পরেরদিন ঢাকার ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের দুই কলেজের ভিতরে শুরু হয়ে গেল সুপার ডুপার ম্যাচ! ঢাকা কলেজের ছেলেদের সাথে সিটি কলেজের ছাত্রদের। আবার আর্মি পুলিশ! এরা দুইপক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে। আর আর্মি পুলিশ এদের দুইজনের বিপক্ষে। এমন সিনেমা সচারাচর দেখা যায় না। সারাদিন ব্যাপী চলেছে একশন। ঢাকা কলেজ একটা মজার আবদার করেছে, বলেছে সাইন্সল্যাব এলাকা থেকে সিটি কলেজকে সরিয়ে দিতে হবে! অনেক আগে সমানেই বাজত এই দুই কলেজের মধ্যে। এইটা বহুদিন বন্ধ ছিল। এইটা কই থেকে যে এসে হাজির হল আল্লাই জানে!
সরকার তথা সমন্বয়কেরা অবশ্য মনে করে যারাই আন্দোলন করে তারাই লীগের দালাল! এই ট্যাগ দিতে দিতে এখন সবাইকেই দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। ছাত্র যারা আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছে তাদের চিকিৎসার জন্য সরকারের তরফ থেকে তেমন সাড়াশব্দ না থাকায় তারা রাস্তায় নামে। মহান সমন্বয়কেরা আহত লীগ বলে তাদেরকেও ট্যাগ দিয়ে দিয়েছে! এইটা কিন্তু ভালো বুদ্ধি। যা হবে সব লীগের দোষ। আর বাকি যা থাকবে তা করছি, করব বলে দিলেই হল, সব সমস্যার সমাধান!
আমার মার্চেন্ডাইজিং জীবন শুরু হয় আশুলিয়ার একটা ফ্যাক্টরি থেকে, নাম হচ্ছে জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন লিমিটেড। ট্রেইনি হিসবে ঢুকেছিলাম। বেশিদিন চাকরি করি নাই। দুই তিন বছর ছিলাম সম্ভবত। খুব ভালো ছিল এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিটা। আমি বাইং হাউজে যোগ দিয়ে চলে আসার কিছুদিন পরে শুনেছি বেক্সিমকো কিনে নিয়েছে জেনারেশন নেক্সট। বেক্সিমকো হচ্ছে সালমান এফ রহমানের কোম্পানি।
এবার আসি কেন এই আলাপ তুললাম সেই গল্পে। সরকার পতনের পরে বেক্সিমকোর অবস্থা খারাপ। দেশের সবচেয়ে বড় গ্রুপ অফ কোম্পানিকে অপেশাদারের মতো নষ্ট করা হয়েছে। বেক্সিমকোর সাথে জড়িত কত কত মানুষ, সবাইকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। অথচ এইটার সমাধানের কোন ব্যবস্থাই করছে না কেউ। শ্রমিকেরা বেতন পাবে, কে দিবে? সরকারের তরফ থেকে বলার মতো কোন চেষ্টাই নাই। বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত কার্যকর কোন ভূমিকা রাখছে না। তিন মাস বেতন পায় নাই জেনারেশন নেক্সটের কর্মীরা। রাস্তায় নেমে আসে সবাই। কথিত বিপ্লব পরবর্তী প্রথম শহীদ হয় এখানেই! গুলি করে মেরে ফেলে ইউনুস সরকারের আর্মি পুলিশ। একজন নারী শ্রমিককে মেরে ফেলল গুলি মেরে, কোথাও এইটা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নাই! ২৩ অক্টোবর গুলি খায়, ২৭ অক্টোবর মারা যায় চম্পা খাতুন! সরকার, সমন্বয়ক নামের ক্লাউনেরা কেউই চম্পা খাতুনের নামও সম্ভবত জানে না। পত্রিকা টেলিভিশন সব উহ আহ করেই যাচ্ছে, এমন আগে দেখি নাই, এমন কেউ বলে নাই! -
"সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!”
মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে!
হুজুরের মতে অমত কার?”
