সেইদিন আবহ ছিল সুন্দর! কৃতী স্বামী সন্তান পরিজন বন্ধু, শ্রদ্ধাতুর সবাই উপস্থিত। নীচু স্বরে সবাই তাঁর কথাই আলোচনা করছে। যিনি চলে গেছেন সামনে তাঁর ফুলমালায় ঢাকা হাসিমুখ। ঐরকমই আদ্যন্ত হাসিখুসি মানুষ ছিলেন তিনি। প্রিয় তানপুরাটিও শোয়ানো রয়েছে ছবির সামনে। কখনো বিভ্রম হয় যেন আলো আলো মুখে তিনি ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে তুলে নেবেন বাদ্যযন্ত্রটি, নরম আলোর মতোই সুর শান্ত ধারা হয়ে বাজবে হৃদয়ে!
বেজেছিল নিশ্চয়ই। অন্তত একজনের মনে। তাঁর সেই স্মৃতিবাসরে বলবার কথা ছিল না, তবু সবার শেষে নিজেই সময় চেয়ে নিলেন তিনি। বলতে শুরু করেছিলেন শেষ যেদিন প্রয়াতাকে নিয়ে যাওয়া হবে নার্সিং হোমে, সব তোড়জোড় চলছে, পাশের বস্তি থেকে একটি শিশুকন্যা বাবার হাত ধরে এসে হাজির। দাদিসে মিলুঙ্গি। অনেক করে তাকে বোঝানো হচ্ছে, দাদি এতো অসুস্থ, তাঁর সঙ্গে দেখা এখন কিছুতেই হবে না, কিন্তু সে নাছোড়, দাদির কাছে সে পড়ে, আদর, প্রশ্রয় পায়, এমন কী অবস্থায় থাকতে পারে দাদি, যে তার সঙ্গে দেখা হওয়া বারণ! তার বদ্ধ মুঠিতে যা ছিল তা না খুলেই সে বিদায় নিতে বাধ্য হলো, দাদির সঙ্গে কথা হল না, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে পেছন ফিরে চাইছিল বার বার, তাই দেখে কথকের মনে পড়ে গেল, সুধা আর অমলের কথা, ভরা সভায় তিনি হাহাকারে ফেটে পড়লেন, মাইকে ছড়িয়ে গেল তাঁর উচ্চারিত তিন শব্দ, স্তব্ধ হও অবিশ্বাসী!
কোন অবিশ্বাসকে নিজের স্ত্রীর শোকসভায় স্তব্ধ হতে বলেছিলেন শ্রদ্ধেয় সলিল বিশ্বাস,আমি বুঝিনি, সে কি কোনো পরাবাস্তবের আভাস, না কি চিরন্তন যে ভালবাসা বস্তি আর হর্ম্যরাজির ফারাক উড়িয়ে দেয় এক তুড়িতেই তার তুখোড় অস্তিত্ব, বুঝিনি, কিন্তু সেই হাহাকারটুকু বড় বেদনার মতো মনে সংলগ্ন হয়ে আছে। কারণ সলিলদাকে জানতাম যেন বজ্রের মতো কঠোর।
একেবারে ছাত্রাবস্থা থেকে ঘোর বামপন্থী এই মানুষটি নিজের রাজনীতির যে অক্ষ বেছে নিয়েছিলেন, শেষ অব্দি তাতেই স্থিত থেকেছেন। কোনভাবেই সেখান থেকে বিচ্যুত হননি। সেই আশির দশকে বেলেঘাটা বস্তিতে এডাল্ট এডুকেশন এবং শিশুদের প্রথাগত শিক্ষার বাইরের শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন বলে কাজে নেমেছিলেন, আমৃত্যু সেই কাজে লেগে থেকেছেন। যে কাজের শেষটুকু দেখেছে শ্রীরামপুর শ্রমজীবীর সহায়সম্বলহীন ছাত্ররা। সলিল বিশ্বাস এবং দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী যতদিন শরীরে কুলিয়েছে সেখানকার আদিবাসী ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছেন।
কাজ আমরা অনেকেই করি। অন্তত শুরু তো করি। শেষ অব্দি হয়তো টেনে নিয়ে যেতে পারিনা, প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে যোঝা হয় না, কখনো বিশ্বাস আদর্শের ভিত নড়ে যায়। খ্যাতিমান অধ্যাপক সলিল বিশ্বাস একসময় হেরম্বচন্দ্র কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন, অনেকটা সময় প্রশাসনিক কাজকর্মে চলে গেছে, কিন্তু পাশাপাশি একই গতিতে চলেছে তাঁর সমাজসেবা, অনুবাদের কাজ, মৌলিক লেখালিখি। এবং সেটা মারাত্মক অসুস্থতা শরীরে বয়ে নিয়ে। আশি সালে ওঁর ডিওডেনাল আলসার ধরা পরে। তাও একেবারে সহ্যের শেষ বিন্দুতে না পৌঁছনো অব্দি সবার কাছে লুকোনো ছিল সেই মারণব্যাধি। অপারেশনের পর পাকস্থলী ছোট হয়ে যায়, আরো নানা উপসর্গ। কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি কখনো।
দেশটার নাম ভারত, তাই আশা করি না, কিন্তু অন্য দেশে হলেও হতে পারে, হওয়া উচিত, তাঁর ইতালির বারবিয়ানা স্কুলের ছাত্রদের সম্মিলিত চিঠিভিত্তিক গ্রন্থের অনুবাদ, "আপনাকে বলছি স্যার" বইটির অবশ্যপাঠ। অন্তত শিক্ষকদের শিক্ষাদান করবার আগে এ বই পড়াই উচিত। শিক্ষা যখন পণ্য, আর শিক্ষার্থীরা বাজার নামক দাবাবোর্ডে দিব্যি জ্যান্ত বোড়ে, তখন বিকল্প শিক্ষার ওপর এ বই হয়তো কাউকে অন্য পথের সন্ধান দেবে। আরেকজন সলিল বিশ্বাস তৈরি হবেন যাঁর মনন জুড়ে থাকবে বিকল্প শিক্ষা ভাবনা। ব্রাজিলের নিপীড়িতের শিক্ষাবিদ পাউলো ফ্রেইরি হবেন যাঁর দিগদর্শক।
সলিলদার আজীবন বন্ধু, যাঁর সঙ্গে তাঁর আমৃত্যু সংলগ্নতা, শেষশয্যাতেও আধো অচেতন অবস্থায় যাঁকে বার বার ডাকতে বলেছেন ছেলেকে, সেই প্রশান্তদা, প্রশান্ত রায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বেরিয়ে এলো সলিলদার চরিত্রের একটি চুম্বক - স্নিগ্ধ অথচ অনমনীয় ব্যক্তিত্ব। কথা বলার ভঙ্গি, সমগ্র ব্যক্তিত্ব ছিল এতো সুমধুর, ওঁর বিরোধিতা করতে গিয়ে ওঁর মতাবলম্বী হয়ে যাওয়া বিরল ছিল না। কখনো কোনো ক্ষতি করা তো দূরের কথা, কারো সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করেননি, কোনো উপদলীয় কাজকর্মে উৎসাহ দেখাননি, এই মানুষকে ভালবাসা ও সম্মান দেওয়া যেত একইসঙ্গে।
একটিই নির্ভরতা ছিল সলিলদার জীবনে, তা ওঁর স্ত্রীর প্রতি। সবিতা বিশ্বাসও ওঁর সমস্ত কাজে থেকেও নিজের ব্যক্তিত্ব ও মননের সৌন্দর্যে আমাদের মুগ্ধ করেছেন। ওঁর লিউকেমিয়া হয়ে তিন/ চার মাসের মধ্যে চলে যাওয়া সলিলদা সহ্য করতে পারছিলেন না। এই বিচ্ছেদই কারণ কিনা জানা নেই, কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের ঠিক সাড়ে তিনমাসের মাথায় চলে গেলেন সলিল বিশ্বাস। পেছনে পড়ে রইল পুত্র কন্যা, অগণিত ছাত্র, বন্ধু, গুণমুগ্ধ মানুষ। পড়ে রইল ফ্রেইরিকে নিয়ে অজস্র চিন্তা, বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ওঁর সারাজীবন উৎসর্গ করা কাজ।
এই আকালে স্বপ্ন দেখি, নতুন পৃথিবীতে সলিল বিশ্বাসের কাজ একদিন সমাদৃত হবে। কমিউনের শিশুরা যৌথ ধানের গোলার চারপাশে ছুটোছুটির পর পড়তে বসবে। তাদের পাঠ্যক্রমে পক্ষ বিস্তার করে থাকবেন পাওলো ফ্রেইরি। আর তাদের শিক্ষকরা সবাই হবেন সলিল বিশ্বাসের সন্তান! হয়তো খুব বোকার মতো, কিন্তু এই স্বপ্ন আমার রক্তের অন্তর্গত।
খুব ভালো লাগলো। তবে সলিল বিশ্বাস শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজ নয়, হেরম্ব চন্দ্র কলেজের দায়িত্বে ছিলেন।
দুটি ছোট্ট সংশোধনী - ১) সলিলদা শ্রীরামপুর শ্রমজীবিতে নয় বেলুড় শ্রমজীবি সংলগ্ন পাঠশালায় পড়াতেন। ২) সম্ভবতঃ হেরম্বচন্দ্রের ইংরজি বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন। অধ্যক্ষ ছিলেন না।
