ওহে মুসাফিররা, আমাকে কি চিনতে পারছেন? উঁহু ,পারছেন না তো। কী করেই বা পারবেন? মধ্যিখানে তো কয়েকশো বছর পেরিয়ে গেছে। তিরিশ বছর ধরে তামাম দুনিয়া ঘুরে যখন দেশে ফিরলাম তখন তো আমাকে কেউ চিনতেই পারে না। বাপ মরে গেছে, মা মরে গেছে। আমি বুড়ো হয়ে গেছি। দেশে ফিরে দেখলাম এই এতগুলো বছরে বিদেশে নানান কাজকর্ম করে টাকাকড়ি মন্দ জমাইনি কিন্তু সেগুলোকেও ছাপিয়ে গেছে আমার রিহলা, হ্যাঁ গো, আমার যাত্রাপথের অসংখ্য কিসসা। ছিলাম মুসাফির, হয়ে গেলাম কিসসাগো। লোকে আমাকে দেখলে কেবল গল্পই শুনতে চায়। এবারে চেনা গেল? আমি হলুম গে ইবন বতুতা। মরক্কোর তাঞ্জিয়ের শহর ছেড়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলাম। দেশভ্রমণ করতে করতে তো গল্প জমতেই থাকে। কিন্তু আরও অনেক কিসসা শোনা যায় কীভাবে জানেন। সওদাগরদের কাছ থেকে। পথে ঠগ-ডাকাতের ভয়ে রাতের বেলা ক্যারাভান সরাইতে থাকতাম।
সেই সরাইখানায় ক্যারাভান নিয়ে সদাগরেরাও থাকত। তারা এক-একটা কিসসার ভাণ্ডার।
চিন দেশ ছেড়ে সমুদ্রের ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে একদিন দেখলাম রক পাখি। যেন রামায়ণের জটায়ু, যেন ভগবান বিষ্ণুর বাহন গরুড় বাপরে বাপ। কী বিশাল! আবার আরব্য রজনীর সিন্দবাদ সদাগরও কিন্তু রক পাখি দেখেছিল। সে আবার গল্প। আরব্য রজনীতে আবার হোমা পাখি আছে। আবার ইরানে গিয়ে দেখুন হোমা পাখির বড়ো বড়ো পাথুরে মূর্তি। তবে কি তারা হোমা পাখি চোখে দেখেছিল? তাই বলি কী, কোথায় বাস্তব শেষ আর কোথায় গল্পের শুরু, কোথায় কল্পনার মিশেল কেউ ধরতে পারে না। কেন জানেন?
অবশেষে সুড়ঙ্গের দরজায়
একটি আশ্চর্য প্রদীপ জ্বলে ওঠে
অন্তরীক্ষে তখন বাজপাখির ভ্রম
সেই যে যমুনা পুলিনে শেষ দেখা হয়েছিল আমাদের, সেদিন
থেকেই আমি মতিচ্ছন্ন,
জিনের কোলেপিঠে মনের ওড়াউড়ি
সংশয় নিয়ে তাকিয়ে আছি তোমার
মন্দিরের দিকে...
কাজেই সবটাই সত্যি !
হাক দস্তুম হাক, হাক দস্তুম হাক—হাক মানে সত্যি কথা, হক কথা আর কি। দস্তুম মানে দাস্তান—যা শুনছেন, সব সত্যি! গল্প নয়, সব সত্যি। এই বলে গল্প শোনায় কারা? মেদ্দা, মেদ্দা, তুরস্কের দাস্তানগোরা।
দেশভ্রমণ করতে করতে ভাষা হারিয়ে যায়। তারপর একসময় হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসে শুধু গল্প। তারপর বানিয়ে দেয় কিসসাগো, দাস্তানগো।
মালবদেশের গল্প যা শুনেছি আপনাদের বলে যাচ্ছি।
আজকাল গদাধরের ঘুম ভালো হয় না। আবছা আবছা, ছেঁড়া ছেঁড়া, হালকা মেঘের মতো। খালি আসছে আর যাচ্ছে। আসছে আর যাচ্ছে। তাকে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গিয়ে আর পারি না। আর ঠিক তক্ষুনি গদাধরের কোঠাবাড়ির সমুখের রাস্তা দিয়ে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। সংকীর্তন চলছে, আবেগে মতোয়ারা। খোল বাজছে, ভোরের আলো প্রায় ফুটি ফুটি। গদাধর তড়িঘড়ি উঠে খড়খড়ি ফাঁক করে দেখে রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা, তার বাড়ির সমুখ দিয়ে চলে গেল। আপনা থেকেই হাত দুটো প্রণামের মতো জড়ো হয়ে গেল গদাধরের। আর ঘুমনোর বালাই নেই। সটান উঠে দিঘির ধারে দাঁড়িয়ে গদা নিমের ডাল ভেঙে দাঁতন করতে লাগল। গদার মনে তখন কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে ওগো সুদূর বিপুল সুদূর তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি... মোর ডানা নাই। নাহ, গদার চোয়াল দুটো শক্ত হল। তার দুটো অদৃশ্য ডানা আলবাত আছে। শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের কী যেন হয় গঙ্গারামের মতোই বাঙালির ছেলে বিজয় সিংহ, হেলায় লঙ্কা করিয়া জয়, তাদের কী যেন কী একটা আত্মীয় হত বলে সে বাপ-পিতেমোর মুখে বহুবার শুনেছে।
