তিস্তা পেরোবার পর জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে নেয় সাকিনা। এদিকে ইতিমধ্যেই শীতের আমেজ। ট্রেনের দুপাশে কুয়াশা এখনো লেপ্টে আছে। একটু নীচে ৩১ নং জাতীয় সড়ক সাপের মত এঁকেবেঁকে এই লাইনের সাথে জড়াজড়ি করতে করতে চলেছে। সাপেরা এভাবেই সঙ্গম করে। এইসব অতি পরিচিত দৃশ্য গত তিরিশ বছর তার জীবনে ছিল না। তিরিশ বছর আগের এই দৃশ্যকে যেন গতজন্মের মনে হয় সাকিনার। ডুয়ার্স ছেড়েছিল ষোল বছর বয়সে, আর ফিরে আসা এই ছেচল্লিশের প্রৌঢ়ার। যদিও তাকে দেখলে কেউ প্রৌঢ়া বলবে না, এখনো পঁচিশ তিরিশ বলেই দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু তবুও চলে যাওয়া কিশোরী আর এই ফিরে আসা প্রৌঢ়া যে আলাদা মানুষ সে নিয়ে তার নিজেরও কোন সন্দেহ নেই। যতই চেনা হোক, এই জাতীয় সড়ক আর রেললাইন নামের সাপদুটোও সেই সাপ নয় যাদের সে দেখত। এরা নবীন, চকচকে সাপ। শরীরে দাগ তেমন নেই এখনো। পুরনো বলতে শুধু ওই চায়ের ডালগুলোই আছে বোধ হয়। চারশো বছর বাঁচে চা গাছ - তিরিশ বছর এদের কাছে পলক মাত্র।
ডামডিম স্টেশনে যখন নামল সাকিনা ঘড়িতে তখন ন'টা বেজে পঁচিশ। প্রায় রাইট টাইম বলা যায়। স্টেশনে ঝকঝকে শরতের রোদ, ঠান্ডা ভাবটা আর নেই, কিন্তু গরমও নয়। সঙ্গে তার একটামাত্র পিঠব্যাগ, টুকটুক করে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে আসে সে। কয়েকটা টোটো দাঁড়িয়ে আছে, লোক ডাকছে। রাণীচেরা যাবার একটা টোটো সহজেই পেয়ে গেল সে। ভুলে যাওয়া চেনা রাস্তা ধরে চা বাগানের ভুলে যাওয়া চেনা গন্ধ বেয়ে বেয়ে গড়গড়িয়ে চলতে থাকে গাড়ি। গ্লাসগোয় টোটো নেই। যদিও ইলেক্ট্রিক কার্টগুলোর সাথে এর বেশী ফারাকও নেই। মজা লাগছিল সাকিনার।
রাণীচেরা বাগানের ভিতরে বিশেষ কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে না সাকিনার। কুলি লাইন, বাঙালিপাড়া, খেলার মাঠ সবই একরকম আছে - যদিও মাঠটাকে একটু ছোট ছোট মনে হল সাকিনার। কিন্তু সেটা তার মনের ভুলও হতে পারে। ছোটবেলার বিরাট মাঠগুলোকে যত বড় হয় তত ছোট মনে হতে থাকে, সে জানে। মানুষ বয়স বাড়লে আকারে বাড়ে, আর মাঠের ক্ষেত্রে উল্টো। অবশ্য একটা বয়সের পরে মানুষকে আবার আকারে কমতেও দেখেছে সাকিনা।
কুলিবস্তির ভিতরে ঢুকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাকিনা। একেবারেই পাল্টায়নি জায়গাটা। শুধু বাড়তি বলতে বোধ হয় কটা বিদ্যুতের খুঁটি - আর কিছু ঘরে টিভি চলছে। বেশ কয়েকজনের হাতে মোবাইল ফোনও দেখতে পেল সে। কিন্তু এই জায়গার মূলসুরটা সেই তিরিশ বছর আগের তারেই থমকে আছে - এটা বেশ বুঝতে পারে সে। এমনকি গলির মুখের মুদি দোকানটা পর্যন্ত - প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। দোকানের কাছে গিয়ে একবার উঁকি মারে সাকিনা - ভিতরে নিয়ামত খালু বসে! এত বছর পরেও লোকটা একইভাবে দোকানদারি করে যাচ্ছে! চুলগুলো সব পাকা - কিন্তু আর বিরাট কোন ফারাক চোখে পড়ে না তার।
সাকিনাকে দোকানের সামনে দেখে চোখ তুলে তাকায় নিয়ামত - "কী দিব?"
"খালু, আমি সাকিনা। জব্বারের মাইয়া। মনে আছে আমারে?" যতটা সম্ভব নিজ ভাষায় বললেও সাকিনা বোঝে তার কথার টান আলাদা হয়ে গেছে। খানিকটা হয়তো মেকি শোনাচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই - রপ্ত করতে একটু সময় লাগবেই। সে আর কথা না বাড়িয়ে একটু এগিয়ে দাঁড়ায়। তাকে খুঁটিয়ে দেখছে নিয়ামত।
"সাকিনা? তিন নম্বর লাইন?"
"হ্যাঁ গো। ঠিকই তো মনে আছে দেখি। আমি ভাবলাম ভুলছ গিয়া"
এবারে নিয়ামতের চোখে আলো জ্বলে - "এতদিন পর! কই ছিলি এতদিন? তোর আম্মু তোর কাছে চলে গেছিল না?"
"আম্মুর এন্তেকাল হইছে পাঁচ বছর হইল" সাকিনা হাসে, "আমি ইংল্যান্ডে ছিলাম। গ্লাসগো বলে একটা জায়গায়"
"ইংল্যান্ড?! আরে বাপ রে - সে তো জব্বর জায়গা! তর আম্মু সেখানেই ছিল?"
"হুম। জারিনা বিবি ইংল্যান্ডের মাটিতেই গোর পাইছে। তোমাগো খবর কও"
"আমরের আর খবর। আছি একই রকম" এবারে ভিতর দিকে হাঁক পাড়ে নিয়ামত - "ও জলিলের আম্মা - কে আইছে দেইখা যাও আইসে"
"কে আবার আইল? আসতাছি" হানিফা বিবির গলা পায় সাকিনা। পাশে নিজের পিঠব্যাগটা নামিয়ে টুলের ওপরে বসে সে। হানিফা ভিতর থেকে বেরিয়ে তাকে দেখে আবার নিয়ামতের দিকে তাকিয়েও আবার চোখ ঘুরিয়ে ভাল করে দেখে তাকে। একটু এগিয়ে আসে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার চোখে আলো জ্বলতে দেখে সাকিনা "সাকিনা!! এদ্দিন পর!" হানিফা এরকম দেখেই তাকে চিনতে পারবে এটা সাকিনা আশা করেনি। সে বেশ অবাক হয়, "তুমি আমারে চিনতে পারলা খালা?"
