২০০৩- '০৪ পর্যন্ত 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিক বেরিয়েছিল বিজয়া রায়ের 'আমাদের কথা'। শ্রীমতী রায় নিয়মিত ডায়রি লিখতেন। সেই সব ডায়রি এবং ওঁর স্মৃতি সম্বল করে এই বই।
আমি তখন প্রবাসে এবং সদ্য এম এ পাশ করে চাক্রিতে ঢুকেছি । তাই প্রথম দিকে 'দেশ' বেরোলেই খুব উৎসাহ নিয়ে পড়তাম । কিন্তু অচিরেই লেখাটি নিরাশ করেছিল এবং লেখাটির পরিচিত পাঠকদের সঙ্গে হাসাহাসির খোরাক জুগিয়েছিল।
আমার স্কুল জীবনে 'সানন্দা' পত্রিকায় সুপ্রিয়া দেবীর 'আমার জীবন আমার উত্তম' ধারাবাহিক বেরুত। সেটা পড়ার অনুমতি ছিল না। কিন্তু বাড়িতে মহিলাদের মধ্যে সেই বইটি নিয়ে আলোচনা শুনতাম ও আমি আর আমার পিসতুতো দিদি লুকিয়ে চুরিয়ে লেখাটা পড়তাম ।
'আমার জীবন আমার উত্তম' এ উত্তম- সুপ্রিয়ার সম্পর্ক মূলত পরকীয়া হওয়ায় তার সঙ্গে একটি স্ক্যাণ্ডেলাস চার্ম ছিল। 'আমাদের কথা' য় সেটাও ছিল না।
লেখাটির প্রথম দিকে উনিশ শতকের বিশ, ত্রিশ, চল্লিশের দশকের একটি বিখ্যাত, অভিজাত ব্রাহ্ম পরিবারের নানা খুঁটিনাটি বিবরণ পাওয়া যায় । বাকীটা শুধুই দৈনন্দিন ধারাবিবরণী ।
ছোটবেলা থেকে তিনি সত্যজিৎ রায়ের ছায়া সঙ্গিনী তাই সত্যজিতের চলচ্চিত্র ও অন্যান্য সৃষ্টির সঙ্গে তিনি যুক্ত অর্থাৎ উপস্থিত কিন্তু চলচ্চিত্রে কস্টিউম এবং প্রথমদিকে কাস্টিং ছাড়া বিজয়া রায়ের সত্যজিতের চলচ্চিত্র ভাবনায় নূতন কোনো ভূমিকা একেবারেই স্পষ্ট নয় ।
এমনকি বিভিন্ন আন্তরজাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অন্য ভাষাভাষীর ফিল্ম ও চলচ্চিত্রকার এবং সেখানে সত্যজিৎ এর প্রতিনিধিত্বের কথার চাইতে তাঁর শপিং ও শহর ভ্রমণের বর্ণনা বেশী ছিল। আপত্তি হত না যদি এটা 'আমাদের কথা' না হয়ে 'আমার কথা' হত।
তবে বিজয়া রায় সেই সময়ের মহিলা যারা দেশে প্রথম বহির্জগতে পা রাখছেন । বেছে নিচ্ছেন নিজের ইচ্ছে মত পেশা। ১৩-১৪ বছর বয়েসে বাবাকে হারিয়ে পাটনা থেকে কলকাতায় কাকার বাড়ি চলে আসা। কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে অতিক্রম করে চাকরির জগতে ঢোকা । বইয়ে আছে প্রথমে একটি মেয়েদের স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন বিজয়া। মাইনে অত্যন্ত কম হওয়ায় ডিপার্টমেন্ট স্টোরে চাকরি নিলেন। তারপর চলচ্চিত্রে প্রবেশ। বোম্বেতে ফিল্ম কেরিয়ার গড়বেন বলে কয়েক বছর রইলেন । সেখানে তখন তার দিদি সতী দেবী মিউজিক ডিরেক্টর । দেশের প্রথম মহিলা মিউজিক ডিরেক্টর ।
ফিল্মে চূড়ান্ত ভাবে অসফল হলেন । তারপর সব মেয়েই যা করে । বিয়ে! তাও বয়েসে ছোট পিসতুতো ভাইকে।
এই যে একটার পর একটা ভিন্ন প্রকৃতির পেশার জগতে ঢোকা ! কৈশোর থেকে তুতো ভাইকে প্রেম করে তাঁকেই বিবাহ করা, কোনোটাই সহজ ছিল না । কিন্তু বিজয়া রায়ের স্মৃতিকথা পড়ে তার এই জীবন পথ একেবারেই কঠিন মনে হয় না !
সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে লেখাটি শেষ হয়। মৃত্যু দৃশ্যটির বর্ণনা আমাকে খুব টাচ করেছিল। তারপরেও অনেককাল রইলেন তিনি। সত্যজিৎ-হীন বিজয়ার কথা আর জানাননি।
বিজয়া রায়ের পিতা চারুচন্দ্র দাস ও সত্যজিৎ রায়ের জননী সুপ্রভা রায় হলেন ভাই, বোন । চারুচন্দ্র ও সুপ্রভার এক তুতো দাদা হলেন অতুলপ্রসাদ সেন । তিনিও নিজের মামা কে জি গুপ্ত'র মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। ঐ পরিবারে অনেক সংগীত প্রতিভা আছে । যেমন সাহানা দেবী, কনক দাস, মঞ্জু গুপ্ত ......। তবে কাজিন ম্যারেজ ব্রাহ্মদের মধ্যে প্রচলিত কিনা সেটা বলা যাচ্ছেনা । সম্ভবত না।
'আমাদের কথা'য় আরেকটি বিষয় আমায় অবাক করেছিল । বিজয়ার আপন মাসিমা দেশবন্ধু পত্নী বাসন্তী দেবী। অথচ পুরো বইয়ে পরাধীন দেশের রাজনৈতিক অবস্থার কথা একটা লাইনেও নেই !!
'লক্ষণের শক্তিশেল' -এ চোদ্দখানা গান ছিল যার স্বরলিপি প্রস্তত করেছিলেন বিজয়া রায়। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তিন খণ্ডের সুকুমার সমগ্রে সেটা অন্তর্ভুক্ত । এ তথ্যটি আমাকে দিয়েছেন @এলেবেলে ওরফে দেবোত্তম চক্রবর্তী ।
ওজ্জুনবাবু , বুইতে অসুবিদে হচ্চে , হেঁ হেঁ। কে কার পিস শ্বশুর কে কার মামাতো ভাই ছপি সহ বুঝায়ে দ্যান দিকি। মানে কচি করে এট্টা ফেমিলি ট্রি আঁকেন।
বিজয়া রায়ের এই একটিই গানের রেকর্ড আছে।
খুবই ভালো গলা।
এমনিতে কিছুই লিখতাম না কারণ আমাদের কথা আমার কাছে দেশ থেকে কেটে বাঁধিয়ে রাখা আছে কেবলমাত্র ছবিগুলোর জন্য। না হলে এত খাজা লেখা জাস্ট টানা যায় না। এর থেকে সুরমা ঘটকের ঋত্বিক ঢের ভালো। শুধু অর্জুনের শেষ মন্তব্যটা একদমই ভালো লাগল না। নিকের গোপনীয়তা এভাবে নষ্ট করা উচিত তো নয়ই, শোভনও নয়। অর্জুনের থেকে এটা আশা করিনি।
দেশে যখন বেরোচ্ছিল, নাম দিয়েছিলাম "বাবু-বৃত্তান্ত"। খালি বাবুর জন্মদিনে পুডিং করলাম আর ক্রিসমাসে বাবুর জন্যে অমুক করলাম। কানাঘুষো শুনেছিলাম দেশ ওনার সংগ্রহের ছবি চেয়েছিল। উনি বলেছিলেন, লিখতে দিলে তবেই ছবি। ধারাবাহিকের সময়ে পুরোটা পড়তেও পারিনি। গেল বছর বইটা পড়লাম। এবার অবশ্য তত অসহ্য লাগেনি। শেষও করেছিলাম।
সেকি ! আপনি তো নিজেই একদিন 'ভাটিয়ালি তে ঘোষণা করলেন আপনার পরিচয় !
আমি ভাবলাম সবাই জানে এখানে !!
@pi, না, "এভরি সাকসেসফুল ম্যানের পিছনে সর্বত্যাগী উইম্যানের তত্ত্ব" না। আমি শুধু যা হয়েছে তাই বলেছি। ওই ভদ্র মহিলা না থাকলে কী হত কে জানে? পথের পাঁচালি থেকে শুরু করে অনেক সিনেমার পিছনেই তো এই নারীর অবদান আছে। কাজেই কী হত তা বলা মুশকিল। সত্যজিতের সাফল্যের পিছনে এই মহিলার অবদান আছে তা অস্বীকার করার উপায় নাই। আর সাহিত্য গুণ? সরাসরি ডাইরি থেকে তুলে দিয়েছে তা সত্য। খুব বিচ্ছিরি লেগেছে অনেক জায়গায়। এমন দোষ খুঁজলে আরও অনেক পাওয়া যাবে আমি নিশ্চিত। উনি যে পরিমাণ শপিঙের গল্প করেছে তা রীতিমত অসহ্য লেগেছে অনেক সময়। চলচিত্র উৎসবে সত্যজিৎ প্রধান বিচারক হয়ে গেছেন, আমরা জানতে পারলাম শুধু উনার কেনা কাটার গল্প। বইয়ের নাম আমাদের না হয়ে আমার গল্প হতেই পারত, তাতে কেউ মনে হয় আপত্তিও করত না। বাবু বাবু করেও মেজাজ খারাপ করেছে তাতেও কোন সন্দেহ নেই, বিশেষ করে এই সময়ে যখন পড়ছি, যখন আমরা জানি বাবু আসলে কী মাল! এমন অনেক কিছুই দোষ আছে বইটার। আমি সত্যজিতের স্ত্রীর বইয়ের ভিতরে অত দোষ খুঁজতে যাইনি, এটাই হচ্ছে সত্য কথা। উনি লেখক না, আমি বিজয়া রায়কে বিজয়া রায় বলে চিনিও না, সম্ভবত কেউই চিনে না। কাজেই বিজয়া রায় নিয়ে খুব বেশি দোষ খুঁজতে যাওয়া উচিত মনে হয়নি আমার। আমার লক্ষ্য তো ছিল সত্যজিৎ, তা কতটুকু পেয়েছি তাই বিবেচনায় ছিল বেশি আমার। কিন্তু ঝরঝরে মনে হয়নি? আমার কাছে কিন্তু মনে হয়েছে, সহজেই পড়া গেছে, এক টানে পড়ে যাওয়া গেছে। অন্তত আমি পড়তে পেরেছি। কী জানি, যখন যখন ব্রেক দিয়েছিলাম তখন কী তাহলে আর পড়তে না পেরে বাদ দিয়েছিলাম? হতেও পারে!
@অর্জুন, ধন্যবাদ, গানটার জন্য আর আরও কিছু দুর্দান্ত তথ্যের জন্য।