বউটা মারা যাওয়া ইস্তক ঘরেও তার মন টেকে না। গদাধরদের বাণিজ্যে বসত লক্ষ্মী। এই শান্তিপুর নবদ্বীপের যত শাড়ি আর নানান তেজারতি ব্যাবসা সেই কোন্ জন্ম থেকে তারা করে আসছে। কিন্তু ওই যে গদার বদ রোগ, এক জায়গায় তার মন বসে না। ঢাকা ফরিদপুরে মসলিনের কারবার করতেও গেছে। কিন্তু এই উড়ো স্বভাবটার জন্য তার তো বিশেষ কিছু করার নেই। সে মেষ রাশি মেষ লগ্ন। চরে বেড়ানোর জন্যই তার জন্ম। গদার যদিও জানার কথা নয় কারণ তার সময়ের আরওতিনশো বছর পর অমনি এক মেষ রাশি মেষ লগ্ন এক চৌহদ্দির মধ্যে শান্তিনিকেতনে পাঁচ-পাঁচখানা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলেন, ওই এক কারণ, এক জায়গায় মন বসে না। আবার তিনিই লিখেছিলেন মায়েরা সন্তানদের বাঙালি করে রেখেছে। আস্ত মানুষ বানায়নি। তারা সক্কলে বোতাম আঁটা জামার নীচে শান্তিতে শয়ান। ইহার চেয়ে হতাম যদি আরব বেদুইন। না, গদা আরব বেদুইন হতে চায়নি বটে তবে আরবের ব্যাবসাদারদের সঙ্গে তার বিলক্ষণ মোলাকাত হয়েছে। তাদেরই একটা দলের সঙ্গে তার বেশ লাগে কথা কইতে। একটু অসুবিধে হয়, তবে আকারে ইঙ্গিতে ভালোই কাজ চালানো যায়। হুশেন শাহি জমানায় বাঙলায় মোটের ওপর খুব কিছু অশান্তি নেই। সেই আরবি ভিনদেশিরাই একটা প্রস্তাব দিয়েছে। দেশের লোক সঙ্গে থাকলে ভিনদেশিদের সুবিধে হয়। গদার মাথায় সেইটাই ঘুরপাক খাচ্ছে আজ প্রায় হপ্তা খানেক হবে।
গদাধর মুখ ধুয়ে রাধামাধবকে পেন্নাম ঠুকে উঠোনে এসে বসে। গদাধরের মা আবার তার বিয়ে দেবেন বলে তোড়জোড় শুরু করেছেন। তিনি কীসব বলে যাচ্ছেন গদার কানে তা এক বর্ণ ও ঢুকছে না। শুধু আমিরউল্লাহের কথা তার কানে-মাথায় বিজবিজ করছে।
বেলা বাড়ছে। সবাই যে যার কাজে লেগেছে। গদা বসেই আছে। যেন কোনো হুঁশ নেই। শুধু একটা কুবো পাখি ডেকে যাচ্ছে কুব কুব কুব কুব। আর গদার মাথার ভেতরে কে যেন বলছে ঘর থেকে ছুট ছুট ছুট।
পরের দিন আবার খোল বাজল, কীর্তন হল, নিমাই পণ্ডিত পথ আলো করে হেঁটে চলে গেলেন। কিন্তু গদাধর তার কিছুই শুনতে পেল না, দেখতে পেল না। ততক্ষণে রসদপত্র নিয়ে আরবি বণিকদের সঙ্গে সে ধরেছে পশ্চিমের পথ। সার সার গোরুর গাড়ি। টুং টাং গলার ঘণ্টা, গাড়ির নীচে লন্ঠন নিভু নিভু। তন্দুরের রুটি আর ঝলসানো ভেড়ার মাংস। তার এতদিনের নিদ্রাহারা রাত আজ ঘুমে ঢলে পড়েছে। অথচ মনের মধ্যে উত্তেজনার তোলপাড়। ওদিকে গদার মা শুয়ে শুয়ে ভাবছেন পানসুপুরি পাঠিয়ে ছেলের বিয়ের পাকা কথা সেরেই ফেলবেন রাত পোহালেই।
গদাধরের জন্মগত বংশগত ব্যাবসাবুদ্ধি, সেয়ানা বুদ্ধি, অজানাকে জানার অদম্য কৌতূহলকে বাঙলার ধান মাছ নারকেল ঠান্ডা হাওয়া আর কীর্তন সুখী করতে পারেনি। কিছু লোক জন্মায় চির বুভুক্ষু। গদাধর সেই অদ্ভুত দলের। সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়!
