এই লেখাটা লিখতে বসেও চুপ করে বসেছিলাম অনেক্ষণ। ঠিক চুপ করেও না, একটা অসহ্য রাগকে সামলানোর যুদ্ধ চলছিল আসলে মনের ভিতরে। রাগের কারণ একটা ভিডিয়ো ক্লিপিং – যেটা হয়তো আপনারা অনেকেই এতক্ষণে দেখে ফেলেছেন। সেই ভিডিয়ো, যেখানে জামাল মন্ডল নামে একটি ছেলেকে, যে পেশায় দিনমজুর, কয়েকজন তথাকথিত ভদ্দরলোক র্যাগিং করছে, বুলিয়িং করছে, মারধোর করছে, স্রেফ নিজেদের মাস্তানি উপভোগ করার উদ্দেশে। মনে হচ্ছিল কী হবে এসব লিখে? মনে হচ্ছিল ওই ট্রেনের কামরায় চলে যেতে পারলে অন্তত: একটু কিছু বলার থাকতে পারত, করার থাকতে পারত। মাথাটা আরেকটু ঠান্ডা হলে আমার ভিতরের অপেক্ষাকৃত হিসেবি আমিটা আবার বলেই দিল যে ওখানে না থাকাটাই আমার পক্ষে ভাল হয়েছে। কারণ চলন্ত ট্রেনে জামালকে ওভাবে অপমানিত, নিপীড়িত হতে দেখেও যে এক কামরা লোক দিব্যি চুপচাপ চলে এল, তারা সবাই, ওদেরই ভাষায় “চুড়ি পরে বসে থাকা” নয়, তারা ওই “ভদ্রসন্তান”দের কেউ পালটা বলতে এলে, এই নির্লজ্জ গুণ্ডাবাজির বিরুদ্ধে বলতে এলে ঠিক এগিয়ে আসত, সেই প্রতিবাদীকে মারধোর করতে, ট্রেন থেকে ফেলে দিতে। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসেনি কারণ এই গুণ্ডাবাজির মূল সুরটা তারা সমর্থন করে, “এগুলোর সাথে এরকমই হওয়া উচিৎ” বলে মনে করে। সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও মনে মনে এই নিগ্রহে সামিল হয়। কারণ তারা ভদ্রলোক, এরা অপর। একে দিনমজুর, তায় মুসলমান, ছোটলোক, ব্যাটা সাহস পায় কীক'রে ভদ্রলোকেদের সীটে এসে বসার?
মালদা – কালিয়াচক। তস্য পিছিয়ে পড়া হলেও নামটা এখন আর প্রায় কারোই অজানা নয়। এখানেই নাকি “দাঙ্গা”য় মারা গেছিল “শ'য়ে শ'য়ে হিন্দু”। ধূলাগোড়ি, বাদু’র মতই এখানেও নাকি মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় তৈ্রি হয় ইসলামি জঙ্গী। ভদ্রলোকেরা এদের “জিহাদী” বলতে ভালবাসেন। তো হতেও পারে সেই “জিহাদী”দেরই একজন এই জামাল। হতেই পারে কারণ তার বাড়িও কালিয়াচক। সেও গুজরাটে যায় রুজিরুটির তাগিদে। এবং সে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম জানে না। তাকে যারা “ইন্টারোগেশন” করছিল, তারা অবশ্য আশা করেছিল নওয়াজ শরীফের নাম নিশ্চই জানবে, তাদের এভাবে হতাশ করা ওই জিহাদী জঙ্গীর উচিৎ হয়নি একথা অনস্বীকার্য। এবং সে জনগণমন জানলেও সেটাকেই যে “জাতীয় সঙ্গীত” বলে সেটা জানে না। এত অপরাধের পর তাজা ছেলেরা নাহয় দু-চারটে থাবড়াই মেরেছে। এটুকুও মারা যাবে না, ভারত মাতার নামে?
