সমাধিশিল্পের আলোচনায় দ্বিতীয়, তৃতীয় ও সপ্তম পর্বে মিশর নিয়ে আলোচনা হলেও পিরামিড নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। পাঠকেরা হয়তো একটু আশ্চর্য হয়েছেন কারণ পিরামিডকে সমাধিশিল্পের ইতিহাসে একটি পরাকাষ্ঠা বলে মনে করা হয়। এই ধারাবাহিকের শেষ করব পিরামিড দিয়েই। পিরামিড কি সত্যিই আশ্চর্যের নাকি শুধু বিশালতাটাই তার মূল আকর্ষণ? চলুন, উত্তর খুঁজি।
অনেকে ইতিহাসের থেকে conspiracy theory বেশি ভালবাসে- শুধু আজ নয় গত কয়েকশো বছর ধরে। আর যে স্থাপত্যগুলিকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি রহস্য তাদের নিয়ে আজগুবি তত্ত্বও তত বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে- বিশেষ করে এমন অনেক সংস্কৃতি যাদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিল না- যেমন প্রাচীন আমেরিকা আর আমাদের পরিচিত পুরোনো পৃথিবী- এমন আলাদা আলাদা জায়গায় পিরামিডের উপস্থিতি অনেককে আশ্চর্য করে। সেইসঙ্গে কিছু অক্ষাংশ, দ্রাঘিমার হিসাব আর জ্যোতির্বিজ্ঞান, নক্ষত্রের অবস্থান লাগিয়ে দিলে তো কথাই নেই! ৬০০০ বছর আগের মেসোপটেমিয়ার জিগুরাত, ৪৫০০ বছর আগের মিশরের পিরামিড, ১০০০-২০০০ বছর আগের আমেরিকার মায়া-আজটেকদের পিরামিড, ইন্দোনেশিয়ার বরোবুদুর- কী থাকে না তাদের তালিকায়! এমনকি নবম শতকের দ্রাবিড়ীয় শৈলীর মন্দিরের গোপুরমকেও লোকে ঐ তালিকায় দিব্যি ঢুকিয়ে দেয়। এই সাদৃশ্যগুলি কি সত্যিই আশ্চর্যের? তাহলে বলি- ঐযুগে মানুষ বড় আকারের স্থাপত্য বানাতে গিয়ে পিরামিড ছাড়া অন্য কিছু বানালেই আশ্চর্য হতাম। কারণ অভিকর্ষের নিয়ম অনুযায়ী একটা বড় আকারের স্থাপত্যকে স্থিতিশীল করার জন্য তাকে পিরামিডের আকার দেয়াই বাস্তবসম্মত। অর্থাৎ নিচের স্তর সবচেয়ে প্রশস্ত হবে, তার উপরের স্তর একটু কম- এভাবে চলতে থাকবে। এভাবে নিচের স্তর উপরের ভার সামলাবে।
তাহলে কি মিশরের পিরামিডে আশ্চর্য কিছু নেই? আছে। অন্য যাদের কথা বললাম- আমেরিকার পিরামিড, ইরাকের জিগুরাত- এরা স্টেপ পিরামিড, অর্থাৎ দেখলে মনে হবে ধাপে ধাপে উঠে গেছে। মিশরের পিরামিড ট্রু পিরামিড অর্থাৎ প্রকৃত পিরামিড। ছবিতে পার্থক্য বোঝা যাবে। স্টেপ পিরামিড বানানো তুলনামূলক ভাবে সোজা। উপরের স্তরের ভারবহনের জন্য নিচের স্তরে কিছু বাড়তি মার্জিন রয়েছে। প্লানিংএ একটু গণ্ডগোল থাকলেও পুষিয়ে দেবার সুযোগ রয়েছে- অর্থাৎ সর্বনিম্ন স্তরের প্রসার সর্বোচ্চ স্তরের উচ্চতার সঙ্গে পুরোপুরি সাযুজ্যপূর্ণ না হলেও দোষ নেই। এভাবে ভাবতে পারেন- আপনাকে রুলার ছাড়া সরলরেখা আঁকতে বলা হল- টানা চারফুট। একফুট সরলরেখা হয়তো আপনি এঁকে দিলেন- কিন্তু যত লম্বা করতে যাবেন খেই হারিয়ে ফেলবেন। তারপরে আপনাকে “স্বাধীনতা” দেয়া হল চারভাগে ভাগ করে আঁকার- এবার একটু সহজ হল কাজটা। তবে সেখানেও হয়তো দেখা গেল সন্ধিস্থলগুলো ১৮০ ডিগ্রী না হয়ে একটু অন্যরকম কোণ হল। এভাবেও ভাবতে পারেন- দুশো-দুশো চারশ পাতার দুটো উপন্যাস লেখার থেকে চারশ পাতার একটা উপন্যাস লেখা বেশী কঠিন। সাযুজ্য হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে। উপরে যে “স্বাধীনতা”র কথা বললাম সেটাকে পরিসংখ্যানবিদ্যার ভাষায় বলা হয় ডিগ্রীজ অফ ফ্রিডম।