উজ্জয়িনী ইন্দোর পেরিয়ে বছর দশেক পর গদাধর হাজির হল এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গায়। এর মধ্যে মাড়বার, কচ্ছ, সিন্ধ ও আরবি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মেলামেশায় তার কূপ মণ্ডূকের সীমানা অনেক অনেক বেড়েছে। বংশগত বুদ্ধি হয়েছে ছুরির ফলার মতো ধারালো, কথাবার্তা হয়েছে তুখোড়, হাতে এসেছে বিস্তর অর্থ, চেহারায় তেল চেকনাই চলে গিয়ে এসেছে একটা কেঠো আকর্ষণ। রাজপুতদের সঙ্গে মিশে মিশে অনেকটা তাদের মতো হাবভাব রপ্ত করেছে। অবিশ্যি এটা বঙ্গজদের জাতগুণ। নকল করতে তারা ওস্তাদ। গদাধর নামটা এখন তার কানে বিচ্ছিরি শোনায়। তাই গদা নিজেকে পরিচয় দেয় মেদিনী রায় বলে। মেদিনী রায় রাজপুত।
এক ভরা বর্ষায় এক সবুজ মলমলে চাদরে ঢাকা সুন্দর জায়গায় গদা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাজির। এখানে সে ব্যাবসা করবে। গত দশ বছরে অনেক নতুন নতুন পণ্যের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। সে আগে কখনও এসব দেখেনি। সরু সরু উজ্জ্বল হলুদ সোনালি রঙের সুতোর মতো, দারুণ সুবাস, নাম জাফরান। পাহাড়ে বরফের দেশ থেকে আসে, আসে মৃগ নাভি কস্তুরী। তার সুরভি নেশা ধরিয়ে দেয়। বড়ো দুর্লভ। চড়া দাম। নবাব-বাদশাদের এগুলো না হলে চলে না। আরও একটা নতুন জিনিসের কারবার সে দেখেছে, হাতির দাঁত। এখানকার কারিগররা সেই দাঁত দিয়ে কী যে সব সূক্ষ্ম কারুকাজ করে, না দেখলে গদা বিশ্বাসই করত না। এ জায়গাটায় কোনো সমুদ্র নেই, বন্দর নেই। কিন্তু বাণিজ্যের স্বর্ণ সুযোগ। কারণ আরব দেশ থেকে আফ্রিকা থেকে লোকজন আনাগোনা করে অথচ পণ্য সরবরাহের তেমন প্রতিযোগিতা নেই। অনেক কৌশলে গদা এইসব খোঁজখবর জোগাড় করেছে অনেকদিন ধরে। বিস্তর আটঘাট বেঁধে গদা তাই মালব দেশের এই নিবিড় সবুজ প্রান্তে এসে নোঙর বাঁধল। পালকি করে পাকদণ্ডি বেয়ে ভেজা সবুজের গন্ধ মেখে মেখে গদা মান্ডু চলেছে। বিস্তীর্ণ সবুজের মাঝে মাঝে সুরম্য প্রাসাদ। ভুট্টার খেত। বড়ো বড়ো ফটক। কড়া নজরদারি। এত সবুজ গত দশ বছরে গদা দেখেনি।
হঠাৎ গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেল। সেই দশ বছর আগে এমনই ভরন্ত সবুজ এক দেশ ছেড়ে সে চলে এসেছিল। দুনিয়া দেখবে বলে।
এমনই ঠান্ডা বাতাস বইছিল সেদিন। প্রাণ জুড়োনো, মায়ের মতো। অনেক দিন পরে গদার চোখে জল এল। পালকি থামিয়ে গদা খাড়াই পথ বেয়ে হাঁটতে থাকল। বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে তার কোঁকড়ানো সামান্য লম্বা চুল, তার রেশমি পোশাক, দামি নাগরা। সেই মহার্ঘ পোশাক ছাড়াও শ্রাবণ তখন গদাধরের হৃদয়ের একূল ওকূল ভিজিয়ে আকুল। চোখের জল, বৃষ্টির ধারাজলে কখন মিশে গেছে। গদার কান্না কেউ দেখতেই পেল না।
কিন্তু গদা সফল হয়েছিল। খুব সফল। পাইকারি হারে ব্যাবসার আড়ত খুলেছিল মান্ডুতে। বিশাল কারবার। দেশবিদেশের কত মাল এসে জমা হত। ছোটো ছোটো ব্যাপারীরা কিনে নিয়ে যেত। সার সার দোকান। সার সার দোকান। দোকানের মধ্যে তাক। খোদ রাজপ্রাসাদে হারেমে তার গুদাম থেকে রাশি রাশি জিনিস পাঠানো হত। পাইকারি আড়ত না বলে আধুনিক শপিং মল বললেই যেন ঠিক হয়। কে না জানে বাঙালিরা বাঙলার বাইরে বেশি সফল। দেশের জন্য নাড়ির টানে কি না জানি না, গদা, মেদিনী রায় নামটা আর লেখেনি।
কোনো প্রাসাদ নয়, অট্টালিকা নয়, মন্দির মসজিদ, বিলাসঘর নয়, কেল্লা নয়, সমাধি নয়। এক বিপুলায়তন দোকানঘর। গদার দোকান, আপনাকে থামিয়ে দেবে মান্ডু ঢোকার মুখে।
সবুজ ঘাসে ঘাসে আর শ্যাওলায় চাপা পড়ে আছে অজস্র বণিকের হট্টগোল, দরদাম, দর কষাকষি। আরবি বাজার বা সুক (souk) ছিল এই জায়গাটা। সৈয়দ মুজতবা আলীকে একেবারে বসিয়ে দেওয়া যায়“মজার ই শরিফ থেকে কার্পেট এসেছে, বদকশান থেকে লাল রুবি, মেশেদ থেকে তসবি, আজারবাইজান থেকে …”
না ভাই এবারের মুক্তোগুলো তেমন ভালো ঠেকছে না।
কী হল? শান্তিপুরের দুকুল ঢাকার মসলিন, আমার সাত গাঁঠরি লাগবে যে!
জাফরানের দাম কিন্তু এবারে বেশি পড়বে। পারস্য থেকে এসেছে ভায়া, মুখের দিকে চেয়ে থাকলে কি হবে?
হাতির দাঁত অমন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছ যে! এখানে বাজে জিনিস রাখি না বুঝলে। আজ সকালেই সুলতানের খাস কারিগর চোখ বন্ধ করে কিনে নিয়ে গেছে।
একবস্তা আখরোট ফাউ নেব কিন্তু!
