মানুষ আসলে বড্ডই বিভ্রান্ত।
সে চায় তার জীবন হবে চেনা ছকের, পরিচিত গন্তব্যের। দিনযাপন চলবে প্রত্যাশিত ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করেই; নিশ্চিন্ততার অভিমুখ বরাবর। অথচ অপ্রত্যাশিতের উপর তার ভীষণ লোভ। সীমিত ক্ষমতা নিয়েও বাধ্য গণ্ডির মধ্যে সে যেমন দাপিয়ে বেড়াতে চায় নিজ ঐশ্বর্যে, আবার তেমনি নতুন এবং অপরিচিতের প্রতিও তার জন্মান্তরের ছোঁকছোঁকানি। মানুষ চায় তার প্রেডিক্টেবল জীবনে মাঝেমধ্যে ঝোড়ো হাওয়ার মত এক ঝলক আনপ্রেডিক্টেবিলিটি ঢুকে তাকে কাঁচা সুখ দিয়ে যাক। বিপদ বাঁচিয়ে সে চেখে নেবে স্বাদ, দুলিয়ে নেবে ভিতর বাহির। আপাদমস্তক রোমাঞ্চ জাগিয়ে তারপর না হয় দিব্যি ঢুকে পড়া যাবে নিশ্চিন্ততার চিরকেলে আস্তানায়।
মানুষ নিজে অবশ্য বেহদ্দ রকমের প্রেডিকটিবল। তার স্বভাবই হল সব কিছুতেই মানে খোঁজা। সে এই বিশ্বাস নিয়েই জীবন পার করল যে সবেরই মর্মার্থ থাকা বেশুমার জরুরি। সে যে তুচ্ছ, র্যান্ডম ইভেন্টের কিছু বাই-প্রোডাক্ট মাত্র এই দুঃসাহসিক ভাবনার মধ্যে যেমন গ্লানি রয়েছে কিছু, তেমনি লুকিয়ে আছে প্রভূত নিরাপত্তাহীনতা, আর নিশ্চিহ্ন হওয়ার দূরবর্তী সম্ভাবনাও। মানুষ তো ঠিক এর উল্টোটাই চেয়েছে – তাই না? সে নিরন্তর লেগে থেকেছে নিরাপত্তার খোঁজে। চেয়েছে ঝাড়েবংশে টিকে থাকতে। সংখ্যায় বাড়তে, শ্রীবৃদ্ধি করতে, সমৃদ্ধি পেতে। তাৎপর্য খোঁজার এই দীর্ঘ অভিযানে নেমে মানুষের সব চেয়ে বড় শত্রু ছিল র্যান্ডমনেস। জাগতিক বিশৃঙ্খলা। সে বাস করতো এমন এক পৃথিবীতে যার উপর তার ন্যূনতম কর্তৃত্ব নেই তখন। নেই তিল পরিমাণ নিয়ন্ত্রণও। মানুষের দৈনন্দিনতা আসলে পারিপার্শ্বিক বিশৃঙ্খলারই প্রতিরূপ একথা মানতে তার কিছু অসুবিধা ছিল বৈকি। আদতে মানুষ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিরিখে চিরকালই একেবারে কোণঠাসা। তাই মানুষ সবার প্রথম এই বিপজ্জনক সত্যিটাকেই আপাদমস্তক গোর দিতে চেয়েছিল। চেয়েছিল অভয়ের পালে একটু বেপরোয়া বাতাস খেলাতে। বাঁচোয়া! সেই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে মানুষের হাতে এলো এক বিস্ময়কর হাতিয়ার- গল্প!
