যতীন ব্যানার্জী সাব ইন্সপেক্টর প্রমোশন পেয়ে ষাটের দশকের শেষে বদলি হয়ে এলেন মোহনপুর। কলকাতার দক্ষিণ উপকণ্ঠে গঙ্গার পশ্চিম পারে এক মফস্বল জনপদ। একটু আগে বাঁক নিয়ে কোমর সোজা করেছে গঙ্গা। ফলে নদী এখানে বেশ চওড়া। স্বাধীনতার আগে এখানে ব্রিটিশ মালিকানায় তৈরী হয়েছিল একটি বড় জুটমিল। কোম্পানির সুপারিশে সরকার তখন ভাঙন রুখতে ইঁটের মোটা উঁচু দেওয়াল তুলে প্রায় এক কিমি নদীর পার বাঁধিয়েছিল। চার দশক পরেও সেই মজবুত দেওয়াল দিব্যি টিকে আছে। বাঁধানো পার থেকে কিছুটা জায়গা ছেড়ে জুটমিলের একটা বড় হোস্টেল। তার পিছনে অনেকটা জায়গা নিয়ে আছে সার সার লেবার কোয়ার্টার।
ফারনেসের ঘেঁষ দিয়ে তৈরি কালো রাস্তা। নদীর পার বরাবর সমান্তরাল। দক্ষিণ প্রান্তে সেটা মিলের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে পশ্চিমে বেঁকে মিলের মেন গেট ছুঁয়ে চলে গেছে মানিকপুরের দিকে। উত্তর দক্ষিণে পার বাঁধানো দেওয়ালের মাঝামাঝি রয়েছে নদীতে নামার দুটি চওড়া বাঁধানো সিঁড়ি। এদিকে রাস্তাটা ঘাট থেকে পশ্চিমে বেঁকে ডান হাতে মোহনপুর থানা ও বাঁদিকে লেবার কোয়ার্টার রেখে চলে গেছে জনপদের মধ্যে দিয়ে রাজগঞ্জ।
ঘাট থেকে উত্তরে অনতিদুরে নদীর তীরে শান্ত সবুজ পরিবেশে জুটমিলের দোতলা গেস্টহাউস। পায়ে চলা পথে সেখান থেকে আরো কিছুটা উত্তরে গেলে ভাঙনরোধী দেওয়ালটা বাঁদিকে কিছুটা বেঁকে শেষ হয়ে গেছে। সেখানে গঙ্গায় এসে মিশেছে সরস্বতী খাল। জোয়ারের সময় বড় মহাজনী নৌকাও খাল ধরে অনেকটা ভেতর অবধি চলে যায়। প্রাচীন বট ও তেঁতুলের ছায়ায় জনপদের একান্তে সেই খাল ও নদীর সঙ্গমে শ্মশান। দাহকার্য রোজ হয় না। সাধু সন্তের ডেরাও নেই। তাই জায়গাটা বেশ নির্জন।
মোহনপুর থানাসংলগ্ন তিনটি অফিসার্স কোয়ার্টার ও দুটি ব্যারাক ব্রিটিশ আমলে তৈরী। একটি পরে হয়েছে। থানার বড়বাবুর বা ওসির কোয়ার্টারটি নদীর কিনারে গেস্টহাউস লাগোয়া। বাকি তিনটি থানা চত্বরে। থানার দক্ষিণে চত্বরের মাঝে একটি চৌকোনা চারপাশ খোলা টালির চালের ঘর। তিনদিকে সিমেন্টের বসার জায়গা। যারা থানায় আসে, অপেক্ষা করতে হলে ওখানেই বসে। তারই দক্ষিণে থানার মেজবাবুর কোয়ার্টার। দুটি শোবার ও একটি বসার ঘর। পাকা ছাদ। সংলগ্ন L আকারের আটফুট চওড়া ভেতরের বারান্দা। তার ঢালু ছাদটা টালির। তারপর চওড়া বাঁধানো উঠোন। পূব দিকে রান্নাঘরটিও বেশ বড়। খানিকটা জায়গা ছেড়ে দক্ষিণ কোনে পাঁচিল ঘেরা শৌচাগার। দক্ষিণের পাঁচিলে সদর দরজা। সেটা ঐ ঘেঁষ বাঁধানো রাস্তায় খোলে। উত্তরের খিড়কি দরজা খোলে থানার চত্বরেই। দুটো শোবার ঘরের জানলা দিয়েই থানার অফিস, চত্বর দৃশ্যমান। ফলে কোয়ার্টারটি নিরাপত্তার দিক থেকে বেশ সুরক্ষিত।
মোহনপুরে বদলি হয়ে এখানেই সপরিবারে এসে উঠলেন যতীনবাবু। পরিবার বলতে স্ত্রী শোভা, বছর চোদ্দর বড় ছেলে বাপী, মাঝে বছর এগারোর মেয়ে রীণা ও ছোট ছেলে বছর আটেকের অতু। বড় খোলামেলা কোয়ার্টার। শ তিনেক মিটার পূবেই গঙ্গা। মাঝে মাঝেই আসে হুহু তাজা হাওয়া। এর আগে যেখানে ছিল ওরা সেই বেলুড়ের ঘিঞ্জি শহুরে পরিবেশ থেকে এখানে এসে সবারই জায়গাটা বেশ ভালো লেগে গেল।
ভাঁটায় জল নেমে যায় বেশ নীচে। তখন ঘাটের সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে নেমে খানিকটা কাদায় হেঁটে নামতে হয় জলে। জোয়ার ভাঁটার মধ্যবর্তী সময় স্রোতহীন নদীর জল পুকুরের মতো স্থির। ভাঁটায় ছোটদের খুব মজা। তীর ধরে দক্ষিণে হেঁটে ওরা চলে যায় মিলের জেটি অবধি। সারা শরীরে মুখে পলিমাটি মেখে ভূত হয়ে ওরা নদী তীরে হুটোপুটি করে। তখন কাউকে চট করে চেনাও যায় না। তবে উত্তরে সরস্বতী খালের সঙ্গমের দিকে যেতে ওদের একটু গা ছমছম করে। ওদিকেই শ্মশান। জায়গাটা বেশ নির্জন। ভরা জোয়ারে জল উঠে আসে বিশ ফুট উঁচু দেওয়ালের প্রায় মাঝ বরাবর। ছেলেদের দল তখন মাঠ থেকেই দৌড়ে গিয়ে জলে ঝাঁপায়। সাঁতার কেটে ঘাটের সিঁড়িতে উঠে চলে আসে মাঠে। আবার দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপায় জলে। সেই জলখেলা ছোটদের খুব প্রিয়।
শহর থেকে মোহনপুরে এসে অতুর যেন লটারি লেগেছে। জলপোকার মতো দিনের অনেকটা সময় নদীতেই কাটে। বড় জাহাজ গেলে বড় বড় ঢেউ আসে। অতু, মন্টু, কমলরা তখন মাঠেই জামাপ্যান্ট খুলে 'জন্মদিনের' পোষাকে জলে ডাইভ মারে। জলের মধ্যে লজ্জা কীসের? তখন জলপোষাকই যথেষ্ট। অবশ্য তখন অতুর বয়স অল্প। আটের কোঠায়। মোহনপুরে এসে সমবয়সীদের সাথে উদোম গায়ে নদীর পারে ঘুরে ঘুরে অতুরও শহুরে লজ্জা শরম ঘুচে গেছে। খানিক ঢেউ খেয়ে ওরা পারে উঠে পরে নেয় জামাপ্যান্ট। ভিজে গা, মাথা রোদে, হাওয়ায় শুকোয়। জাহাজের আনাগোনা বেশী হলে সেদিন ওদের ঝাঁপাঝাঁপিও হয় বেশ কয়েকবার।
খোলা আকাশের নীচে রোদ, জল, হাওয়া, কাদায় এভাবে ছোটবেলায় বড় হওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। জীবনের এমন প্রারম্ভিকতায় কারুর পা জীবনের মতো গেঁথে যায় মাটিতে। কেউ বা যতো বড় হয়, সজ্ঞানে এড়াতে চায় মাটির স্পর্শ।
-২-
মোহনপুরে এসে অতুর প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠলো মন্টু। ওর থেকে বছর দুয়েকের বড়। অতু এখানে এসে ভর্তি হয়েছে চতুর্থ শ্রেণীতে। মন্টু স্কুলের ছায়াই মাড়ায় নি। অতুর বাবা থানার মেজবাবু। মন্টু ওদের বাড়ির কাজের মাসির ছেলে। দুজনের বৈপরীত্যের এখানেই ইতি নয়। অতু ফুটফুটে ফরসা। মন্টু কুচকুচে কালো। দুজন পাশাপাশি উদোম গায়ে নদীর পারে দাঁড়ালে মনে হতে পারে ব্ল্যাক এ্যান্ড হোয়াইট আর্ট ক্যালেন্ডার।
পিতামাতার শ্রেণীসচেতনতার কারণে সচরাচর এমন অসম গোত্রের বন্ধুত্বের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। তবে অতুর পিতা থানার কাজে ব্যস্ত থাকেন। বাড়ির ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় তাঁর নেই। ষোলো বছরে হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়ার আগে অবধি অতুর মাও ছিলেন পাঁচিল টপকে লোকের বাগানে ঢুকে পেয়ারা, জামরুল গাছে দাপিয়ে বেড়ানো গেছো মেয়ে। তিনি আর কোন মুখে বারণ করেন। পান খাওয়া লাল ঠোঁটে ফরসা গালে টোল ফেলা হাসিতে অতুর মা নিতান্তই ভালোমানুষ। তাই অতু বড় হচ্ছিল মুক্ত বিহঙ্গের মতো। তবে কিছু না বললেও রাশভারী বাবাকে অতু বেশ ভয় পেতো।
স্বাধীনতার পর সাহেবরা দেশীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মিল বেচে দিয়ে দেশে চলে গেছেন। চাহিদার সাথে পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদনও কমে গেছে। মিলের সেই রমরমা আর নেই। সারি সারি লেবার কোয়ার্টার, যেগুলো একসময় লোকজনের অস্তিত্বে গমগম করতো, এখন অধিকাংশই খালি। মিলের কাছের গুলোয় তবু কিছু শ্রমিক থাকে। যেখানে কেউ থাকে না সেখানে অনেক ঘরের দরজা জানলাও লোপাট হয়ে গেছে। হা হা শুন্যতা নিয়ে কালি ঝুলি মাখা পুরোনো ঘরগুলো খাঁ খাঁ করে।
ঐসব পরিত্যক্ত সার সার ভুতুড়ে ঘরগুলোয় মন্টু আর অতু গুপ্তধন সন্ধানীদের মতো ঘুরে বেড়ায়। তবে পায়না কিছুই। কাঠবিড়ালির মতো ওরা জলের পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে যায়। জমি থেকে বারো ফুট উঁচু জলের পাইপ বেয়ে বাঁদরের মতো ঝুলতে ঝুলতে চলে যায় বিশ ফুট দুরে অন্য লাইনের কোয়ার্টারে। সেখান থেকে পরেরটায়। কমপ্ল্যান খেয়ে মায়ের সাথে রবিবার সকালে গাড়িতে চড়ে সাদা পোষাকে ক্রিকেট কোচিং নিতে যাওয়ার চল তখন ছিল না। থাকলেও সেসব ওদের জন্য নয়। এভাবে হাওয়ায় ভেসে পাইপ বেয়ে চোর পুলিশই ছিল ওদের খেলা। হাত ফসকে পড়লে, না মরলেও, হাত পা ভাঙার সম্ভাবনা ছিল। তবে ঐ বয়স ওসব সম্ভাবনা নিয়ে ভাবিত হওয়ার সময় নয়।
মন্টু সাথে থাকলে জলে কোনো ভয় করতো না অতুর। ও সাঁতার কাটে ডলফিনের মতো। অসম্ভব দম। ডাঙাতেও ও সাথে থাকলে অতুর মনে জোর আসে। ছেলেটা ডাকাবুকো। তবে দিনের বেলায় এমনিতেই ভয় কম লাগে। তখন ওরা দুজনে কখনো চলে যায় খালের দিকে শ্মশানে।
কোনো নিকট আত্মীয় চলে না গেলে অল্পবয়সে মৃত্যুর তাৎপর্য অনুধাবন করা যায় না। সচক্ষে মৃত্যু দেখলে তার অভিঘাত মনে আরো গভীর ছাপ ফেলতে পারে। অতুর সেসব কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। শ্মশানবৈরাগ্য উপলব্ধি করার বয়সও সেটা নয়। তাই জনহীন শ্মশানের নির্জনতায় ও শুধু অনুভব করে এক ধরনের ছমছমে কৌতূহল। চিতার আশপাশে কালো কালো কিছু আধজ্বলা পোড়া কাঠ, ভাঙা কলসি, মাটিতে লুটিয়ে থাকে কাদামাখা রঙিন পোষাক। এসব দেখে শিশুমনে কিছু বিমূর্ত অনুভূতি হয়। সকাল থেকে খেলনাবাটি সাজিয়ে খেলায় ডুবে গেলে মা কখনো ধমকে ডাকেন, কি রে, তোরা খেতে আসবি না, বেলা হয়ে গেল যে? তখন ওরা দ্রুত, অগোছালো ভাবে সাজানো বাসন পোঁটলায় ভরে খেলা ফেলে উঠে যায়। এখানে এলে অতুর অস্পষ্ট ভাবে মনে হয় যেন তেমন কিছু ঘটনা প্রায়ই ঘটে এখানে।