দুটো বড়ো বড়ো বাউলি, উজালা আর অন্ধেরি। আর এই বাউলির চারদিক ঘিরে আছে অনেকগুলো সার সার ঘর। অর্থাৎ এটি একটি আড়ত বা দোকানঘর শুধু নয়, এখানে ছিল ক্যারাভান সরাই। মান্ডুতে যারা সওদা করতে আসত, তাদের অস্থায়ী আস্তানা। বাউলি মানে ধাপ কুয়ো, স্টেপ ওয়েলের জলের দরকার হত খুবই। বোঝাই যাচ্ছে।
আফ্রিকা থেকে এক ধরনের গাছ আনিয়েছেন সুলতান। মান্ডুর এই ঠাসা জঙ্গুলে আবহাওয়ায় সে গাছ দিব্যি বেঁচে গেল। আজ মান্ডুতে গেলেই চোখে পড়বে আফ্রিকার বাওবাব। সাতশো বছর বাঁচে। এক-একটা গাছ বহু ইতিহাসের সাক্ষী, নেহাত কথা কইতে পারে না। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ডগুঁড়ি। ফল হয় ইয়া বড়ো বড়ো। নারকেলের মতো শক্ত খোলা।খোলা ফাটালে শুকনো রাম টক বিচিওয়ালা ফল। মান্ডু কি ইমলি। স্থানীয় লোকেরা তাই বলে।
লে কে যাও, লে কে যাও, মান্ডু কি ইমলি, মশহুর। সুলতান আফ্রিকা থেকে আনিয়েছিলেন, এটা পঞ্চাশ, ওটা চল্লিশ। দশ বছরেও কিচ্ছু হবে না।
সন্ধে নেমেছে। সারাদিনের ব্যাবসা কেনাবেচার পর ক্লান্ত বণিকের দল হাত-পা এলিয়ে বসেছে। ক্যারাভান সরাইতে শুরু হয়েছে গল্পের মৌতাত। গল্প শোনাচ্ছে হারুন কিসসাগো। সওদাগরের দল সবুজ ঘাসের মলমলি জমিতে বসে আছে, কেউ আধ শোয়া, কেউ পাথরের ঢিপিতে হেলান দিয়ে, কেউ আয়েশ করে হুঁকো শুদ্ধু বসে পড়েছে। অম্বুরি তামাক আর গোলাপের পাপড়ির খোশবায়। বুড়ুক বুড়ুক শব্দ।
সবে বর্ষা শেষ হয়েছে। আর আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে দেশবিদেশের সওদাগরদের। এটা ব্যাবসার মরশুম। ভেজা জমি শুকিয়ে উঠছে। সেই ভেজা মাটি কুমোরের চাকে ঘুরে ঘুরে প্রদীপের আকার নেবে। তেলের প্রদীপ জ্বলবে দীপাবলির রাতে। তখন শেষ হবে সব সওদার কাজ। যে যার দেশে মুলুকে ফেরার পালা।
উজালা আর আন্ধেরি বাওলির মাঝখানে অনেকটা ফাঁকা জমি। সারা দিনের চুলচেরা হিসেব আর নানান কিসিমের জিনিসপত্রের ব্যাবসা সেরে বণিকের দল হাত-পা এলিয়ে দিয়ে ওই জমিতে বসে জিরোয়। ক্যারাভান সরাই-এর মাথায় তখন পশ্চিমের আকাশ লালে লাল। সেই জিরেনের মৌতাতকে আরও একটু উস্কে দিতে সন্ধেবেলা হাজির হয় এই কিসসাগো হারুন। এসেই হাঁক পেড়ে বলে, কই গো, মুসাফিরের দল, কোথায় গেলে সব?
“মান্ডবগড় বা সাদিয়াবাদের খানপানের কিসসা কি আর সহজে শেষ হবে, হুজুর? এখন তো সবে তন্দুর তৈরি হয়েছে। চুলা জ্বলবে, আপনাদের রাতের খাবার পাকানো হবে, তবে না আপনারা খেতে বসবেন! দেখুন পুবআকাশে চাঁদ কেমন জ্বলজ্বল করছে। জোছনার ফটফটে আলোয় আপনাদের সব্বাইকে কেমন দেখতে পাচ্ছি আমি।
ওহে ভিনদেশি মুসাফির সওদাগরের দল, আমাদের মুলুকে এসেছেন যখন, দুদণ্ড জিরিয়ে আমাদের রঙ্গিলা সুলতানের কিসসা শুনে যান। দেশে ফিরে গিয়ে সবাইকে গল্প শোনাবেন, হ্যাঁ একটা দেশে গেছিলুম বটে! আর সেই সঙ্গে এই অধমকেও মনে রাখবেন, কেমন? আপনাদের সন্ধেগুলো কেমন কুলপি মালাইয়ের মতো জমিয়ে রাখছি বলুন!”
কখনও এক জায়গায় স্থির হয়ে বসবে না হারুন। দিন কয়েক মৌজ করে দাস্তান শুনিয়েছ। এখন বলছে আবার পাখির মতো ফুড়ুত করে উড়ে যাবে আর-এক মুলুকে।
ব্যাপারীর দল হাঁ হাঁ করে ওঠে। আবার চলে যাবে হারুন?