‘কেন’ প্রশ্নটা যেখানে অনিবার্য অপরিহার্য অন্তহীন, সেখানে গল্পের মত স্বস্তিদায়ক জোড়াতালি পেয়ে মানুষ বেহদ্দ খুশি হবে তাতে আর অবাক কি। র্যান্ডম কে যতটা ঘৃণা করেছে সে, বুকের নির্যাস দিয়ে ততটাই আরাধনা করেছে প্যাটার্ন বা ছাঁচকে। তাই ছন্দের প্রতি মানুষের আজন্মলালিত প্রেম। মিল খুঁজে পাওয়াতে যে নিষিদ্ধ সুখ সে খুঁজে পায় তার সমতুল আর কিছুর অস্তিত্ব এ ব্রহ্মান্ডে মেলা দুষ্কর। কাজেই নিয়ম নিষ্ঠতার আইনে মানুষ তার পারিপার্শ্বিককে বাঁধতে চাইবেই শক্ত করে। ঘটনার পরিণতি কী হবে তার আন্দাজ করতে আগেভাগেই চালাবে ডুবসাঁতার! খুঁজে নেবে কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি।
মানুষ যেসব আখ্যান শুনতে আগ্রহী তার গড়ন বেশ পরিচিত, সহজে অনুমানযোগ্য। পরিণতি আশাব্যঞ্জক এবং অবশ্যই স্বস্তিদায়ক। মরণের পর ঘটনাপ্রবাহর রূপরেখা তাই সে আগাম লিখে ফেলে সুবিধাজনক ছাঁচে। বলে দেয় খেলার ছলে। গল্প এমনই কিছু আরামদায়ক অনুভূতির যোগফল যাতে মানুষ মনে করতে বসে পারিপার্শ্বিকের উপর তার নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে কিছু,কর্তৃত্ব এসেছে প্রভূত। দূর ও সন্নিহিত যেন বশ মেনেছে আরও খানিকটা। গল্পের প্রেক্ষাপটের মধ্যে তীব্র আবেগ, দুর্দমনীয় অনুভূতির কামড় সে সহ্য করে কারণ জানে রেজোলিউশন দ্বন্দ্বকে পিছু ধাওয়া করবে। ঝড় থেমে প্রত্যাশিত শান্তি নেমে আসবেই।
গল্প যুগ যুগান্তরের। প্যালিওলিথিক গুহাচিত্রই বোধহয় মানুষের প্রথম প্রামাণ্য গল্প। সেই ছবি থেকে আন্দাজ হয় মানুষের গল্পের বিষয়বস্তু ছিল ভয়, আকাঙ্ক্ষা এবং প্রার্থনা। যে পশুর শিকার সব চেয়ে বিপজ্জনক ছিল তারই ছবি আঁকতে বসেছে মানুষ। যে পশুর শিকার করতে চেয়েছে এঁকেছে তার ছবিও। সে মনে করেছে এই ছবিই নির্ঘাত বদলে দিতে পারে তার অদৃষ্ট। আর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা প্রতিবন্ধকতাও তখন বনে যাবে কলের পুতুল।
মানুষ আদপে তো হোমো ন্যারেটিভাস। আখ্যান তার শিরায় শিরায়। গল্পই তার দিবারাত্রির আরাধ্য। তাই শুধু গল্পের ছলে সূত্র বলা নয়, গাণিতিক সমীকরণ এবং অ্যালগরিদম দিয়েও কৌতূহলের সার্বজনীন গল্পই রচনা করে মানুষ। দেখাতে চায় আনপ্রেডিক্টবল মাত্র কয়েকটা যতি চিহ্নে কেমন ঝুলিবন্দি করা যায়।
গল্প নিঃসন্দেহে অসীম ক্ষমতা ধরে। সময়, ভাষা ও সংস্কৃতির বেড়াও টপকে যায় অনায়াসে। অতিক্রম করে দুরূহ সব বাধা বিপত্তি। সামাজিক প্রাণী হিসেবে মানুষ ইতিহাসে প্রোথিত রয়েছে বহুযুগ। গল্প সেই সমাজবদ্ধ প্রাণীরই বিক্ষিপ্ত ভাবনার অনুরণন, যা দিয়ে সে জীবনের অর্থ খোঁজে, নিজেকে বোঝে – অন্যকে বোঝায়, একাকীত্ব ঘোচাতে চায়। লিখতে চায় জীবনবোধের একটা আস্ত ম্যানুয়াল। আমরা সেগুলোকে ডাকি রূপক বা আখ্যান, পুরাণ, আর্কিটাইপ, মানচিত্র এমনকি ইকুয়েশন বলেও।
মগজ কীভাবে গল্প তৈরি হয় তা একবার দেখে নেওয়া যাক। ই.এম. ফরস্টার তাঁর অ্যাসপেক্টস অফ দ্য নভেল-এ একটা মজার উদাহারন দিয়েছেন: “রাজা মারা গেলেন এবং তারপরে রানী মারা গেলেন।”
রাণী কেন মারা গেলেন তা না ভেবে এই ঘটনাগুলোর সংমিশ্রণ পড়া প্রায় অসম্ভব। এই বাক্যে ঘটনার ন্যূনতম বর্ণনা থাকলেও, বাক্যটির নির্মাণ এমনই যে তা আমাদের চেতনায় একটা প্যাটার্ন রচনা করে। কেন লেখক একই বাক্যে উভয় ঘটনা উল্লেখ করবেন যদি তিনি কার্যকারণ সম্পর্ককে বোঝাতে না চান?