"ধুরো মাইয়া" হানিফা হাসে, "তর মায়ের থেকে আমি তোরে বেশী কোলে তুলছি, আমি চিনব না তোরে? তোর চোখের পাশের ওই জড়ুল দেইখেই তো যে কেউ চিনব"
নিজের চোখের পাশে হাত দেয় সাকিনা, এটার কথা মনেও ছিল না তার। চশমা নেবার পরে এই ছোট্ট জড়ুলটা চট করে কারো চোখেও পড়ে না, আর পড়লেও কারো শারিরীক বৈশিষ্ট্য নিয়ে মন্তব্য করা ইংরেজ এটিকেটের মধ্যে পড়ে না, আর গ্লাসগোয় তার কোন ভারতীয় বন্ধু নেই। কিন্তু হানিফা বিবির চোখ এড়ানো এত সহজ নয়, সে ভুলে গেছিল। সত্যিই, সে তার মায়ের থেকে হানিফার কাছেই বেশী থাকত, সেটাও তার মনে পড়ে গেল। হানিফার বড় ছেলে জলিল তার চেয়ে দু বছরের ছোট, তাকে প্রচুর শাসনে রাখত সাকিনা।
জারিনা আর হানিফা, জব্বার আর নিয়ামতের বিবি, ছিল এই কুলিবস্তির দুই উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গ। দুজনেই কুমলাই বাগানের মেয়ে, বাল্যসখী। জব্বার যখন জারিনাকে শাদী করতে গেছিল, নিয়ামৎ ছিল বরযাত্রীদের পান্ডা। আর কন্যাপক্ষের পান্ডা যথারীতি হানিফা। তাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছিল নিয়ামত। এক বছর পরে দুই বাল্যসখী আবার একই পাড়ার হল।
দুই সখীই মাধ্যমিক পাশ, সেই সময়ের তুলনায় ব্যতিক্রমী ব্যপার। তাদের বরেরা এইট পাশ করে আর ইশকুলের ধার মাড়ায়নি। জারিনা আর হানিফা অচিরেই এই কুলিবস্তির মহিলামহলের নেত্রী হয়ে উঠল। দুজনেই ভাল গান গায় - প্রকাশ্যে গান বাজনা যে ইসলামে হারাম এসব কথা বলার মত কোন সুন্নি মৌলবী সেই কুলি লাইনে ভাগ্যিস ছিল না। জারিনা হানিফা সকলের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মেয়েদের ইশকুলে পাঠাতে উৎসাহ দেয়, চিঠি লেখা থেকে হিসাব করা সবেতে তারাই ভরসা। ক্রমে শুধু মেয়েরা নয়, পুরুষেরাও তাদের গ্রামের নেত্রী বলেই মেনে নিল।
জারিনার প্রভাবেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া জব্বারের। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সূত্রে এই বাগান, সেই বাগান। ডুয়ার্সের চা শিল্প তখনো ধুঁকতে শুরু করেনি ঠিকই, কিন্তু লক্ষণগুলো ক্রমেই ফুটে উঠছে। সেইরকমই এক মীটিং এর জন্য জব্বার গেল কুমলাই বাগান - তার শ্বশুরবাড়ির এলাকা। রাতে সেখানেই থেকে যাবার কথা। কিন্তু সে বাড়ি আর যাওয়া হয়নি জব্বারের। মিছিল হচ্ছিল। গুলি চালাল পুলিশ। তিনজন শহিদ হল, তাদের একজন জব্বার হোসেন। তার পরের দিন জারিনাকে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। নিয়ামত দোকানে ছিল, আছাড়ি পিছাড়ি করা হানিফাকে ভিতরের ঘরে শিকল দিয়ে আটকে রেখে।
তিনদিন পরে প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে ঘরে ফেরে জারিনা। এই তিনদিনে তার ওপর দিয়ে কী কী ঝড় গেছে তা তার চেহারা দেখে আন্দাজ করা গেলেও আসল সত্যিটা হানিফা ছাড়া কেউ জানে না। সাকিনাও না। সাকিনা শুধু জানল, এই রাণীচেরায় তাদের আর থাকা চলবে না। এক মাস পর সে আর তার মা, জারিনা চলে যায় শিলিগুড়ি, ফুলেশ্বরী বাজারের কাছে জারিনার এক ফুফাতো বোনের বাড়ি। তারপর সেখান থেকে কলকাতা, একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সেলস গার্লের চাকরি পায় জারিনা। সাকিনা আবার ভর্তী হল নবম শ্রেণীতে।