পিরামিড একদিনে তৈরী হয়নি। পিরামিডের পিছনে অনুপ্রেরণা ছিল মেসোপটেমিয়ার জিগুরাত। এগুলি চতুর্থ সাধারণ পূর্বসহস্রাব্দ নাগাদ তৈরি শুরু হয়। পিরামিডের থেকে হাজার দেড়েক বছর পুরোনো। জিগুরাত সমাধি হিসাবে ব্যবহার হত না, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার হত। জিগুরাতের শীর্ষে দেবতার বাস বলে মানুষ ভাবত। শুধু পুরোহিতরাই সেখানে উঠতে পারত। তাম্রপ্রস্তর যুগের শেষদিকে যখন কৃষি একটা পরিণত জায়গায় পৌঁছেছে- সমাজে স্তরবিন্যাস এসেছে- সেই সময়কার সৃষ্টি এগুলি। আর পিরামিডের নির্মাণ ব্রোঞ্জ যুগে যখন রাজতন্ত্র এসেছে- ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের কেন্দ্রায়ন শুরু হয়েছে। জিগুরাতের অনুকরণে মিশরে প্রথমে নির্মিত হয় মাস্তাবা- ৩০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ (আমি খৃষ্টাব্দ না বলে সাধারণ পূর্বাব্দ বলছি- BCEর বাংলা তর্জমা)। পিরামিডের মতই কিন্তু এদের মাথাটা সমতল- যেন বড় আকারের একটা বেদী। তারপর মিশরে আসে স্টেপ পিরামিড যার কথা আগে বলেছি- উদাহরণ দ্জোসারের পিরামিড- ২৭০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য- স্টেপ পিরামিডের এক একটা স্তরকে একেকটা আলাদা আলাদা মাস্তাবা হিসাবে ভাবা যায়। তারপর আসে বেন্ট পিরামিড বা বাঁকা পিরামিড- উদাহরণ দাহশুরের পিরামিড- ২৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। সম্ভবত ট্রু পিরামিড হিসাবে বানানোর চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু কিছুদূর ওঠার পর কারিগররা গণনা করে দেখেছিল এর স্থিতিশীলতার জন্য এর ঢাল কিছুটা কমানো দরকার। যার ফলে এই বাঁক।
তারপর এল ট্রু পিরামিড- ঠিক যেমন জ্যামিতিক আকার হবার কথা- সেরকম। তবে ট্রু পিরামিডের ভিতরে প্রথম দিকে স্টেপ পিরামিড বানানো হত- কারণ সেটি কম ব্যয়বহুল- অর্থাৎ একটু অসমানভাবে কাটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ পাথর নিয়েও এটি স্থিতিশীল হতে পারে। তারপর বাইরের দিকে আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ ভালভাবে কাটা পাথর ব্যবহার করে ট্রু পিরামিডের আকার দেয়া হত। মাস্তাবা থেকে ট্রু পিরামিডের এই ক্রমবিবর্তন নিচের ছবিগুলোতে পাবেন।
ইরানের চোগা জানবিল জিগুরাত
image credit: By Pentocelo - Own work, CC BY-SA 3.0
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=5105889
মিশরের মাস্তাবা
Image Credit: By Jon Bodsworth - , Copyrighted free use
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=2316988
দ্জোসারের স্টেপ পিরামিড
Image Credit: By Charles James Sharp - Own work,
from Sharp Photography, sharpphotography, CC BY-SA 3.0