একটা বাক্যে যখন কোন সম্পর্কের ইঙ্গিত দেওয়া থাকে, তখন আমাদের ডিডাক্টিভ স্কিল কাজ করতে শুরু করে। সেই বাক্য লব্ধ জ্ঞানের দিকে নিক্ষিপ্ত করে আমাদের। মগজের তথ্যভাণ্ডার থেকে আমরা পেড়ে আনি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত। যেমন প্রচলিত জ্ঞানে একজন স্ত্রী তার স্বামীর শোকে বিহ্বল হয়ে মারা গেলেও যেতে পারেন। সুতরাং রানী নিশ্চয় মারা গেছেন রাজার মৃত্যু শোকেই। গল্প এভাবেই নির্দ্বিধায় ডালপালা মেলে দেয়।
পঞ্চাশের দশকে অ্যালান টুরিঙদের জামানায় মানুষ মনে করতো বুদ্ধিমত্তা বা ধীশক্তি স্রেফ সিম্বোলিক রিজনিংয়ের প্যাঁচ - যা মানুষকে তার প্রাইমেটদের চেয়ে এক ধাক্কায় বিবর্তনের অনেকগুলো ঘাট পার করে দিয়েছে। নিয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে বিবর্তনের শীর্ষে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বাড়বাড়ন্তে অবশ্য একটু বেজোড় ভাবনাতেই আস্থা রাখলেন প্রবাদপ্রতিম নিউরাল সায়েন্টিস্টরা। তাঁরা বললেন সিম্বোলিক রিজনিং নয়, বরং তার বাই-প্রোডাক্ট গল্পই হল মানব বুদ্ধিমত্তার একমাত্র চাবিকাঠি। মানব অস্তিত্বের একেবারে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে রয়েছে ওই গল্পের আবডালেই। বিবর্তনের ধারাক্রমে মানুষ রপ্ত করেছে বর্ণনার এক আশ্চর্য ক্ষমতা যা দিয়ে সে পর্যায়ক্রমে নিত্যনতুন আষাঢ়ে গল্প গাঁথে। শিম্পাঞ্জি এবং নিয়ান্ডারথালদের টেক্কা দিয়ে মানুষ থানা গেঁড়ে বসে যায় ইভল্যুশনের সবচেয়ে উঁচু বেদিতে।
গল্প বলতে পারে মানুষ কারণ অতীত কে সে খুঁড়তে জানে। কল্পনা করতে পারে ভবিষ্যতের খোলনলচে। অতীতের ধূপছায়ায় মানুষ সমান্তরাল ভবিষ্যৎ আঁকে আবার কখনো অতীতকে আরও দূরে ঠেলে নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। হোক সে যতই বিষম বেমানান বিরল। তবে গল্পের এই বাড়বাড়ন্ত থাকতই না, যদি না মানুষের সাথে সাথে ভাষারও তুল্যমূল্য বিবর্তন চলত।
ভাষাকে মানুষ কী ভাবে কোলেপিঠে বড় করল তা নিয়ে কিছু তাক-লাগানো অনুমান করেছিলেন রবার্ট বারউইক এবং নোয়াম চমস্কি। যুক্তি দিয়েছিলেন ভরপুর। তাঁরা বললেন ভাষার ক্রমবিকাশ হয়েছে যোগাযোগের শুধুই একটি হাতিয়ার হিসাবে নয় বরং অভ্যন্তরীণ চিন্তার প্রতিফলনের দরুন। ভাষা আদৌ উচ্চারণের অর্থ নয়, বরং ঠিক উল্টো অর্থের উচ্চারণ। তাঁরা দেখালেন মানুষই একমাত্র প্রজাতি যারা “merge” নামের একখানা চমৎকারী কগনিটিভ স্কিলের খোঁজ পেয়েছে।
একটা উদাহারন খাড়া করা যাক। “বিস্কুট” আর “খাওয়া” একেবারে পৃথক দুটো শব্দ। শুধু পৃথক শব্দই নয়, দুটো বিচ্ছিন্ন ধারণাও বটে। এর সাথে “অমলকান্তি”, মানে আরও এক পারস্পর্যহীন ধারণাকে জুড়ে দিয়ে তৈরি করতে পারি সম্পূর্ণ নতুন এক অর্থপূর্ণ ধারণা “অমলকান্তি বিস্কুট খেয়েছিল”। শ্রেণীবদ্ধ ধারণার এই প্রক্রিয়াকে চালিয়ে নিয়ে গেলে, বলাই বাহুল্য, আরও অনেক জটিল যৌগিক নিগূঢ় অর্থের জন্ম দেওয়া যায়। বারউইক-চমস্কির থিওরি অনুযায়ী ভাষার কেন্দ্রীয় এবং সার্বজনীন বৈশিষ্ট্যই হল এই “merge”। গল্পের শুরুওয়াতও ঠিক এভাবেই।
