আমাদের উল্লাস খুব ব্রেনি ছেলে। আবিষ্কারের নেশায় পাগলপ্রায়। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম সে বড়মাপের বিজ্ঞানী হতে চলেছে। একবার একটি বিড়াল ধরে কি কাণ্ডটাই না করলো! এরকম কাণ্ড সে আরও অনেক কিছু নিয়ে করেছে। বিড়ালকেন্দ্রিক ঘটনাটার বিবরণ দিলেই বাকিগুলো আন্দাজ করা যাবে।
বিড়ালটি ছিল আমাদের পরিবারেরই একজন। জন্ম থেকে এ বাড়িতে আছে। রান্নাঘরের দেখভাল সে বেশ দায়িত্ব নিয়েই করে—তার উপস্থিতিতে অন্য কোনো বিড়ালের সাধ্য নেই রান্নাঘরে প্রবেশ করার। গবেষণার জন্যে উল্লাস যখন বিড়ালটি বেছে নিলো, বড় ভাবী, মানে উল্লাসের মা একটুও অমত হননি। তিনি বললেন, বেশ তো। অনেকদিন থেকে বাড়িতে আছে, যদি কোনও কাজে লাগে, লাগা। তবে দেখিস, ওর যেন ক্ষতি না হয়। বড়ভাই এক মিস্ত্রিকে ধরে এনে একটা জবরদস্ত খাঁচা বানিয়ে নিলেন। ছেলের আবিষ্কেরে স্বভাবের জন্যে তিনি যারপরনাই খুশি। বন্ধুমহলে আনন্দের সাথে বলে বেড়াতেন, আমার উল্লাস এই করল, সেই করল! চাচা হিসেবে আমিই কী কম গল্প করি!
বিড়ালটি খাঁচায় নিয়ে প্রথমেই যা করল—একমাস জামাই-আদর করে আপ্যায়ন করল। আমরাই ওর কথামতো বাজার থেকে এটা-সেটা কিনে এনে দিতাম। বসে বসে আয়েশ করে খেয়ে বিড়ালটি ছোটখাটো বাঘের আকার ধারণ করল। খাঁচার ভেতরে সে কী আস্ফালন তার! একদিন উল্লাস আমাদের সবাইকে ধরে নিয়ে গিয়ে বলল, বিড়াল বাঘের ছোট ভাই—এইবার বিশ্বাস হয় তো? বিশ্বাস আগে থেকেই ছিল, সত্যি সত্যি আজ অনুভব করলাম। আমার কথা শুনে উল্লাস বলল, ইঁদুরের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক আছে, সেটা জানো তো? এইবার সেটা দেখাব তোমাদের। আগামী একমাস ওর খাবার বন্ধ। উল্লাসের মা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, সে কি! মরে যাবে তো?
মা, তুমি যা বোঝো না তাই নিয়ে কথা বলতে এসো না। উল্লাস বলল। আমরা কেউ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেলাম। ও বড়ভাই-ভাবীকে তখন বুঝ দিচ্ছে- দেখো, বিড়ালটির কিচ্ছু হবে না। তাছাড়া হলেই-বা-কী, নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রয়োজনে এমন দু একটা কুরবানি দেওয়া নতুন কিছু না। লাইকার গল্পটি শোনোনি? ওই যে একটা কুকুরকে এক সপ্তাহের খাবার দিয়ে মহাশূন্যে পাঠান হল। কিছুদিন পরে সে তো মরলই। কিন্তু মাঝখান থেকে সে যে কাজটি করে গেল তার আন্দাজ আছে তোমার? সভ্যতার ইতিহাসে লাইকার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হল। একটা কুকুরের ভাগ্যে এমনটি জোটে? তোমার-আমার ভাগ্যে জুটেছে? তারপরই বড়ভাইয়ের মাথায় বুদ্ধি এলো—আমাদের বিড়ালটার জুতসই একটা নাম রাখতে হবে। উল্লাস যদি সত্যি সত্যিই কিছু একটা করে বসে তাহলে তার সাথে সাথে বিড়ালটার নামও ফলাও করে প্রচারিত হবে।
আচ্ছা, উল্লাস আমাদের অনেক বড় হবে—না গো?