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=32434567
বেন্ট পিরামিড
Image Credit: By lienyuan lee, CC BY 3.0
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=54566893
ট্রু পিরামিড: গিজার খুফুর পিরামিড
Image Credit: By Nina - Own work, CC BY 2.5
https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=282496
এত ভারী ভারী পাথর কীভাবে এত উপরে তোলা হত সেই নিয়ে অনেকরকমের তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের মধ্যে আছে। এই লেখার স্বল্পপরিসরে সেটা তুলে ধরা কঠিন- তবে সবচেয়ে বেশী গৃহীত তত্ত্বগুলি র্যাম্পের ব্যবহারের দিকে জোর দেয়। মাটি দিয়ে তৈরী ঢালু র্যাম্প ব্যবহার করে পাথর ঠেলে তোলা হত। একটা স্তর তৈরী হয়ে গেলে র্যাম্পটা আরও প্রসারিত করা হত। কিন্তু এভাবে যত উঁচুতে যাবেন তত বেশী বিস্তৃত র্যাম্পের দরকার হবে! যোজনবিস্তৃত র্যাম্প হয়ে যাবে তো! সম্ভবতঃ র্যাম্পের মধ্যে পাকদণ্ডীর মত জিগজ্যাগ বানানো হত এর বিস্তার কমানোর জন্য। এছাড়া আভ্যন্তরীণ র্যাম্প, স্পাইরাল র্যাম্প- এরকম একাধিক অনুমান আছে। সেই সঙ্গে স্লেজ বা লিভারের ব্যবহারও হত। আবার বলছি এই নিয়ে একাধিক অনুমান ও তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের মধ্যে আছে। নিচের ছবি দেখলে সাধারণ র্যাম্প ও জিগজ্যাগ র্যাম্পের পার্থক্য বুঝতে পারবেন।
জিগজ্যাগ র্যাম্প
সাধারণ র্যাম্প
পিরামিড নির্মাণ ছিল পরিশ্রমের কাজ। ভারতীয় মন্দিরগুলির বিমান বা গোপুরমের ভারী পাথর র্যাম্প দিয়ে তোলার কাজ আংশিকভাবে হাতিরা করত। পিরামিডের ক্ষেত্রে সেরকম কোনও প্রাণীর ব্যবহার নেই। মানুষই করত। কিন্তু তারা কি ক্রীতদাস বা যুদ্ধবন্দী ছিল? আগে সেরকমই ভাবা হত- হেরোডোটাস সেরকমই দাবি করেছিলেন। বিভিন্ন হলিউড সিনেমার দৌলতে অনেকে এটাও ভাবে ইহুদী দাসদের দিয়ে পিরামিড নির্মাণ হয়েছিল- যদিও দুটি সময়কালের হাজার বছরের তফাত আর তাছাড়া ইহুদীদের বাইবেল অর্থাত তোরায় এমন কোনও উল্লেখ নেই। গত ত্রিশ বছরে প্রত্নতত্ত্ববিদরা অনেক প্রমাণ পেয়েছেন যেখান থেকে আন্দাজ করা যায় বেতনভুক শ্রমিকরা এই কাজ করত। এই প্রমাণও পাওয়া যায় সমাধিশিল্প থেকেই। শ্রমিকদের সমাধি- সেখানে সাম্মানিক হিসাবে বা পারলৌকিক জীবনের রসদ হিসাবে বিয়ার ও রুটির ঘড়ার উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে এই শ্রমিকদের সমাধিগুলো থেকে পাওয়া তথ্য থেকে এটা বোঝা যায় তাদের কঠিন পরিশ্রম করতে হত আর আয়ুও কম হত।
মিশরের পিরামিডগুলি কীভাবে বিভিন্ন নক্ষত্রমণ্ডলীর সঙ্গে সম্পর্কিত সেই নিয়েও অনেক সত্য-মিথ্যা-মিশ্রিত তত্ত্ব ও অনুমান আছে। তবে মিশরের পিরামিডে জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটা প্রয়োগ লক্ষণীয় এবং অনস্বীকার্য- সেটা হল বেশীরভাগ পিরামিডের কিনারাগুলির একদম নিখুঁত উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম অভিমুখ। গিজার পিরামিড সহ বেশকিছু পিরামিড যেগুলোর প্রবেশদ্বার আছে তাদের