকশনের 'আঁ সাহত রিগা' ( Un Certain Regard) যা মূলত পৃথিবী সেরা তরুণ নির্মাতাদের বিভাগ, সেই বিভাগে মনোনীত হয়েছে।
পোটোকল ও মেট্রো ভিডিও’র ব্যানারে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ প্রযোজনা করেছেন সিঙ্গাপুরের প্রযোজক জেরেমী চুয়া, নির্বাহী প্রযোজক এহসানুল হক বাবু ও সহ-প্রযোজনা করেছেন রাজীব মহাজন, আদনান হাবিব, সাঈদুল হক খন্দকার। যতদূর জানা গেছে রেহনা মরিয়ম নূর একজন নারী শিক্ষকের গল্প, তার জীবন সংগ্রামের গল্প। নারী শিক্ষক চরিত্রে অভিনয় করেছেন আজমেরি হক বাঁধন। ছবিতে বাঁধন ছাড়াও অভিনয় করেছেন আফিয়া জাহিন জাইমা, কাজী সামি হাসান, আফিয়া তাবাসসুম বর্ন, ইয়াছির আল হক, সাবেরী আলমসহ অনেকে। ছবিটির সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন তমিজুল, প্রোডাকশন ডিজাইনার আলী আফজাল উজ্জল ও সাউন্ড ডিজাইনার শৈব তালুকদার। ছবিটি সহ-প্রযোজনা করেছে সেন্সমেকারস প্রডাকশন।
সিনেমা সম্পর্কে যেহেতু আর কিছু বলার নাই তাই যতদূর জানা গেছে পরিচালক সম্পর্কে তাই বলি। খুব বেশি জানার উপায় যে নেই তা পরিষ্কার। ২০১৬ সালে লাইভ ফ্রম ঢাকা সিঙ্গাপুরে পুরস্কার জেতায় সাদকে দেশের প্রতিভাবান পরিচালক হিসেবে ধরা হচ্ছিল। ২০১৯ সালে প্রথম আলো পত্রিকার ছুটির দিনেতে সেরা উদীয়মান পরিচালকের নাম হিসেবে বলা হয় সাদের কথা। পরিচালক রেদোয়ান রনি লেখেন এক বিশেষ প্রতিবেদন। তা থেকেই যতদূর জানা যায় এই নীরব প্রতিভাবান সম্পর্কে। তিনি চট্টগ্রামে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েন, এরপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ২০০৬ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা শুরু করেন। কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়ে হাত পাকিয়ে ২০১২ সালে দেশ টিভির জন্য একটি অপ্রকাশিত কবিতা নামের ফিকশন নির্মাণ করে প্রশংসিত হন। এ ছাড়া ওয়াহিদ তারেকের ছবি আলগা নোঙ্গর–এর চিত্রনাট্য লিখেছেন। এরপরেই লাইভ ফ্রম ঢাকা আর তারপরেই রেহনা মারিয়ম নূর। রেদোয়ান রনিকে দেওয়া সাক্ষাকারে তিনি বলেন, ‘অনেকেই হয়তো আমাকে ভুল বোঝেন, কিন্তু আমাকে নিয়ে মাতামাতিটা আমার আন–ইজি লাগে, বিব্রত হই।' দুনিয়া কাঁপাতে চলছে যে যুবক সে যদি বিব্রত হয় মাতামাতি নিয়ে তাহলে মুশকিল না?
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে যে ছেলে ইতিহাস রচনা করছে সে যে সামনে আরও ইতিহাস রচনা করবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কানে রেহনা মারিয়ম নূর দিয়ে ক্যাবল মাত্র শুরু। বাংলাদেশের নাম তিনি আরও উজ্জ্বল করবে এইটা এখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আমরা।
তথ্যসূত্র - প্রথম আলো পত্রিকা, বিডি নিউজ।
ছবি - ইন্টারনেট
বাঃ, দারুণ খবর।
@aranya, সত্যিই দারুণ খবর। এইটা এত বড় খবর যে মানুষ এর মাপও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না। সাদ সামনে দারুণ কিছু করবে বলে আশা করি।
সত্যিই ভাল খবর। এঁর কাজ কীভাবে দেখা যায়?
কাজ দেখার উপায় নাই। এর আগে সিনেমাই বানাইছে একটা। ওইটাও কোন সিন্দুকে তুলে রাখছে আল্লাই জানে! এখন কত অনলাইন প্লাটফর্ম, কোন একটা দিয়ে দিলে সবাই দেখতে পারত।
জানতে পেরে খুবই আগ্রহ জাগছে। তবে বাংলাদেশে উচু মানের সিনেমা তো নিয়মিত বানানো হচ্ছে, ইউরোপীয়দের নিমন্ত্রণ বা নেক নজর কেন মাপকাঠি হবে।
এই সিনেমাটার কাহীনি, নির্মাণ, মেজাজ, বৃত্তান্তের ধরণ আর সুর সমবন্ধে যদি আরো কিছু বলতেন তাহলে আরো আস্বাদ পাইতাম আমরা।
@শুদ্ধসত্ত্ব দাস, নিয়মিতই ভাল ছবি তৈরি হচ্ছে তা আর বলতে পারছি কই? বেশ কিছু ভাল সিনেমা তৈরি হয়েছে কিন্তু আবর্জনাই বেশি তৈরি হচ্ছে। আপনাদের ওইদিকের একটা ভাল জিনিস হচ্ছে আবর্জনাও বেশ সুন্দর করে উপস্থাপন করা হয়, দেখতে আরাম লাগে। এদিকে রাখঢাক নেই কোন, সরাসরি আবর্জনা তৈরি করে বলা হচ্ছে এইটাই দেখতে হবে! একে খারাপ বলবা মানে তুমি সিনেমার কিছুই বুঝ না! ইউরোপিয়ানদের নেক নজরের অপেক্ষায় থাকার দরকার নাই এই কথা বলার মত অবস্থায় যেতে পারছি কি? সব কিছুতেই ইউরোপের দিকে তাকিয়ে থেকে কোন সাহসে বলি যে সিনেমার জন্য ইউরোপের মাপ কাঠির দরকার নেই? সেইদিন হয়ত একদিন আসবে। না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নাই।
সিনেমার কাহিনী একটু লিখেছি। এর বেশি কিছু জানা যায়নি। জানতে পারলে অবশ্যই জানাব।
@muhammad sadequzzaman sharif অনেকদিন পর গুরুচন্ডালি খুলতেসি, উত্তর দিতে দেরি হইয়া গেল। আসলে বাংলাদেশের সিনেমায় আর নাটকে চিত্রনাট্য পশ্চিম বঙ্গের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত মানের লাগে। ফলতঃ অভিনয়ও আরো দারুণ লাগে। আমাদের কোলকাতার সিনেমায় চালিয়াতি, অথবা কিছু বাধাধরা সেন্টিমেন্ট, বা কেতাই ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে।