“(যদি) দেশপ্রেমিক নাচে!!
খবরদার চাইবে না কেউ
চাকরি তাহার কাছে
চাইবে না কেউ ভাত বা রুটি
চাইবে না কেউ খেতে
(থাকো) চার পা তুলে
সিনেমা হলে
‘জনগণ’তেই মেতে” -
দেশপ্রেম অতি বিষম বস্তু - দেশপ্রেমী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয় - চাড্ডীখানি কথা বলে অনেকের ধারণা। তো এই ধারণা - অর্থাৎ কিনা দেশপ্রেম ও চাড্ডিত্ব - এদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিবিধ ডাইনামিক্স, ইত্যাকার জটিল বিষয়সমূহ নিয়েই আজকের এই রচনার অবতারণা। বাদীপক্ষ এরূপ আশা রাখেন যে এতদ্বারা এই বিষয়টির কিছু স্বরূপ জনতার আদালতে উদ্ঘাটিত হইবে।
দেশপ্রেমের সবচেয়ে বড় প্রমাণ কোনটি? নিঃসন্দেহে - অচলা ভক্তি। দেবদ্বিজে তো বটেই - তবে তারা তো আর নিজ মুখে প্রচারের সুবিধা পান না - তাই তাদের কথা তাদের হয়ে যারা বলেন, যেমন ধরুন রবিশঙ্করবাবু বা রামদেববাবু, এবং এদের যারা আশীর্বাদ করেন - যেমন নরেন্দ্রবাবু বা নির্মলা দেবী কিম্বা অরুণ স্যার অথবা অমিতবাবু - এবং এদেরও যারা আশীর্বাদ করেন - যেমন ধরুন মুকেশ বাবু মোটাভাই, নীরব স্যার, গৌতম ভাই, জয় বেটা - এদের সকলের প্রতি অখন্ড ভক্তি থাকলে তবেই তাকে সাচ্চা দেশপ্রেমিক বলা চলে। এই অখন্ড ভক্তি এক আশ্চর্য মহাশক্তি - শস্ত্র তাকে ছিন্ন করতে পারে না, বায়ু তাকে শুষ্ক করতে পারে না, পানি তাকে সিক্ত করতে পারে না, আগুন তাকে দহন করতে পারে না - মোদ্দা কথা কোন যুক্তিই তাকে বিদ্ধ করতে পারে না। যতই যুক্তি দাও, তথ্য দাও - সবের ওপরে বিশ্বাস সত্য এবং মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী - এই দেখলেই নিশ্চিত বুঝবেন বাবুটি (বা বিবিটি) ভক্ত এবং দেশপ্রেমী।
এখন দেশপ্রেমের এই বহুধা ভক্তির মধ্যে অন্যতম হল সেনাবাহিনীতে ভক্তি। এটি অতি প্রয়োজনীয় উপকারী ভক্তিও বটে, সেনাবাহিনীতে ভক্তি না থাকলে শাসকের ওপর ভক্তিও হুট করে চটে যেতে পারে - আত্মারামও যেমন মাঝে মাঝে খাঁচাছাড়া হয় আর কি। সেনাবাহিনীর নামে কোন খারাপ কথা কোন সাচ্চা ভক্ত কখনোই মেনে নেবে না। তারা সিয়াচেনে দাঁড়িয়ে আছে বলেই আপনি এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়ে মরে যাওয়ার বৈধতা পেয়েছেন - একথা ভক্তেরা কখনো ভোলেন না। তারাই পুলওয়ামায় শহীদ হয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে পাকিস্তান কত বড় শয়তান। যদিও দুর্জনে বলে এমন প্রমাণ দেবার ইচ্ছে তাদের খুব একটা ছিল না - কিন্তু সরকারের ছিল বই কি - সেনাবাহিনী দেশের জন্য যা যা করতে পারে, সরকার বাহাদুর ভোটের জন্য তার থেকেও অনেক বেশী কিছু করতে পারে এ কথা কে না জানে? ফলে আগে থেকে সতর্কবার্তা থাকা সত্ত্বেও তাদের আশি ট্রাকের কনভয় স্থলপথেই পাঠানো হল প্রোটোকল ভেঙে - জইশ এবং পাকিস্তান কত বড় বদমাশ তার প্রমাণ সংগ্রহ করতে। সেই প্রমাণ ভোটবাজারে খুবই জরুরী। বেয়াল্লিশ জন সাধারণ ঘরের সেনাকে শহীদ বানিয়ে সেই প্রমাণ সংগ্রহ করা গেছে লোকসভা ভোটের মুখে - এবারে তা চড়া মূল্যে বিকোবে। লাশের চেয়ে মূল্যবান আর কী বা আছে? আর শুধু তো লাশ নয়, এই সুবাদে আবার সার্জিকাল সার্জিকাল খেলাও একটু খেলে নেওয়া গেল, নিন্দুকেরাও বলতে বাধ্য হচ্ছে যে পাকিস্তানের পাইন মারা গেল (পান নট ইন্টেন্ডেড)। যুদ্ধ ভোটবাজারে লাশের চেয়েও বেসী দামে বিকোয়।
