ক্রিকেটের বিশ্বযুদ্ধ। চারিদিকে রে-রে রব। আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান এ খেলা খেলে না। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন খেলে না। নিদেনপক্ষে নাইজেরিয়া, মেক্সিকো বা ঘানাও নয়। তবে কি না এ হল গে রাজার খেলা – যাকে বলে খাঁটি ইংলিশ ম্যানার গেম। আর তাতে আবার ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হল গে আমাদের এই মহান ভারতবর্ষ – যেখানে নাকি সেই বৈদিক যুগ থেকে মঙ্গলযান চালু আছে, প্লাস্টিক সার্জারি তারও আগে থেকে। অতএব গর্জন – বকশিস টঙ্কা। বিশ্ববিজয় অভিযানে বেরিয়ে আমাদের দামাল ছেলেরা ‘বধ’ করছে একের পর এক ‘শত্রু’ – উল্লাসে ফেটে পড়ছি আমরা। আর সমস্ত যুদ্ধে যেমন হয়, কিছু ক্ষয়ক্ষতি, কিছু কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ থাকেই – যেমন ধরা যাক রাজনৈতিক সম্পর্কের উর্ধে সীমানার দুই পারের মানুষের আঙুলে আঙুল ছোঁয়াবার ইচ্ছে। তা সে ইচ্ছেরা মরুকগে যাক – যুদ্ধ চলছে এখন এসব গায়ে মাখলে চলে?
এখানে একটা ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখি। ক্রিকেটের বিরুদ্ধে কলরব করতে এই কলমের অবতারণা করিনি। কে খেলে আর কে খেলেনা সেটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ততটা নয় আমার কাছে কারণ খেলাটা খেলতে আমার ভালো লাগে। আমি নিজেই একটা পর্যায় অবধি খেলেছি এবং এখনো দেখতে ভালোবাসি। আর সেভাবে বলতে গেলে আমার ছোটবেলার প্রিয়তম খেলা যে লুকোচুরি, তার তো আন্তর্জাতিক দূরস্থান পাড়া স্তরেও কোন টুর্নামেন্টই হয়না – তা বলে কি খেলাটাকে ভালোবাসব না? কিন্তু কথাটা হল, ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসি, যুদ্ধ করতে নয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, খেলাটা যখন একটা স্তরে পৌঁছে যায়, যেমন আন্তর্জাতিক স্তর, তখন তো তা যুদ্ধের পর্যায়েই – পছন্দ করি বা না করি। ধারণাটায় আমার আপত্তি আছে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখন থাক, ওই তর্কে আপাততঃ যেতে চাই না বলে মেনেই নিচ্ছি যে হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানে একটা যুদ্ধ, যেমন আন্তর্জাতিক ফুটবল মানেও। তা প্রশ্নটা হল কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধ? বস্তুতঃ এই কথাটা বলতেই এই লেখার শুরুতে ধান ভানতে শিবের ওই ‘এলিটিস্ট’ গীত। যে খেলাটা খেলেই মাত্র দশ-বারোটা দেশ (যার অন্যতম প্রধান চারটে আবার এই উপমহাদেশ থেকেই), তাদের খেলার ‘যুদ্ধ’টা কি সত্যিই ‘বিশ্বযুদ্ধ’ আখ্যা পাওয়ার যোগ্য?
অথচ উপমহাদেশের সমর্থকদের আচরণ দেখলে মনে হয় এর থেকে জরুরী দুনিয়াতে কিছু আর নেই। শুধু এই খেলার হারজিতের ওপরেই নির্ভর করে আছে আমার ‘দেশে’র সম্মান-উন্নয়ন-স্বপ্ন। তা-ও আবার সীমান্তের ওপারের পাকিস্তান ভারতকে অথবা ভারত বাংলাদেশকে হারালে যতটা ‘সম্মানহানি’ হবে, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকা হারালে ঠিক ততটা নয়। অতএব স্লোগান ওঠে – বিশ্বকাপ না জেতো ক্ষতি নেই, পাকিস্তানের কাছে হেরে এসো না। যদি হারো তো দেশে ফিরলে ইঁট-পাটকেল নিশ্চিত। বাড়িতে দু-চার পিস এক্সট্রা জানালা ফানালা অর্ডার দিয়ে রাখো বাপু – পয়সার জন্য ভাবতে হবে না। পরের ম্যাচটা জিতলে আবার আমরাই সুদে-আসলে সব উশুল করে দেবো।
কেন এই শিশুপনা? ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ সর্বত্র এই একই মানসিকতা – এই অপরিণত আচরণ। এমনিতে বহু ক্ষেত্রে এই অপরিণতি আমরা দেখিয়ে থাকি ঠিকই, কিন্তু ক্রিকেট ঘিরে এই ছেলেখেলা যেন একটা চরম আকার নেয়। শুধুই আবেগ? ক্রিকেট ঘিরে একটা জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর মহান কাহিনী? যেমন ব্রাজিলে ফুটবল কিংবা জাপানে কুংফু? কিন্তু আদৌ কি ক্রিকেট কোন বৃহত্তর পরিবর্তন আনতে পেরেছে এই উপমহাদেশে? ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-আফগানিস্তান – ক্রিকেট কোন বড় অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিপ্লবটা ঘটিয়েছে এই সব দেশগুলোয়? হ্যাঁ এই প্রসঙ্গে অন্ততঃ ভারতের ক্ষেত্রে অনেকেই ক্রিকেট অর্থনীতির কথা বলবেন – ক্রিকেট নাকি ভারতে বিদেশী মুদ্রা আনার এক বিরাট হাতিয়ার। বিশেষতঃ আইপিএল উত্তর ভারতে। মিথ।
হ্যাঁ, মিথ। প্রথম কথা এই আলোচনাটাও পুরো উপমহাদেশের মধ্যে শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ (বস্তুতঃ সমস্ত ক্রিকেট খেলিয়ে দেশের মধ্যেই) – এই বিপুল অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টা। অন্যান্য দেশগুলি এর ছিটেফোঁটাও দেখতে পায় না। কিন্তু যদি শুধু ভারতের কথাও ধরি, এই যে “বিপুল পরিমাণ ক্রিকেট বাণিজ্য”, এই বিপুল তরঙ্গ কোথা হইতে কোথায় আসিয়া কোথায় চলিয়া গেল, কেউ তাহা জানে কি? একটা কোন সামাজিক, রাজনৈতিক বা এমন কি নিখাদ অর্থনৈতিক প্রকল্পের কথা কারুর জানা আছে যা ক্রিকেট থেকে হওয়া আয়ের টাকায় চলে? বলতে পারবেন না, কারণ চলে না। কোন প্রকল্প। “ভারতীয়” ক্রিকেট দল, আমার আপনার কাছে যতই ‘জাতীয়’ দলের আবেগের রিপ্রেজেন্টেটিভ হোক না কেন, আইনতঃ তা “বিসিসিআই একাদশ” – যার পোশাকী নাম “টীম ইন্ডিয়া”। এই দলের মালিকানা “বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া”র– যা একটি স্বয়ংশাসিত বেসরকারী সংস্থা। এবং ‘ভারতীয় ক্রিকেটে’র যাবতীয় লাভ-লোকসানের দায় এবং অধিকার শুধু এবং শুধুমাত্র তাদেরই। ভারতে ক্রিকেট ব্যবসা ভাল হয় কারণ বিসিসিআই অন্যান্য বোর্ডগুলির তুলনায় ভালো ব্যবসায়ী, এবং যে কোন সফল ব্যবসায়ীর মতই তারা এক্সপ্যানশন করে ও মুনাফা বাড়ায়। সরকার একটা কর পায়। মোটা কর। কিন্তু তাতে আবার ছাড় দিতে দিতে তার অবস্থা দাঁড়ায় হরিপদ কেরানীর ছাতা বা জরিমানা দেওয়া মাইনের মত।