চম্পা খাতুন যেমন হারিয়ে গেছে সব জায়গা থেকে তেমনই গাজি টায়ারের ফ্যাক্টরিতে যে ১৭৪ জন আগুনে পুড়ে মারা গেল সেই গল্পও হারিয়ে গেছে! কেউ লেখেও না, কেউ প্রশ্নও করে না কেন কেউ লেখা না! এগুলা নিয়ে কথা বলার উপায় নাই, বাকস্বাধীনতার স্বর্ণযুগে বাস করছি আমরা, এমনটাই বলেছে উপদেষ্টা নাহিদ!
মাঝে মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া এই মুহূর্তে কিছুই করার নাই আমাদের। দীর্ঘশ্বাসকেও কবে কে হিসাব করতে বসবে কে জানে! এই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই বিনোদন হচ্ছে বিনোদন উপদেষ্টা ফারুকি! তিনি নানান সময় নানান বানী দিয়ে আমাদেরকে বিনোদন দিয়ে যাচ্ছে। গতকাল বলেছেন আগে ( অবশ্যই আগে মানে হচ্ছে গত পনেরো বছর! এবং তার কর্মকাণ্ড বাদ দিয়ে সেই পনেরো বছর!) ইসলাম নিয়ে না কি কিছু বললেই জামাত শিবির ট্যাগ খেতে হত! আমাদের সংস্কৃতিতে ইসলামকে ঝেটিয়ে খেদানো হয়েছে! ফারুকি এমন কথা এইটাই প্রথম বলল না। এর আগেও ও বলার চেষ্টা করছে যে কেন ইসলাম বা মুসলিমদের কথা কেউ বলে না! বললে কেন অন্য চোখে দেখে সবাই?
এইটার উত্তর কী হতে পারে? বাংলাদেশে এসে বর্তমানে ইসলাম নিজেই গলা টিপে মরে যাচ্ছে! ইসলাম তারস্বরে বলতে চাচ্ছে ভাই, আমার ইজ্জত এমন করে আর কোথাও কেউ লুণ্ঠন করে নাই তোরা যেমন করে করছস! সারাদিন হুজুরেরা জান্নাতের লোভ দেখায় আর আকাম করে, কেউ কোন শব্দ করে না! আর ফারুকি হাদিস শোনায় দেশে ইসলাম নিয়ে কথা বলা যায় নাই এতদিন! ফারুকির কথা শুনে আমার মনে হয়েছে একটা কথাই তা হচ্ছে হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের সমর্থকেরা ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারের বিপরীতে অল লাইফ ম্যাটার নামে একটা মুভমেন্ট শুরু করার চেষ্টা করেছিল, তার কথা।
সংখ্যাগুরর দেখা রাখার কিছু নাই। সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতি ভেসে চলে যাবে না কোথাও। কারো ঘাড়ে দুই তিনটা মাথা নাই যে সংখ্যাগুরুর ধর্ম চর্চার ওপরে হাত দিবে কেউ। ফারুকি উদাহরণ দিয়েছে সেহেরি নিয়ে যে সেহেরি নিয়ে কোথাও কিছু হয়? আরে হয় না না হয় তা জানতে তো তোমাকে সেহেরির সময় উঠতে হবে! ধর্ম তো কতখানি আপনেরা পালন করেন তা জাতি জানে!
গল্প আছে এক মহারাজা আফ্রিকা থেকে জিরাফ আনেন জাহাজে করে। এমন অদ্ভুত প্রাণী কেউ জীবনে দেখনি তখন। মানুষ ভেঙ্গে পড়ল এই প্রাণী দেখতে। আশেপাশে রাজারা কিছুটা ঈর্ষায় মোল্লাদের দিয়ে, পুরোহিতদের দিয়ে বলায় দিল এমন কোন প্রাণীর কথা কোন ধর্ম গ্রন্থেই নাই, কাজেই এইটা কোন স্বাভাবিক প্রাণী না। এইটা নিশ্চয়ই শয়তানের সৃষ্টি কোন প্রাণী, এই প্রাণী দেখা যাবে না। কিন্তু মানুষ মানলে তো? মানুষ প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গেলেও আবার ঠিকই দেখতে আসতে লাগল। মহারাজ বুঝলেন কৌতূহলের কাছে কোন ফতোয়াই কাজ করবে না। তিনি চিড়িয়াখানা রাতেও খোলা রাখা শুরু করলেন। দেখা গেল যারা দিনে বেলা জিরাফ দেখা পাপ বলে গলা ফাটাত তারা চুপিচুপি রাতে এই অদ্ভুত প্রাণীটাকে দেখতে আসছে! ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি কথাটা সম্ভবত এই গল্প থেকেই এসেছে।
আমাদের সকল তথাকথিত ধার্মিক উপদেষ্টারা সবাই ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে। ফারুকি ধর্মের বানী শোনায়, নিজের সিনেমায় লিটনের ফ্ল্যাট প্রোমট করে। রাতে সবাই জিরাফ দেখতে যায় জামাতের সাথে!
