এখানে মেঘ গাভীর মত চরে
--------------------
এবারের গাড়ি রিৎজ। এই গাড়িতে আমি আগে কখনো চড়িনি - পিছন দিকটা কেমন চ্যাপটা মতন, দেখে বেশ অদ্ভুতই লাগত। কিন্তু বাইরে থেকে চ্যাপ্টা হলেও, ভিতরে জায়গা আছে বেশ, আনলাইক অল্টো, এটায় আমাদের দুটি বড় বাক্স আর দুটি পিঠের ব্যাগ দিব্যি সেঁধিয়ে গেল। ফলে আরাম করে বসা গেল। প্রদীপ্তার বমির ধাত, তাই সে সামনে - তাতে একটু কম গা গোলায়। আমি আর মেঘ পেছনে। গাড়ি ছাড়ার সময় অবশ্য প্রদীপ্তা যথারীতি অন্ডেম খেতে ভুলে গেছিল।
আমাদের সারথীর নাম হাসান শেখ। ভারী শান্তশিষ্ট মানুষ, মিশুকেও। মেঘের সাথে আধ ঘন্টার মধ্যেই দিব্যি জমে গেল। আর তার অল্প পরেই আমরা এসে পড়লাম রোহিনী ছাড়িয়ে একটা ছোট্ট ধাবায়। ব্রেকফাস্ট ব্রেক। দেখি একঝাঁক বাইকারও ভীড় করেছে সেখানে। তাদের কয়েকজনকে বীয়ার নিয়ে বসতে দেখে আমারও মনটা আনচান কচ্ছিল বটে, কিন্তু নিজেকে বোঝালাম - এখন থাক। অনেক সময় আছে। নিজের সেল্ফ কন্ট্রোলে নিজেই ইম্প্রেসড। আমরা পুরী, সবজি, খুশী (প্রদীপ্তা লেখার চেয়ে কম টাইপ করতে হয়) মোমো - আর ফাটাফাটি চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট হল। আবার রওনা।
পরপর দুটো শার্প টার্নে এক হ্যাঁচকায় শ চারেক ফিট উঠে যেতেই খুশীর খেয়াল হল, অন্ডেম খায় নি। আমাকে বলল, দাও। আমি বললাম কোথায়? বলল আমার ছোট ব্যাগে। আমি বললাম, ছোট ব্যাগে কোথায়? বলল, তা মনে নেই। জিজ্ঞেশ করলাম নিয়েছিলে তো? বলে, মনে তো হয়! অগত্যা আমি সার্চ শুরু করলাম। চার পাঁচটা খুপরি, তাতে কত কিছু বেরোল। শেষে অবশ্য অন্ডেমও বেরোল। সেটা খেয়ে সে নেতিয়ে বসে থাকল। আবার তার কথা ফুটবে ঘুমে পৌঁছে।
এদিকে মেঘ তখন সাঙ্ঘাতিক উত্তেজিত। এর আগে ডুয়ার্স দেখলেও পুরোদস্তুর পাহাড় এই প্রথম ওর। যত ওপরে উঠছে, ঠান্ডা বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে নীচের ফেলে আসা রাস্তা। চা বাগান। আর মেঘ। ওপরে মেঘ, নীচে মেঘ। তাড়া খেতে খেতে কোনমতে কার্শিয়াং পৌঁছালাম। শহরে জ্যাম। সেসব পেরিয়ে যখন কার্শিয়াং ছাড়ালাম, মেঘের পাল আমাদের ধরে ফেলেছে। টুং পৌঁছাতে বৃষ্টি নামল। সোনাদা ছাড়াতে ছাড়াতে তা হয়ে দাঁড়াল শিলাবৃষ্টি। বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস।
টুং সোনাদা ঘুম পেরিয়ে অ্যাঁকাব্যাঁকা রাস্তা ধরে যখন ডালি মনাস্ট্রির কাছাকাছি, বৃষ্টি থামল। এবং আমরা আবিষ্কার করলাম, আড়াই ঘন্টারও কম সময়ে আমরা দার্জিলিং এসে পড়েছি। ছবির মতন দার্জিলিং স্টেশন। আমার শৈশবের শহর। এই স্টেশনে হুইলারের বুক স্টল থেকে ছোট হাফ এ ফোর সাইজের আনন্দমেলা কিনতাম। কাগজ আসত একদিন পরে। এখানেই আনন্দমেলায় ধারাবাহিক রুআহা (বুগু) পড়া শুরু করেছিলাম - আর কাকাবাবুর জঙ্গলমহলের চাবি। হুইলারের স্টলটা আর নেই, কিন্তু বাকি স্টেশন চত্বরটা একই রকম আছে বলেই মনে হল।