বিকেলে স্থানীয় লোকজন নদীর পারে হাওয়া খেতে আসে। পারের সিঁড়িতে বসে ওপারে তাকিয়ে বয়স্করা গল্প করে। ছোটরা নদীর পারে খোলা মাঠে 'এলাটিং বেলাটিং', চোর পুলিশ বা পিট্টু খেলে। সন্ধ্যায় নদীর পারে মিল থেকে গেস্টহাউস অবধি ল্যাম্পপোষ্টে আলো জ্বলে ওঠে। তখন টিভি আসে নি। তাই রান্নাবান্না সেরে পুলিশ পরিবারের মুষ্টিমেয় মহিলাগোষ্ঠী নদীর ধারে চলে আসে। ল্যাম্পপোষ্টের তলায় বসে গজালি হয়। পাশেই থানা তাই রাতেও কোনো ভয় নেই। কর্তারা ঘরে আসেন দেরীতে। পড়া শেষ করে ছেলেমেয়ের দলও চলে আসে নদীর পারে। মা, পাড়াতুতো কাকিমা, জেঠিমার জটলার কাউকে বুড়ি বানিয়ে তারা দৌড়াদৌড়ি করে খেলে বুড়িবসন্ত।
রাতের অন্ধকারে বড় বড় সমূদ্রগামী জাহাজ মাঝ নদী ধরে ধীর গতিতে চলে যায়। দুর থেকে ডেক, কেবিন, মাস্তুলের আলোগুলো মনে হয় মায়াবী। খানিক পরে নদীর কালো জল বেয়ে ঢেউ এসে পারে সাদা ফেনা তুলে আছড়ে পড়ে। জাহাজের গম্ভীর ভেঁপু অদৃশ্য চরাচরে বহুদূর অবধি ছড়িয়ে যায়। ছোটরা খেলা থামিয়ে স্বপ্নিল চোখে চেয়ে থাকে অন্ধকারে অপস্রিয়মাণ জাহাজের দিকে। এ দৃশ্য রোজ দেখেও আশ মেটে না। দিনের বেলা কিন্তু এমন অদ্ভুত লাগে না। তখন সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায় যে। যত রহস্যময়তা রাতের আঁধারে। মাঝনদীতে দুরে দুরে নির্দিষ্ট ব্যবধানে বয়ার আলোগুলো নিয়মিত ছন্দে টিপ টিপ করে জ্বলে নেভে। মনে হয় যেন নদীর হৃদস্পন্দন। ওগুলো আসলে জাহাজ চলাচলের পথনির্দেশক।
-৩-
দুর্গাপূজা থেকে কালীপূজা অবধি রাজগঞ্জের রাজবাড়ীর বড় মাঠে তিন সপ্তাহের মেলা বসে। নাগরদোলা, চরকি বসে। মানুষ কঙ্কাল হয়ে যাওয়ার ম্যাজিক, আমেরিকান কথা বলা পুতুল ও আরো নানা খেলা আসে। মনিহারি জিনিস, বাসন, খেলনা, ঝুঠো গয়নার দোকান লাগে। মেলার মাঠের বাতাস তেলেভাজা, জিলিপি, হিমাপি, ফুচকার গন্ধে 'ম'ম করে। ঐ কটা দিন মোহনপুর বাসিন্দাদের আনন্দ উচ্ছলতার সময়। নানা লোকের আনাগোনায় যাতে কোনো ঝুটঝামেলা না হয় তাই কদিনের জন্য মেলায় বসে পুলিশ পিকেট। ছোট ছেলে মেয়ে হারিয়ে গেলে ওখান থেকেই মাইকে ঘোষণা হয়।
যতীনবাবু মাঝে কয়েকবার সন্ধ্যায় ভীড়ের সময় মেলায় গিয়ে তদারক করে এসেছেন। সেবারের মেলায় কোনো গোলমাল হয়নি। তবু মেলা শেষ হওয়ার তিনদিন আগে দুপুরে যতীনবাবু আবার গেলেন। সাবধান করে এলেন পুলিশ কর্মীদের। এতদিন সব ঠিকঠাক চলেছে বলে যেন নজরদারিতে ঢিলে না পড়ে। শেষ দিকে ছিনতাইবাজরা ছোবল মারতে পারে। এসব রুখতে না পারলে থানার বদনাম হয়ে যাবে। হঠাৎই কয়েকটা কুকুরের সম্মিলিত হিংস্র চিৎকারে সবাই একসাথে ঘুরে তাকায়।
সে এক দৃশ্য! একটা তাগড়াই হলদেটে কুকুরকে গোটা পাঁচেক নেড়িকুত্তা ঘিরে ধরে আক্রমণ করেছে। ষন্ডামার্কা কুকুরটা বিদ্যূৎবেগে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ওদের সাথে প্রবল বিক্রমে লড়ে যাচ্ছে। এমন অসম লড়াই যতীনবাবুর সহ্য হয় না। পাশের পুলিশকর্মীর হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিয়ে দৌড়ে গেলেন। পুলিশের লাঠির বাড়ি দু একটা পিঠে পড়তেই নেড়িকুত্তার দল ল্যাজ গুটিয়ে চম্পট। অন্য পুলিশকর্মীরা তেড়ে গিয়ে ওদের মাঠের বাইরে পগাড় পার করিয়ে আসে।
আশ্চর্য ব্যাপার, হলদেটে তাগড়াই কুকুরটা কিন্তু পালায় নি। ও ওখানেই দাঁড়িয়ে জিভ বার করে হাঁফাচ্ছে। ও যেন বুঝতে পেরেছে ঐ খাঁকি তৎপরতা তার বিরুদ্ধে নয়, তাকে বাঁচাতে। যতীনবাবু কাছে যেতে ও মুখ তুলে তাকায়। দু চোখে গভীর কৃতজ্ঞতার চাউনি। গুটিগুটি কাছে এসে যতীনবাবুর প্যান্ট শোঁকে। তখন চোখে পড়ে তার গলায় একটা বকলস। তার হৃষ্টপুষ্ট শরীর, লোমের চমক দেখেই বোঝা যায় সে কারুর বাড়ির যত্নে পালিত পোষা কুকুর।
কুকুরদের মধ্যেও হয়তো শ্রেণীবৈষম্যের জ্বালা আছে। নেড়িদের মনে হয় আমাদের রাস্তা ঘাটে লোকের লাথি ঝ্যাঁটা খেয়ে টিকে থাকতে হবে আর ওরা বাইরে থেকে এসে কেন থাকবে এতো আরামে? তাই বাড়ির পোষা, যত্নে পালিত বিদেশী কুকুর নিয়ে মালিক রাস্তায় বেরোলে নেড়িকুত্তার দল একযোগে চেঁচায়। অথচ তাদের কারুর কিন্তু একা সেই পোষ্য কুকুরের সাথে পাল্লা নেওয়ার ক্ষমতা নেই। যতীনবাবু তাকে মুখে আয়, আয় করে ডেকে পিকেটের দিকে এগোন। কুকুরটা সুবোধ বালকের মতো পিছু পিছু আসে।
পিকেটর তাঁবুতে এসে কুকুরটা এক কোনে চুপ করে বসে। যতীনবাবু কাছে গিয়ে দেখেন পিছনে কয়েক জায়গায় নেড়ির দল কামড়ে দিয়েছে। রক্ত বেরোচ্ছে। উনি এক বাটি জল ওর মুখের সামনে দেন। লড়াই করে বোধহয় খুব তেষ্টা পেয়েছিল। চোঁক চোঁক করে খানিকটা জল খেয়ে সে যতীনবাবুর দিকে আবার মুখ তুলে তাকায়।
পেশাগত কারণে মানুষ চরিয়ে অভ্যস্থ যতীনবাবুর মনে হয় কুকুরটার তাকানোর ভঙ্গিমা খুব অভিব্যক্তিময়। যেন চোখের ভাষায় কথা বলে। অচেনা কুকুর। তবু তার রকমসকম দেখে যতীন বাবুর ভয় করে না। একজনকে বলেন ডেটল তুলো আনতে। ক্ষততে ডেটল লাগালে চিড়বিড়িয়ে ওঠে। তবু ক্ষতে ডেটল ভেজানো তুলো লাগাতে সে একটু চমকে উঠেই চুপ করে বসে থাকে। যেন বোঝে যা করা হচ্ছে তা ওর ভালোর জন্যই।
যতীনবাবু সহকর্মীদের বলেন, মনে হচ্ছে কারুর পোষা কুকুর। এখানেই থাকুক। খেয়াল রেখো আবার যেন রাস্তার কুকুর এসে কামড়ে না দেয়। মাঝে মাঝে মাইকে ঘোষণা কোরো যদি কারুর কুকুর হারিয়ে থাকে যেন এখানে এসে দেখে যায়। ওদের কিছু টাকা দিয়ে বলেন, কিছু খেতে টেতে দিও ওকে। যতীনবাবুকে চলে যেতে দেখে কুকুরটা উঠে আসে। সেরেছে, এ আবার সাথে যাবে নাকি। যতীনবাবু আকারে ইঙ্গিতে বলেন, ওরে তুই এখানেই থাক, আমি আসছি। বোধহয় বোঝে। আর আসে না। বসেও পড়ে না। সাময়িক বেড়া দেওয়া পিকেটের গেটে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নেড়ে দেখতে থাকে যতীনবাবুর চলে যাওয়া।
-৪-
মেলা ভাঙার দিন বিকেলে যতীনবাবু আবার যান পিকেটে। কুকুরটা এক কোনে বসে ছিল। ওনাকে দেখেই উঠে কাছে এসে প্যান্ট শুঁকে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে ল্যাজ নাড়ে। যতীনবাবু অবাক হয়ে বলেন, আরে! এ এখনও এখানে রয়েছে? কেউ নিয়ে যায়নি ওকে? পিকেট ইনচার্জ বলে, স্যার, অনেকবার মাইকে ঘোষণা করা হয়েছে। কেউ আসেনি। ওকে দুধ, পাঁউরুটি, বিস্কুট দিয়েছি। অল্প খেয়েছে। মনে হয় এসব খেয়ে অভ্যস্ত নয় ও। বাইরে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজ করে এসেছে। পিকেটের মধ্যে কোথাও নোংরা করেনি। কুকুরটা খুব ভালো স্যার। খোলা অবস্থায় ছাড়া ছিল তবু কাউকে বিরক্ত করেনি। ঐ খানে চুপ করে বসে থাকতো। এ কদিনে একবারও বাইরে যায়নি। হয়তো ভয় পেয়ে গেছে। এখন কী করা যায় স্যার ওকে নিয়ে? এখানে ওকে ফেলে রেখে ক্যাম্প তুলে চলে গেলে তো ওকে ঐ নেড়িকুত্তার দল আবার ছিঁড়ে খাবে।
এ কথা যতীনবাবুরও মনে হয়েছে। তিনি বলেন, ঠিক আছে ওকে জীপের পিছনে তুলে দাও। থানায় নিয়ে যাই। তারপর দেখা যাক কী করা যায়। ফেরার পথে উনি একটা কুকুরের চেন কিনে ওর গলার বকলসে আটকে দেন। ও চুপ করে পিছনে বসে থাকে। থানায় এনে ওকে রাখবেন কোথায় ভেবে পান না। ও তো অপরাধী নয়। বিপন্ন। তাছাড়া কুকুরকে হাজতেও রাখা যায় না। তাই কোয়ার্টারেই নিয়ে আসেন।
চারপেয়ে অচেনা অতিথির আগমনে বাড়িতে সাড়া পড়ে যায়। শোভা বলেন, ওমা এ আবার কে? যতীনবাবু ভেবেছিলেন যার কুকুর সে নিয়ে যাবে তাই এর কথা বাড়িতে বলতে ভুলেই গেছিলেন। এখন সংক্ষেপে সে বৃত্তান্ত বলে স্ত্রীকে বলেন, ভালোই হয়েছে আজ মাংস রান্না হয়েছে। ওকে মাংস ভাত দাও। এর বোধহয় বিস্কুট, পাঁউরুটি খাওয়ার অভ্যাস নেই। বেচারা কদিন ধরে খায়নি ভালো করে। খিড়কি দরজার পাশে শোবার ঘরের জানলার গরাদে চেনটা আটকে সবাইকে বলেন, চেহারাটা বড়সড় হলেও কুকুরটা শান্ত, ভদ্র। তবু মনিব হারিয়ে অচেনা জায়গায় এসেছে। মেলাতে একপাল রাস্তার কুকুরের কামড় খেয়েছে। হয়তো ওর মন মেজাজ ভালো নেই। তোমরা কদিন ওর কাছে যেও না। নতুন জায়গা, লোকজন, ওকে একটু বুঝে নিতে দাও। যতীনবাবু থানায় চলে যান।
তিন ভাইবোন নিজেদের মধ্যে ওকে নিয়ে জোর আলোচনা শুরু করে দেয়। অতু বলে, এই দিদি ওর একটা নাম দিলে হয় না? রীণা বলে, কিন্তু ও যখন কারুর বাড়ির পোষা কুকুর তখন ওর তো একটা নাম নিশ্চয়ই আছে। নতুন নাম দিলে ও কি সাড়া দেবে? সবার বড় বাপী দাদাসূলভ বিজ্ঞতা নিয়ে বলে, আসতেই তোরা ওর নাম নিয়ে পড়লি কেন? নাম নিয়ে ধুয়ে জল খাবে নাকি ও? নতুন নাম দিলেও ও তা বোঝার আগেই হয়ত ওর মালিক থানায় এসে ওকে নিয়ে চলে যাবে। অতু অবাক হয়ে বলে, ওকে নিয়ে যাবে? বাপী বলে, যাবে না? যার পোষা কুকুর হারিয়ে গেছে সে খোঁজ পেলে নিয়ে যাবে না? এমন কুকুর রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতে দেখেছিস কখোনো? তাছাড়া, বাবা বললো শুনলি না, মালিক হারিয়ে হয়তো ওর মনমেজাজ খারাপ, ওকে বিরক্ত কোরো না?
