এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  শরৎ ২০২০

  • গ্রামবাংলার গরিব দাওয়ায় পড়ে থাকে মহার্ঘ্য জ্যোৎস্না

    মৃণাল শতপথী
    ইস্পেশাল | উৎসব | ০৯ নভেম্বর ২০২০ | ৩৯৯৪ বার পঠিত | রেটিং ৪.৬ (৮ জন)
  • ‘The sun does not forget a village / just because it is small’—African Proverb

    সকালগুলো মনোরম এ সময়। বাতাসের গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তে শুরু করে। উৎসবের ফুল শিশিরভেজা ঘাসে ছড়িয়ে দেয় গাছ, একটা মনকেমনের সুগন্ধ শরীরময় আনচান করে। এসময় সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছাড়তেও আলস্যি নেই। গ্রামের বাড়িতে থাকলে পুকুরঘাটের ভাঙা পাথরের ধাপে বসে জলে ভাসা কুয়াশা দেখতাম। সেই কুয়াশা কেমন মৃদু বাতাসে ধোঁয়া কেটে কেটে উড়ে গিয়ে স্থির হত ওপারে শুরু হওয়া হৈমন্তী ধান-জমির এক মাথায়। রাতের জল লেগে আছে ধানের শিষের আনত শিরে, যেন ঘুমভার জড়িয়ে আছে সারা খেতে । কবে পড়া ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’-র লাইনগুলি মনে পড়ে, ‘কোলে ধান, কাঁখে ধান নিয়ে একেকটি গাছ নিঃসাড়ে ঘুমায়। কুয়াশা চুঁইয়ে শিশিরের একেকটি বিন্দু শীষের ওপর স্বপ্নের তরল ফোঁটার মতো পড়লে ধানগাছের ঘুম আরও গাঢ় হয়।’
    সদ্য কচি ধানে দুধ আসার সময় ধানের ভারী ঘুম হয়। তার আগে দীর্ঘ শ্রমের ইতিবৃত্ত। মাটি তৈরি হবে বলে কৃষক তার ভাঙা গাল নিয়ে নীচে নয় আকাশের দিকে তাকায়। শুরুতে কয়েক পশলা বৃষ্টি পেলে মাটির কঠোর বুক ভেজে, নরম হয়। লাঙল দিতে সহজ তখন। এক ফসল তুলে নিয়ে আর-এক বোনার আগে জমিতে থেকে যায় কেটে নেওয়া ফসলের অবশেষ। খড়ের নড়ার গোড়ায় জল পেলে সে মাটি চষতে কষ্ট নেই। তবু এক-এক শীতের সন্ধ্যায় জমির পর জমিতে ধু ধু আগুন জ্বলে, নড়ায় ধরানো আগুন। চাষির অন্ধবিশ্বাসে নড়ার ছাই জমিতে মিশে উর্বর হয়! সন্ধে-নামা বাতাসে তার ধোঁয়া কুয়াশার মতোই স্থির হয়ে থাকে বহুক্ষণ।
    তারপর সে কত আয়োজন। চাষির মাটির ঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা অস্ত্রশস্ত্র, লাঙল, জোয়াল, মই। পুকুর শুকিয়ে তখন কিনার থেকে মাঝের দিকে সরে যাচ্ছে জল। আর পায়ে পায়ে বেরিয়ে পড়ছে রাস্তা, পুকুরের মধ্য দিয়ে রাস্তা। এমন সকালগুলোয় দেখি কাঁধে লাঙল নিয়ে সেই সংক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া পথ ধরে চাষি চলেছে জমির পানে, সামনে রোগা রোগা দুই বলদ অনিচ্ছুক হাঁটে। তাদের জোয়ালে জুতে বারবার চষতে হয় জমি, যত ভালো চষা, তত ভালো চাষ। মাটি হবে ফুলের মতো নরম তবেই আহ্লাদ চারাদের। আবার মেঘের দিকে চাওয়া। বর্ষা নামলে বীজতলা প্রস্তুতি হয়। সবুজ সবুজ ধানের শিশুর গোছা। কাদা কাদা দই হয়ে যাওয়া