মার্জ হাইপোথিসিস যদিও দক্ষতার সাথেই ব্যাখ্যা করে কীভাবে গল্প তৈরি করে মানুষ, তবে ‘গল্প কেন’ এই প্রশ্নের সদুত্তর সে দেয় না। সমসাময়িক গবেষণা থেকে উঠে এসেছে গল্প আদপে একটা evolutionary process যা আমাদের পূর্বপুরুষদের বেঁচে থাকতে মদত যুগিয়েছিল। সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজিকে ধারালো করেছিল কয়েকশো গুণ। আশু বিপদকে গল্পের মোড়কে আগাম জানান দিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছিল বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। আমি যদি বলি, “ওই গাছের গোড়ায় গোখরো আছে, তাই ওদিকটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো” এই সতর্কীকরণ যতটা না কার্যকর বরং তার চেয়ে যদি বলি, “আমার এক পরিচিত ওই গাছের গোড়ায় সাপের কামড়ে গতকাল মারা গেলেন” এই বার্তার ওজন উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
মাইগ্রেশন আর ন্যাভিগেশন ছিল আদিম মানুষের ছায়াসঙ্গী। চারদিগরের ইঞ্চি ইঞ্চি তাকে ঢুঁড়ে ফেলতে হয়েছিল প্রয়োজনের বেসামাল তাড়নায়। উঠে যেতে হত নিশ্চিত আস্তানার নিরাপত্তা ছেড়ে। আবার নতুন করে বাঁধতে হত ঘর। আধুনিক পৃথিবী মনে করছে গল্প তৈরির প্রেরণা মানুষ পেয়েছে তার সেই নেভিগেশনের পেল্লায় তাগিদ থেকেই।
হিপ্পোক্যাম্পাস, মস্তিষ্কের এমন এক সংবেদনশীল অঞ্চল যা অতীতকে ধরে রাখে, ভবিষ্যতকে অনুমানের আওতায় আনে। সেই হিপ্পোক্যাম্পাসেই আবার স্পেস বা স্থান সম্পর্কিত বিস্তারিত ধারণাও তৈরি করে মানুষ। রাস্তাঘাটের নকশা তৈরি হয় নিরন্তর। সেই খসড়া আওড়াতে আওড়াতেই নেভিগেট করে গন্তব্যে পৌঁছয় আমরা। গল্পও খানিক রাস্তার মতই। মোড়ের মাথায় কনফ্লিক্ট –দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ লড়াই। তাই আগেভাগেই ওসব জানা থাকলে সংঘাত এড়িয়ে গন্তব্যের রেজোলিউশনে পৌঁছনর সম্ভাবনা বাড়ে বৈকি। গল্প ছাড়া আর কিই বা পারে মানুষকে সেই সমূহ বিপদের খুঁটিনাটি বাতলাতে।
নৃতাত্ত্বিক মিশেল সুগিয়ামা একবার বছরখানেক কাটালেন যাযাবরদের মৌখিক ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করতে বসে। দেখা গেল সারা বিশ্বের সংস্কৃতি জুড়ে গল্প এবং নেভিগেশনের মধ্যে আশ্চর্য সংযোগ, তুমুল যোগাযোগ। আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকশো উপজাতির প্রায় কয়েক হাজার গল্পের বিশ্লেষণে মিলল অপ্রত্যাশিত এবং অভিনব ফলাফল। সব গল্পেরই প্রায় নব্বই শতাংশ জুড়ে উপচে