স্টেশন পেরিয়ে লাডেনলা রোড - দুটো বাঁক নিতেই হেড পোস্টাপিসের সেই অতি পরিচিত বিল্ডিং - যার তিনতলায় কেটেছে আমার ছোটবেলার একটা বড় অংশ। উল্টোদিকে রিংক সিনেমা হলটা এখন আর নেই - সেখানে এখন শপিং মল, আইনক্স। রিংকের সামনের বেনীজ কাফে অবশ্য এখনো স্বমহিমাতেই আছে, আগের চেয়ে বড়সড় হয়েছে কলেবরে। পোস্টাপিসকে বেড় দিয়ে বাঁক ঘুরে একটু এগোলেই ক্যাপিটাল - সেটাও আগের মতই আছে। পোস্ট অফিস আর ক্যাপিটাল - দুটো বিল্ডিংই হেরিটেজ বিল্ডিং এর তকমা পেয়েছে দেখলাম।
ম্যালের রাস্তাটা ডাইনে রেখে নীচে দিয়ে চলে আসা গেল রবীন্দ্র ভবনের সামনে - এখন সেটা গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর কোন কার্যালয় হয়েছে সম্ভবতঃ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সামনে সান্ত্রী বন্দুক নিয়ে। সেসব ছাড়িয়ে গাড়ি চলে এল রাজভবনের সামনে। আমাদের যাত্রা এখান অবধিই, কারণ এরপরে আর গাড়ি যাবে না ম্যালের দিকে। এখানে গাড়ি বেশীক্ষণ দাঁড়াতেও দেয় না। তবে ভাগ্যক্রমে আমাদের হোটেল, দা রিট্রীট, বেশ কাছেই, একশো মিটারও না। ফলে অসুবিধা কিছুই হল না তেমন। খালি গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে টের পেলাম, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। কুয়াশা।
*******************
দার্জিলিং জমজমাট
-----------------------------
হোটেলের ভিতরে ঢুকেও হাড় কাঁপানো ঠান্ডার হাত থেকে রেহাই না পেয়ে বাধ্য হয়ে রুম হীটার চালাতে হল। তারপর আমরা একে একে স্নান সেরে নিলাম গরম জলে। এদিকে খবর পাওয়া গেল, চন্দ্রবিন্দুর উপল সেনগুপ্ত, সে আবার খুশীর দাদা কাম বন্ধু - সে ও একদিনের জন্য দার্জিলিং এ। ফোনে ঠিক হল একসাথে লাঞ্চ করা যাবে।
তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়া গেল ঘন্টা খানেকের মধ্যেই। রুমের বাইরে পা রাখতেই বোঝা গেল, ইট'স কুল। কুল মানে একেবারে মহাকুল।বিশ্বকুল। বাপ্রে কুল। একে তো ছয় ডিগ্রি, তায় আবার কুয়াশা। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। কয়েক মিনিটেই জ্যাকেট, সোয়েটার, উলিকটের গেঞ্জি ভেদ করে কাঁপিয়ে দিল একদম। কিন্তু তাই বলে তো আর সেলফি তোলা বন্ধ রাখা যায় না। নাই বা থাকল কাঞ্চনজঙ্ঘা, ভিউ পয়েন্ট (আমাদের হোটেলটার ঠিক মাথাতেই একখানা আছে) থেকে মিস্টি মাউন্টেইনসের ব্যাকগ্রাউন্ড কি কম আকর্ষণীয়?
হাঁটতে হাঁটতে ম্যাল। ম্যালের এইদিকটায় বেশ একটা জমজমাট বাজার বসে গেছে দেখলাম।সোয়েটার, জ্যাকেট, শাল, স্টোল, পঞ্চু, টুপি, গ্লাভস - ঢেলে বিক্রি হচ্ছে ফুটপাথে। সেখানে পরে আসা যাবে ঠিক করে আপাতত ম্যাল পেরিয়ে ম্যাল রোডে নামা গেল। কিউরিও শপগুলো, দাস স্টুডিও (এখন বন্ধ), গ্লিনারিজ - এক রাশ স্মৃতি কেমন যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। কথা হয়েছিল ওরা (উপলরা) থাকবে গ্লিনারিজ এই - কিন্তু সব তলা খুঁজেও তাদের দেখা পাওয়া গেল না। এদিকে খুশী যথারীতি ফোনটা হোটেলেই ফেলে এসেছে। চোখ ফাটা কান্নার ডাবল ইমোজি। খুঁজে পেতে উপলের নম্বর আমার পুরনো ফোন, যেটা এখন মেঘ ইউজ করে, সেখান থেকে পেয়ে ফোন করা গেল। জানা গেল ওরা গেছে পেনাং এ। গ্লিনারিজ থেকে পেনাং কাছেই, হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম চট করেই।