মাটিতে ফাঁক রেখে রেখে চারা বোনা তবেই গাছ বাড়বে দ্রুত। কাদাজলে বাড়বে, কাদাজল মেখে মেখে চাষির পায়ে হাজা। জল শুকিয়ে এলে শিকড় চারাবে কিছু গভীরে। নিড়ানি দিতে হবে, এমন কত্ত কাজ। লকলক করা সেই সবুজ ধান্যক্ষেত্র দু-চোখ ভরে দেখতে হয়। হাওয়া বয়, সবুজ ঢেউ ওঠে, শরতের মেঘ ছায়া, সেই রোদ, ঢেউয়ের সঙ্গে খেতের একধার থেকে অন্য ধারে বয়ে চলে যায়! এমন অঢেল সুন্দরের সঙ্গে মিশে থাকে রং, থাকে মানুষের অন্নচিন্তা, মন আর শরীরের রসদ পাকে পাকে জড়িয়ে থাকে বলেই অপার্থিব মনে হয়।
    তারপর ধান ‘ফুলে’ ওঠার সময়। ভোরের দিকে ঘুমের ভেতর কতবার শুনেছি মাঠ থেকে সম্মিলিত স্বর ভেসে আসে, ‘ছোটো ধান বড়ো ধান ফুলে ফুলে!’ এই এমনই নল সংক্রান্তির সময়ে। নলগাছের ডাল উপাচারে বেঁধে ছোঁয়ানো হয় বাড়ন্ত ধানগাছের মাথায়, আশীর্বাদের মতো, যেন মনে মনে বলা, বড়ো হও, বড়ো হও, মানুষ হও! এই বড়ো হওয়ার পথে যতেক বাধা, পাখিদের থেকে, ইঁদুরের থেকে, মাজরা পোকা থেকে, পঙ্গপাল থেকে বাঁচাতে অবিশ্রান্ত লড়াই, গাছে গাছে জোড় লেগে গেলে হাত দিয়ে তাদের আলগা করে চাষি, আলো বাতাসের ঘর বুনে দেয়। এত সবের পর তবেই না একদিন সময় আসে ধান কাটবার।
    ‘সুরুজে বিদায় মাঙে শীতেতে কাতর।
    শীষের ভিতের ধান কাঁপে থরথর।।
    পশ্চিমে হইল রাঙা কালাপানি অচিন ডাঙা
    ফকিরে করিবে মেলা রাত্রি দুই পহর।
    ধানের আঁটি তোলো চাষা মাঝি ফেরো ঘর।।’
    কাস্তে দিয়ে ঘসঘস করে ধান কাটার শব্দ খানিকটা নেশা লাগার মতো। একসময় জঙ্গলমহল থেকে পুরুষ-রমণীরা মেদিনীপুর জেলার নীচু জমিতে নাবাল খাটতে আসত দূর পথ পাড়ি দিয়ে। গোরুর গাড়ি বোঝাই করে ধানের গাদা চাপানো হয়। ধানের গায়ে ধান লেগে খুব মৃদু তান ওঠে। ঝমর ঝমর ধানের বোঝা চলতে চলতে ফেলে যেতে থাকে ধানের শিষ, সীতার গহনার মতো।
    ‘সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথ পরে,
    মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে!’
    আমরা ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের দল গাড়ির পিছু ছুটতে ছুটতে সেই শিষের গয়না কুড়োই। যত বেশি শিষ তত বড়ো ‘লোট’। নবান্নের পুজোয় ধানের শিষের লোটে সিঁদুর লাগিয়ে ঘরের মাটির দেয়ালে টাঙানো থাকে সারাবছর। আহা শস্যের সেই উৎসব! ঢেঁকি তোমার দিন গিয়াছে, তুমি কেবল এখন স্বর্গেই ধান ভানো! গোবর দিয়ে নিকোনো হয় খামার। চালের গুঁড়ির আলপনা। ধান ঝাড়ার কাজ, কুটো থেকেও ধান বের করে আনতে গোরু দিয়ে হয় পাতলা খড়ের পতলি মাড়া! গাদায় পচে কালো হয়ে যাওয়া খড়ের ছন সরে নতুন খড়ের গাদা বসে এক-একটা দোতলা বাড়ির মতো! সারি সারি খড়ের গাদার মাঝে অলিগলি দিয়ে আমাদের লুকোচুরি খেলা। নতুন খড়ের গন্ধে মজে থাকে গোটা গ্রাম, আমার শৈশব।