পড়ছে টপোগ্রাফিক তথ্য – রাস্তাঘাট, ল্যান্ডমার্ক, জলাশয়, গাছপালা, রাত কাটানোর মত নিরাপদ কোন ছাউনি এবং সম্ভাব্য বিপদের হালহকিকত। সুগিয়ামা লিখলেন মানুষের মন প্রাথমিকভাবে প্রস্তুত হয়েছিল স্পেসকে এনকোড করতে। টপোগ্রাফিক(স্থান বিবরণ সম্বন্ধীয়) তথ্যকে সামাজিক তথ্যে রূপান্তরিত করে তা গল্পের আকারে চালান করার মৌখিক উপায় বের করেছিল মানুষ। বেঁচে থাকা এবং প্রজননের মত গুরুতর বিষয়ের তথ্য সংরক্ষণ এবং সেই তথ্যকে বংশানুক্রমে জিইয়ে রাখার বাহন হিসাবে কাজ করে গল্প।
একইভাবে, ভাষাগত নৃতত্ত্ববিদ কিথ বাসো ‘উইজডম সিটস ইন প্লেসেস’ লেখার সময় অ্যাপাচি উপজাতিদের সাথে নিবিড় ভাবে মেলামেশা করেছিলেন। তাঁর কিছু অবাক করা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয় সেইসময়। তিনি লক্ষ্য করতেন অ্যাপাচিরা প্রায়শই ক্রমানুসারে বিভিন্ন জায়গার নাম উল্লেখ করে যায়, ঠিক যেন জায়গার নাম সম্বলিত একটা তালিকাকে আগাপাশতলা আউরে যাওয়া। এক অ্যাপাচি কাউবয় বাসোকে বলেছিল এটা কিছুটা হলেও মনে মনে একটা অভিযানের পুনঃনির্মাণ করা, যেন সে সত্যিই ওই রাস্তা বরাবর ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে। আশ্চর্য হওয়ার মতই বিষয় বটে!
গল্প কী এবং কেন, সে নিয়ে শতাব্দী জোড়া বিতর্ক চলতেই পারে, তবে গল্প যে মূলত উপলব্ধির সংকলন তা নিয়ে নেই তিলমাত্র ধন্দ। অবশ্য সেই উপলব্ধির খুব সামান্যই চাক্ষুষ, বাকিটা বিবর্তনজাত। চোখ মূলত দেখে না, পুরনো অভিজ্ঞতাকে নতুন করে যাচাই করে মাত্র। অনুমান এবং প্রত্যাশার এক অদৃশ্য ছাঁকনি ঠিক করে দেয় কতটা খেয়াল করবো, আর কাকেই বা লক্ষ্য করবো। মণিতে স্থির হবে কতটুকু ছবি। চোখ খোলা থাকলেই সামনে যা আলগোছে পড়ে আছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এলোমেলো, তার সবটা প্রত্যক্ষ করছি এমনটা নিশ্চয় নয়। বরং সেগুলোই দেখছি যা অতীতে কোনোভাবে প্রয়োজন হয়েছিল, বা ভবিষ্যতে যা আমার অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে পারে। যেমন নিশুতি রাতে আলোআঁধারি রাস্তায় পড়ে থাকা অচেনা ছায়া। সেও তো প্রতিফলনেরই খেলা। হতেই পারে তা মরণ ফাঁদ, হতে পারে কোন বিপজ্জনক গর্ত, নয়তো স্রেফ ছায়াই। তাও সে ছায়া আমি এড়িয়ে যাই, কারণ বিবর্তনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আমার অবচেতনকে প্রস্তুত করেছে সেভাবে। শিখিয়েছে সাবধান হতে। গল্প শুনিয়েছে সারভাইভালের। আমাদেরই কোনো অগ্রজ হয়তো হারিয়ে গিয়েছিলেন এমনই কোন মরণফাঁদে। বেঁচেছিলেন যিনি, তিনি পরের প্রজন্মকে শোনালেন তাঁর বেঁচে ফেরার লোমহর্ষক গল্প। সেই গল্পের প্রতিধ্বনি আমারই কানে এসে পৌঁছল।
আর সেই জাগতিক উপলব্ধির অনুরণন গল্পেরই প্রতিচ্ছবি করে শুনিয়ে গেলাম আমি আমারই পরের প্রজন্মকে।