অতুর বিষ্ময় বিমর্ষতায় বদলে যায়। মনে মনে ভাবে, যাঃ, একে নিয়ে যাবে? তাহলে এ এলো কেন? রীণা বলে, মনে হয় না ওকে কেউ নিতে থানা অবধি আসবে। শুনলি না বাবা বললো, তিনদিন ধরে মেলায় মাইকে ঘোষণা করা স্বত্ত্বেও কেউ আসে নি। দিদির অভিমত শুনে অতুর মুখটা আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনে মনে বলে, হে ভগবান, যেন তাই হয়। শিশুমন নিজের ভালো লাগায় ভুলে যায় পরিচিত পরিবেশ, সঙ্গ হারিয়ে ঐ পশুটির কেমন লাগছে। অতু বলে তাহলে ওর নাম বাঘা রাখলে কেমন হয়? কেমন বাঘের মতো চেহারা দ্যাখ। যদি কেউ নিয়ে যায় তো নিয়ে যাবে, কিন্তু ততদিন আমরা কী বলে ডাকবো ওকে? রীণা কয়েকবার আপন মনে বাঘা, বাঘা করে ভাইয়ের নামকরণ সমর্থন করে বলে, হ্যাঁ, নামটা ওর জন্য বেশ মানানসই হয়েছে।
-৫-
বসার ঘরের দরজায় পরিচিত কড়া নাড়ার আওয়াজ হয়। শোভা বলেন, এই, তোরা সব পড়তে যা, মাস্টারমশাই এসেছেন। তিনজনে চলে যায় বসার ঘরে। একটা বড় টেবিলের একপাশে বসেন সুব্রত মাস্টার। ফর্সা সুদর্শন মার্জিত যুবক। অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে সদ্য বিএ পাশ করেছে। সচ্ছল পরিবারের ছেলে। পড়াশোনা নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। তাই এখনই কোনো চাকরি বাকরি করার কথা ভাবছে না। ইচ্ছে কস্টিং পড়ার। যতীনবাবুর অনুরোধে সপ্তাহে তিনদিন সন্ধ্যায় ঘন্টা দেড়েকের জন্য পড়াতে রাজি হয়েছেন। আসেন মূলতঃ বাপী ও রীণার জন্য। তবে দুরন্ত অতুটার ওপর ওনার প্রথম থেকেই একটা অব্যক্ত স্নেহ জন্মে গেছে। তাই ওকেও ডেকে নিয়ে পাশে বসান। ও এক ফাউ ছাত্র।
কিন্তু অতু এক নম্বরের ফাঁকিবাজ। ছাত্রবন্ধু খুলে খানিকটা পড়েই, মাস্টার মশাই জল তেষ্টা পাচ্ছে। মাস্টারমশাই হিসি পাচ্ছে। এইসব হাবিজাবি বায়না করে সেই যে যায় আর পাত্তা নেই। শোভা চা বিস্কুট নিয়ে এলে সুব্রত বলেন, বৌদি অতু কোথায় গেলো দেখুন তো, জল খাবো বলে তো অনেকক্ষণ গেছে।
বড় বাড়ির আনাচে কানাচে কোথায় যে কি করে বেড়ায় ছেলেটা খুঁজে পাওয়াই ভার। একদিন দেখেন বড়ঘরের খাটে ওর সমান লম্বা বাবার পেল্লায় পাশবালিশ জড়িয়ে অতু বেমালুম শুয়ে আছে। শোভা গিয়ে মুচকি হেসে সুব্রতকে বলেন, এসে দেখে যান আপনার ছাত্রের কান্ড। ফটফটে টিউবের আলোয় অতু অকাতরে ঘুমোচ্ছে। সারাদিন গঙ্গায় দাপাদাপি করে হতক্লান্ত। পড়ার ঘরে সবার সামনে ঢুলতে লজ্জা করে বলে খাটে শুয়ে পড়েছে। সুব্রত চুপ করে খানিক দেখেন। মুখে মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি। বলেন, বৌদি, এখন ওকে ডাকলেও পড়া মাথায় ঢুকবে না। ওকে ঘুমোতে দিন।
সেদিন সুব্রতমাস্টার আসতেই অতু উৎসাহের আতিশয্যে চেঁচিয়ে বলে, মাস্টারমশাই আমাদের বাঘাকে দেখবেন আসুন। হাত ধরে টেনে আনে খিড়কির উঠোনে। নতুন মানুষ দেখে বড় শরীরটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় বাঘা। মুখে কোনো আওয়াজ নেই। সুব্রতর কুকুর সম্পর্কে কিছু ধারণা আছে। ওর মনে হয় ল্যাব্রাডরের সাথে দেশজ কুকুরের সঙ্কর হতে পারে। তাই হলদেটে লোমে অমন জেল্লা। অতু হাত পা নেড়ে বাঘার আগমন বৃত্তান্ত শোনায়। সুব্রতরও মনে হয় বাঘার ব্যক্তিত্ব বেশ সমীহ উদ্রেককারী।
সেদিন পড়তে বসে খানিক পড়েই অতু বলে, মাস্টারমশাই জল তেষ্টা পাচ্ছে। সুব্রত বোঝেন আজ ওর পড়ায় মন নেই। পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন, যাও তুমি বাঘার কাছে। নতুন জায়গায় এসে ওর বোধহয় একা একা মনখারাপ লাগছে। আজ তোমার ছুটি। অতুর খুব আনন্দ হয়। মাস্টারমশাই কি ভালো!
অতু খিড়কির উঠোনে আসে। শোভা উঠোনের আলোটা জ্বালিয়ে রেখেছেন। বাবা বলে দিয়েছেন বলে চেনের নাগালের বাইরে বাঘার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে অতু। বাঘা উঠোনে সামনের দুটো পায়ের ওপর মুখটা রেখে চুপ করে বসে ছিল। অতুকে দেখে মুখ তুলে তাকায়। অতুর মনে হয় এমন সুন্দর কুকুর এর আগে ও দেখেনি। কিন্তু বাঘার মুখে বিষন্নতা দেখে খারাপ লাগে। মুখে চু চু আওয়াজ করে অতু। দাঁড়িয়ে পড়ে বাঘা। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে অতুর দিকে। গরাদে মৃদু খচাং আওয়াজ করে চেনে টান পড়তে দাঁড়িয়ে যায়। বাঘাকে কাছে আসতে দেখে অতুও উঠে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে নয়, কৌতূহলে। নাক তুলে অতুর গন্ধ নিয়ে বাঘা ওর দিকে তাকিয়ে ল্যাজ নাড়তে থাকে। ভাবখানা, কী হোলো, দুরে দাঁড়িয়ে রইলে যে?