    পূর্বমেদিনীপুরের তমলুকের প্রত্যন্ত গ্রামে পানবরজের গল্প শোনান সেলিম মল্লিক তাঁর ‘আশমান জমিন’ বইতে। আর সেই পান চাষির গ্রামে চাষের কারণেই এক হয়ে বসবাস ‘যবন-কাফেরের!’ কে হিঁদু, কে মোসলমান চেনা দায়। সেখানে মুসলমান রমণী আর তার দুধেল গাইয়ের ভাব-ভালোবাসার গল্প। বাছুর মরা গাই-মায়ের কাছে খড়ের তৈরি নকল বাছুরের ভ্রম! প্রতি বাড়িতে থাকে একটি ছোট্ট দালান। সেখানে বরজের পানের গোছ বানানোর কাজ চলে। ভিটে লাগোয়া কালাবাড়িতে অল্প ক-গাছ পানের বরজ। বরজ গড়তে চাই ওস্তাদ কারিগর। নিকাশির খালে ভাসিয়ে ভাসিয়ে দূর হাট থেকে আসে বরজের জন্য বড়ো বড়ো জুতের বাঁশ, আমন ধানের খড় আর খড়ি গাছের পাকাঠি। নারকেল দড়ি বাঁধা বাঁশের কাঠামোর ওপর খড়িগাছের ছাউনি ছেয়ে চারপাশে খড়ের ঘেরা দিয়ে তৈরি হয় ‘প্রকাণ্ড দেশলাই বাক্সের মতো মিঠে পানের ঘর।’ পান রোয়ার দিন হিঁদু-মুসলিম বাড়িতে যৌথ উৎসব। উভয় সম্প্রদায়ের ছোটোদের নতুন জামাপ্যান্ট, বাড়ির কর্তা পরবেন পাটভাঙা লাল গামছা। বাড়িতে ভালো-মন্দ রান্নাবান্না। কেউ আনবেন রাজজাতের লতা। ল বসানোর আয়োজন হয়। ধূপ জ্বলে, পেতলের ঘটিতে কলাপাতা বেঁধে কালীমন্দির থেকে আসে চরণামৃত, ঈশান কোণে তার ছড়া পড়ে। বাজে শাঁখ। পান বাড়ির অন্দরে সম্প্রদায় নির্বিশেষে হাতে হাতে সাজানো হয় লতা। সাজানো হলে পানচাষি বরজের দরজার বাইরে এসে মাটিতে সালাম রাখে। ঈশানকোণে প্রতিষ্ঠা হয় মানকচুর পোয়া।
    ‘মানের পাতা মানের পাতা
    পান ফলবে কত,
    যেমন নয় তেমন নয়
    মান পাতার মতো।’
    বড়ো বড়ো পানের স্বপ্ন। কুনজর আটকাতে ঈশানকোণে ঝুলতে থাকে গোরুর খুলি।
    গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে খেতে খামারে বছরভর চলে এইসব শস্যের উৎসব। আর ফসলের কারিগর, শিল্পীরা ধুলোকাদা মাখা মলিন দেহে অতি যত্নে, নিপুণতায়, অঝোর শ্রমে, অভাবে, তিতিক্ষায় ভাস্করের মতো গড়ে তোলেন ফসলের শিল্প।