কিন্তু তাই বলে ভোটই কি জীবনের একমাত্র মোক্ষ হতে পারে? ক্ষমতায় আসা অবশ্যই জরুরী - কিন্তু সেই ক্ষমতাকে চেটেপুটে উপভোগ করা কি তার চেয়েও জরুরী নয়? এখন ক্ষমতা উপভোগ করতে চাই আরো ক্ষমতা এবং আরো টঙ্কা - কে দেবে? এটা কোন প্রশ্নই নয় ক্ষমতায় থাকলে - কত লোক আছে দেবার - ধরুন সেনাবাহিনীই দিল। তাই বলে ভাববেন না সেনাবাহিনী অন্যের বা নিজের দেশে লুটপাট করে রাজকোষে টাকা এনে দেবে - এসব হীন চিন্তা কেন আপনার? লুটপাট করে কটা টাকাই বা পাবে? তার চেয়ে ধরুন যদি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বীমার নামে গাদাগুচ্ছের টাকা নিয়ে তা ভুলভাল জায়গায় লগ্নি করে ফেলা যায়, তাদেরও কিছু থাকল, আমাদেরও কিছু থাকল - সেনাবাহিনী তো দেশপ্রেমের ট্রেনিংপ্রাপ্ত - রা কাড়বে না। একে বলে উইন-উইন সিচুয়েশন। যে লড়াইএর শেষে সবাই যেতে এবং কেউ হারে না, সেই যুদ্ধের প্রয়োজন কি - একথা জিজ্ঞেস করলে আপনি নিশ্চিত দেশদ্রোহী।
IL& FS - নামটা শুনেছেন? যদি আপনি শেয়ার বাজার সম্বন্ধে খোঁজ খবর রাখেন তাহলে শুনে থাকবেন - নাহলে শুনবেন না। ২০০৮ এর পর বিশ্ব অর্থনীতিতে যে দুনিয়াব্যাপী মন্দা নেমে আসে, ভারতীয় অর্থনীতিতে তার সামগ্রিক প্রভাব পড়েনি - তার কারণ অন্যত্র আলোচিত হয়েছে - এখানে সেটা অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু যেটুকু প্রভাব পড়েছিল, সেটাও কম নয় - এবং যে সব কোম্পানির ব্যর্থতা এজন্য দায়ী, এই কোম্পানিটি তার মধ্যে অন্যতম। এবং এর পরে তাদের বাজার সুনাম ক্রমশঃ কমেছে - ICRA রেটিং (এটাও খায় না গায়ে মাখে তা যারা খবর রাখেন তাদের জন্যই থাক - আমাদের এটুকু জানলেই চলবে যে এটা বাজারে মান্য এক ধরণের রেটিং যা কোম্পানির আর্থিক সামর্থ্য বিচার করে) ক্রমশঃ কমেছে - কিন্তু তাতে কি? আপনার প্রিয় সেনাবাহিনীর জীবনবীমার প্রিমিয়ামের টাকা এদের শেয়ার কিনতেই লগ্নি হয়েছে। এবং এই টাকা কিন্তু সরকারের দেওয়া নয়। কত টাকা? একটা মোটামুটি হিসেব ধরা যাক - ভারতীয় সেনা (শুধু মিলিটারি) তে জেনারেল এর সংখ্যা কমবেশী ৩৫০ জন - এরা জীবনবীমা বাবদ প্রিমিয়াম দেন মাসে ৫০০০/- অর্থাৎ বছরে ৬০০০০/- টাকা - ৩৫০ x ৬০০০০/- = ২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। জওয়ান এর সংখ্যা কমবেশী ১৩ লক্ষ - এরা দেন মাসে ২৫০০/- অর্থাৎ বছরে ৩০০০০/- টাকা - মোট ১৩,০০,০০০ x ৩০০০০/- = তিন হাজার ন’শো কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বছরে মোট তিন হাজার এগারোশো কোটি টাকার মত - এই বিপুল অঙ্কের টাকার দায়ীত্ব কার? ফান্ড ম্যানেজমেন্ট কে করেন? ভক্তবৃন্দ জানতে চান না - আপনি জানতে চাইলেও পাবেন না - কারণ এর কোন সদুত্তর কারো কাছে নেই। একটি ডুবন্ত কোম্পানির শেয়ার কিনতে এই টাকা লগ্নি করা হয়েছে এবং হচ্ছে - অথচ কোম্পানি বা সেনাবাহিনী কোন তরফেই এই টাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন সদুত্তর নেই। আমাদের মহান সেনাবাহিনী যখন দেশের সেবা করতে নিজের প্রাণ হাতে করে যুদ্ধ করেন, সিয়াচেনে দাঁড়িয়ে পাহারা দেন, তখন তার পরিবারের ন্যুনতম নিরাপত্তা বিধানে সরকার বাহাদুর উদাসীন থাকেন - তাঁকে দেখিয়ে ভোট কেনাটা বেশী জরুরী। বিমান কিনতে দুর্নীতি করতে গিয়ে যদি পুরো প্রক্রিয়া পিছিয়ে যায় তো বায়ুসেনা ভাঙা বিমান নিয়ে যুদ্ধে যাবেন - কী আছে? ধরা পড়লে আমরা দেশপ্রেমের তাস খেলব - না পড়লে তো খেলবই।