অতুর আর বাবার বারণ মনে থাকে না। গুটিগুটি কাছে এগিয়ে যায়। বাঘা মাথা ঘষে ওর প্যান্টে। অতু আলতো করে বাঘার মাথায় ওর কচি হাতটা রাখে। ভেলভেটের মতো মাথার ওপরটা। কী নরম! অতুর খুব মজা লাগে। আস্তে আস্তে হাত বোলায় বাঘার মাথায়। অতু জানে না পোষা কুকুর ছোটদের অনেক আদরের অত্যাচারও নীরবে সহ্য করে। ওরা শিশুদের সঙ্গ পছন্দ করে।
কে জানে কবে থেকে বেচারা বাড়ি ছাড়া। খিদে, অনিশ্চয়তা, রাস্তার কুকুরের দলবদ্ধ আক্রমণ, পরিচিত লোকজন না দেখতে পাওয়া - এসব কারণে হয়তো সে ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। এমন অবহেলায় তো অভ্যস্ত নয় পোষা কুকুর। কথাই শুধু বলতে পারে না ওরা তবে বহুদিন ধরে মানুষের সাহচর্যে থেকে চাউনি, শারীরভাষ্যে অনেক কিছু বোঝাতে পারে। শুধু সে ভাষা বোঝার মতো মন থাকা চাই। ঘোড়াও তার মালিকের সাথে এভাবে নীরবে অনেক আদানপ্রদান করতে পারে। জনশ্রুতি বুন্দেলাখন্ডের মহারাজা ছত্রশাল একাশী বছর বয়সে তাঁর বহু যুদ্ধের বিশ্বস্ত সঙ্গী প্রিয় ঘোড়া ভলেভাইকে একটা গাছে বেঁধে সংসার ত্যাগ করে অরণ্যে চলে যান। সেই শোকে নাকি ভলেভাই ওখানেই প্রাণত্যাগ করে। সমস্ত গৃহপালিত পশুর মধ্যে কুকুর ও ঘোড়াই মানুষের সবথেকে নিকট সঙ্গী।
কে জানে কতদিন পর এক পূর্ণবয়স্ক সারমেয় এক অচেনা বালকের মমতায় খুঁজে পায় মানব সঙ্গের উষ্ণতা। ভিজে তোয়ালের মতো জিভ দিয়ে চাটে অতুর কচি হাতের পাতা। অতু খিলখিলিয়ে হাসে, কী করছিস রে বাঘা, সুড়সুড়ি লাগে যে। আর বাঘা! সে তখন মজা পেয়ে গেছে। হাঁ করে আলতো ভাবে কামড়ে ধরে অতুর হাত। তাতেই অতুর অবশিষ্ট ভয় কেটে যায়। বোঝে বাঘা ওর সাথে খেলতে চাইছে। মাথা ছেড়ে পাশবালিশের মতো ওর মোটা ঘাড়টা দুহাতে খুবসে চটকায়। আপন মনে কীসব বকবক করে ওর সাথে। শোভা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এ দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যান। আজই এলো, অচেনা কুকুর, তবে তাঁরও মনে হয় বাঘা তাঁর ছেলের কোনো ক্ষতি করবে না। ছলছল করে ওঠে শোভার চোখ। সেদিন গোগ্ৰাসে মাংস ভাত খায় বাঘা। খাইয়ে তৃপ্তি হয় শোভার। বাড়িতে আর এক নামানুষী সদস্য বাড়লো। টিয়া, বেড়াল, সাদা ইঁদুর, কয়েকটা হাঁস তো ছিলই।
-৬-
পরের দেওয়ালী আসতে চললো। কেউ বাঘার মালিকানা দাবি করে থানায় আসে নি। ফলে বাঘা যতীনবাবুর বাড়িতেই রয়ে গেছে। তবে কে কোথায় কতদিন থাকবে কেউ জানে না। সবই বিধাতার ললাট লিখন। কুকুরের ললাটে সে লিখন কে লেখেন? কুকুর আর মানুষের বিধাতা কি এক? অতশত অতুর জানার কথা নয়। হয়তো কেউই জানে না। বাঘাকে কেউ নিয়ে যায়নি, এতেই অতু খুশি। বাঘার আগে কোনো নাম ছিল কিনা জানা নেই তবে এতদিনে সে নতুন নামে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অতু - এ্যাই বাঘা - বলে দেওয়ালের কোন থেকে ফিসফিসিয়ে ডাকলেও সে ঘুমের মধ্যেও মুখ তুলে তাকায়।
গরমকালে বাঘার থাকার জায়গা হয়েছে টানা ঢাকা বারান্দায় বড়ঘরের জানলার পাশে। অন্য ঘরে শোয় তিন ভাইবোন। শীতকালে রাতে বাঘা থাকে বসার ঘরে। থানার পাশে পুলিশ কোয়ার্টারে রাতে কুকুরের পাহারা দেওয়ার কিছু নেই। চোর এখানে ভুলেও আসবে না। বাঘার আনুগত্য তার পরিত্রাতা যতীনবাবুর ওপর আজও অটূট। পাশেই ঘর বলে সারাদিনে তিনি কয়েকবার আসাযাওয়া করেন। তখন বাঘা কিছু বলে না। কিন্তু রাতে ডিউটি শেষ করে বাড়ি এলেই বাঘা দুপায়ে দাঁড়িয়ে প্রায় ছ ফুট লম্বা যতীনবাবুর কাঁধে সামনের দু পা তুলে আদরের গুঁতোয় অস্থির করে। কী করে যেন বোঝে বাড়ির কর্তা এইবার কাজ শেষ করে ঘরে এলো। যতীনবাবু গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে বাঘা নেমে চুপ করে বসে। এ রুটিনের কোনোদিন ব্যত্যয় হয় না।
অতুর কাছেই মর্ণিং স্কুল। সাড়ে ছটা নাগাদ বেরিয়ে হেঁটেই চলে যায়। তাই সকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাপী, রীণার কেউ ওকে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে বিকেলে বাঘাকে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে নিয়ে যায় অতু। চেনে হ্যাঁচকা টান মারলে অতুর পক্ষে ওকে সামলানো অসম্ভব। কিন্তু কখনো ও বেয়াদবি করে না। মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুর ওকে দেখে চেঁচালে বাঘা দাঁড়িয়ে পড়ে রক্তজল করা একটা গরগর আওয়াজ ছাড়ে। অতু বোঝে বাঘার পুরোনো অপমান মনে পড়ে যাচ্ছে। চেন টেনে বলে, চল বাঘা আমরা ওদিকে যাই। ওকে অন্যমনস্ক করে দেয়। এক বালকের সঙ্গ বাঘার ওর স্বজাতির প্রতি আক্রোশ ভুলিয়ে দেয়।
সেদিন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কেউ এসেছিল যতীনবাবুর সাথে দেখা করতে। তাকে বিদায় জানিয়ে উনি দক্ষিণের দরজা বন্ধ করে উঠোন পেরিয়ে ঘরে আসছিলেন। সুব্রত মাস্টারের সেদিন পড়ানোর কথা নয়। অতু দাঁড়িয়েছিল রান্নাঘরের দরজায়। বাঘা বারান্দার পাশে ঘরের দেওয়াল ঘেষে ওর নির্দিষ্ট জায়গায় বসে ঘাড় বেঁকিয়ে লেজের দিকে মুখ দিয়ে চুলকোচ্ছিল। গলার চেনটা বাঁধা জানলার গরাদে। বাপী রান্নাঘর থেকে হাতে দুধের গ্লাস নিয়ে বসার ঘরে পড়তে যাচ্ছিল। কী যে ওর মতিচ্ছন্ন হোলো, ঢাকা বারান্দায় উঠে হঠাৎ, ডান পা দিয়ে বাঘার গায়ে একটু খোঁচা মারলো। বলতে গেছিলো, কী এতো চুলকোচ্ছিল তুই?
না বলা কথা মুখেই রয়ে গেল। চকিতে মুখ ঘুরিয়ে বাঘা ঘ্যাঁক করে কামড়ে ধরলো বাপীর গোড়ালি। ওরে, বাবারে বলে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে বাপী। ঝনঝন করে মেঝেতে ছিটকে পড়ে দুধের গ্লাস। পা ঝাঁকিয়ে বাঘার কামড়ে ধরা মুখ ঝেড়ে ফেলতে চায়। পারে না। ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়। তিন হাত পায়ে ঘষটে বাঘার থেকে দুরে সরে যেতে যায়। তাও পারে না। ওর গোড়ালি মোক্ষম কামড়ে আটকে আছে বাঘার চোয়ালে। আচমকা উত্তেজনায় কুকুর কাউকে কামড়ালে ক্ষণিকের জন্য তাদের চোয়াল খিল ধরার মতো লক হয়ে যায়। বাঘার দাঁত বাপীর গোড়ালিতে দেওয়ালে গজাল পোঁতার মতো বসে গেছে।
আবার কাজে আসে যতীনবাবুর প্রত্যূৎপন্নমতিত্ততা। বারান্দার কোনে পড়ে ছিল একটা কাঠের ব্যাট। তিন লাফে বারান্দায় উঠে সজোরে সেই ব্যাটের এক ঘা বসিয়ে দেন বাঘার পিঠে। 'ভ্যাক' করে একটা আওয়াজ বেরোয় ওর মুখ দিয়ে। তাতেই মুখটা হাঁ হতে কামড়টাও ছেড়ে যায়। হাঁচোড় পাঁচোড় করে বাঘার নাগালের বাইরে চলে যায় বাপী। টপটপ করে রক্ত পড়ছে পা দিয়ে।
বাঘা কিন্তু আবার আক্রোশে তেড়ে গিয়ে বাপীকে কামড়াতে যায় না। বরং যতীনবাবুর এক ঘা ব্যাট পেটা খেয়েই সে এক লাফে নিজের জায়গায় চলে যায়। ভয়ে বড়সড় শরীটা কুঁকড়ে দেওয়াল ঘেঁষে বসে করুণ ভাবে তাকায় যতীনবাবুর দিকে। ভাবখানা, আর মেরো না। হয়তো হঠকারিতা হয়ে গেছে বুঝে মুখটা মলিন হয়ে গেছে। হয়তো হয়েছে গভীর অভিমানও। এই লোকটাই সেদিন লাঠি হাতে নেড়িকুত্তা ঠেঙিয়ে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল, আজ তার হাতেই ব্যাট পেটা খেলাম!
যতীনবাবু বাপীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিজের ঘরের খাটে শুইয়ে দেন। অতুকে বলেন, শিগগির মাস্টারমশাইকে খবর দে, বল ডাক্তার কাকুকে নিয়ে আসতে। সুব্রতর এক কাকা ডাক্তার। বাড়িতেই চেম্বার। হালকা শরীরে অতু চিতার মতো দৌড়ে চলে যায় হাফ কিমি দুরে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি।
-৭-
মিনিট পনেরোর মধ্যে সুব্রতমাস্টার ওর ডাক্তার কাকাকে নিয়ে চলে আসে। বাপী তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ডাক্তার বাপীকে পরীক্ষা করে বোঝেন গোড়ালির হাড়ের সাথে পায়ের পিছনে গুলফ পেশীর (calf muscle) সংযোগকারী মানব শরীরের সবথেকে মজবুত পেশীবন্ধটা (Achilles tendon) একটুর জন্য বেঁচে গেছে। বাঘার একপাশের শ্বদন্তের কামড় সেই পেশীবন্ধের একটু পিছনে ফুটো করে দিয়েছে। তিনি বলেন, অল্প বয়স, দিন সাতেকের মধ্যে চলাফেরা করার মতো ঠিক হয়ে যাবে। ততদিন ওকে ধরে ধরে শৌচাগারে নিয়ে যেতে হবে। হাঁটাহাঁটি একদম বারণ। তবে টেনডন ইনজুরি সারতে সময় নেয়। অনেকদিন অবধি জুতো পরতে গেলে ব্যাথা লাগবে। উনি ভালো করে ক্ষতস্থান টিঙ্কচার আয়োডিন দিয়ে ধুয়ে ব্যান্ডেজ করে যন্ত্রণা কমানোর ট্যাবলেট, টিটেনাস ইঞ্জেকশন দিয়ে দেন।
যতীনবাবুকে বছর চারেক আগে রাণাঘাট স্টেশনের ওভারব্রিজে একটা কুকুর কামড়েছিল। রাতের অন্ধকারে কালো কুকুরটাকে দেখতে না পেয়ে গায়ে পা দিয়ে ফেলেছিলেন। পেটে চোদ্দটা ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছিল। বেশ যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। তিনি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেন, বাপীকেও কি তাহলে ইঞ্জেকশন নিতে হবে? ডাক্তার বলেন, কুকুর যদি কামড়ানোর সময় রেবিসে আক্রান্ত না হয় তাহলে না নিলেও চলে। কুকুর কামড়ালেই রেবিস হবে তার কোনো মানে নেই। তাছাড়া বাড়ির কুকুর তো, ভয়ের কিছু নেই।
যতীনবাবু বলেন কিন্তু ওকে তো আমি রাজগঞ্জের মেলায় পেয়েছি। ওখানে কয়েকটা রাস্তার কুকুর ওকে কামড়েও দিয়েছিল। ডাক্তার বলেন কতদিন আগের ঘটনা সেটা? যতীনবাবু বলেন, তা প্রায় বছর ঘুরতে চললো। ডাক্তার বলেন, এর মধ্যে কি কখোনো ওকে ঝিম মেরে বসে আছে, মুখ দিয়ে লালা পড়ছে, খেতে চাইছে না বা হঠাৎ রেগে চেঁচিয়ে উঠছে, এমন কিছু দেখেছেন? যতীনবাবু বলেন, না তো। শুরু থেকেই বেশ স্ফূর্তিতে আছে ও এখানে। খুবই শান্ত, বাধ্য ও। ছেলেমেয়েদের সাথে খেলে, হাঁটতে যায়।
ডাক্তার বলেন, তাহলে ভয়ের কিছু নেই। কুকুরের রেবিস সংক্রমণ হলে জীবাণু সুষুম্নাকাণ্ড হয়ে মস্তিষ্কে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রতে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে আসে লালাগ্ৰন্থীতে। তখন মুখ দিয়ে অনবরত লালা ঝরে। একটু ঝিমিয়েও পড়তে পারে। ঐ লালা থেকেই সংক্রমণ হয়। ঐ অবস্থায় কাউকে কামড়ালে বা আঁচড়ালেও রেবিস সংক্রমণ হতে পারে কারণ কুকুর তো নিজের থাবাও চাটে। তাই নখেও লালার মাধ্যমে রেবিসের জীবানু থাকতে পারে। তবে এতদিন যখন ও সুস্থ আছে তাহলে ও রেবিসে আক্রান্ত নয়। ভাববেন না, রাস্তার অচেনা কুকুর হলে আমি কোনো চান্স নিতাম না কেননা একবার রেবিসের রোগলক্ষণ শরীরে প্রকাশ পেলে তখন আর ইঞ্জেকশন দিয়ে লাভ নেই। তখন মৃত্যু অবধারিত।
ডাক্তার চলে যেতে, বাঘাকে দেখে খারাপ লাগে যতীনবাবুর। মারটা জোরেই পড়েছে পিঠে। অবশ্য তা না হলে তো কামড়টাও ছাড়তো না। তবে ভাগ্য ভালো মেরেছেন ব্যাটের চ্যাপ্টা দিক দিয়ে। না হলে ওরও শিরদাঁড়ায় জোরে চোট লাগতে পারতো। তবু পুলিশের পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে অতুকে ডেকে বলেন, ধরতো ওর পিঠে। তিনি ভালো করে লোম সরিয়ে সরিয়ে পরীক্ষা করেন। বাঘা চুপ করে বসে থাকে। না, কোথাও ছড়ে বা ফুলে যায়নি।
অবলা একটা পোষা জীবকে এভাবে মেরে বসার অপরাধবোধে ওর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের মনেই যতীনবাবু বলেন, কেন তুই হঠাৎ এভাবে কামড়ে দিলি বলতো? বাঘা চুপ। তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অতু বলে, ওর কোনো দোষ নেই, দাদা ওকে আচমকা পা দিয়ে খোঁচালো যে। অতুর কথায় যতীনবাবুর মাথায় তৎক্ষণাৎ বাঘার মোডাস অপারেন্ডি জলের মতো পরিস্কার হয়ে যায়। পুলিশ ট্রেনিং, ক্রিমিনোলোজিতেও এটার ওপরেই বেশী জোর দেওয়া হয়। কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তদন্তে গিয়ে সবার আগে বোঝার চেষ্টা করো, অপরাধীর Modus Operandi কী হতে পারে? এক্ষেত্রে সত্যিই বাঘার কোনো দোষ নেই। প্রাকৃতিক পশু প্রবৃত্তি ও প্রতিবর্তী প্রেরণার যুগপৎ ক্রিয়ায় স্রেফ চমকে গিয়ে বাপীকে কামড়ে দিয়েছে, কোনো আক্রোশ থেকে নয়। বাপী যদি পা দিয়ে ওর গায়ে আচমকা খোঁচা মারার আগে ডাকতো, বাঘা যদি মুখ ফিরিয়ে ওকে দেখতো, তাহলে ওকে কামড়াতো না। এক্ষেত্রে দোষটা পুরোপুরি বাপীর। অথচ বেচারা বাঘা শুধুমুধু মার খেল। গভীর অনুশোচনায় যতীনবাবু বাঘার পিঠে হাত বুলোতে থাকেন।
সেই ঘটনার পর মাস ছয়েক কেটে গেছে। মাঝে ডাক্তারবাবু কয়েকবার এসে দেখে গেছেন বাঘাকে। এ কমাসে বাঘার কোনো অদ্ভুত ব্যবহার, অসুস্থতা চোখে পড়েনি। বরং উল্টোটাই মনে হয়েছিল। যেন ও এই পরিবারের বহুদিনের সদস্য। একটা বড় ভুল করে ফেলে গভীর অপরাধবোধে ভুগছে। তাই কিছুদিন খুব মনমরা হয়ে ছিল। যতীনবাবু থানা থেকে রাতে এলে আগের মতো আর দৌড়ে এসে লাফিয়ে উঠে কাঁধে পা তুলে আদরের আতিশয্য দেখাতো না। হয়তো বুঝেছিল নিজের ভুলে ও সেই অধিকার হারিয়েছে। শুধু নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে আস্তে আস্তে ল্যাজ নাড়তো।
পুলিশের চোখে এই পরিবর্তন নজর এড়ায় নি। দিন পাঁচেক বাদে একদিন যতীনবাবু রাতে বাড়ি ফিরে, কী রে বাঘা, কেমন আছিস, তুই আর আসিস না কেন আমার কাছে? রাগ হয়েছে? বলে দুটো হাত বাড়িয়ে দিলেন ওর দিকে। আর যায় কোথায়। হঠাৎ দুপায়ে বাঘা আগের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে যতীনবাবুর বুকে মাথা ঘষে, গাল চেটে একসা কান্ড করে। কুকুর মানুষের ভাষা বোঝে না কিন্তু শারীরভাষ্য বোঝে। কুকুর বা পুলিশ, কারো চোখেই সহজে জল আসে না। তবু কিছু ভাবাবেগ কখনো আপাতকঠোর মানুষকেও সাময়িকভাবে আচ্ছন্ন করে দেয়। শোভা দুর থেকে দেখেন সেই মুহূর্তে যতীনবাবু দাড়িয়ে পড়া বাঘাকে সন্তানবৎ দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে ক্ষণিকের জন্য স্থাণু হয়ে গেছেন।
কুকুরের অভিমানবোধ গভীর হলেও অপমানবোধ প্রবল নয়। তাই একবার আদর করে ডাকতেই বাঘা ব্যাটপেটা খাওয়ার দুঃখ ভুলে যায়। বাপীকে কামড়ানোর সপ্তাহ দুয়েক বাদে একদিন বিকেলে অতু আর মন্টু ওকে নিয়ে গঙ্গার ধারে বেড়াচ্ছিল। অতু মাঝে মাঝে বাঘার চেন খুলে দিতো। ও পাশে পাশে মাটি শুঁকতে শুঁকতে যেতো। কখনো এদিক সেদিক চলে যায় না। সেদিন হঠাৎ লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বাঘা দৌড় লাগালো শ্মশানের দিকে। অতু আর মন্টুও - বাঘা দাঁড়া, যাস না - বলে পিছন পিছন ছুটলো। কিন্তু কুকুরের সাথে দৌড়ে কি মানুষ পারে? বাঘা এদিক ওদিক দৌড়য়। আসলে মনের ভার চলে যেতে বাঘার প্রাণে সেদিন পুলক জেগেছিল। তারই প্রকাশ ঐ উদ্দাম দৌড়। তবে যেমন হঠাৎ দৌড় লাগিয়েছিল হঠাৎই আবার ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে ল্যাজ ন্যাড়ে - ভাবখানা, কেমন দৌড় করালাম?
-৮-
আসামীকে থানায় জেরা করা, যাকে কাস্টোডিয়াল ইন্টারোগেশন বলে তাতে মেজবাবু যতীনবাবু বেশ দক্ষ। ধরে আনা লোকটি দোষী না নির্দোষ তার অকাট্য প্রমাণ ছাড়াই মারধোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রচলিত পুলিশী পন্থায় উনি বিশ্বাসী নন। খাতায় কলমের কাজেও উনি বেশ পোক্ত। তাই গুরুত্বপূর্ণ কেসের জেনারেল ডাইরি লেখা, জটিল কেসের নিঁখুত চার্জশিট বানানো, যাতে আদালতে আসামীপক্ষের উকিল ফাঁকফোকর বার করতে না পারে, সেসব কাজের জন্য ওনাকে প্রধানত থানাতেই থাকতে হয়। বড়বাবু ছুটিতে বা সদরে গেলে মেজবাবুকেই থানা সামলাতে হয়। গোলমাল দমন বা ঘটনাস্থলে গিয়ে অপরাধের তদন্ত করার জন্য সেজবাবু, ছোটবাবু আছেন। জটিল কেস হলে যতীনবাবুও যান।
মফস্বলের থানা। একটাই জীপ। তখন মোটরবাইকের চলও অতো ছিল না। তাই আশপাশে কোথাও যেতে হলে যতীনবাবু সাইকেলেই চলে যান। তবে বেশিরভাগ সময় থানায় থাকেন বলে ওনার সাইকেলেই বাপী সাইকেল চালানো শিখে নিয়েছিল। এখনও বেশী হাঁটলে গোড়ালিতে লাগে। তাই সম্প্রতি যতীন বাবু বাপীকেও একটা সাইকেল কিনে দিয়েছেন। তাঁর সাইকেল উঠোনে থাকে। নিজের সাইকেল হতে বাপী এখন সাইকেলেই স্কুলে যায়। এদিক ওদিক আড্ডা মারতে চলে যায় সাইকেলে।
দাদার সাইকেলেই কয়েকবার আছাড় খেয়ে অতুও কিছুদিনের মধ্যে হাফ প্যাডেলে চালাতে শিখে গেল। মন্টুও ওর সাথে থেকে শিখে নিলো। জলে তো দুজনে মাছের মতো পড়েই থাকতো। এবার ডাঙ্গাতেও দুজনে সাইকেল পেলেই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। ছোট জায়গা, গাড়ি চলাচল কম। তাই দুর্ঘটনার ভয় কম।
অতু সাইকেল চালাতে শিখে গেছে শুনে যতীনবাবু খুশী হন। জড়োয়ার গয়নার মতো উনি তুলোয় মুড়ে ছেলে মানুষ করার পক্ষপাতী নন। ওনার মতে ছেলেদের সাঁতার, সাইকেল, গাছে ওঠা, পাঁচিল টপকানো এসবে দক্ষতা থাকলে ভালোই। কখন কাজে আসে কে বলতে পারে। তাই অতুকে বলেন, আমি থানায় থাকলে তুই আমার সাইকেলটাও চালাতে পারিস, তবে দুরে কোথাও যাস না। আর এপ্রিলের গরমে চারটের আগে বেরোস না। প্রচন্ড গরমে হিট স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে।
দু তিন বছর বয়সে মাঝে মাঝে অতুর ফরসা মুখটা নীলচে হয়ে যেতো। খেলতে খেলতে হঠাৎ অবসন্ন হয়ে ঝিম মেরে বসে পড়তো। কয়েকবার অচৈতন্যও হয়ে গেছে। অনেকে বলেছিল মৃগী। অনেক ডাক্তার বদ্যি দেখানোর পর কলকাতার আর জি কর হাসপাতালের এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন ওর কোনো সমস্যা নেই। বয়স হিসেবে ওর শরীরটা একটু ভারী তবে সেই অনুপাতে হার্টে রক্ত চলাচলের কয়েকটি মূখ্য শিরা, ধমনী এখনও ঠিকমতো পুষ্ট হয়নি। তাই মাঝে মাঝে হার্টে ঠিকমতো রক্ত চলাচল করতে পারে না। চিন্তার কারণ নেই পাঁচ ছ বছর নাগাদ ঠিক হয়ে যাবে। ততদিন শুধু খেয়াল রাখবেন যেন ডুবজলে কোথাও একা চলে না যায়।
সেই ডাক্তারের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। পাঁচ বছরের পর এখনও অবধি সেই উপসর্গ আর দেখা যায় নি। এখন সাড়ে আট বছর বয়সে ওতো এই চওড়া গঙ্গায় সারাক্ষণ দাপিয়ে বেড়ায়। কতদূর চলে যায় সাঁতার কেটে। মাঝে মাঝে মনে একটু শংকা হয়। তবে ভাবেন ভেবে লাভ নেই। কপালে যা আছে তাই হবে। বরং ডানপিটেমি করে বেড়ায় বলে অতুটা প্রাণশক্তিতে ভরপুর। তুলনায় বাপী একটু সুখী টাইপের।
প্রাইমারী বিভাগে অতুর স্কুল ছুটি হয়ে যায় দশটায়। ঐ স্কুলেই বাপী পড়ে। ওর মাধ্যমিক বিভাগ শুরু হয় সাড়ে দশটায়। রীণা পড়ে পাশেই মেয়েদের স্কুলে। দু জনেরই ছুটি হয় সাড়ে চারটেয়। সেদিন এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের এক শুক্রবার। বাপী রীণা স্কুলে। কয়েকদিন বাদে গরমের ছুটি পড়বে। যতীনবাবু সেদিন সদরে গেছেন সকালে। বিকেল নাগাদ ফিরবেন। ভোরে উঠেছে বলে অতু খাওয়া দাওয়া করে পাশের ঘরে শুয়ে পড়েছে। দুপুরে খাওয়ার পর হাতের কাজ সেরে শোভাও বড় ঘরে শুয়েছেন। অতুর তিনটে নাগাদ ঘুম ভেঙে যেতে বসার ঘরে পড়ার টেবিলে বসে শুকতারা পড়ছে।
এমন সময় দরজায় গরাদ দেওয়া খোলা জানলায় হাজির হয় মন্টু। বলে, এ্যাই, কী মুখ গুঁজে বই পড়ছিস, চল না একটু সাইকেল চালিয়ে আসি। শুনে অতুরও প্রাণটা চনমন করে ওঠে। বাবার সাইকেলটা একটু ভারী আর উঁচু তবে চলে একদম জলের মতো। কিন্তু বাবা যে বারণ করেছেন চারটের আগে সাইকেল নিয়ে না বেরোতে? সে কথা শুনে মন্টু ওদের বসার ঘরের ঘড়ি দেখিয়ে বলে, আরে সোয়া তিনটে বাজে, আজ রোদও কম, জেঠুও গেছেন সদরে, তুই এতো ভীতু কেন ? চল না যাই। মন্টুর প্রস্তাব, উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা চকচকে সাইকেল, নির্জন দুপুরে নদীর পাশে ফাঁকা রাস্তায় সেটা চালানোর মজা - সব মিলে যেন নিশির ডাকের আহ্বান। প্রতিরোধ ভেঙে যায় অতুর।
মন্টুকে বলে শোন, বাঘা খিড়কির উঠোনে শুয়ে আছে। সাইকেলটা এপাশের উঠোনে মেন দরজার সামনে বারান্দার পিলারে হেলান দেওয়া আছে। লক করা নেই। মা ঘুমোচ্ছে। তবে আমায় সাইকেল নিয়ে বেরোতে দেখলে বাঘা যদি চেঁচিয়ে ওঠে তাহলে মা উঠে পড়বে। তুই এক কাজ কর। আমি মেন দরজাটা খুলে বাঘার সামনে গিয়ে আড়াল করে দাঁড়াচ্ছি। তুই আস্তে করে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে যা। আমি দরজা বন্ধ করে এসে এই পড়ার ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবো। বুঝেছিস তো? বাঘা চ্যাঁচালেই কিন্তু প্ল্যান মাটি। মন্টু মাথা নেড়ে জানায় বুঝেছে।
-৯-
কিন্তু অতুর জানা ছিল না কুকুরের নাক ও কান দুটি অত্যাশ্চর্য ইন্দ্রিয়। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি মানুষের পঞ্চাশ গুণ বেশী। তাই কুকুর কেবল চোখে দেখে নয়, শুঁকেও অদৃশ্য কারুর উপস্থিতি বুঝতে পারে। নানান গন্ধের মধ্যেও নির্দিষ্ট কোনো গন্ধ আলাদা করে চিনতে পারে। যেমন বম্ব বা ড্রাগ ডিটেকশন স্কোয়াডের ট্রেইনড ডগ। বাঘার শরীরেও আছে সেই ল্যাব্রাডর রিট্রিভারের রক্ত। আবার কোনো বিশেষ গন্ধ - যেমন মনিবের শরীরের গন্ধ - বহুদিন সঞ্চিত থেকে যেতে পারে কুকুরের স্মৃতিতে। ফলে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর দেখা হলেও কুকুর তার মনিবকে চিনতে পারে, তবে শুধুই গন্ধের সাহায্যে নয়। কুকুর মানুষের মুখও মনে রাখতে পারে। কানের ক্ষেত্রেও তাই। পরিবেশের নানান আওয়াজের মধ্যেও কুকুর কিছু বিশেষ পরিচিত শব্দ - মনিবের কাশি, লাঠির ঠকঠক দুর থেকে শুনেও বুঝে ফেলতে পারে।
অতু উঠোনের সদর দরজার খিল খুব সন্তর্পণে খোলে। তাও খুট করে একটা মৃদু আওয়াজ হয়। বাঘা অঘোরে ঘুমোচ্ছিল বিশ ফুট দুরে বড় ঘরের ছাওয়ায় খিড়কির দরজার কাছে উঠোনে। চেনটা প্রথম দিনের মতো সেই জানলার গরাদে বাঁধা। তবু ঐ সামান্য আওয়াজেও ও শুয়ে শুয়েই মুখ ঘুরিয়ে তাকায়। দেখে অতু এগিয়ে আসছে ওর দিকে। শরীরে সদ্য ঘুমভাঙা আলস্য নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। যতই হোক প্রিয় বন্ধু কাছে আসছে, শুয়ে থাকা ভালো দেখায় না। অতু প্ল্যান অনুযায়ী বাঘার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে ওর মাথায়, গলায় হাত বুলোয়। তন্দ্রাজড়ানো চোখে অতুর কোলে মুখ ঢুকিয়ে আদর খায় বাঘা। মন্টু বেতালের মতোই নিঃশব্দে উঠোনে ঢুকে সাইকেলটা নিয়ে চলে যাচ্ছিল।
হঠাৎ বাঘা চনমন করে ওঠে। একটা ছোট্ট 'ভুক' করে আওয়াজ ছাড়ে। মন্টুর গন্ধ পেয়েছে। অতুর আদর করা হাত সরিয়ে ওর শরীরের পাশ দিয়ে মুখ বার করে দেখতে চায়। অতু দরজার দিকে আলগোছে একটু টেরিয়ে দেখে। মন্টু প্রায় পৌঁছে গেছে বাইরের দরজায়। কিন্তু অতু পাশ ফিরতেই দরজার দৃশ্যপট বাঘার দৃষ্টিতে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। মন্টু এ বাড়িতে আসে না। অতুর সাথে যত দোস্তি ওর বাইরে। তাই বাঘা মন্টুকে চেনেনা। ফলে অচেনা কেউ মনিবের সাইকেল নিয়ে চলে যাচ্ছে ওর পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল। বাঘা এবার জোরে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে।
প্ল্যান ভেস্তে যাচ্ছে দেখে অতু দিশাহারা হয়ে করে বসে এক চরম নির্বুদ্ধিতা। দুহাতের তালু দিয়ে বাঘার মোচার মতো লম্বাটে মুখটা চেপে ধরে যাতে ও চেঁচাতে না পারে। বাঘা চেপে ধরা মুখেই কয়েকবার দমচাপা আওয়াজ ছাড়ে। কিন্তু অমন পেল্লায় কুকুরের মুখ কোনো প্রাপ্তবয়স্কের পক্ষেই চেপে রাখা মুশকিল আর অতু তো ছেলেমানুষ। বাঘার জিনে সঞ্চিত বহু সহস্র বছরের পাশব প্রবৃত্তি সেই মুহূর্তে ভুলিয়ে দেয় ওর অর্জিত আনুগত্য বোধ।
এক ঝটকায় অতুর মুঠি থেকে মুখটা ছাড়িয়ে পেছনের দু পায়ে লাফিয়ে ওঠে বাঘা। সামনের উদ্যত দু পায়ের থাবা অতুর বুক বেয়ে নেমে আসে কোমর অবধি। আচমকা ধাক্কায় অতু পড়ে যায় মাটিতে। লাফিয়ে দরজার দিকে ছুটে যেতে চায় বাঘা। ঘচাং করে চেনটা জানলার গরাদে আটকে গিয়ে বিকট একটা আওয়াজ হয়। বাঘা গর্জন করতে থাকে উন্মত্তের মতো। শোভা গভীর ভাতঘুম ভাঙা জড়িত গলায়, কে রে? কি হয়েছে? বলতে বলতে বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে বারান্দায়। বাঘার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ও চেঁচানি শুনে সাইকেলটা দরজায় হেলান দিয়ে চোখের নিমেষে হাওয়া হয়ে গেছে মন্টু।
-১০-
সদ্য ঘুমভাঙা চোখে বাইরে এসে শোভা দেখেন অতু বাঘার চেনের নাগালের বাইরে উঠোনে বিমূঢ় হয়ে থেবড়ে বসে আছে। খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে বাঘা লাফিয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছে। ছুটে গিয়ে অতুকে মেঝে থেকে তুলে ধরতেই দেখেন মাটিতে বড় বড় তাজা রক্তের ফোঁটার দাগ। প্রবল উৎকণ্ঠায় শোভা চিৎকার করে ওঠেন, কী হয়েছে তোর? বিহ্বল হয়ে তাকায় অতু। নখের আঁচড়ে বুক পেট জ্বালা করছে। আস্তে আস্তে জামাটা বোতামমুক্ত করে। ফরসা বুকে পেটে কয়েক সারি সিঁদুরে দাগ। তাতে বিন্দু বিন্দু ঘামের মতো ফুটে উঠেছে রক্ত। কিন্তু তাতে তো উঠোনে অত রক্ত পড়ার কথা নয়। হঠাৎ চোখে পড়ে অতুর ডান হাতের কনুই দিয়ে টপ টপ করে বড় বড় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে মাটিতে। হাতটা সামনে আনতেই শোভা দেখতে পান কব্জির নীচের দিকে হাতে লম্বা একটা ক্ষত। সেখান দিয়েই গলগলিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। ঝটকা মেরে মুখ সরাতে গিয়ে বাঘার দাঁতেই কেটেছে। কিন্তু অতু তখন কিছু টেরই পায় নি। এখনও ওর কবজির ক্ষততে কোনো যন্ত্রণাবোধ নেই কিন্তু নখের আঁচড়ে বুক পেট জ্বলে যাচ্ছে।
হঠাৎ খিড়কির দরজায় দুম দুম করে ঘা পড়ে, বৌদি কী হয়েছে? দেবেনের গলা। থানারই এক যুবক কনস্টেবল। পাশেই ব্যারাকে থাকে। সবার চেনা। তখন ওর ডিউটি ছিল না। বেরিয়েছিল চা খেতে। বাঘার গর্জন ও শোভার আর্ত চিৎকার শুনে দৌড়ে এসেছে। অতুকে বারান্দায় বসিয়ে ছুটে গিয়ে শোভা খিড়কির দরজা খুলে হাঁউমাঁউ করে বলেন, দেবেন, অতুকে বাঘা কামড়ে দিয়েছে। দেবেন ছুটে এসে অতুর কবজি চেপে ধরে বলে, বৌদি শিগগির ডেটল, তুলো নিয়ে আসুন।
এইসব তৎপরতা দেখে বাঘা বোঝে পাহারাদারি করতে গিয়ে ক্ষণিকের উত্তেজনায় এবারেও কোনো গন্ডগোল করে ফেলেছে ও। বাপীকে চমকে উঠে কামড়ে দেওয়ার পরমুহূর্তেই ব্যাটপেটা খেয়ে ও চুপ করে দেওয়াল ঘেঁষে বসে পড়েছিল। একটু আগে এতো চেঁচাচ্ছিল কিন্তু এখন সবার ছোটাছুটি দেখে কারুর কাছে মার না খেয়েও ও হঠাৎ চুপ করে জানলার কাছে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভয়ে ভয়ে এপাশ ওপাশ দেখে। অতুও ঠুস মেরে গেছে। বাঘা যখন লাফিয়ে ওর গায়ে পড়েছিল তখনও ওর মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয় নি। অতু যতো না ভয় পেয়েছে তার চেয়ে ভীষণ অবাক হয়ে গেছিল। সেই মুহূর্তে বাঘাকে খুব অচেনা লাগছিল ওর।
বাড়িতে যতীনবাবু নেই। দেবেন গতবারে বাপীর ঘটনাটা জানে। দ্রুত দরজায় হেলান দেওয়া যতীনবাবুর সাইকেলে গিয়েই সেই ডাক্তারকে ডেকে আনে। সুব্রত মাস্টার, ডাক্তার, দেবেন ও যতীনবাবু প্রায় একই সময়ে ঘরে ঢোকেন। একটু পরে বাপী ও রীণাও চলে আসে স্কুল থেকে। শোভার মুখে সংক্ষেপে ঘটনা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। আবার বাঘা কামড়ে দিলো? অতুকে!