    চলে যাই আমার মামাবাড়ির দেশ। সুবর্ণরেখা নদী। ভসরাঘাটের বৃহৎ চওড়া নদীখাত, কমই দেখা মেলে এমন। জঙ্গলকন্যা সেতুর ওপারে নয়াগ্রাম, ঝাড়গ্রাম জেলা, কাছেই ওড়িষা বর্ডার, এপারে পশ্চিম মেদিনীপুর। আর এই সীমান্ত এলাকাগুলিতে এলে বোঝা যায় বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রকমফের। এদিকের বাংলায় যেমন মিশে থাকে ওড়িয়া ভাষা, যাকে হাটুয়া ভাষা বলে, কেউ বলে সুবর্ণরৈখিক। আবার বাঁকুড়া জেলা সীমান্তেই মেদিনীপুরের বাংলা মিশে যায় বাঁকুড়ার বাংলার সঙ্গে। সুবর্ণরেখার দুইধারে প্রত্যন্ত গ্রামীণ বসতি নিয়ে সুবর্ণরৈখিক অঞ্চল। কে জানত এমন জলজঙ্গলের দেশে নিভৃতে চর্চা হয়, গ্রামীণ নাট্যশৈলী! ধামসা মাদলের সঙ্গতে ওড়িয়া মেশা বাংলার সুবর্ণরৈখিক গানের সুরে সুরে অভিনীত হয় ‘চড়িয়া-চড়িয়ানি’-র পালাগান, ‘মালতি-শবরপালা’। আসরে একজন সাজে চড়িয়া, সে গানে গানে সংলাপ বলে। সে বসে পড়লে ওঠে চড়িয়ানি সাজা আর-একজন। মূলতনয়া গ্রাম, গোপীবল্লভপুরেই দেখা যায় এই শৈলী। লুপ্ত হতে বসা এই সমস্ত নাট্যশৈলী নতুন করে পুনরুদ্ধার হচ্ছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, রাজ্য সরকারের তথ্যসংস্কৃতি দপ্তরের সহায়তায়। উদ্ধার হচ্ছে প্রাচীন বইপত্রে লিপিবদ্ধ এইসব পালাগান অথবা গ্রামের মানুষের স্মৃতিতে থেকে যাওয়া পালাগানের সংলাপগুলি সংগ্রহ করে। চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত দিনমজুর, জনখাটা শ্রমিকদের গড়ে পিটে চলছে এই নাট্যচর্চা। আবার জামবনীর গ্রামীণ শিল্পীরা নতুন করে তুলে আনছেন দুর্লভ ‘পড়ভা’ নাচ। কিছুটা পুরুলিয়ার ছৌ নাচের আদল কিন্তু ছৌয়ের মতো মুখোশ নয়, ‘পড়ভা’-র মুখোশটি কাঠের যা কোমর থেকে পরতে হয়। শোনা যায় চিল্কিগড়ের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি এই নাচ, যেখানে রাজাও ছিলেন অন্যতম নৃত্যশিল্পী।
    ভসরাঘাটের সেতুর তলা থেকে কয়েক কিলোমিটার এপাশ ওপাশ কাশফুলের মহাকায় বন এ সময়। নদীপাড় জুড়ে সারা বছর নানা ধরনের চাষ। নদীপাড়ের খেতগুলিকে এখানে বলে পালের ক্ষেত। পালের বেগুন, পালের কুমড়ো, পালের তরমুজ, পালের শশা, এমন সব ডাক। নদীপাড় জুড়ে আখের খেত, আখ মাড়াইয়ের কল, গুড় জ্বাল দেবার উনুন জ্বলে। দুইপারের ঘরে ঘরে কুঁদো কুঁদো গুড় দেখতাম ছোটোবেলায়। অন্ধকার মাটির ঘরে ঢুকলেই জমিয়ে রাখা রহস্যময় প্রাচীন গুড়ের নাগরি, মোহরের কলসের মতো সাজানো, অদ্ভুত মাদক গন্ধে মাতোয়ারা। শীতের সময় ক্ষীণতোয়া নদী পেরিয়ে নয়াগ্রামের জঙ্গল থেকে আসে হাতিরা। হাতিশাবকটিকে পিঠে নিয়ে জল পেরোয় মা হাতি। আখের খেত মুড়িয়ে খায়, ফসল মাড়ায়, ঘরের মাটির দেয়াল ভেঙে গুড়ের নাগরি খোঁজে! আর সেই হাতি তাড়াতে গ্রামে গ্রামে আছে হুলা পার্টি। লোহার রডে চটের বস্তা জড়িয়ে পোড়া মোবিলে ভিজিয়ে নিয়ে হয় হুলা, হাতির কাছে এসে আগুন দেওয়া হয় তাতে তারপর হা-রে-রে করে তেড়ে যাওয়া। হাতি আর মানুষের এমন বিচিত্র সংগ্রামের চিত্র দেখেছি আরও পশ্চিমে জঙ্গলমহলের বাঁকুড়া সীমান্তে শালবনী, উড়া সাই, দক্ষিণ শোলের জঙ্গলে।