কল্লোলদা, পরে উনি শ্রীরামপুর শ্রমজীবীতে দীর্ঘকাল ক্লাস করেছেন। আমিও সেখানে গেছি। তবে ক্লাসে উপস্থিত থেকে এ-ই কর্মকান্ড দেখতে।
না, উনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষও ছিলেন। হেরম্বচন্দ্র কলেজে। ওপরে ঐ কলেজবাড়ির এক অধ্যাপকের মন্তব্য আছে ওপরে।
তালিকা থেকে আরো দুটো বই বাদ গেছে। নব্বইয়ের দশকে পিবিএস থেকে প্রকাশিত ছায়া হারলেম, কালো মানুষের কবিতা সংকলন এবং কল্পবিজ্ঞান গল্প সংকলন মিথেন ফোয়ারার প্রেম।
সলিলদাকে নমস্কার। আপনাকে বলছি স্যার — বইটি পড়েছি। তাঁর আরও কয়েকটি অনুবাদগ্রন্থও পড়েছি।
আশা করি তাঁর স্মৃতি আমাদের প্রদীপ্ত রাখবে।
সংশোধনী সম্পর্কে কয়েকটি কথা: উঁনি বেলুড় এবং শ্রীরামপুর উভয় শ্রমজীবিতেই যেতেন। ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান থাকার সাথে সাথে অল্প কিছুদিনের জন্য হেরম্বচন্দ্র কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষও হন। ওনার মিথেন ফোয়ারার প্রেম বইটির গল্প ও কিছু নতুন গল্প নিয়ে খোয়াবওয়ালা গ্রন্থটি বের হয়। ছায়া হারলেমে আশা করি আপনারা পড়বেন।
ভালো লেগেছে
দুর্গাপুর আড্ডা ইয়ং অ্যাসোসিয়েশন এর সিঞ্চন প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। আর্থিক ভাবে দূর্বল ছাত্র দের এখানে সম্পুর্ণ বিনামূল্যে পড়াশোনা করানো হয়। খুবই ভালো মনের মানুষ ছিলেন।
ভালো লাগলো ।অনুসরণযোগ্য এক অচেনা ব্যক্তিত্ব সামনে এসে দাঁড়ালেন । বইগুলি পড়ার ইচ্ছে জাগলো ।
একজন পুণ্যশ্লোক মানুষ । একটি নিবিড় তর্পণ। ঋদ্ধ হলুম...
বিরাট মানুষ। প্রণাম।
এক আদর্শ অধ্যাপক, আদর্শ মানুষ, সদা স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সৃজনশীল থেকেছেন। অসম্ভব ভালো ছবি তুলতেন। নিরহঙ্কার এক ব্যতিক্রমী সত্তা।
কাল রাতে ঘুম ঘুম চোখে লেখাটি পড়ার পর চুপ করেছিলাম অনেকক্ষণ। কি মন্তব্য করবো ভেবে উঠতে পারিনি। আজ সকালে আবার লেখাটি পড়ে ভাবলাম, আর কিছু না হোক, চণ্ডালের শ্রদ্ধাটুকু জানিয়ে যাই। সেল্যুট!
ধন্যবাদ প্রতিভাদি, এই গুণিজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। আরো লেখ
খুব বড় মনের মানুষ সলিল দা। আমার সাথে প্রথম আলাপ যখন, তখন আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, আর সলিল দা খ্যাতনামা অধ্যাপক। স্যার বলতে বারন করেছিলেন, তখন থেকেই তিনি আমার এবং আরো কত প্রজন্মের ছাত্র ছাত্রীদের প্রিয় মানুষ, সলিল দা। পেগেসাসে লিখেছি, কত বিষয় না বুঝতে পেরে ফোন করেছি, প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বই - চিত্র তে যেতে বলতেন, ফটোগ্রাফির কিছু মাত্র না বুঝেও গেছি শুধু তিনি ডেকেছিলেন তাই।
বেশ কিছু monograph লিখতে বলেছিলেন, ব্যক্তিগত সমস্যায় লিখে উঠতে পারিনি - প্রায় কয়েক বছর পর লজ্জায় অধোবদন হয়ে সে কথা জানাতেই সলিল দা বললেন - আরে , তাতে কি হয়েছে, লিখবে ' খন। আমি তো আছি রে বাবা। তুমি একটু সামলে নাও।
সামলে ওঠাও হলো না, আপনার সাথে আর দেখাও হলো না। ফোনে কথা হয়েছিল তাও অনেক মাস আগে।
প্রতিভা দি, বড় সুন্দর লিখেছেন।