ডাক্তারবাবু অতুকে বলেন, বাঘা তোমায় কামড়ে দিলো কেনো? অতু বেজায় ঘাবড়ে গেছে। শিশু মনে মনে হয় মন্টুর কথা চেপে যাওয়াই ভালো। আমতা আমতা করে বলে, আমি একটু সাইকেল চালাতে যাচ্ছিলাম। দরজা খুলে বেরোনোর সময় হঠাৎ ও চেঁচাতে শুরু করলো। আমি সাইকেলটা দরজায় হেলান দিয়ে এসে ওকে আদর করে থামাতে গেলাম। না হলে মার ঘুম ভেঙে যেতো। হঠাৎ বাঘা কামড়ে দিল।
আগেরবার অতু প্রত্যক্ষদর্শীর বিবৃতি দিয়ে বাঘার দোষ লাঘব করেছিল। এবার ও নিজেই দোষী। ভয় পেয়ে সেটা স্বীকার করার সৎসাহস দেখাতে পারলো না। অন্য কোনো প্রত্যক্ষদর্শীও নেই যে সত্যাসত্য জানাবে। ফলে দোষটা গিয়ে পড়লো বাঘার ঘাড়ে। সবাই বাঘার দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকায়। ওর কি মাথায় কোনো গন্ডগোল আছে? প্রিয় সঙ্গীকে কেউ এভাবে আঁচড়ে কামড়ে দেয়? বাঘা জুলজুল করে সবার দিকে চোরের মতো তাকাচ্ছে। কোনোভাবে হয়তো উপলব্ধি করতে পারছে ব্যাপার সুবিধার নয়।
অতুর ক্ষতস্থান সেলাই করলেন না ডাক্তার। বললেন, দরকার নেই। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। কিছুদিন আগে যেমন বাপী পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে শুয়েছিল, আজ বড়ঘরের খাটে শুয়ে আছে অতু। ডাক্তারবাবু চিন্তিত মুখে যতীনবাবুকে বসার ঘরে ডাকেন। শোভাও আসে। তিনি বলেন, যতীনবাবু, আমি আবারও বলছি, বাঘার রেবিস হয়নি, কিন্তু ওর মতিগতি ভালো বুঝছি না। হয়তো ও একটু বদমেজাজি। কয়েকমাসের মধ্যে বাড়ির দুটো ছেলেকে এভাবে কামড়ে দিল। আজ চেন বাঁধা না থাকলে সাংঘাতিক কিছু হয়ে যেতে পারতো। এবার হয়তো কোনদিন রীণাকেও কামড়ে দিতে পারে। আগে যেখানে ও ছিল তারাও হয়তো এরকম কোনো কারণেই ওকে ইচ্ছে করে মেলার আশেপাশে ছেড়ে দিয়ে গেছে। না হলে বাড়ির কুকুর হারিয়ে কতদূর যাবে? তিনদিন ধরে মাইকে আপনারা ঘোষণা করলেন তাও কেউ নিতে এল না? ওকে আর বাড়িতে না রাখাই ভালো। যতীনবাবুর মেয়ে অন্ত প্রাণ। একদিকে সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা। অন্যদিকে অবলা পোষ্যপ্রীতি। ডাক্তারের কথায় খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন যতীনবাবু।
-১১-
দিন দশেক পর। অতুর হাতের ক্ষত সেরে গেছে। সেই ঘটনার পর যতীনবাবু ছেলেমেয়েদের বাঘার কাছে যেতে বারণ করে দিয়েছেন। কেবল শোভা দুবেলা খাবারের থালা ওর পাশে রেখে আসেন। বাটিতে জল দেন। যতীনবাবু ভাবেন ওকে তিনি এ বাড়িতে এনেছেন। ফলে দায়িত্ব ওনারই। তাই উনিই ওকে সকালে বাইরে নিয়ে যান প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। বাকি সারাদিন বাঘা ব্রাত্যজনের মতো উঠোনের এক কোনে বসে থাকে। এ কদিন ওর কোনো আওয়াজ শোনা যায় নি।
যতীনবাবু সেদিন বিকেলে বাড়ির সবাইকে ডেকে ঘোষণা করেন বাঘাকে আর এ বাড়িতে রাখা হবে না। অতুর বুকটা মুচড়ে ওঠে। ওর দোষেই বাঘার আবার দুর্গতি হতে যাচ্ছে। ও মিনমিন করে বলতে যায়, বাবা, ওর কোনো দোষ নেই, চেঁচাচ্ছিল বলে আমি ওর মুখটা চেপে ধরতে গেছিলাম বলে হয়তো...। কথা শেষ হয়না অতুর। প্রচন্ড জোরে গর্জন করে ওঠেন যতীনবাবু, কোনো কথা শুনতে চাই না, একদম চুপ করে থাকবে তুমি, বেয়াদব ছেলে কোথাকার। তোমাকে আমি নিজে বলেছিলাম আমার সাইকেলটাও চালাতে পারো, তবে বিকেল চারটের আগে নয়। তাও তর সইলো না? মা একা বাড়িতে ঘুমোচ্ছে আর তুমি চুপচাপ দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছিলে দুপুর রোদে সাইকেল চালাতে? তোমার মতো ছেলেকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া উচিত। কিছু বলি না বলে সাপের পাঁচ পা দেখেছো না?
ওদের বাড়ি কেতাদুরস্ত নয়। বাবা মা ওদের তুই তোকারি করেই কথা বলেন। কেবল কচিৎ কখনো রেগে বলে বাবা তুমি করে কথা বলেন। যেমন এখন বলছেন। অতু বাবাকে যমের মতো ভয় পায়। তাই একদম চুপসে যায়। বোঝে হাওয়া খুব খারাপ। যতীনবাবু বাঘা বিদায়ের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন। আজ রাত নটা নাগাদ উনি ওকে নিয়ে বাইরে গিয়ে চেন খুলে দেবেন। তারপর ঘরে চলে আসবেন। বাঘা ঢুকতে এলে কেউ যেন দরজা না খোলে। সবার বুক ফেটে যায় তবু এহেন কঠিন সিদ্ধান্তও সবাইকে মুখ বুঁজে মেনে নিতে হয়। যতীনবাবুর মুখের ওপর কথা বলার ক্ষমতা বাড়িতে কারুর নেই।
রাত আটটা নাগাদ শোভা ওর মুখের সামনে একথালা মাংসভাত রাখেন। যেমন দিয়েছিলেন প্রথম দিন নতুন অতিথির আগমনে। আজ দিলেন অতিথি বিদায়ের আগে, বড়াখানা। রান্নাঘরে গিয়ে পিঁড়িতে বসে নিঃশব্দে চোখে আঁচল চাপা দেন। সেদিন বাঘা খেয়েছিল গ্ৰোগ্ৰাসে। আজ খেল নিয়মরক্ষার খাতিরে। কোনো অজানা উপায়ে বাঘাও বুঝে গেছে এ বাড়ির পরিবেশ এখন আর ওর অনুকূলে নেই। নটা নাগাদ যতীনবাবু জানলা থেকে বাঘার চেন খুলে ওকে নিয়ে বেরিয়ে যান বাড়ির বাইরে। রীণা, বাপী, শোভা উঠোনে এসে দাঁড়ায়। অতু আসেনি। ও তখন খাটে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে।
এত রাতে ওকে নিয়ে কেউ বাইরে যায় না। তবু বাঘা কোনো আপত্তি করে না। বাধ্য ছেলের মতো যতীনবাবুর সাথে বেরিয়ে যায়। গরমকালের রাত। আকাশে ফুটফুটে জোৎস্না। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। যতীনবাবু ওকে নিয়ে কিছুক্ষণ গঙ্গার ধারে উদ্দেশ্যেবিহীন ঘোরাঘুরি করেন। সংকল্প করেও কাজে রূপান্তরিত করতে বুক মুচড়ে উঠছে। তবু করতেই হবে। চেনটা খুলে দেন। অন্য সময় চেন খুলে দিলে বাঘা উৎফুল্ল হয়ে খানিক ছোটাছুটি করে। আজ কিছুই করলো না। ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। যতীনবাবু হাঁটা লাগলেন বাড়ির দিকে। বাঘা কয়েক পা এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। যতীনবাবু একটু গিয়ে ফিরে দেখলেন। জোৎস্নার আলোয় দেখলেন বাঘা স্থির হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে আছে। ঐ আলোতে চোখ দেখা যায় না। কিন্তু না দেখেও অনুভব করতে পারলেন বাঘার মর্মভেদী দৃষ্টি।
বাড়ি ফিরে যতীনবাবু রাতের খাওয়া সারেন দায়সারা ভাবে। বাড়ি নিস্তব্ধ। কেউ কোনো কথা বলছে না। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। কারুরই ঘুম আসছে না। মাঝ রাতে দরজার বাইরে কুঁই কুঁই করে চাপা আওয়াজ পাওয়া যায়। বাঘা এসেছে। ঘরে ঢুকতে চাইছে। অতু তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে ছুটে যায় বারান্দায়। বাপী, রীণাও উঠে পড়েছে। ওঘর থেকে বেরিয়ে আসেন শোভাও। কিন্তু উঠোনে গিয়ে দরজা খোলার সাহস কারুর হয় না। এ ওর মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকায়। হঠাৎ কিছু কুকুরের সম্মিলিত চিৎকার শোনা যায়। ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। সেই মেলার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। খরখর করে দরজায় প্রবল নখ আঁচড়ানোর শব্দ হয়। বাঘা ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকতে চাইছে। ঈশ্বর, এ কি বিষম শাস্তি! বাইরে একার। ঘরে সবার।
হঠাৎ দরজায় নখের খড়খড়ানি বন্ধ হয়ে শোনা যায় তীব্র খেয়োখেয়ির আওয়াজ। নেড়িদের সম্মিলিত আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা যায় বাঘার ভারী গর্জন। হঠাৎ বাঘার আওয়াজ থেমে যায়। নেড়িদের সম্মিলিত চিৎকার দ্রুত সরে যাচ্ছে পশ্চিমে। অর্থাৎ শরণার্থী আশ্রয় না পেয়ে পালাচ্ছে। আর থাকতে পারে না অতু। ছুটে গিয়ে খিল খুলে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। মাঝরাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে কয়েকটা কুকুর ভয়ংকর চিৎকারে তাড়া করেছে বাঘাকে। পিছু নিয়েছে মেলার স্মৃতি। 'ক্ষেত্রবিশেষে পলায়নই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়' নীতি অবলম্বন করে লম্বা লম্বা লাফে স্ট্রিট লাইটের আলোয় হলদেটে ঝলক তুলে দৌড়ে পালাচ্ছে বাঘা। এখন ওর নাগাল পাওয়া নেড়িদের পক্ষে মুশকিল। নেড়ির দল থেকে দ্রুত ওর দূরত্ব বাড়ছে। ওদের এলাকার বাইরে নেড়িরা যাবে না। এযাত্রা হয়তো মানুষের সাহায্য ছাড়াই বেঁচে যাবে বাঘা।
-১২-
মাস দুয়েক পরের কথা। জুলাইয়ের শুরুতে এক রবিবারের বিকেল। মনোরম আবহাওয়া। বাপী গেছে কোথাও আড্ডা মারতে। রীণা গেছে পাশের কোয়ার্টারে। বিকেলের চা খাওয়া হয়ে গেছে। বারান্দায় বসে শোভা ও যতীনবাবু কিছু অলস গল্প করছেন। অতুকে শোভা এক গেলাস গরম দুধে বোর্নভিটা মিশিয়ে দিয়েছেন। দুধ খেতে খুব ভালোবাসে ছেলেটা। অতু মায়ের পাশে বসে সুক সুক করে দুধ খাচ্ছে। মন্টুর মা একটু আগে কাজ করে চলে গেছে। উঠোনের দরজাটা ভেজানো।
হঠাৎ দড়াম করে দরজা ঠেলে উঠোনে ঢুকে পড়ে বাঘা। এক পলকে পরিস্থিতিটা বুঝেই ছুটে এসে শোভার কোলে মুখ গুঁজে দেয়। ওর এখানে বসবাসকালীন অন্নদাত্রী। শোভা প্রচন্ড অবাক হয়ে, আরে বাঘা? তুই কোত্থেকে এলি? বলে ওর মাথায় হাত রাখেন। বাঘা আনন্দের আতিশয্যে ছটপট করে ওঠে। কী করবে ভেবে পায় না। পাশেই বসে যতীনবাবু। শোভাকে ছেড়ে বাঘা যতীনবাবুর কোলে মাথা ঘষে। একদিন আদর করে এনে অন্যদিন বেড়াল পার করেছেন ওকে। সে কথা মনে রাখেনি বাঘা। মানুষ হলে হয়তো উপকার ভুলে মনে রাখতো শুধু অপমান। ও মনুষ্যেতর প্রাণী। ওর গন্ধস্মৃতিতে শুধু সযত্নে রক্ষিত আছে আশ্রয়দাতার বদান্যতা। কিছু অভিমানের কারণ থাকলেও তার অভিঘাত ম্লান হয়ে গেছে সময়ের প্রলেপে।