    সুবর্ণরেখা তো স-সাগরা নদী। ওড়িশার বালেশ্বরের কাছে গিয়ে মিশেছে সাগরে। নদীর বাঁকে বাঁকে কত ‘দঁক’, মহিষাসুর দঁক, কত ‘দহ’ মশানির দহ, বৈশাখী পাল, খুদপাড়ের চর। নদী তো নয়, আস্ত ইতিহাস! মিথ আর লোকগাথা স্রোতের সঙ্গে বয়ে চলে। ‘জঙ্গলকন্যা’ সেতু হবার পর ফেরিনৌকার দিন গেছে। এখন মাছ ধরার জেলেনৌকো, কোশা, পানসি, জেলেডিঙি দেখা যায়। এই নৌকা তৈরিরও বেশ কেরামতি আছে। নলিনী বেরার ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’-য় আছে শিমুলতলার নৌকার কারিগরদের কথা। নৌকো তৈরি হয় শালকাঠে, অর্জুন কাঠে অথচ কারিগরদের নিয়ে গান বাঁধা হয়,
    ‘শিমুলখুঁটার নৌকা তোমার হে,
    ও নৌকা তলায় জলের ভারে,
    ও শিমুলকাঠের নৌকা তোমার হে...’
    নৌকোয় আলকাতরা লেপে রং করা। গলুইয়ের কাঠে দুইধারে আঁকা হয় চোখ। নৌকোর তখন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়! নৌকোর মিস্ত্রিরা, গ্রামের বউরা মিলে করে নৌকোপূজা। ‘সিঁদুরদান’, ‘দণ্ডাপূজা’ শেষে একদিন জলে ভেসে পড়ে নৌকো। মাছ ধরার কতরকমের জাল। নদীময় বিছিয়ে রাখা ‘গাঁতি’ জাল, নৌকায় দাঁড়িয়ে মাথার ওপর একপাক ঘুরিয়ে নদীতে ফেলা ‘মাথা ফাবড়ি’ জাল, ‘কাঠি জাল’। এন্তার রুই-কাতলা-বাটা-খয়ের, জলের রুপোলি শস্য!
    নদী বয়ে গেছে দাঁতনের দিকে। সেখানের মাটিতে মাটিতে মিথ, ইতিহাস। কাছেই মোগলমারি গ্রামে ২০০৩ সালে মাটি খুঁড়ে পাওয়া প্রায় দেড় হাজার বছর আগের ষষ্ঠ শতকের বৌদ্ধবিহার। সারা গ্রামটিতে ছড়িয়ে আছে শতাব্দী-প্রাচীন ইট, পোড়ামাটির পাত্রের টুকরোটাকরা, ভাঙা প্রদীপের অংশ। এই ছোটো গ্রামে অতুলনীয় প্রত্নসম্পদ। মাটির গর্ভে তো বটেই সাধারণ মন্দিরের গায়ে, রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের প্রাচীরে যে কারুকাজ, অবলোকিতেশ্বর, গন্ধর্ব, কুবের, জাঙ্গুলির স্টাকোর নির্মিত যে মূর্তিসকল, তা ইতিহাস-প্রাচীন উন্নত শিল্পবোধের দৃষ্টান্ত বহন করে চলেছে। হিউয়েন সাঙয়ের লেখাতেও উল্লিখিত এই বিহারের কথা। আর আছে মিথ। খননকাজ চলা সাইটটি আসলে তো ঢিবি, প্রাচীন ইটের ঢিবি। মহাবিহারের ইট, গর্ভগৃহের ইট, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কুঠুরির ইট। এই ঢিবির নাম সখীসেনার ঢিবি, সখীসেনার পাঠশালাও বলে। অহিমাণিক আর সখীসেনার প্রেম আর বিচ্ছেদের লোকায়ত কাহিনি। সেই কাব্য লিখেছিলেন এক মুসলমান কবি, ফকিররাম। সেই ঢিবিতে আবিষ্কার হল বৌদ্ধধর্মের পীঠস্থান।