"ঘরে চল, এইখানেই দাঁড়ায়ে থাকবি নাকি ছেমড়ি?" হানিফার ডাকে হুঁশ ফেরে সাকিনার। ব্যাগটা তুলে হানিফার পিছন পিছন ভিতরে ঢোকে সে। ঘরের ভিতরটা কিছুটা বদলেছে বটে। উঠোনের ওপারে আগে কাঁটাগাছের বেড়া ছিল, মাঝে মাঝে ফাঁকা। ওখানটায় একটা ঘর উঠেছে। পাকঘরটা ছিল ডান দিকে, বাম দিকে খালপাড়ে খাটা পায়খানা। এখন ওখানে পাকা পায়খানা হয়েছে, রাস্তাটায় একটু সিমেন্ট দেওয়া। রান্না হচ্ছে এদিকের বারান্দার এক কোনে, সেখানে দুটি বউ কাজ করছে। সম্ভবতঃ জলিল আর খলিলের বিবি ওরা। ওদের আসতে দেখে একটু অবাক হয় দুজনেই। তাদের কাছে ডাকে হানিফা, "এই দেখ ছেমড়িরা, আমার একখান মাইয়া আছে কইছিলাম না? এই হইল সাকিনা বানু - আমার সই জারিনার মাইয়া। কিন্তু আসলে আমারই। ছালাম কর"
দুজনেই ব্যস্ত হয়ে উঠলে সাকিনাই তড়িঘড়ি আটকায় তাদের "আরে খালার কথা বাদ্দাও - নিজেদের মধ্যে আবার ছালাম টালাম কি? নাম কী তোমাদের, সেইটা কও"
"আমি ফরিদা" অপেক্ষাকৃত কালো মেয়েটি হেসে ফেলে বলে, "আর এই হল ফরজানা" জা এর গাল টিপে দেয় ফরিদা, "আমাগো খলিল মিঞাঁর পেয়ারী সোন্দরী" বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ে ফরিদা। ফরিদার বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত হয় সাকিনা। কেমন এক কথায় বুঝিয়ে দিল সে জলিলের বিবি - একবারও তার নাম না করেই। মেয়েটা কালো, কিন্তু চোখেমুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক দেখে সাকিনা। মনে মনে হাসে সে - হানিফা বিবি তার মত করে বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছে, বোঝাই যায়।
সাকিনার সঙ্গে পাঠকেরও চোখে জল এল।
খুব ভালো লাগল গল্পটা।
এতো ভালো লাগলো, রেশ রয়ে গেল। দুদিন আর কিছু পড়ব না.....তারপর কি হলো ভাবতে হবে..... ছোট গল্পের সারথকতা!
মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা। এর পরেরবার যখন ওই বাগানের ধরবো , নিঃসন্দেহে জারিনা , সাকিনা , হানিফাদের মনে পড়বে।
জয়ী হোক হানিফা বিবি, সাকিনা, জারিনারা
কুলি লাইন খুব বিশ্বস্ত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্বাস্য হেডমিস্ট্রেস থেকে শুরু করে আর সব চরিত্র। শুধু কুলি লাইনের ভাষা যে অদ্ভুত জগাখিচুরি সেইটেতে কিছু খামতি আছে। তবে তাতে মূল কাহিনির রসগ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হয় না।
বেশ লাগল
@প্রতিভাদি, হ্যাঁ কুলি লাইনের ভাষা নিয়ে সমস্যা আছে, মানছি। এর একটা কারণ স্মৃতির লুকোচুরি। ডুয়ার্স অঞ্চলের এই বিশেষ চা বাগানটিতে (রাণীচেরা) আমি নিজে দুয়েকবার গেছি - কিন্তু বাঙালিপাড়ার ভাষা (বাবুদের) আর কুলি লাইনের ভাষায় জমিন আশমান ফারাক। সেই শোনা ভাষা আজ ৩০ বছর পরে (আমারও) অনেকটাই গুলিয়ে গেছে। তবে এই ভাষার কিছুটা সংশোধনের চেষ্টায় আছি
তোমার কাছ থেকে পরামর্শ পাচ্ছি এটা আমার বিরাট সৌভাগ্য
কেমন যেন একটা রেশ রয়ে গেল।।
কী ভাল গল্পটা। শুধু ওই বস্তির ভাষাটা কোথাও কোথাও একটু শহুরে লাগছে। সাকিনা, জারিনাদের গল্প আরও হোক।
গল্পটি সদর্থক পরিণতিতে নেওয়া ভালো লেগেছে।
হানিফা সাকিনা ফরিদারা এগিয়ে চলুক সঙ্গে চলুক দেশ