এ সময় দরজায় মুখ বাড়ায় একটি বিচলিত মুখ। হয়তো বাঘা বর্তমানে এর জিম্মায় আছে। দেখেই বোঝা যায় সে বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে ছুটে এসেছে। কুকুরটা দরজা খোলা পেয়ে কার বাড়িতে ঢুকে কী উৎপাত করছে কে জানে। কিন্তু বাঘার রকমসকম, ওর পিঠে যতীনবাবুর পরম মমতায় হাত বোলানো দেখে লোকটি হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে। বোঝে কুকুরটা এ বাড়িতে বিশেষ পরিচিত।
বাঘা কাউকেই ভোলে নি। প্রাণভয়ে সেদিন আকুল হয়ে দরজা আঁচড়েছিল। তাও খোলেনি কেউ। বাঘাকে দেখেই সেই অপরাধেবোধের গ্লানিতে মলিন হয়ে গেছে অতুর শিশুমন। কিন্তু বাঘা বিনদাস। সে ছুটে আসে অতুর কাছে। অতু গ্লাস থেকে খানিক দুধ ঢেলে দেয় বারন্দার পরিস্কার মেঝেতে। বাঘা নিমেষে চকাস চকাস করে চেটে মুখ তুলে তাকায়। ভাবখানা, কী ভালো খেতে! আর নেই? খাওয়ার ওপর বাঘার কোনোকালেই অভিমান নেই। শরীরটা বড়। খিদে পায় খুব। এখন হয়তো ভালো করে খেতে পায় না। মোটা পাশবালিশের মতো চেহারাটা একটু রোগা হয়ে গেছে। অতু একটা বাটি এনে গ্লাসের বাকি দুধটা ঢেলে দেয়। বাঘা সটাসট খেয়ে নেয়।
অচেনা কাউকে তুমি বা আপনি - কী সম্মোধন করা সমুচিত, তা হয়তো মানুষটির চেহারা, পোষাক, বয়স, হাবভাব দেখে অজান্তেই মনে এসে যায়। লোকটার বয়স বছর তিরিশেক হবে, দীনহীন চেহারা, মলিন পোষাক, মুখচোখে কুণ্ঠা। যতীনবাবু বলেন, তুমি কে ভাই? লোকটা হাতজোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করে বলে, স্যার, আমার নাম সুলেমান, আপনি তো থানার মেজোবাবু, আপনাকে আমি চিনি। তাই টাইগার হঠাৎ এ বাড়িতে ঢুকে পড়তে আমি ভ্যান থামিয়ে দৌড়ে এসেছি। কে জানে যদি কাউকে কামড়ে টামড়ে দেয়, সেই ভয়ে।
যতীনবাবু সুলেমানের সাথে কথা বলে জানেন ও অবিবাহিত। বাড়ি কয়েক মাইল দুরে মানিকপুর। সেখানে আছেন শুধু ওর বাবা, মা। বাবা ছোট একটা চায়ের দোকান চালান। তাতে সংসার চলে না। তাই ও চলে এসেছে রাজগঞ্জে। পাইকারি বাজারে ভ্যানরিকশা চালায়। লরি থেকে আলু, পেঁয়াজের বস্তা নিয়ে আড়তে যায়। সেখান থেকে অর্ডার অনুযায়ী খুচরা দোকানে। রাতে আড়তের পাশেই ভ্যানে শোয়।
মাস দুয়েক আগে একদিন ভোরে উঠে দেখে এই কুকুরটা ভ্যানের তলায় শুয়ে আছে। যতীনবাবুর মতো সুলেমানও ওকে দেখেই বোঝে কারুর বাড়ির পোষা কুকুর হবে। কোনো কারণে বাড়িছাড়া। কেমন যেন ভয়ে কুঁকড়ে শুয়েছিল। সুলেমান আশ্রয় দেয়। সেই থেকে বাজারে সবার সাথে মিলেমিশে আছে। এখন আর ও কারুর একার নয়। তবু সুলেমানের কাছে প্রথম আশ্রয় পেয়েছিল বলে ওর একটু বেশী ন্যাওটা।
গলার বকলস খুলে দিয়েছে। ওদের আড়তে দু তিনটে নেড়িকুত্তাও সবার পোষ্য। এখন ওদের সবার সাথে টাইগারের ভাব হয়ে গেছে। সুলেমানরা যা খায়, ডাল, ভাত, রুটি, সবজি, নেড়িদের সাথে টাইগারও তাই খায় ও। ওকে মাংসভাত খাওয়ানোর সামর্থ্য ওদের নেই। তবে বাজারের মাংসের দোকানের চাচা ওর জন্য কিছু ছাঁট, টেংরি রেখে দেয়। বাজারের ভাতের হোটেলটা তাই দিয়ে ওর জন্য মাঝে মাঝে বানিয়ে দেয় টেংরির ঝোল। টাইগারের চেহারাটা বড়সড়। ওর মাঝে মাঝে ভালো খাওয়া দরকার ওরা বোঝে। সেই টেংরির ঝোলই সেদিন ওর মাংসভাত। চেটেপুটে খায় টাইগার।
এখানে থাকতে শোভা ওকে মাসে বার দুয়েক সাবান মাখিয়ে চান করাতেন। অতু চৌবাচ্চা থেকে বালতি বালতি জল ঢালতো ওর গায়ে। গা মোছানোর সময় বাঘা পটাপট পটাপট আওয়াজ করে দুপাশে দ্রুত মাথা ঘোরাতো। জল ছিটতো ফুলঝুড়ির মতো। অতুর খুব মজা লাগতো তাতে। খিলখিলিয়ে হাসতো। কাকভেজা হয়ে, লোম বসে গিয়ে বাঘাকে তখন গোবেচারার মতো লাগতো। বিকেলে শুকিয়ে গিয়ে উনি আবার হয়ে যেতেন ফুরফুরে ফুলবাবুটি। শোভা খেয়াল করেন বাঘার লোমের সেই জেল্লা কমে গেছে। বাজারে বারোভূতের কারবার। কে আর অতো যত্ন করবে ওর। যেখানে সেখানে শোয় হয়তো। গায়ে নানান দাগ। তবে বাঘার চোখমুখ আগের মতোই কথা বলে। তাতে বিষন্নতার লেশমাত্র নেই। শোভার মনে হয় বাড়ির চার দেওয়ালের আশ্রয় হারিয়ে খোলা বাজারেও বাঘা ভালোই আছে।
শোভা বলেন, ওর নাম টাইগার বুঝি? কে দিয়েছে? সুলেমান বলে আমিই দিয়েছি, কিরকম বাঘের মতো চেহারা না? শোভা আড়চোখে একবার অতুর দিকে তাকান। অতুর চোখেও একই ঝিলিক খেলে। ঠিক তখন খিড়কির দরজা খুলে উঠোনে ঢোকে রীণা। বাঘা ছুটে যায় ওর দিকে। মাস দুয়েক পর হঠাৎ দেখে ক্ষণিকের জন্য ওকে চিনতে পারেনি রীণা। মুখ দিয়ে ভয়ে আচমকা আওয়াজ বেরিয়ে যায়, ও মা গো! পরক্ষণেই চিনতে পেরে পরম বিষ্ময়ে, আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে, ওমা, তুই! বাঘার কিন্তু রীণাকে চিনতে অনুপলও লাগেনি। রীণার ফ্রকে মুখ ঘষে বাঘা আনন্দ প্রকাশ করে।
-১৩-
শোভার মুখে ‘বাঘাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ কাহিনী শুনে রীণা যতীনবাবুর কাছে আব্দার করে, বাঘাকে রেখে দাও না, বাবা। বাঘা তখন উঠোনের এপাশ ওপাশ, হাঁসের ঘর, সাদা ইঁদুরের ঘর শুঁকে বেড়াচ্ছে। যেন বিয়ের পর প্রবাসে চলে যাওয়া মেয়ে বহু বছর পর বাপের বাড়ি এসে এখানে ওখানে স্মৃতি খুঁজে বেড়াচ্ছে। দড়িতে ঝোলানো খাঁচার টিয়াটা উত্তেজিত হয়ে এপাশ ওপাশ করে ট্যাঁ ট্যাঁ করে চ্যাঁচাচ্ছে। তবে বাঘা ঢাকা বারান্দায় ওঠেনি। বসার ঘরেও যায়নি। কোনো অবোধ্য কারণে হয়তো ও বুঝেছে ওসব জায়গায় যাওয়ার অধিকার সে হারিয়েছে।
এমন মিলনদৃশ্য দেখে যুবক সুলেমানের চোখও ছলছল করে ওঠে। বুঝতে পারে ওদের টাইগার একদিন এ বাড়ীতে সবার খুব প্রিয় ছিল। তবে ও জানতে চায়নি আদরের বাড়ীর কুকুর সেদিন কেন অনাদরে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শুধু বলে, স্যার, আপনারা ওকে ইচ্ছে হলে রেখে দিতে পারেন। দিদিমণিও যখন চাইছেন। ওর মতো ভালো জাতের কুকুর হয়তো আপনাদের কাছেই ভালো থাকবে। আমি না হয় মাঝে মধ্যে এসে ভ্যানে করে ঘুরিয়ে আনবো ওকে।
যতীনবাবু ম্রিয়মাণ কণ্ঠে স্বগতোক্তির মতো মাথা নেড়ে নেড়ে মেয়েকে বলেন, তা আর হয় না রে মা। শুনলি না, আমাদের বাঘা এখন ওদের সবার টাইগার। ওকে আমরা রেখে দিলে ওদের মন খারাপ লাগবে যে। মুখে ওসব বললেও সুলেমানের অনুক্ত মনোবাঞ্ছাও অবশ্য তাই। কুকুরটা রোজ রাতে ওর পাশে ভ্যানে উঠে শুয়ে থাকে। এ একটা বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখানে থেকে গেলে ভ্যানের পাশে খালি জায়গাটার মতো ওর মনটাও ফাঁকা লাগবে। ও ভদ্রতার খাতিরে টাইগারের ভালোর কথা ভেবেই কথাটা বলেছিল। মেজবাবু রাজি হয়ে গেলে নাও করা যেতো না। যতীনবাবুর চাপা দীর্ঘশ্বাসের সাথে অরাজি হওয়া সুলেমানকে আশ্বস্ত করে।
শোভার সেলাইয়ের হাত ভালো। এ বাড়ীতে থাকার সময় তিনি শীতকালে বাঘাকে পরানোর জন্য যতীনবাবুর বাতিল উর্দি দিয়ে একটা জামার মতো বানিয়েছিলেন। সামনে ও পিছনের পায়ের মাঝে শরীরের অংশটুকুতে পেটের তলা দিয়ে নিয়ে এসে পিঠে বোতাম আটকে দিলে দিব্যি আটকে থাকতো। কুকুরের পেটেই বেশী ঠান্ডা লাগে। বাঘার হলদেটে রঙের সাথে খাঁকি রঙটাও বেশ মিলে যেতো।
শোভা উঠে গিয়ে ঘর থেকে সেটা এনে সুলেমানের হাতে দেন। খোলা জায়গায় শীতকালে কাজে দেবে। সুলেমান জোড়হাতে সেটা নিয়ে কপালে ঠেকায়। বোঝে এর সাথে শোভার গভীর মমতা জড়িয়ে আছে। যতীনবাবু সুলেমানের হাতে একশোটা টাকা দেন। তখন একশো টাকার মূল্য অনেক। খাসির মাংস তখন মোটে সাত টাকা কিলো। বলেন, তোমরা সকলে মিলে একদিন ভালো করে মাংসভাত খেয়ো। তোমাদের টাইগারকেও খাইয়ো। বেচারা মাংসভাত খেতে খুব ভালোবাসে।
সুলেমান বিনীতভাবে শরীর ঝুঁকিয়ে নমস্কার করে বেরিয়ে যায়। পিছু পিছু পা ঘষে ঘষে যায় বাঘা। মাঝে মাঝে ঘুরে ঘুরে তাকায়। সুলেমান সীটে উঠে প্যাডেলে পা দেয়। বাঘা অভ্যস্ত ভঙ্গিতে লাফিয়ে ওঠে ভ্যানের পিছনে।
রবিবার বিকেলে আড়ত বন্ধ বলে ও টাইগারকে নিয়ে গঙ্গার ধারে এসেছিল একটু হাওয়া খেতে। তা যে এভাবে এক পূনর্মিলন অধ্যায়ে পর্যবসিত হবে কে জানতো। কালো ঘেঁষ ফেলা রাস্তায় আস্তে আস্তে ভ্যান চালিয়ে চলে যাচ্ছে সুলেমান। হিস মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরটার মতো ভ্যানের পাটাতনে বসে বাড়ীর দিকে তাকিয়ে আছে টাইগার। সবারই মন খারাপ লাগছে। অতুর বুক ফেটে কান্না আসছে। মায়ায়, গ্লানিতে। ওর দোষে বাঘাকে চলে যেতে হোলো।
এই রাস্তা ধরেই এক বিকেলে জীপের পিছনে বসে গলায় চেন বেঁধে এ বাড়িতে এসেছিল অপরিচিত বাঘা। এই রাস্তা ধরেই সেদিন মাঝরাতে প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়েছিল গলা থেকে চেন খুলে খেদিয়ে দেওয়া বাঘা। আজ সেই পথেই ভ্যানে করে চলে গেলো টাইগার। আজ ওর গলায় নেই বকলস, নেই চেন। ওসব আর পরার, খোলার কোনো দায় নেই ওর। ও এখন মুক্তবিহঙ্গ। মানুষের আশ্রয়ে প্রিভিলেজড্ ক্লাস হিসেবে থাকেনা বলে ওর ক্ষীণকায় স্বজাতিরাও আর ওকে দেখে তেড়ে আসে না। চেহারায় বড়সড় হলেও বাঘাকে ওরা ওদেরই একজন ভাবে। এসব বাঘা থেকে টাইগারে উত্তরণের ফল। বাঘার পক্ষে এ ভালোই হোলো। আর ওকে বাড়ির আশ্রয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে হবে না। নিরাশ্রয় হওয়ার সম্ভাবনাও আর নেই।
পুনশ্চঃ-
বাঘার সেই কামড়ের দাগই পরে অতুর পাসপোর্টে আত্মপরিচয়ের চিহ্ন বা Personal Identificatiin Mark হয়ে রয়ে গেছে। বাঘা ধরাধামে না থাকলেও পঞ্চান্ন বছর পরেও ঐ দাগ দেখলে অতুর মনে পড়ে যায় বাঘার কথা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।