    সারা জেলা জুড়েই এমন অভিনব ইতিহাস, মিথ আর সংগ্রামের গল্প। এই জেলা কর্ণগড়ের চুয়াড় বিদ্রোহের ভূমি, শালবনী-চন্দ্রকোণার লায়েক বিদ্রোহের পটভূমি যা নিয়ে দেড়শো বছর আগে লেখা হয়েছিল, অধুনাবিস্মৃত ‘শালফুল’ নামক উপন্যাস। এই শালের দেশে ঘুরে বেড়িয়েছি আদিগন্ত। শালবনের মাথায় ওঠে আশ্চর্য নীল মেঘ। শনশন হাওয়ায় রাস্তা-জুড়ে ঝরে পড়ে স্তূপ হতে থাকে যত বিষাদগন্ধ মাখা শালফুল। শালগাছ অভিজাত এখানে। তাকে ঘিরে অগণিত প্রান্তিক গাছপালা ভরে ওঠে অজস্র কুসুমে। সেই অপরূপতা যেন গরিবের মাটির দাওয়ায় পড়া জ্যোৎস্নার মতো, এমন অকারণ সম্পদে তার কী হবে ভেবে বিব্রত!
    গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহের পর বিকেলে জঙ্গলের রাস্তার ধরে হেঁটে যাই। ফসল তুলে নেওয়া শূন্য খেতের গা ছুঁয়ে ছুটে আসে বাতাস, প্রাণ জুড়োয়। তিল পেকে খামারে উঠেছে। পাকা সড়কে সেই তিল বিছিয়ে দিলে গাড়ির আসা-যাওয়ায় বিনা শ্রম মাড়াই। মাড়াই হওয়া তিল কুলোয় নিয়ে দখিনা বাতাসে ধরলে ধুলোর মতো খোসারা উড়ে যায়। এখানে পাকা রাস্তাও কাজে লেগে পড়ে চাষিদের সঙ্গে, বাতাসও দিয়ে যায় তার শ্রম! শুকনো শালফল মাড়াইও চলে। গোলাকার ফলের খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের অংশ চোদ্দ-পনেরো টাকা কিলো দরে যায়। বীজ থেকে তেল হয়, শাল তেল, আরও কী কী যেন হয়।
    ভোট আসে। মাঠেঘাটে দরদরে ঘাম ঝরিয়ে পাশাপাশি জনখাটা মানুষ, হাটেবাজারে একসঙ্গে পসরা মেলা মানুষ, একে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া কাকা, খুড়া, চাচা সম্পর্কের মানুষ ভোট এলে পরস্পরের রক্ত নিতে চায়! ভোট এলে পাশের মানুষ হিন্দু সাজে আর মুসলমান হয় একটি গালির নামান্তর। ভোট শেষ হলে শহুরে রাজা, রানি সিংহাসনে বসে। গ্রামের ঘাড়ে পা রেখে, গ্রামের রক্ত ঘাম অশ্রুতে ধুয়ে অভিষেক হয় তাঁদের। হা-ক্লান্ত গ্রাম শ্মশানে চিতার আগুন ছুঁয়ে এসে শূন্য ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে। শিরিষের ডালে উড়তে থাকে রোদ-বৃষ্টিতে শুকিয়ে ভিজে ন্যাতা হওয়া ভারহীন সামান্য পতাকার কাপড়।
    আর আমি দেখি বরের সাইকেলে চেপে আদিবাসী রমণী চলে যাচ্ছে সূর্যডোবা পশ্চিমের দিকে। তার হাতে ধরা নতুন শালপাতা ভরা গুচ্ছ ডাল। আমার গ্রামবাংলার গাছেদের এই ভূমি। নদী, খেত-খলিয়ান, পরবপার্বণ, ফসলের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে লতায় পাতায় জড়িয়ে থাকা মানুষের এই ভূমি।