দরজার গর্তগুলির নিখুঁত উত্তরদিকের অভিমুখ। এখন আমরা যেটিকে ধ্রুবতারা বলি সেই পোলারিস তারাটি তখন উত্তর মেরুর ধ্রুবতারা ছিল না। ধ্রুবতারা বদলায় কারণ পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি ছাড়া তৃতীয় একটা গতি আছে- অয়নচলন। সেইযুগে যে তারাটি ধ্রুবতারার স্থানে ছিল সেটি খুবই আবছা- দেখাই যায় না। তবে সেই তারাটিকে ছাড়াও উত্তরমেরু সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়। আকাশের সমস্ত নক্ষত্রের পৃথিবীর চারিদিকে আহ্নিক গতি হয় উত্তরমেরুকে (বর্তমানে ধ্রুবতারা) কেন্দ্রে রেখে। অতএব উত্তরমেরুর আশেপাশের দুটি তারার ঘূর্ণন দেখে সম্ভবতঃ উত্তরমেরু সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছিল বলে অনুমিত হয়।
এছাড়া বলে রাখি, অধিকাংশ পিরামিডের নিচে বা ভেতরে খালি প্রকোষ্ঠ থাকত- কফিন বা বিদায়-উপহার রাখার জন্য। এই প্রকোষ্ঠগুলিতে ঢোকা যায়। এগুলি কর্বেল আর্চ ব্যবহার করে নির্মিত- যার কথা আমরা ভারতবর্ষের সুলতানি যুগে আলোচনা করেছি।
আমরা অনেক সময় প্রাচীন মিশর মানেই পিরামিড- এমন ভাবি। মনে রাখতে হবে প্রাচীন মিশরের ইতিহাস, অন্ততঃ ফারাও উপাধির ইতিহাস ৩১০০ পূর্বাব্দ থেকে ৩০ পূর্বাব্দ অবধি- তিন হাজার বছর ধরে ব্যাপ্ত। পিরামিডগুলি তৈরী হয়েছিল মূলতঃ ওল্ড কিংডমের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থাত ২৭০০ থেকে ২১০০ পূর্বাব্দ অবধি। অর্থাত আমাদের চোখে ক্লিওপেট্রা (শেষ প্রকৃত ফারাও) যতটা প্রাচীন, ক্লিওপেট্রার চোখে শেষতম পিরামিডগুলি ততটাই প্রাচীন! আর গিজার বিখ্যাত পিরামিডগুলি তার থেকেও পুরোনো। ওল্ড কিংডমের পতনের পর পিরামিড নির্মাণে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন হয় আর ভাঁটাও পড়ে। কিছু অরাজকতার যুগের শেষে আসে মিডল কিংডম। পাথরের বদলে ইঁটের পিরামিড নির্মাণ শুরু হয়। এই পিরামিডগুলি প্রযুক্তিগতভাবে বরং বৌদ্ধস্তূপের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ (দৃশ্যগত সাদৃশ্য নেই যদিও)। কেন? কারণ এগুলি ভেতরে মাটি এবং কিছু পাথর ভরে বাইরেটা ইঁট দিয়ে সাজানো হত। অনেক সময় প্রাকৃতিক টিলা বা উচ্চভূমিকে ব্যবহার করে তার গায়ে মাটি ও ইঁট বসানো হত। এরপর আসে নিউ কিংডম। এই যুগে পিরামিড নির্মাণ বন্ধই হয়ে যায়। তবে মিশরের সবচেয়ে সুন্দর মন্দিরগুলো- লুক্সর টেম্পল, কারনাক টেম্পল, এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য- আবু সিম্বেল, ভ্যালি অফ কিংস, ভ্যালি অফ কুইনস এই যুগেই তৈরি।
প্রচুর মানুষ একত্রিত করতে ধর্মীয় তাড়নার ব্যবহার আমরা কৃষিকাজ শুরুর আগের যুগ থেকে- অর্থাৎ তুরস্কের গোবেকলি তেপের সময়কাল থেকে দেখে আসছি। এই সুবিশাল কলাকৃতিক্ষেত্রের নির্মাণ হয়েছিল নব্যপ্রস্তর যুগ শুরুর কিছু আগে। সেই যুগে যখন চাষবাস প্রকৃত অর্থে শুরু হয়নি কিছু মানুষকে আলাদা করে খাবারের জোগান দিয়ে এত বড় নির্মাণকার্য করানোটা বেশ বিস্ময়ের ছিল। এই গোবেকলি তেপের অস্তিত্ব চাষবাস এবং ট্রেড (খাদ্যের বিনিময়ে শ্রম বা পরিষেবার আদানপ্রদান)- এর আদিরূপের প্রতিভূ। জিগুরাত আর পিরামিডও তেমনই আরএকটা সময়কালকে দেখায়। প্রায় হাজার দশেক মানুষকে একত্রিত করা হত একেকটা পিরামিড নির্মাণ করতে। বেতনের বিনিময়েই হয়তো তারা কাজ করত। কিন্তু একটা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা এত লোককে দশকের পর দশক ধরে বেতন দিত- সেটাও কম আশ্চর্যের নয়। সেইযুগে অন্য কোনও তুলনীয় এত বড় ওয়ার্কফোর্স ছিল এক চীনের সেনাবাহিনী এবং সম্ভবতঃ মিশরের ফারাওদের সেনাবাহিনী। তবে সেনাবাহিনী শুধু বেতন দিয়ে চলত না। কারণ সেনাবাহিনী যুদ্ধজয় থেকে প্রাপ্ত লুণ্ঠনের ভাগও পেয়ে থাকে। অর্থাত এখনকার বেতনভুক কর্মচারী বনাম বেতন তথা অংশীদারিত্বভোগী কর্মচারীর যেমন তফাত আছে। তাছাড়া একটা গোষ্ঠী-আবেগও সেনাবাহিনীতে কাজ করে। যাই হোক অনেক মানুষকে একত্রিত করার পদ্ধতি মিশরীয় ফারাওরা আবিষ্কার করেছিল। তা আর্থিক সংস্থানের মাধ্যমেই হোক, ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করেই হোক। মিশরে পরবর্তী কিংডমগুলিতে পিরামিড নির্মাণ হ্রাস পায়- কারণ তাদের প্রথমদিকের মত অতটা কেন্দ্রীভূত ঐশ্বর্য ছিল না।
অন্ত্যেষ্টিশিল্পের আলোচনা এখানেই শেষ। অনেক দেশ এবং অনেক সময়কালের কাহিনী বাকী রইল। আশা করি সেগুলি তুলে ধরার জন্য কখনও এই ধারাবাহিকের দ্বিতীয় খণ্ড নিয়ে ফিরে আসব। যাবার আগে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই- কেন এই ধারাবাহিক শুরু করেছিলাম। বিভিন্ন সমাজের সামাজিক গঠন, তাদের ভিতরকার উঁচু-নিচুর শ্রেণীভেদ, লিঙ্গবৈষম্য, সাজপোশাক, খাদ্যাভ্যাস এগুলো তাদের সমাধি ও অন্যান্য বিদায়-উপহার দেখে বোঝা যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বনাম গোষ্ঠীবোধ- কোন সমাজে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটারও আভাস পাওয়া যায়। পরলোক বিষয়টিকে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ কীভাবে কল্পনা করে এসেছে তার ধারণা পাওয়া যায়। বোঝা যায় সমাজগুলির শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত বিবর্তন। পাওয়া যায় সামরিক অভিযানের কাহিনী, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিষয়ে অনেক তথ্য। পাওয়া যায় কিছু প্রেমকাহিনী, কিছু সমাধিলেখ, কিছু কবিতা। সামগ্রিকভাবে মানবসভ্যতার লিপিবদ্ধ ইতিহাসের অভাবকে অনেকটাই পুষিয়ে দেয়- অন্ত্যেষ্টিশিল্প।
অসাধারণ একটা সিরিজ শেষ হলো, এইটা বই হয়ে বেরুবে আশা করি।
একটাই মন্তব্য, একটু যেন শেষ প্যারার শুরুটা abrupt লাগলো, ভেবে দেখো।
ধন্যবাদ জেডি। বই হিসাবে প্রকাশের অবশ্যই ইচ্ছা আছে। এই বিষয়ে গুরুচণ্ডা৯র মতামত নিয়ে পাঠকদের অবগত করব।
খুব ভাল লাগল। অনেক কিছু জানতে পারলাম।
এই সিরিজটি খুবই ভালো। আমার ধারাবাহিক ভাবে সবকটা পড়ে ওঠা হয় নি। মন্তব্যও করা হয় নি। সময় নিয়ে প্রতিটিই পড়তে হবে। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।