কী করি হুজুর! গল্পের জাম্বিল (থলি) খুলে আপনাদের শোনাই কিন্তু পেটের জাম্বিলটা তো ভরতে হবে। আবার নতুন নতুন কিসসা এনেগল্পের জাম্বিল থেকে যা খরচা হয়ে যাচ্ছে তাকে পুষিয়ে দিতে হবে, তাই এক জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে আমরা কিসসাগোরা বসতেই পারি না। এই খানিকটা আপনাদের মতোই, সওদা করতে যেমন বেরিয়ে যান। তবে কিনা এই মালওয়া আমার দেশ-গাঁ। এইখানেই আমার ঘরবাড়ি। এখানকার গল্প শোনাতে সবচেয়ে আরাম পাই। তাহলে শুরু করি আমার কিসসা।
জানেন মুসাফিররা, মালওয়ার সুলতান ঘিয়াদ শাহ এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। নাচগান, খানপান, আয়েশ আর রইসি, এই ছিল তার জিন্দগি। আমাদের এই মালওয়া, দেখছেন তো কেমন শান্ত, সবুজ, মখমলের মতো আরামের। তো, এই আরাম সুলতানকে একেবারে আপাদমস্তক ঢেকে দিয়েছিল। এত সুন্দর ছিল এই মান্ডবগড় যে তাকেসবাই বলত প্রেমনগর বা সাদিয়াবাদ। ঘিয়াদ শাহের একটা অদ্ভুত শখ ছিল। কীসের বলুন তো? দেখি, কে কেমন ঢিল মারতে পারেন? দেখি দেখি। সওদাগরের দল একে একে ঢিল মারতে থাকে।
মৌসিকি?
আশিকি?
শায়েরি?
মোহব্বত?
শিকার?
সওদা গিরি?
উঁহু উঁহু উঁহু। না না না। কোনোটাই ঠিক হল না।
তবে কী? ভ্যারেন্ডা ভাজা। খই ভাজা?
হো হো করে হেসে ওঠে সব্বাই।
হারুন বলতে থাকে, অনেকটা কাছাকাছি গেছেন কিন্তু! একটা কিতাব শুরু হয়েছে আরশোলাদের দেবতাকে পেন্নাম ঠুকে, আর শেষ হয়েছে ওইআর-একবার পেন্নাম ঠুকে, আরশোলাদের দেবতাকে। বলুন, বলুন কী হতে পারে?
অল্প দূরে তন্দুর জ্বলছে, জ্বলন্ত কাঠের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। রাতের খাবারের জোগাড়যন্ত্র, গেহুঁ, বাজরা, মকাই-এর আটা, ঘি। আর-একদিকে মাংসখণ্ডে মাখানো হচ্ছে মশল্লা। অড়হর ডালে ফোড়ন।
সেই সুঘ্রাণ নাক লম্বা করে টেনে নিতে নিতে হারুন বলল, একটা কিতাব। রসুই-এর কিতাব। বলে নাকি রসুই কিতাব লেখার শুরুতে এবং শেষে আরশোলার বন্দনা করলে এই কিতাব বেঁচে যায়। সময়ের পোকা তাকে কাটে না। তাই তো এত হাত ঘুরে উর্দু ফারসিতে লেখা সেই কিতাবটা আজও আছে। এর নাম নিমাতনামা। খুব আনন্দ করে এই বইখানা লিখেছিলেন সুলতান। মালওয়ার সুলতান ঘিয়াদ শাহ।
তার মানে হল সুলতানের শখ ছিল খানাপিনা, রসুই, রান্না করা। আর সেই খানাপিনা তার কাছে দস্তুর মতো এক শিল্প, কী তার লাজিজ পেশকশ আর বর্ণনা। শুধু তাই নয় প্রতিটি পাতায় পাতায় রকমারি খাবারের ছবি-টবি শুদ্ধু সে এক অপূর্ব সুন্দর কিতাব।
দিল্লিতে সেই সময় লোদি সুলতান। মাওলয়া তখন এক রমরমা দেশ।কিন্তু ঘিয়াদ শাহের রাজ্য শাসন ভালোলাগত না একেবারেই। তিনি বললেন, আমি আর রাজত্ব টাজত্ব বাড়াব না। আমার সে ইচ্ছেও নেই। যদ্দিন বাঁচব খেয়েদেয়ে সুখে আয়েশে বাঁচব। ওই যে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লেন না, ভ্যারেন্ডা ভাজা, খই ভাজা?
সাদিয়াবাদ নাম কী আর এমনি এমনি হয়েছে, এ যে খুশিয়াল শহর। তো এই মৌজ-মস্তির মধ্যে সুলতান পাকশালা নিয়ে বুঁদ হয়ে রইলেন। কী নেই তাঁর সেই কিতাবে? পুলাউ, রুটি, পুরি, মাংস, সামোসা, হরেক রকম কাবাব, সুগন্ধি, আরক, জারক, জড়িবুটি, পান আর শরবত। রকমারি,হরেক রকম। সে কিতাব একেবারে নেশা ধরিয়ে দেয় বটে!
আজ আমরা কী কী খাচ্ছি বলুন তো? শুরু করি শরবত দিয়ে। এই নিন, পেশ করছি গিয়াধ শাহি শরবত, ডুমুর ফলসা আর খেজুর একসঙ্গে কুচিয়ে নিন। জলে মিশিয়ে খুব করে নাড়াচাড়া করে সিরাপ মেশান। এবারে এই শরবতের সঙ্গে আসছে কোফতা।
মাংসকে ভালো করে পিটাতে হবে। পিটিয়ে পিটিয়ে নরম হয়ে এলে ছড়িয়ে দিন পোস্ত দানা। এবারে দিন নুন, মৌরি জাফরান কর্পূর আর কস্তুরী।
বল কী হারুন? কস্তুরী? আজকের বাজারে তো বিরাট দাম চড়েছে। এক পয়সাও কমানো গেল না!