যাবে, খুব যাবে, এবং যাবে যে সেটা ওরা জানে। জানে যে এটাই এখন এদেশের দস্তুর। জানে যে এক কামরা লোক চুপচাপ বসে দেখবে এবং মনে মনে ওদের সাথেই এই মারধোরে অংশ নেবে। এখনো খুব বেশীদিন তো হয়নি, ঈদের বাজার করে ফেরার পথে একটা পনেরো বছরের বাচ্চাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল চলন্ত ট্রেন থেকে, ফলে বাচ্চাটি মারা যায়। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি সেই ঘটনায় – এবং বহু লোক, হ্যাঁ এদেশের বহু লোক, আমার আপনার স্বদেশবাসী সে ঘটনা প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে সমর্থন করেছিল। আরও অল্পদিন আগে আফরাজুল খান, তার গ্রাম সৈয়দপুর এই কালিয়াচক থেকে খুব বেশি দূরে নয়, ভা্রি সভ্যভব্যভাবে খুন হয়েছিল। তার খুনী শম্ভুলাল এখনো এই বাংলাতেও বহু স্বদেশবাসীর কাছে বীরের সম্মান পায়। মাত্র কিছুদিন হল আমরা আসিফার শিশুমুখের ছবি দেখেছি, তার হত্যাকারীদের স্বপক্ষে আমাদের শাসক দলের জনতার দ্বারা নির্বাচিত নেতারা মিছিল করেছিল। সেখানে এ তো সামান্য দু-চারটে চড় থাপ্পড় – খুনখারাপি তো হয়ই নি। ট্রেন থেকেও ফেলে দেয়নি।
এগিয়ে বাংলা।
জামালের বৌএর নাম জুলেখা মোমিন। একটা মেয়ে আছে ওদের। আরে অবাক হবেন না – একটাই। একপাল নয়। তা সেই মেয়ে আর বৌ কে নিজের এই হেনস্থার কথা আর জানিয়ে উঠতে পারেনি জামাল। কী বা বলত? যে কয়েকজন বাবু ট্রেনে আমাকে পড়া ধরেছিল, বলতে পারিনি বলে মেরেছে? ও সেটা বলে উঠতে পারেনি। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের ( এরপর বা স ম বলে উল্লেখ করা হবে) লোকজন যখন মহেশপুর গ্রামে (কালিয়াচক থানা) জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করেন বিষয়টা নিয়ে, তখন তারা প্রথম জানতে পারে। এবং জুলেখাকে নিয়ে সংস্কৃতি মঞ্চের পক্ষ থেকে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি এফ আই আর দায়ের করা হয় কালিয়াচক থানায়, বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের পক্ষ থেকে। জামাল মোমিন ফোনে বা স ম এর নাজিবুর রহমানকে জানিয়েছেন যে ওই ভিডিয়োটা তোলার আগে তাঁকে মারধোর করা হয় এবং মূলত: তাঁর বসার জায়গাটা নিয়েই ঝামেলা শুরু হয়েছিল। এরপরে ওই “প্রশ্নোত্তর পর্ব” শুরু হয় যেখানে আমরা সবাই দেখেছি, সারাক্ষণ প্রশ্নকারী অত্যন্ত নোংরা ভাষায় জামালের সঙ্গে কথা বলে গেছে, এবং অন্তত: দুবার তাকে থাপ্পড় মারা হয়েছে। জামালের তরফ থেকে এমনকি জোর গলায় একটা কথাও আসেনি। এবং বীর প্রশ্নকারীর কথামত ভারত মাতা কি জয় থেকে জনগণমন সবই বলেছে। মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে টা অবশ্য বলতে বলা হয়নি, কেন কে জানে।
কিছুদিন আগে পঞ্চায়েত ভোটের সার্বিক সন্ত্রাসের আবহে একজন ভোটকর্মী মারা যান। রাজকজমার রায়, স্কুলশিক্ষক। সরকার মৃত্যুটাকে আত্মহয়্যা বলে চালানোর চেষ্টা করলেও সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে সেটি আত্মহত্যা ছিল না। সেই বিষয় নিয়ে খুব ন্যায্যভাবেই তোলপাড় হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া এবং নাগরিক সমাজ। প্রতিবাদকারী শিক্ষকদের ওপর নেমে এসেছে শাস্তির খাঁড়া – তবুও প্রতিবাদ থেমে থাকেনি। কিন্তু তার ক'দিন আগেই গড়িয়া স্টেশনের কাছে সুলতানা নামের একটি মেয়ে প্রথমে ধর্ষিতা ও পরে খুন হলেন, তাঁর টুকরো করে ফেলা হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকল পথে – এ নিয়ে কিন্তু প্রায় কিছুই শোনা গেল না। জামাল মোমিনের ঘটনাটাও ঘটে গেছে প্রায় এক সপ্তাহের ওপর – এখনো অনেকে জানেনই না বিষয়টা। না এটা কোন হোয়াট অ্যাবাউটারি নয়। রাজকুমারবাবুর মৃত্যু একইরকম ন্যক্কারজনক, এবং যারা সেটার প্রতিবাদ করছেন তাদের অন্য সব বিষয়ের প্রতিবাদে মাঠে নামতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু একটু নজর করে দেখলেই এখানে একটা প্যাটার্ণ আমরা দেখতে পাই, যা প্রায় অবভিয়াস। জামাল বা সুলতানা, দুজনেই তথাকথিত “ছোটলোক” এবং সংখ্যালঘু (পড়ুন মুসলমান)। না এদের জন্য তাই বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ শুধু – সোশ্যাল মিডিতা উত্তাল হয়ে ওঠে না। কারণ এরা “আমরা” নই – এরা অপর।
এই অ্যালিয়েনেশন, নিজেদের পৃথক ভাবার প্রবণতা বহু প্রজন্ম ধরেই আমাদের মধ্যে পালন করে চলেছি আমরা – এখন খালি ওই যাকে বলি অনুকূল জল হাওয়া, তার সুবাদে এগুলি প্রকাশ্যে আনতে দ্বিধাবোধ করিনা, জানি এটা সামাজিকভাবে গৃহীত এখন। প্রতিবাদ করতে গেলে, জামালদের হয়ে কথা বলতে গেলে আপনাকে “পাকিস্তানে চলে যান” শুনতে হতেই পারে। তবে কিনা শুনলাম তো অনেক – এবার মনে হয় পালটা বলা দরকার যে না, আমি পাকিস্তান যেতে রাজি নই। এই দেশ, এই মাটি, এই সংস্কৃতিকে তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসি, বুঝি, আমি, আমরা। অতএব যেতে হলে তোমরা যাবে – আমাদের জলজমিন ছেড়ে, যেখানে খুশি, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট যে চুলোয় চাও। আমরা এখানেই থাকব, জামালরা এখানেই থাকবে, সুলতানারা থাকবে। কারণ বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।