এখানে এখন বর্ষাকাল। এখানে, মানে বোম্বে-তে।
এখানে প্রায় সারাদিন বৃষ্টি হয়। আমরা যে বাড়িটার যে ঘরটায় থাকি, তার জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখা যায়। দু'মাস হলো আমরা এখানে এসেছি। জানলার বাইরে একটা লতানে গাছ, এই দু'মাসে বৃষ্টির জল খেয়ে কতো বড় হয়ে গেছে - এখন জানলার ভেতরে ঢুকে পড়েছে। পাতা বেয়ে ঘরে ফোঁটা-ফোঁটা জল পড়ে।
এই বাড়িটা আমাদের নয়। আমাদের বাড়ি অনেকদূর। এই বাড়িটায় আমরা ভাড়া থাকি। এই একটা ঘরে আমরা তিনজন। আমি, মা, আর বাবা। ঘরটায় তিনটে চৌকি আছে, কুটকুটে কালো কম্বল বেছানো। দু'টো চৌকি জোড়া লাগিয়ে আমি আর মা শুই। আরেকটায় বাবা। ঘরটা স্যাঁতস্যাঁতে, দেয়ালে ড্যাম্প। খুব ছোটবেলায় আমরা এমনিই একটা ড্যাম্প কোয়ার্টারে থাকতাম। রাতে খুব ঠান্ডা লাগে। আমার সর্দি-কাশি হয়েছে। মাঝে মাঝে জ্বর আসে, আবার ঠিক হয়ে যায়। আমার বাড়ির কথা মনে পড়ে।
এই বাড়িটার নাম মারুতি ভবন। গেটের ওপরে বড় বড় করে লেখা আছে।
এই বাড়িটা থেকে বেরোলে বড় রাস্তা। রাস্তাটা ধরে একটু এগিয়ে বাঁ দিকে ঘুরলে আশ্রম। আশ্রমের দেয়াল গেরুয়া রঙের। না না, ঠিক গেরুয়া নয়, পিঙ্ক। আমরা সন্ধ্যেবেলায় আশ্রমে যাই। রাতের খাবারের আগে মন্দিরে আরতি হয়। এক মহারাজ বসে বসে ধুপকাঠির গন্ধ শোঁকেন। ঢাক বাজে, তাই আমার খুব ভালো লাগে। আমার কাছে একটা খুব মোটা বই আছে। শার্লক হোমস সমগ্র। আমি ঘরে ফিরে চামচ দিয়ে বইটার ওপর ঢাক বাজাই। আশ্রমে খাবার ঘর আছে। আমরা ওখানেই খাই। খাবার ঘরটার নাম অন্নং ব্রহ্মম। দরজার পাশে বড় বড় করে লেখা আছে।
খাবার ঘরের উল্টোদিকের বড়ো বাড়িটার একতলায় গোবিন্দদার চায়ের দোকান। দোকানঘর নেই। লম্বা করিডরের কোণায় গোবিন্দদা টেবিল সাজিয়ে বসে। টেবিলে একটা চায়ের মেশিন। পেছনে দুটো বড় বড় আলমারি। আমি এর আগে কখনো চায়ের মেশিন দেখিনি। মেশিনের গায়ে লেখা নেসটি, নেসকফি।
গোবিন্দদার দারুণ চেহারা। আমার মতো রোগা-প্যাঁটকা নয়। মাথার চুল কদমছাঁট। সাদা গোল-গলা গেঞ্জি, সাদা ধুতি পড়ে। এই ঠান্ডায় সকালবেলায় ঠান্ডা জলে চান করে আসে। গোবিন্দদা আমায় খুব ভালোবাসে। আবার আমাকে নিয়ে মজাও করে। সকালে হসপিটালে যাওয়ার আগে জলখাবার খেতে গেলে বলে -
- কিঁ খাঁবি, টোঁস?
কিন্তু গোবিন্দদার টোস্ট খুব বাজে, শক্ত শক্ত। টেনে টেনে ছিঁড়তে হয়। আমার ভালো লাগে না। টমেটো সুপ-টাও খেয়েছি একবার, খুব টক।
গোবিন্দদা জানে আমি বই পড়তে ভালোবাসি। আমি আশ্রমের লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসি পড়বো বলে। একটা হ্যারি পটারের বই এনেছি। গোবিন্দদা মজা করে বলে, আমায় একটা বই-ভর্তি কাঠের বাক্সে ভরে সমুদ্রের জলে ফেলে দেবে।
গোবিন্দদার দোকান ছাড়িয়ে এগোলে বাঁ-দিকে একটা ঘর। দরজায় লেখা, ডে কেয়ার। এই ঘরটায় কেমো হয়। রোজ না, বড় ডাক্তার যেদিন আসেন, সেদিন। সেদিন ঘরের বাইরে খুব ভিড় হয়। দরজার পাশে যে কাঠের বেঞ্চিটা আছে, সেটায় চাপাচাপি করে লোক বসে থাকে। আমি একজনকে চিনি। কেমো নিয়ে ওর মাথার চুল পড়ে গেছে। আমায় দেখলেই হাসে। মাথায় একটা স্কার্ফ পড়ে থাকে। হলুদ-সবুজ-লাল-কমলা ছোপ-ছোপ। আমার ক্লাসের মেয়েরা শীতকালে এমনি স্কার্ফ পড়তো।
বড় রাস্তার ওইপাড়ে একটা পার্ক। মায়ের সঙ্গে বিকেলে সেখানে হাঁটতে যাই। অনেকে আসে। ওই স্কার্ফ পড়া বউটাও। আমায় দেখে হাসে, হাত নাড়ে। গোবিন্দদাও আসে। হাফপ্যান্ট, জুতো-মোজা পড়ে। দৌড়ে দশ বার পার্কটাকে পাক দেয়। আমায় দেখে হাসে, কথা বলে না।
গোবিন্দদা যখন আমার মতন ছোট, তখন নাকি ও অ্যাথলিট ছিল। ব্যারাকপুরের আশ্রমে থাকত তখন, দৌড়ে প্রচুর প্রাইজ পেয়েছে। ওর সব ট্রফি ওই আলমারি দু'টোয় রাখা আছে।
--
এসব কবেকার কথা!
আজ গোবিন্দদার সঙ্গে দেখা করতে খুব ইচ্ছে হলো। সকাল সকাল, ও দোকান খোলার আগে গিয়ে হাজির হলাম। গোবিন্দদা এল, ন্যাকড়া দিয়ে টেবিল মুছে ধুপকাঠি নাড়িয়ে দোকান খুললো। হঠাৎ, পেছন ঘুরে,আমার দিকে তাকিয়ে একবার থমকে দাঁড়িয়েই আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। কে জানে, দেখতে পায়নি হয়তো।
আসলে, আমি তো এখন একটা ছায়ার মতন হয়ে গেছি
আগে পড়া হয়নি, হোঁচট পাথর পড়ে লেখকের অন্য লেখা পড়তে এলাম।
ধন্যবাদ। কেমন লাগছে, জানাবেন।