    ছবিঃ ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক

    পড়তে থাকুন, শারদ গুরুচণ্ডা৯ র অন্য লেখাগুলি >>
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০৯ নভেম্বর ২০২০ | ৩৯৯৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Subhajit Sekhar Naskar | 165.225.***.*** | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ১০:২৭99792
  • boro bhalo likhechen dada

  • santoshbanerjee | 103.76.***.*** | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ১১:৩৭99793
  • অদ্ভুত শোনায় এই সব তথ্য গুলো ।..তাই না ??আমরা যারা গ্রাম বাংলা কে ঘুরে দেখতে পারিনি বা এখনো জানতে চেষ্টা করিনি ।..তাদের কাছে এই নিবন্ধ টা অনেক কাজে লাগবে মনেহয় !!

  • b | 14.139.***.*** | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ১২:৩০99797
  • বড়ো ভালো লাগলো। 

  • | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ১৩:০৯99799
  • অপুর্ব। 

  • শঙ্খ | 2402:3a80:a99:e542:b5eb:bb44:5ab5:***:*** | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ১৭:০২99805
  • অপূর্ব লেখা। এই ছবি আমি চিনি। বড় মন কেমনিয়া আর উদাস এইসব ছবি। ধানসেদ্ধ হবার গন্ধ, ধান ঝাড়াই মেশিনের শব্দ, কাঁকুরে ল্যাটেরাইটের রাস্তার মোড়ে মোরগঝুটি ফুলের ঝোপ ফিরে ফিরে আসে ভোরের স্বপ্নে। খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন এইসব ছবি, ঘ্রাণ আর শব্দের সমাহার।

  • সুরজিত ঘোষ | 116.193.***.*** | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ১৭:১০99806
  • খুবই ভালো লিখেছ মৃণাল। গ্রামের নিকানো উঠোনের মত ঝকঝকে।

  • ব্রতী মুখোপাধ্যায় | 2405:201:9003:e016:1ca3:2343:265e:***:*** | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ১৭:১৯99807
  • মন ভরে গেল। পড়তে পড়তে কোথায় কোথায় হারিয়ে গেলাম। কত দীর্ঘ সময় হেঁটে এলাম। খুব ভাল লিখেছ, মৃণাল।

  • Prativa Sarker | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ১৭:২৭99808
  • আহা, এই তো উৎসব, সত্যিকারের। শহরের নানারঙা আলো মাইক আর শব্দের উৎসব নয়। প্রকৃতির নিজের হাতে সাজানো উৎসব। 

  • স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত | 2409:4061:2c13:7db3::7389:***:*** | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ২২:০২99818
  • সুন্দর, মৃণাল।

  • সেলিম মল্লিক | 42.***.*** | ০৯ নভেম্বর ২০২০ ২২:০৪99819
  • খুব খুব আন্তরিক আর সংবেদনে স্পন্দিত লেখা।

  • Saoni Mandal | ১০ নভেম্বর ২০২০ ০৩:৪৮99833
  • বড়ো মনোরম .

  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ১০ নভেম্বর ২০২০ ০৯:২৭99841
  • তথ্য সমৃদ্ধ মরমী লেখাটি পড়ে চলেছিলাম, ভালো লাগছিল খুব। কিন্তু যে ছবিটা ছাড়া চালচিত্রটি অপূর্ণ লাগছিল, একেবারে শেষে এসে তার সন্ধান মিলল এবং পটটি সম্পূর্ণ হল। 

  • বিপ্লব রহমান | ১০ নভেম্বর ২০২০ ১০:৫৭99847
  • মাটির সোঁদা গন্ধ আর রোদ্দুরের ঘ্রাণ লেখার জমিন জুড়ে। পড়তে পড়তে কেমন ঘোর লেগে যায়...

  • reeta bandyopadhyay | ১০ নভেম্বর ২০২০ ১৯:১৫99850
  • অপূর্ব...... আরও অনেক অনেক লিখুন....আমরা ইট কাঠের জ‌ংগলে বসে মাটির গন্ধ টেনে নিই বুকে।

  • ফরিদা | ১২ নভেম্বর ২০২০ ০৭:২৭99999
  • আহা.… 


    চাষের গন্ধ লেগে আছে লেখার সুতোয় সুতোয়। 


    মৃণাল বাবুকে অনুরোধ করব যদি ফুল-চাষ নিয়ে কিছু লেখার জন্য... 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন