টিকরি বা সিংঘু বর্ডারে গিয়ে বড় রাস্তা দিয়ে চললে অন্য রকম অনুভূতি না হয়ে পারবেনা। টিকরি বর্ডার থেকে ফিরে পরের দিন যখন লিখতে বসেছি সেদিন সারাদিন খবরে কৃষক আন্দোলন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য নিয়ে চর্চা চলছে, আগের দিনই কোর্ট রায় দিয়েছে। রায় বেরোনোর সময়ে, আমি ছিলাম টিকরি বর্ডারে।
আদালতের রায় নিয়ে নানা মহলে নানা আলোচনা চললেও, আন্দোলনের রোজকার জীবন কিন্তু সেসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, আন্দোলনের স্পিরিট তুঙ্গেই। যেহেতু আন্দোলনে এসেই পড়েছি তাই ভাবলাম সরাসরি কৃষকদের থেকেই এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। পাঞ্জাবের মোগা থেকে আসা অবতার সিং বললেন, “কোর্ট সরকারের। কোর্ট কৃষকের নয়। কোর্ট আদানির হয়ে ব্যাটিং করছে। এইসব বলে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে দুবছর মামলা চালিয়ে শেষমেশ এই আইনই লাগু করবে এরা। আমরা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত লড়াইয়ের ময়দান ছাড়ছি না। আমরা ছাব্বিশ তারিখে দিল্লিতে ট্র্যাক্টর নিয়ে মার্চ করব, তার মহড়া দেওয়া হয়ে গেছে, আমরা প্রস্তুত। হরিয়ানার ফতেহয়ারা থেকে আসা রাম সিং বললেন, এর আগে সরকার কোর্টের কথা শোনেনি, এবার কিসান কোর্টের কথা শুনবে না। আমাদের এইসব দিয়ে ভুলিয়ে রাখা চলবে না। আমার এমনিতেও অনেক বয়স, বাড়িতে ছেলে- নাতি রয়েছে আমার মরবার ভয় নেই। ছাব্বিশে আমরা দিল্লিতে মার্চ করবই। একদম সামনে থাকব আমি, গুলি চালালে চালিয়ে দিক, সরকার কত লোককে আর মারতে পারবে, যত লোক মারবে আরো বেশি বিরোধ শুরু হবে। আমাদের অনেক লোক আছে জান দেওয়ার জন্য।”
রাম সিংয়ের মনোবল যে কতটা জোরদার তা বোঝা গেল, যখন তিনি বললেন, “এখনো আমরা ৩ দিক ঘিরেছি দিল্লির, এরপর আমরা বাকি বর্ডারও আটকে দেব। দিল্লির বাইরে কেউ বেরোতে পারবে না।” পাশে বসে থাকা একই গাঁয়ের জগদীপ সিং বললেন, “পশু পাখির জাত হয়, মানুষের জাত হয় না, হিন্দু মুসলমান শিখ সব এক। এসব বলে আমাদের একতা ভাঙা এখন আর সম্ভব নয়। আইন বাতিল না হলে আমরা গ্রামে ফিরছি না।“
বাহাদুরগড় মেট্রো স্টেশন থেকে টিকরি মেট্রো স্টেশনের দিকে কয়েক কিলোমিটার ধরে হাঁটলে দেখা যাবে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্র্যাক্টর আর হাইওয়ে জুড়ে খাটানো তাঁবু। পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা থেকে আগত কৃষকরা বসে রয়েছেন মরণপণ সংগ্রামে। কোথাও রান্না হচ্ছে, কোথাও তাঁবু খাটানো চলেছে, কেউ আবার আগুনে হাত সেঁকে নিচ্ছে কেউ। কেউ ট্র্যাক্টরে শুয়ে দুপুরের বিশ্রাম করে নিচ্ছেন।
রোজই যাচ্ছি টিকরি বর্ডারে। আগের দিন অনেক সকালে খেয়ে বেরোনোর দরুন খিদেও পাশের একটা লঙ্গরে ঢুকে লাইন দিয়ে নিয়ে নিলাম পায়েস। খেতে খেতেই আলাপ হল বিজয় কুমারের সঙ্গে। বিজয় পেশায় চাষি। এসেছেন টিকরি বর্ডারে ৫ দিন হল। আর দুদিন থেকে চলে যাবেন। হরিয়ানার সিরসায় বাড়ি। জিজ্ঞাসা করলাম, “এতদিন ধরে আন্দোলন চলছে, পরিবারের বাকি সবকিছু কীভাবে সামলাচ্ছেন?“ জানা গেল তাঁদের গ্রামে কমিটি তৈরি হয়েছে, সেই কমিটি থেকেই লোকের যাওয়া-আসা স্থির হয়। বিজয় দিল্লিতে আন্দোলনের কাজে চলে এলে, সেইসময় চাষের কাজ সামলান তাঁর ভাই। কদিন পরে বিজয় ফিরে গিয়ে চাষের কাজের হাল ধরলে, আন্দোলনে যোগ দেবেন তাঁর ভাই। বিজয়কে প্রশ্ন করতে হয়নি। তিনি নিজেই বললেন, “এই কৃষি বিল লাগু হলে আমাদের ভবিষ্যত বিপন্ন হয়ে পড়বে, গোটা পাঞ্জাব হরিয়ানা ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়াবে। মোদিজি আম্বানি-আদানিদের হাতে, বিদেশি প্রভুদের হাতে আমাদের জমি তুলে দিতে চাইছেন, আমাদের অস্তিত্ব সঙ্কটে। এই বিল আমরা কোনো মতে লাগু হতে দেব না।"
বিজয় জানালেন আরও মাস ছয়েক এখানে আন্দোলন চালাবার মত জিনিসপত্র নিয়ে আসা হয়েছে। চাইলে আরও বেশি মজুত করা যাবে। লঙ্গরের খাবারও যে ক্ষেতের ফসল থেকেই তৈরি হচ্ছে, তা জানাতেও ভুললেন না। তিনি জানিয়ে দিলেন, “এতদিন আমরা বর্ডারে ছিলাম, ২৬ তারিখ আমরা দিল্লি যাব।” “সরকার এত অনমনীয় কেন? কী মনে হয় আপনার? সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, চুক্তি চাষ করলে চাষিরা আরো দাম পাবে, চাষিদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে, চাষিদের ভুল বোঝানো হচ্ছে, আপনার কী মনে হয়?” “চাষিরা নিজেদের স্বার্থ নিজেরা বোঝে, সরকারের উচিত কৃষকদের কথা শুনে বিল প্রত্যাহার করে নেওয়া, সরকারের আলাদা করে কৃষকদের স্বার্থ বোঝানোর দরকার নেই। ন্যুনতম সহায়ক মূল্য না পেলে আমাদের আত্মহত্যা করতে হবে। সরকার বিদ্যুতেও ভরতুকি তুলে দিতে চাইছে, এভাবে চলতে গেলে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাব। সরকার কোনভাবেই আমাদের ভোলাতে পারবেনা। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অনড়।”
ইতিমধ্যে এগিয়ে গেছি মূল টিকরি স্টেশনের কাছে মূল মঞ্চের দিকে। যেতে যেতে দেখা হল একদল ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে, দেখলাম কৃষক-আন্দোলনের খবরাখবর নিয়ে হাজির হওয়া ট্রলি টাইমসের তাঁবু। এর মধ্যেই দেখা হয়ে গেল প্রকাশের সাথে। প্রকাশ গুরগাঁওয়ের মারুতি কারখানার শ্রমিক এবং শ্রমিক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনও দাঁড়িয়েছে। প্রকাশ নিজে হরিয়ানার গ্রামের ছেলে, কৃষক আন্দোলনে সক্রিয়, একদিন বাদে সে রওনা দেবে নিজের গ্রামে। নিজের গ্রামে এবং আশে পাশের গ্রামে গিয়ে কৃষক আন্দোলনের পক্ষে প্রচার করবে। জিজ্ঞাসা করলাম, শ্রমিকরা কতটা স্বতঃস্ফুর্ত কৃষক আন্দোলনের ব্যাপারে? প্রকাশের কথায়, শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নিতে সরকার লেবার কোড নিয়ে এসেছে, কোনো অধিকারই বেঁচে থাকবে না শ্রমিকদের, তবে শ্রমিকরা এখনও এই ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন নন, তাই শ্রমিকদের একার পক্ষে এই মাপের আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তবে এত বড় কৃষক আন্দোলন, নিঃসন্দেহে শ্রমিকদের মধ্যে নাড়া দিয়েছে, এবং শ্রমিকদের সচেতন করে তোলার নতুন সুযোগ এসেছে। প্রকাশের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই খবর এল, রাজস্থান থেকে, কৃষকরা হাইওয়ে বরাবর আসছেন দিল্লির দিকে। দুদিন আগেই পুলিশের সঙ্গে এঁদের সরাসরি সংঘাত হয়েছে। হরিয়ানার ধারুহেরাতে এঁরা হাইওয়ে আটকে রয়েছেন। জানা গেল, এরাও দিল্লির দিকে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রকাশের বক্তব্য, পথে পড়বে প্রচুর কারখানা, এই কারখানাগুলির থেকেও শ্রমিকরা যোগ দিচ্ছেন কৃষকদের সাথে।
কৃষক আন্দোলনের শুরুর থেকেই শুনছিলাম এই আন্দোলন ধনী চাষি তথা কুলাকদের। এই বক্তব্যের সমর্থনকারীদের থেকে শুনতে হয়েছে, কৃষকরা পিজ্জা খাচ্ছেন বা মার্সিডিজের ছাদে চড়ে বসে আছেন। সরকার-বাহাদুরও নানা ভাবে একই কথা বলে আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। তাই চাক্ষুষ দেখার ইচ্ছা ছিল অনেক দিনই। দেখলাম, হুড খোলা জিপের সঙ্গে, ত্রিপলের নিচে খড়ের বিচালিতে শোয়া, চামড়া কুঁচকে যাওয়া আধ-ময়লা চাদর-জড়ানো বৃদ্ধ চাষিও রয়েছেন দিব্যি।
পুরোটা দেখে মনে হল, এঁরা যেন সংখ্যায় হুড খোলা জিপ বা মার্সিডিজের তুলনায় অনেক অনেকটা বেশি। আলাপ করেই ফেললাম পাতিয়ালা থেকে আসা রাজবীর সিংয়ের সঙ্গে। সরাসরিই জিজ্ঞাসা করলাম, “অনেকে বলছেন, এটা ধনী কৃষকদের আন্দোলন, আপনি কী মনে করেন?” রাজবীর বললেন- “আমার বাড়িতে দুটো ঘর আছে, আমি আমার মেয়ের পড়াশোনা চালাতে পারি না ঠিক করে, আমার জমিও নেই, আপনার মনে হয় আমি ধনী কৃষক? এখানে আমাদের গ্রাম থেকে সমস্ত ক্ষেতমজুর পরিবার এসেছে। এই কৃষি আইন এলে আমরা যেটুকু এতদিন রোজগার করতে পেরেছিলাম আমাদের গ্রামে থেকে এটুকুও হারাব, শহরে গিয়ে আমাদের কাজ খুঁজতে হবে। আমরা তিন পুরুষ ধরে একই গাঁয়ে রয়েছি, আমি আমার গ্রাম ছেড়ে যেতে চাইনা।”
রাজবীর সিংয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেলাম মেট্রো স্টেশনের দিকে, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ফিরতে হবে এবার। এই আন্দোলন কোনও ভাবেই যে কুলাকের আন্দোলন, বা শিখেদের আন্দোলন নয়, তা এতক্ষণে নিশ্চিত জেনেছি। দেখেছি বিপুল সংখ্যায় ক্ষেত-মজদুররা এসে পৌছেছেন এই আন্দোলনে। কৃষক-ক্ষেতমজদুরদের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন দিল্লির আশে পাশে থাকা শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকেরা। এছাড়াও এঁদের পাশে রয়েছেন পাঞ্জাব-হরিয়ানার গোটা সমাজ, যাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন ছাড়া এই আন্দোলন চালানো সম্ভব নয়। ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অক্ষ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে এই আন্দোলনের। আদালতের রায় নিয়ে সমাজে তর্ক বিতর্ক চলতে থাকলেও আন্দোলন কিন্তু চলছে সমান উদ্দীপনা নিয়েই।
ভাল লাগল ।
'এই আন্দোলন কোনও ভাবেই যে কুলাকের আন্দোলন, বা শিখেদের আন্দোলন নয়, তা এতক্ষণে নিশ্চিত জেনেছি। দেখেছি বিপুল সংখ্যায় ক্ষেত-মজদুররা এসে পৌছেছেন এই আন্দোলনে। কৃষক-ক্ষেতমজদুরদের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন দিল্লির আশে পাশে থাকা শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকেরা'
- এই তথ্য গুলোর প্রচার দরকার
সঠিক তথ্য তুলে আনার জন্য ধন্যবাদ।
ব্যাপার হলো সব দেশেই এই কর্পোরেক্রেসি মাথা চাড়া দিচ্ছে। এইটা এখুনি না থামানো গেলে সব কিছুু গিলে ফেলবে।