আচ্ছা সেনাবাহিনী নিয়ে বেশী বলতে গেলে আবার আপনার ভাবাবেগে আঘাত লেগে যেতে পারে - এবার বরং একটু অন্যদিকে ঘুরে দেখা যাক। আপনি দেশপ্রেমী - দেশী সংস্থাকে বাঁচাতে আপনার চিন্তার শেষ নেই। ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (BSNL) একটি দেশীয় এবং সরকার পরিচালিত সংস্থা, এই নাম আপনি শেয়ার বাজারের খবর না রেখে থাকলেও শুনেছেন অবশ্যই। কে জানে আপনার নিজেরই হয়তো একটি বি এস এন এল সিম আছে যা আপনি দিব্যি ব্যবহার করছেন। কেমন লাগবে হঠাৎ সেই সিম বন্ধ হয়ে গেলে? কোম্পানি উঠে গেলে? ভক্তবৃন্দ অবাক হবেন হয়তো, কিন্তু কিছু মনে করবেন না - আপনি করবেন কি? তাহলে শুনে রাখুন - সেই প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। যারা বি এস এন এল এর সঙ্গে চুক্তিতে বা অস্থায়ী হিসাবে কাজ করেন, তারা গত ডিসেম্বর মাস থেকে বেতন বা প্রাপ্য টাকা পাননি - এবং বি এস এন এল এর নিয়মিত কর্মীরাও ফেব্রুয়ারী মাসের বেতন এখনো অবধি পাননি। কেন পাননি? কারণ হিসাবে বি এস এন এল ম্যানেজমেন্ট জানিয়েছেন, তাদের হাতে কর্মীদের বেতন দেবার মত টাকা এই মুহুর্তে নেই। কেন নেই? কারণ গত দু-বছর ধরে কোম্পানি লাগাতার লসে চলছে। কেন লস? যে কারণে অন্য সমস্ত ফোন কোম্পানিগুলি লসে চলছে - জিও। রিলায়েন্স জিও বাজারে এসে যে রেটে কলচার্জ নেওয়া শুরু করে তাতে তারা নিজেরা সহ সবকটি টেলিকম কোম্পানি বিপুল ক্ষতির মুখে পড়ে। কিছু কোম্পানি উঠে যায়, কিছু নিজেদের মধ্যে মার্জার করে, এবং এরা প্রায় সকলেই বাইরে থেকে লোন নিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে। ব্যতিক্রম বি এস এন এল - সরকারী টেলিকম দপ্তর তাদের বাইরে থেকে ধার নিতে দেয়নি। নীতি আয়োগ বস্তুত স্পষ্টই সুপারিশ করেছিলেন বি এস এন এল হয় তুলে দেওয়া হোক অথবা বেসরকারী করে দেওয়া হোক, যদিও পরে সেই বক্তব্য থেকে নিজেরাই কিছুটা সরে এসেছেন। কিন্তু এটা বুঝতে কোনই অসুবিধে হয় না যে সরকারের মনোগত ইচ্ছা বি এস এন এল উঠে যাক। এই সময়ে অন্য যেভাবে টাকার সংস্থান হতে পারত, তা হল নিজেদের ধার দেওয়া টাকা শোধ পেলে - কত টাকা? রিলায়েন্সেরই আরেক সংস্থা, অনিল আম্বানির আর কম থেকে বি এস এন এল এর পাওনা প্রায় ৭০০ কোটি টাকা - কিন্তু অনিলভাই চাইছেন এই টাকাটা মকুব হয়ে যাক। তাঁর বড়দা মোটাভাইও চাইছেন টাকাটা না আসুক - তাহলে তাঁর কিনতে সুবিধে হয়। সরকারের খুব একটা চাড় নেই বলাই বাহুল্য - ফলে এই টাকা উদ্ধার হবার আশা কম - কয়েক লাখ কর্মী দু-চার মাস মাইনে না পেলে কী বা আসে যায়? দেশের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সৈন্যরা সিয়াচেনে দাঁড়িয়ে আছে আর আপনার একমাস মাইনে না পেলেই চেঁচাতে হবে? দেশদ্রোহী আর কাকে বলে?