আহাহাহা, এ কী আমার আপনার জন্য বানানো কোফতা! মাংসটাকে ওইসব দিয়ে মেখেমুখে তারপর গোল্লা পাকিয়ে লেবু পাতা দিয়ে মুড়ে ফেলতে হবে। লেবুপাতাটা টক টক হলেই ভালো। এইবার বেশ কিছুক্ষণ রেখে মাংসের হাড়গোড় দিয়ে ফোটানো ঘন সুরুয়ার মধ্যে সেদ্ধ করে, ওই যে শরবতটা বানানো হল সেটা দিয়ে গরম গরম কোফতা খেতে থাকুন।
ওই দেখুন গো, চুলার আগুনে ঢুকেছে আপনাদের জন্য রাতের কাবাব। কাল আবার আসব খন।
এ কী হারুন! এত কম কম করে বললে চলবে?
আরে জনাব! আরও দুই সন্ধে সামনে পড়ে আছে।
এই বলে জিভের নোলা সুড়ুত করে টেনে হারুন ধাঁ করে রাতের আঁধারের মধ্যে হুশ করে মিলিয়ে গেল।
মিলিয়ে তো গেল, কিন্তু হারুনের এই ঝড়ের মতো হাজির হওয়া, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে মজাদার কিসসা বলে এতগুলো ঝানু ব্যাবসাদারকে মাতিয়ে রাখা আবার ঝুপ করে অন্ধকার পথে মিলিয়ে যাওয়া এসবই একজন হাঁ করে গিলছিল। তার নাম হরিণ। বারো-তেরো বছরের বালক। এসেছে শান্তিপুরের দুকুল আর মলমল নিয়ে, দামোদর শেঠের তল্পিবাহক হয়ে। ফাই-ফরমাশ খাটে। শেঠের গা হাত পা টিপে দেয়। মাথায় তেল মাখিয়ে দেয়। শেঠ খাটিয়ে নেবে কিন্তু খেতে পরতে দেবে, কিছু টঙ্কাও আসবে গরিবের সংসারে। এই ভেবেই তাকে যেতে দিল তার বাপ। তা মন্দ লাগছে না হরিণের, এই শেঠের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে। তবে এই ভর হেমন্ত সন্ধ্যায় তার বাড়ির কথা মনে পড়ে। আকাশে মস্ত চাঁদ। জোছনার মধ্যে সে পিঠেপুলির গন্ধ পায়। নারকেলে গুড়ের পাক দেওয়ার গন্ধ।
ওই বাউন্ডুলে হারুন কেমন সুন্দর করে খাবারের গল্প বলছিল। অত শত খাবারের নাম সে কোনোদিন শোনেইনি। কিন্তু লোকটা কেমন সুন্দর কথা বলে। গল্প শোনায়। ঠিক তার ঠাকুরমার মতো। ঠিক নদীর ঘাটের বটগাছের নীচে বসে থাকা খুনখুনে দাদাঠকুরের মতো। শুক সারি,বেতাল বিক্রমাদিত্য, বেহুলা লখিন্দর, এমনকি নিমাই পণ্ডিতের গল্পও শুনেছে সে। আর রামায়ণ, মহাভারত।
তারও ইচ্ছে করে অমন করে গল্প শোনায় সবাইকে। ফটফটে জ্যোৎস্নায় এলোমেলো এবড়ো খেবড়ো পাথর আর ঢিবি তার শ্রোতা। সওদাগরের দল তখন রাতের খানা খেতে গেছে। দূর থেকে হুল্লোড় শোনা যাচ্ছে।একটা পাথরের ওপর হাতের ভর দিয়ে উঠে হরিণ ফিসফিসিয়ে বলে,অনেক দিন আগে অনেক অনেক দিন আগে সমুদ্রে ভেসে ছিল এক সওদাগর, তার নাম চাঁদ সওদাগর ...।
রাতের হাওয়া, আকাশের মলমলি চাঁদের আলো, দুটো রাতচরা পাখি আর ওই পাথরের ঢিবিগুলো এক জোটে বলে উঠল, তারপর? তারপর?
সন্ধের মুখেই সব জড়ো হয়ে বসে।
“এই যে এসেছি, এসেছি এসেছি”
হারুন গলা তুলে বলে আসুন মশাইরা, পান সাজা হচ্ছে। একটা করে পান মুখে ফেলুন। টপাটপ।
এতো ভারী মজা! পান পেলে কোথায় হে?
সবুর করুন জনাব, এই এক্ষুনি হাজির করছি। গিয়াধ শাহি পানের বিরা। পান পাতা ধুচ্ছি এখন কর্পূর আর গোলাপ জলে। একটা পদ্ম নকশা কাটা শ্বেতপাথরের গামলা। গোছা গোছা পান ধোয়া হচ্ছে সেই জলে। এগারোটি পান দিয়ে নবাবের পানের বিরা। মিহিন চুন তৈরি হল। আর সুপুরিকে কুচি কুচি করে কেটে ফুটিয়ে নিতে হবে ঘৃতকুমারী তেলে, তারপর ওই সুপুরি কুচিগুলোতে জম্পেশ করে মাখাতে হবে কস্তুরী আর সাদা অম্বরগ্রিস। একটু গোলাপ সুগন্ধি ছিটেফোঁটা। এইবারে গালে ফেলুন পানটি।
অম্বরগ্রিস? বল কী হে? সে তো ভয়ানক দামি! শুধুমাত্র পান খাবার জন্য এত্ত তরিবৎ!
