Commonwealth War Graves Commission নামে একটা সংস্থা আছে। এরা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ব্রিটিশ যত সৈন্য নিহত হয়েছে তাদের প্রতি সম্মান জানানোর কাজ করে। বিভিন্ন জায়গায় যত কবর আছে যুদ্ধের সব গুলোর যত্ন নেওয়া, ইতিহাস তুলে রাখা এবং তাদের যেন কখনোই মানুষ ভুলে না যায় তা নিশ্চিত করা হচ্ছে এদের কাজ। CWGC একটা ওয়েব সাইট আছে, তাতে তারা বলছে পুরো দুনিয়ায় ২৩ হাজার স্থানে ওয়ার সিমেট্রি আছে আর তাতে শায়িত আছে ১.৭ মিলিয়ন নর নারী সৈনিক। এই সংস্থা ১৯১৭ সালে Imperial War Graves Commission নামে যাত্রা শুরু করে, ১৯৬৫ সালে নাম পরিবর্তন করে Commonwealth War Graves Commission হয়। কিন্তু কাজ একই আছে, এই দীর্ঘ দিন ধরে তারা নিজেদের বীরদের সম্মান দিয়ে আসছে।
বাংলাদেশে দুইটা বড় ওয়ার সিমেট্রি আছে। একটা কুমিল্লার ময়নামতিতে আরেকটা চট্টগ্রামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা বর্তমান মায়ানমার যুদ্ধে নিহত ৪৫ হাজার সৈন্যের স্মৃতি রক্ষার্থে মায়ানমার, আসাম, এবং বাংলাদেশের ৯টি রণ সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। ময়নামতি সমাধিক্ষেত্রে আছে ৭৩৬ টি কবর আর চট্টগ্রাম সমাধিক্ষেত্রে আছে ৭৫৫ টি কবর। অবিভক্ত ভারতবর্ষ ছাড়াও দুনিয়ার নানা দেশের নাগরিক এখানে শুয়ে আছে। যাদের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের নাম পরিচিয় সহ সব কিছু দেওয়া আছে। যার যার ধর্মীয় পরিচয় অনুযায়ী নানান প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। যার কবরে ক্রুশ দরকার সেখানে ক্রুশ দেওয়া আছে যার আরবি লেখা দরকার তার কবরে আরবি ব্যবহার করা হয়েছে। ময়নামতি সমাধিক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী একটি কবর রয়েছে, যেখানে একসাথে ২৩টি কবর ফলক দিয়ে একটা স্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই স্থানটি ছিল মূলত ২৩ জন বিমানসৈনিকের একটি গণকবর, যেখানে লেখা রয়েছে:
" These plaques bear the names of twenty-three Airmen whose remains lie here in one grave" |
প্রতি বছর নভেম্বর মাসে মাসে সকল ধর্মের ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে এখানে একটি বার্ষিক প্রার্থণাসভা অনুষ্ঠিত হয়। নানান জায়গা থেকে মানুষ আসে এই রণ সমাধিক্ষেত্রে। আসে সম্মান জানাতে, শ্রদ্ধা জানাতে। দুইটা সমাধিক্ষেত্রই এত চমৎকার করে সাজানো রয়েছে যে যে কোন ব্যক্তি ঘুরে দেখলে তার ওই অজানা অচেনা বিদেশি সৈন্যের জন্য মন কেমন করে উঠবে, শ্রদ্ধায় নত হবে মাথা।
এবার একটু নজর ফেরাই আমাদের নিজের দিকে। আমরা আমাদের জন্য কী করেছি? আমরা কেন ৫০ বছর পার হওয়ার আগেই মুক্তিযুদ্ধ নামটা শুনলেই নাক সিটকাই? যেন মুক্তিযুদ্ধ না তো যেন কোন পাপ কাজের আলাপ করতেছি! যেটা আমাদের গর্বের বিষয় তা কীভাবে আমাদের এত অবহেলার হয়ে গেল? শয়েই কবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েহে, শয়েই কবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে, তাদের নিয়ে এখনো সিনেমা তৈরি হয়, হাজার হাজার গল্প উপন্যাস লেখা হয়, হচ্ছে। কেউ একবারের জন্যও মনে করে না আর কত, লেবু বেশি চিপলে তিতা হয়ে যায়? কেউ তাদেরকে একবারের জন্যও বলে না কেন? তাহলে আমাদের কেন প্রতি নিয়ত শুনতে হয় পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কী? আর কত অতীত নিয়ে পরে থাকবে?
২৩ জনের একটা গণ কবরকে কী চমৎকার করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ২৩ জনের গণ কবর আমদের মনে হাহাকার তৈরি করে। আপনি কী জানেন দেশে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত গণ কবরের সংখ্যা কত? যা পাওয়া গেছে তার চেয়ে আরও অনেক এখনো আবিষ্কারের বাকি, তা আমি শত ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে আপানকে বলতে পারি। কিন্তু পাওয়া গেছে কত? ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি এখন পর্যন্ত ৯৪২ টা বধ্যভূমি খুঁজে পেয়েছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে যাদের আপত্তি তারা এই খবর জানে? তারা জানে চট্টগ্রামের পাহারতলির বধ্যভূমির একটা কবরে পাওয়া গেছে ১১০০ মানুষের খুলি! ওই বধ্যভূমিতে গণ কবর আছে একশর উপরে! আমাদের কী করা উচিত?
আমাদের কী করা উচিত তা তো দূরের বিষয়, আমরা প্রাণপণে চাচ্ছি এসব ভুলে যেতে! দিনের পর দিন আমাদেরকে বুঝানো হয় অনেক হইছে, আর কত? বাদ দাও এবার। আমরা বাদ দিতে পারি, আমরা CWGC এর কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে বলতে পারি ট্যাকা থাকলে কত ভঙ্গি দেখানো যায়, তারপর পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঘুম দিতে পারি। কিন্তু জেনে রাখুন, আপনার আমার এই নির্লিপ্ততা আগামী প্রজন্ম ক্ষমা করবে না। আমাদের এবং আমাদের আগের পুরো প্রজন্মকে এর জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ইতিহাস বিমুখতা গর্বের বিষয় নয়, লজ্জার, এই সত্য আমাদের বুঝতে হবে পরিষ্কার ভাবে।
জিনিস তো একই, সম্ভবত আমেরিকান আর ব্রিটিশ উচ্চারণের তফাত।
আমার কোন দোষ নাই, আমি যেমন দেখছি তেমন লেখছি। সমাধিক্ষেত্রের যে উইকি পেজ আছে সেখানেও একই রকম লেখা আছে। যত গুলো নিউজ আর্টিকেল পড়েছি, বই পড়েছি সব জায়গায় সিমেট্রিই লেখা আছে। আর সমাধিক্ষেত্রের সাইনবোর্ডের ছবি দিলাম, নিজেরাই দেখুন। https://ibb.co/jv1FYkJ
আমি ছবি পোস্ট করতে পারছি না। উপরে যে লিংকটা দিয়েছি তাতে কি দেখতে পারছেন সমাধিক্ষেত্রের সাইনবোর্ড? এখানে উইকির লিংক দিলাম।