কিন্তু কেন? কি প্রয়োজন এই মিথের? কি ভাবে তৈরী হল উপমহাদেশ জোড়া এই ক্রিকেট কাল্ট?হল কারণ তাকে নির্মাণ করা হল – পরম যত্নে। ১৯৮৩ তে ভারতের বিশ্বকাপ জয় এবং তার পরপরই ১৯৮৫ তে বেনসন এন্ড হেজেস কাপ জয় এই উপমহাদেশে ক্রিকেটকে একটা বাড়তি গুরুত্বের আসন পাইয়ে দেয়। মাঝে ১৯৮৭ টা বাদ দিলে ১৯৯২ এবং ১৯৯৬ তে পরপর পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপ জেতায় (মাঝে ভারতের হীরো কাপ জেতাও আছে) সেই আবেগে একটা বাড়তি পরৎ যোগ হল। লক্ষ্য করে দেখবেন, এই দেশগুলি কিন্তু এর আগে বা পরে কখনো কোন আন্তর্জাতিক খেলায় তেমন বড় কোন খেতাব জেতেনি (সেই মান্ধাতা আমলে ভারত-পাকিস্তানের হকি মাস্তানিটা ধরছি না ইমপ্যাক্টে ধারে কাছে আসে না বলে)। ফলে আম জনতা থেকে মিডিয়ার যাবতীয় আবেগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াতে লাগলো এই একটা খেলা। ক্রিকেট হয়ে উঠলো ধর্ম। পুরো উপমহাদেশ জুড়ে এবং বিশেষতঃ লোকসংখ্যার কারণে ভারতে তৈরী হল এক বিরাট ক্রিকেট বাজার। লক্ষ কোটি ছাড়িয়ে লাভের হিসাব হতে থাকলো বিলিয়ন – ট্রিলিয়ন ডলারে। আর সেই পথ দিয়েই ক্রিকেটের হাত ধরল রাজনীতি – ক্রিকেট রাজনীতি। ক্রিকেট বোর্ডগুলিতে বাড়তে লাগলো রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের আনাগোনা। আর এই সংসদীয় রাজনীতির বাইরেও তৈরী হচ্ছিল আরেক রকম রাজনীতির ক্ষেত্র – রাষ্ট্রযন্ত্রের রাজনীতি। রাষ্ট্র বা সিস্টেম তো এরকম একটা আফিমেরই সন্ধানে থাকে – যা লোকে সহজে খাবে – গোগ্রাসে খাবে। খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকবে। প্রশ্ন করবে না। বলিউডি সিনেমা এবং ক্রিকেট ভারতীয় জনতার জন্য রাষ্ট্রের দুই সেরা আফিম। কত সহজে মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া যায় দাঙ্গার স্মৃতি, বন্যার স্মৃতি, ভূমিকম্পের স্মৃতি, দুর্ভিক্ষের স্মৃতি। উদ্ভুত হল নতুন ফ্রেজ – “ক্রিকেটের হাত ধরে একটি জাতির উঠে দাঁড়ানো”র ছেলে ভোলানো গপ্প। ক্রিকেটের সঙ্গে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুনে দেওয়া হল জাতীয়তাবাদ।ক্রিকেট ঘিরে তৈরী হল “জাতীয়” আবেগ – দেশের সম্মান, সম্মানের যুদ্ধ। ক্রিকেট একটা যুদ্ধ।
এই জাতীয়তাবাদ এবং দেশের সংজ্ঞা নিয়ে আগের একটা লেখায় কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলাম। তার জের টেনেই বলি, ক্রিকেট ঘিরে নির্মিত এই জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা মূলতঃ একটি পরিকল্পিত নির্মাণ। ‘দেশ’ এর সংজ্ঞা প্রশ্নাতীত নয়। ‘দেশ’ কাকে বলে এ প্রশ্ন বহুবার তুলেছি, আমার মতো অনেকেই তুলেছেন। প্রাপ্ত উত্তরগুলোও বহু আলোচিত। আমি বরং আমার একটা নিরীক্ষা পেশ করি। দেখছি, উত্তরটা দিয়েছেন মূলতঃ তাঁরাই যাঁদের কাছে দেশ একটা আবেগের প্রশ্ন, সম্মানের প্রশ্ন। না তার মানে এই নয় যে যাঁরা