আশার কথা আছে কিছু। ইউনুস সাহেবের সুর এখন অনেক নরম। সশস্ত্র বাহিনী দিবসে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা স্মরণ করেছেন তিনি। ভারতের একটা পত্রিকায় আওয়ামীলীগকে নির্বাচন করতে দিবে এমনও বলেছেন। ট্রাইব্যুনালের আইন পরিবর্তনের খসড়ায় রাজনৈতিক দলকে শাস্তি দেওয়ার একটা আইন ছিল। খসড়ায় থাকলেও যে আইন পাস হইছে সেখানে এই ধারাটি নাই! এইটা অনেক বড় আশার কথা। ভিতরে ভিতরে কী হচ্ছে জানি না। সেনাকুঞ্জে যে দৃশ্য দেখা গেল তাতে আমি শুরুতে যে সন্দেহ করেছিলাম তেমন কিছুই হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে এখন। বিরোধিতা করা, একে অন্যকে সমানে খোঁচা দেওয়া, সমন্বয়কেরা উপদেষ্টাদের নিয়ে কথা বলছে, বিএনপিকে নিয়ে কথা বলছে, এই সবই হচ্ছে লোক দেখানো। সব সুনিপুণ পরিকল্পনার অংশ!
শেষ করি। আন্দোলনের ট্রেডমার্ক ঘটনা ছিল দুইটা। রংপুরে আবু সাইদের মৃত্যু আর ঢাকায় মুগ্ধের পানি লাগবে পানি বলে ঘুরার ভিডিও এবং পরে মুগ্ধের মৃত্যু। সবাই, প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে এই অ্যামিবা মার্কা মিডিয়া কেউই আবু সাইদকে নিয়ে যত কথা বলে তার সিকিভাগ মুগ্ধকে নিয়ে বলে না কেন? মুগ্ধ হারিয়ে গেল কেন নিউজ ফিড থেকে? আমি বলছি কেন, কারণ মুগ্ধ মারা যাওয়ার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল -
"জামাত-শিবির, ছাত্রদলের উদ্দেশ্য কিছু কথা:
ছাত্র আন্দোলনে ঢুকে ছাত্র আন্দোলনটাকে রাজনৈতিক দলের আন্দোলন বানাবেন না। হ্যাডম থাকলে আগেই আসতেন আপনারা, সুযোগ সন্ধানী আচরণ করে এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যটা নষ্ট করবেন না, জাত চেনাবেন না। আপনি যদি ছাত্র হোন তবে ছাত্র হয়েই আসুন। আমাদের আন্দোলনে ছাত্র প্রয়োজন, কোনো উদ্দেশ্য হাসিলকারী নেতা নয়।" ( ১৮ জুলাই, ২০২৪)
মুগ্ধ না জেনেই মারা গেছে, সে জানে নাই যে আন্দোলনে তাদেরকে আসতে ওঁ না করেছে সেই আন্দোলনটা ছিল মূলত তাদেরই আন্দোলন। মুগ্ধরা ছিল শুধু তাদের আন্দোলনের রসদ। মুগ্ধের চিন্তা চেতনাই মুগ্ধকে এই সরকারের নজর থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ইউনুস সরকার এই সব কথার সাথে একমত না, জামাত হচ্ছে প্রধান সহযোগী তার! তাই মুগ্ধ আউট। মুগ্ধের ভাই স্নিগ্ধকে ইউরোপ পাঠায় দেওয়া হয়েছে, কাজেই তাদের পরিবারেরও কিছু বলার নাই! দারুণ না?
আমরা আর কী? হা করে দেখছি শুধু এই সব খেলা!