সে আর বলতে। এই হল বলে। ভাই কণ্ঠ ভরাট করে উত্তর দিলেন। তারপর তারা খোশগল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
আমরা যে যার কাজে ব্যস্ত, উল্লাস উল্লাসের। বড়ভাই কাস্টমসে চাকুরি করেন, দু হাতে আয় তার। তাই ওর ভবিষ্যত নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না। মাঝেমধ্যে অবসর পেলে আমি ওর রুমে ঢু মেরে আসি। কখনও কখনও বলে- কাকু আসো, তোমাকে একটা নতুন আবিষ্কারের কথা বলি। বেশিরভাগ সময় বলত, কাকু, এখন বিরক্ত করো না-তো। অন্যসময় এসো।
একমাস পর সে বিড়ালটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করল। বেঁচে আছে দেখেই বড় ভাবীর আনন্দ যেন আঁটছে না। কিন্তু এ কেমন বেঁচে থাকা? বিড়ালটির শরীর শুকিয়ে একেবারে কাঠের জো অবস্থা। পাগুলো চড়ুই পাখির পায়ের পায়ের মতো শুকনো। শরীরের হাড়গুলোর ওপর চামড়াটা কোনোমতে লেগে আছে। বিড়ালটির কিছুদিন আগের যে চেহারা সেটা কেউ না দেখলে তাকে ইঁদুরই মনে করবে। ইঁদুরের মতোই মাথাটা সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে গেছে।
জল-পানি কিছুই দিসনি নাকি? ভাবী জিজ্ঞেস করল।
ইঁদুরের পরীক্ষা শেষ। আরও পনের দিন টানা ও কিছুই খেতে পাবে না। তারপর ওকে দিয়ে আমি নতুন পরীক্ষা শুরু করব।
বাঁচবে তো?
মা বকবক করো না তো। যাও। তোমাদের কাজ শেষ।
সপ্তাখানেক পরের এক সকালে বিলুর মা চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল। গিয়ে দেখি মাথায় হাত গিয়ে হায়হায় করছে। ফ্রিজের ডিপ খুলে মাংসের প্যাকেটটা সরাতেই দেখেছে মাংসপিণ্ডের মতো জমে বরফ হয়ে আছে বিড়ালটা। ভাবী ডেকে পাঠালেন উল্লাসকে। পাঁচদিন ধরে বিড়ালটি ডিপে। বোঝো কাণ্ড! উল্লাস বের করে বলল, বিলুর মা, চুলায় একটু পানি চড়াও তো।
কি করবি? ভাবী জানতে চাইলেন।
একটু জ্বালালেই ঠিক হয়ে যাবে। দেখবে নড়াচড়া করছে। উল্লাসকে বোঝায় এমন সাধ্য কার! ঘণ্টাখানেক জ্বালিয়ে রোদে শুকাতে দিল।
বিকালে সবাইকে ছাদে ডেকে বলল, দেখো চিনতে পারো কি-না!
বিড়ালটা পিটপিট করে তাকাচ্ছে। গায়ে পশম বলতে নেই, লোম-ছেলা মুরগির মতো দেখাচ্ছে। গায়ে সেলাইয়ের দাগ দেখে মনে হল কয়েকবার অস্ত্রোপচারও করা হয়েছে। না বলে দিলে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি এ গ্রহেরই প্রাণী। সবার চোখ তখন কপালে—যতখানি না বিড়ালটির পরিবর্তন দেখে তার চেয়ে বেশি ওর বেঁচে থাকা দেখে।
ভাবী অবাক হয়ে জানতে চাইল, দুই মাস না খাইয়ে রাখলি, ফ্রিজে রাখলি পাঁচদিন তারপর আবার চুলোয় জ্বালালি ঘণ্টাখানেক—এতকিছুর পরও মরলো না? ঘটনা কিরে?
মরবে কী করে! এইটাই তো আমার আবিষ্কার।
সবাই তাজ্জব বনে গেলাম—এ কেমন পিলে চমকানো আবিষ্কার রে বাবা! চারিদিকে উল্লাসকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেল। নামসহ বিড়ালটির ছবি ফলাও করে ছাপা হল কাগজে—উল্লাসের সঙ্গে সঙ্গে বিড়ালটিও এখন সেলিবিট্রি। ওর নতুন নাম উলাইকা! উল্লাস আর লাইকার সঙ্গে মিলিয়ে।
আমরা একদিন উল্লাসের ঘরে গিয়ে জানতে চাইলাম, গোপন রহস্যটা কি রে? বল, আমরা বাইরের কাউকে বলব না, কথা দিলাম।
উল্লাস একটু ভেবে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে: ধুর, মরবে কি করে, ও তো আগে থেকেই মরা। আমি একটু একটু করে মেরে নিয়েছি না! বিলুর মা মরেছে? মা, তুমি এত অত্যাচার করো। বিলুর বাপ প্রতিদিন পেটায়। চাচ্চু, মদ খেয়ে তুমি মাঝে মধ্যে যাচ্ছেতাই ভাবে...! সেদিন দেখলাম বাবা, তুমিও!
ভাবী ওর মুখ চেপে ধরল।
আমরা ওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম চোরের মতো দ্রুত, নিঃশব্দে।
আমার আসল আবিষ্কারের কথা তো শুনে যাও?—চেঁচিয়ে বলল উল্লাস।
কুর্নিশ। সৈয়দ মুজতবা আলীকে মনে করালেন।