পর্ক স্লাইস ফ্রাই, গার্লিক প্রণ ইন অয়েস্টার সস আর মিক্সড মীট রাইস - দার্জিলিং এর সেরা লাঞ্চ প্রথম বেলাতেই সেরে ফেলা গেল। আর সেলফি। পেনাং এর ঠিক উল্টোদিকে দার্জিলিং হেড পোস্ট অফিসের তিনতলা বাড়ি - আমার ক্লাস ফাইভের অনেকটা আর ক্লাস সিক্স পুরোটা কেটেছে যেখানে। যেখান দিয়ে ঢুকতাম, রাস্তার ওপরে সেই গেটটা এখন বন্ধ - দোতলার ইন্সপেকশন বাংলোয় ঢোকার মুখটাও। হেরিটেজ বিল্ডিং এর তকমাটা হাওয়ায় দুলছে। আগেরবার যখন খুশীকে নিয়ে এসেছিলাম ষোল বছর আগে, তখনও এই ইন্সপেকশন বাংলোতেই উঠেছিলাম।
এবার আবার ম্যাল। মেঘ ঘোড়ায় চড়ল - আজ ছোট পাক। ঘোড়ার নাম চেলসি। ভারী মিষ্টি মেয়ে - ঘিয়ে রঙের লোমশ শরীর বেশ শক্তিশালী। স্বভাবে শান্তশিষ্ট, আদর করলে মুখটা ঘষে দেয়। সেসব পর্ব মেটার পর খানিক্ষণ বসে এগোলাম বাজারের দিকে। মেঘের একটা জ্যাকেট, খুশীর পঞ্চু, গিফট করার জন্যও কিছু জিনিষ কেনাকাটা হল। তারপর চড়াই - মহাকাল মন্দির। যতদূর মনে পড়ে, ৭০০ মিটার মত চড়াই - কিন্তু এতই খাঁড়াই যে সেটা প্রায় তিন কিলোমিটার হন্টনের সামিল। মন্দিরে আমি ঢুকি না, খুশী ঢোকে। আমি পাশের জঙ্গলে ঢুকলাম। একটু পরে মেঘও আমার সাথেই চলে এল। দুজন কর্মী আগুন জ্বালিয়েছে - সেখানে হাত পা সেঁকে নেওয়া গেল একটু।
এদিকে খুশীর দেখা নেই। আমরা বেরোবার জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ালাম - সে আর আসে না। একবার মেঘ, একবার আমি গিয়ে ভিতরেও দেখে এলাম, দেখা গেল না। খুশীর কাছে ফোন নেই, কী করা যায় ভাবছি, ইতিমধ্যে প্রায় আধঘন্টা কেটে গেছে। এমন সময় ফোন বাজল। খুশী। দেখেই নিশ্চিন্ত - তার মানে হোটেলে পৌঁছে গেছে। অতএব আমরা বাপ বেটাও চললাম সেদিকেই।
তারপরেও অবশ্য আরো একবার বেরোতেই হল - এটিএম যেতে হত, এখানে বেশীরভাগ দোকানেই ক্যাশের কারবার। একটা হুইস্কিও তুলে নেওয়া গেল - পাহাড়ে ছয় ডিগ্রি ঠান্ডায় সন্ধেবেলা এট্টু হুইস্কি না খেলে ঠাকুর খুব পাপ দেন। গ্লিনারিজ এর পাবটা টানছিল ঠিকই, কিন্তু ওরাই বা হোটেলে বসে কী করে, এই ভেবে ঘরে বসে সলিটারি ড্রিঙ্কই সাব্যস্ত হল। কারণ খুশী হুইস্কি খায় না। ওরা কফি খেল। আমি তিন পেগ। প্রথম দিন সমাপ্ত।
@বিপ্লব রাহমান কই গেলা। এটায় ছবিছাবা আছে
পড়ছি।
"পোস্টাপিসকে বেড় দিয়ে বাঁক ঘুরে একটু এগোলেই ক্যাপিটাল - সেটাও আগের মতই আছে"
ক্যাপিটাল এখন দার্জিলিং মিউনিসিপ্যালিটির অফিস। আগে সিনেমা হল ছিলো। ওখানেই আমার জয় বাবা তারকনাথ আর সজন বিনা সুহাগন দেখা।
পড়ছি রৌহীন।
দ্য রিট্রিট ঐ হোটেল ড্রীমল্যান্ডের ওদিকটায় তাই না?
@দ দি - হ্যাঁ, ড্রীমল্যান্ডের ঠিক পাশেরটাই।
@b - ক্যাপিটালে আমি দেখেছিলাম "দা লায়ন্স অফ ব্রাজিল" - পেলে, গ্যারিঞ্চা, ভাভা দের নিয়ে। আরো অনেক সিনেমা দেখেছি। তখন ক্যাপিটালে একটা রিল দেখিয়ে সেটা নিয়ে দৌড়ে রিঙ্কে চলে যেত। সেখানে আধ ঘন্টা পরে শো টাইম হত