উত্তর দেন নি, তাঁরা কেউ দেশ নিয়ে কোন আবেগ লালন করেন না। কিন্তু সম্ভবতঃ তাঁরা যুক্তিকে আবেগের ওপরে রাখতে চান কোন কিছুকে ‘সংজ্ঞায়িত’ করার সময়ে। এঁরা দেখেছি দেশ এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে প্রায় মৌন – অথবা বড়জোর ওই “যতদূর আমি পাশপোর্ট ছাড়া ঘুরতে পারি” গোছের পলিটিক্যালি কারেক্ট উত্তর। কিন্তু যাঁরা আবেগসহ উত্তর দেন তাঁদের সেই আবেগটার কি কোন দামই নেই? আছে তো অবশ্যই – অতএব তাঁদের উত্তর থেকেই খঁজা যাক দেশের সংজ্ঞা। কিন্তু কি মুশকিল দেখুন, প্রত্যেকের উত্তর যদি আলাদা আলাদা হয় তাহলে কোনটাকে ধরব? প্রশ্নটা তাই থেকেই যায়, নিরীক্ষায় যা উঠে আসে তা হল ‘দেশ’ প্রত্যেকে নির্মাণ করে নেন নিজের মত করে – নিজের মনের মধ্যে। আর রাষ্ট্র তার সুবিধেমতো মানচিত্র এঁকে নির্ধারণ করে দেয় তার ক্ষেত্র।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কি নিজের ‘দেশ’, তা বলতে আমি হাতি ঘোড়া বেগুনপোড়া যা-ই বুঝিনা কেন, তাকে সমর্থন করব না? ভারত বা বাংলাদেশের হয়ে গলা ফাটাবো না? উত্তরে বলি (আমার কাছে উত্তর চাননি হয়তো, তবু এতখানি ধ্যাস্টামো যখন করেই ফেলেছি), সমর্থন আমিও করি – আপনিও করেন। সমর্থন করতেই পারি। খেলা দেখতে যারা ভালোবাসি, খেলা দেখবো। কিন্তু সেই দেখা, সেই সমর্থনকে আমার স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতাকে গ্রাস করতে দেবো কেন? ধরুন কাল যদি ভারতের বুকে বসে ‘ভারতবাসী’ হয়ে কেউ অস্ট্রেলিয়াকে সমর্থন করেই (কী ভাগ্যি কাল বিপক্ষে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ নেই), তবে তার সহজ এবং একমাত্র ব্যখ্যাটা এটাই হয়না যে সে বা তারা ‘দেশদ্রোহী’। না হয়না। কারণ প্রথম কথা ‘দেশ’ এর সংজ্ঞা প্রত্যেকের কাছে আলাদা এবং রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া সীমানাকে অস্বীকার করা মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার। আর দ্বিতীয় কথা, এটা ‘যুদ্ধ’ নয়। দু দেশের ক্রিকেট বোর্ডের দল নিজেদের মধ্যে খেলেছে, আমরা কোন না কোন দলকে ‘দেশ’ হিসাবে (বা আমার দল হিসাবে) ধরে নিয়ে সমর্থন করছি আমার স্বাধীন নির্বাচন অনুযায়ী, কোন রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতায় নয়। আমার বিপরীত দিকে বসা মানুষটারও তার মতন করে নির্বাচন করার অধিকার আছে বৈ কি। সেটা আমার সঙ্গে না মিললে সমর্থকের কথার লড়াই চলতেই পারে – দেশের বিরুদ্ধে লড়াই হয় না।
জীবনে অনেক যুদ্ধ। বেঁচে থাকার যুদ্ধ, প্রতিদিনের হাসার যুদ্ধ। ওটা থেকে পালাবার পথ নেই বিশ্বাস করুন, ক্রিকেট আপনাকে ওই যুদ্ধে একটুও বাড়তি সুবিধা দেবে না। স্টেডিয়ামের লক্ষ ওয়াটের আলোর ছিটেফোঁটাও ঢুকবে না আপনার ঝুপড়িতে বা এক চিলতে ফ্ল্যাটে – ম্যান অফ দি ম্যাচের কোটি টাকার গাড়ি আপনার একটা ই এম আই শোধের কাজে আসবে না। না ওটা আমাদের যুদ্ধ নয় – স্রেফ এন্টারটেইনমেন্ট। ক্রিকেট থাকুক, সমর্থন থাকুক, আনন্দ বিষাদ থাকুক, সেই সঙ্গে স্যানিটিও থাকুক।