আহাহাহাহা, এ কী আপনার-আমার পান? খোদ ঘিয়াদ শাহের জন্য বানানো হত। হ্যাঁ, অম্বরগ্রিস তো খুব দামি, তিমি মাছের বমি। সেই জমাটবাঁধা সুগন্ধি। পাওয়াই যায় না।
আরও একটা শুনুন, জাফরান, চন্দন, কস্তুরী, কর্পূর একটু একটু নিয়ে তাতে একটু গোলাপজল আর অম্বরগ্রিস মিশিয়ে পান দিয়ে থেঁতো করবেন। করতেই থাকুন করতেই থাকুন। না, এখনই খাবেন না। একটা ভেজা খড়ের পাথা দিয়ে খুব করে বাতাস করুন। খুব জোরে জোরে। তারপর সেই থেঁতো পান ঠান্ডা ঠান্ডা হয়ে এলে টুপুস করে মুখে ফেলুন!
বল কী, হারুন! এ তো বিশ্বাসই হয় না!
ওগো, শুনুন তবে, জ্বরজারি হলে, গরমে শরীর শুকিয়ে নাক দিয়ে রক্ত বেরুলে বমিবমি ভাব হলে এই পান থেঁতোটাই তখন ওষুধ! বুঝলেন?
কত কত রকমের পান সাজা! এমন কিতাব দুনিয়ায় খুঁজে পাবেন না। আছে আমাদের এই মালবদেশে। শুনবেন এই নানা কিসিমের পান সাজার কী কী গুণ! আধিব্যাধি রোগবালাই দূর হয়। গলা জিভ শ্বাসনালীর রোগ দূরে পালায়। পরিষ্কার শুনতে পাবেন, পরিষ্কার দেখতে পাবেন। বুদ্ধি হবে খোলাতাই! এবারে যে একটু জল চাই। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল গো।
বণিকের দল এতক্ষণ হাঁ করে হারুনের কিসসা গিলছিল। এবারে হুঁশ ফিরে লোকজনদের ডাকাডাকি শুরু করে দিল।
হরিণ এক ছুট্টে গিয়ে একটা মাটির ভাঁড়ে করে জল নিয়ে দুহাতে হারুনের মুখের সামনে তুলে ধরে। হারুন জলের পাত্র ধরে একটু হাসে, সে হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার চোখে ঝিলিকে। হরিণ অবাক হয়ে দেখে সেই চোখের ভেতরে একটা সরু সুড়ঙ্গ। ঘন কালো একটা পথ চলে গেছে কত দূর। সে যেন ঢুকে যাচ্ছে একটু একটু করে।
ভাঁড়টা নাও খোকা।
চমক ভাঙে হরিণের। খালি ভাঁড় টা নিয়ে চলে যায় সে।
ওই লোকটা হারুন লম্বা জোব্বা পরে হনহন হাঁটে। সঙ্গে একটা ঝোলা। মাথার চুল জট পাকানো, খাড়া নাকের পাশে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ,গভীর, সুড়ঙ্গ দেওয়া। যেন কোথায় তলিয়ে যাওয়া যাবে!
কত কত দেশ ঘোরে। গল্পের জাদুজাল বিছিয়ে দেয়। ইশ, হরিণ যদি অমন ঘুরতে পারত!
হারুন আবার গলা চড়িয়ে বলে, কাল ভোরে আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে যে। ওহ, কত খোশবায় বেরুচ্ছে চারদিকে! ফুলেল তেলের গন্ধে চারদিক একেবারে ম ম কচ্ছে গো। কী সুবাস। আপনারা কত বড়োলোক, ভালো ভালো জিনিস মাখেন। আমাদের এই মালব দেশের জল-হাওয়ায় কী চেকনাই খুলেছে গো আপনাদের।
তো কী হল জানেন, নর্মদা পারের রানিমা ডেকে পাঠিয়েছেন। উনি নাকি সুগন্ধি বানাবেন নিজের হাতে। আর আমাকে নাকি তার সব হদিস দিতে হবে। আবার সিরপুরের মেলায় সবাই হা-পিত্যেশ করে বসে আছে, হারুন কবে আসবে হারুন কবে আসবে? কী জ্বালা বলুন দিকি। সেখান থেকে বুরহানপুরের আহুখানায় মেহফিলে!
ওহে বাপু, তুমি সিন্ধুদেশেতে একবার এসো কিন্তু।
আমাদের শান্তিপুরেও এসো একবার, অ্যাঁ? দামোদর শেঠ বলে ওঠে।
বিদিশায় এসো, কলিঙ্গে এসো, মাড়বারে এসো, সুরাটে এসো। খোরাসানে এসো।
চারদিক থেকে হু হু করে নেমন্তন্ন আসতে লাগল। হো হো করে হাসছে হারুন। তার চিকমিকে চোখ দুটো যেন বলছে, এই ভাবেই তো আমি বেঁচে থাকি, আমার কিসসা বেঁচে থাকে।
ছোট্ট পাথরটায় তড়াক করে উঠে হারুন বলল, এই সুগন্ধিটা অনেকরকম ভাবে ব্যাবহার করা যায়, পোশাকে, চুলে লাগাতে পারেন। পানের মধ্যে দিয়ে চিবুতে পারেন, এমনকি খাবারে আর জলেও মেশাতে পারেন।
কী কী লাগবে শুনুন, কাবলি ছোলার বেসন, কর্পূর, কমলালেবুর শুকনো খোসা, গোলাপ জল, লাল গোলাপের পাপড়ি, এলাচ দানা,দালচিনি, চাঁপা ফুল, লবঙ্গ এলাচ আর কর্পূরের গুঁড়ো, পিষে বের করে আনা তিল তেল, চন্দন, সাদা অম্বরগ্রিস আর গাছের মিস্টি আঠা।
দারুণ সুগন্ধ, দারুণ!
আরে হারুন! এমন সব পসরার সওদা যদি করতে পারতাম, তাহলে তো মুনাফা লুটে লাল হয়ে যেতাম। ওই এক কস্তুরীই তো বাজার দখল করে বসে আছে।
আমি তো কত হদিস দিলুম গপ্প করতে করতে। যাই গো, এবারের মতো। আজ রাতেই ভিন শহরে রওনা দেব, কাল ভোরেই রানিমার কাছে।
পেট গরম হলে চাট্টি ভাত খেও। হারুন বলতে থাকে।
ভাত?
দামোদর শেঠ চমকে ওঠে। হরিণ হাঁ করে থাকে।
সে তো আমরা খাই বঙ্গ দেশে, তা তুমি কী করে জানলে?
আমি আবার কী করে জানব? নিমাতনামায় যা লেখা আছে, তাই বলছি তো! ভাত, ভিজিয়ে রাখতে হবে লেবুজলে। লেবুর রস পুরো শুষে নেবার পর ওই ভাত ঠান্ডা জলে সাতবার ধোবেন। তারপর তাজা তাজা ফুল গাছ থেকে পেড়ে ভিজে ভাতের ওপর বিছিয়ে রাখুন। কিছুক্ষণ পরে ফুলগুলো সব তুলে ফেলে দিয়ে সেই লেবু আর ফুলের গন্ধ মাখা ভাত খাবেন আর আমাকে মনে রাখবেন। সামনের বছর আবার এই সময় দেখা হবে। যাই গো।
আপনারা সব ভালোভাবে ঘরে ফিরুন।
সওদাগরের দল, হারুনকে বুকে জড়িয়ে ধরে, কেউ হাতে হাত মেলায়। যে যা পারে ওর ঝোলায় ভরে দেয়। টাকাপয়সা, উপহার। যার যা খুশি।
শুক্লপক্ষের চাঁদ রাস্তা আলো করে রেখেছে।
হারুন লম্বা লম্বা পা ফেলে জ্যোৎস্নায় মিশে যাচ্ছে একটু একটু।
হারুনের পিছনে দৌড়ে আসছে এক বালক। দৌড়তে দৌড়তে সে প্রায় হারুনের কাছে চলে এসেছে। পায়ের শব্দে হারুন পেছন ফেরে।
কে রে তুই? কে রে তুই “ছোটোখাটো বেঁটেখাটো গেঁড়ি মেড়ি তেড়ি”?
আমি হরিণ। শেঠের সঙ্গে বঙ্গদেশ থেকে এসেছি।
আমার পেছনে ছুটছিস কেন? তোকে কে পাঠাল?
কেউ না। আমি তোমার সঙ্গে যাব, তোমার সঙ্গে ঘুরব। তোমার সঙ্গে গল্প বলব।
সে কী? শেঠ বকবে না? আর আমার নিজের কি কিছুর ঠিক আছে রে? যা যা, ফিরে যা তুই।
হাতিপোল পেরিয়ে একের পর এক ফটক পেরিয়ে যাচ্ছে দুটি শরীর। একজন লম্বা, একজন বেঁটে। মশগুল হয়ে গল্প করছে তারা। সময়ের পোকা যে গল্প কাটবে না। পাকদণ্ডি বেয়ে বেয়ে নামছে তারা দুজন। এই শহরের অনেক ফটক। প্রতি ফটকে পাহারা। তাদের কেউ আটকাচ্ছে না। গল্পকে কেউ আটকাতে পারে না। বাঁধতে পারে না। সে তো বয়ে চলে দেশে দেশে। কালে কালে। লম্বা শরীর বলে ওঠে, আমাকে একটা গল্প শোনাবি? শুনে শুনেই গল্প বলা শিখেছি। এখন কেউ আমাকে গল্প বলে না, জানিস? সবাই শুনতে চায়।
—কমলেকামিনী জান? থই থই সাগর জল। তার মধ্যে এক বিশাল পদ্মফুলের মধ্যে এক দেবী বসে আছেন। এক হাতে হাতি ধরে তাকে টপ করে গিলে ফেলছেন। আবার উগরে ফেলছেন। সাগরে ডিঙা ভাসিয়ে চলেছে সওদাগর। সে দেবীকে দেখতে পেল একদিন... ।
হনহন করে হাঁটছে দুজনে। গলার স্বর ফিকে হয়ে আসছে।
আকাশের তারা, পথের ছমছমে বাঁক আর রাতের শিরশিরে হাওয়া কেবল বলে ওঠে—
তারপর?
তারপর?
মারহাব্বা !
এই লেখাটা.... ভাবি এইবারটা পড়ে কিছুটা চুপ থাকব, নির্লিপ্ত থাকব....
এই লেখাটা.... ভাবি এইবারটা পড়ে কিছুটা চুপ থাকব, নির্লিপ্ত থাকব....
এই লেখাটা.... ভাবি এইবারটা পড়ে কিছুটা চুপ থাকব, নির্লিপ্ত থাকব....