তীক্ষ্ণ, রুক্ষ , বিক্ষুব্ধ — এভাবেই হয়ত মনে রাখব তাঁকে। বদ্ধ ঘরের জানালা খুলে দেওয়ার অনিবার্যতা, নতুবা বৈশাখী ঝড়ের আকস্মিকতায় — আপাদমস্তক প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েও তিনি ফিরে আসবেন চর্চায়। পোকায় কাটা কাব্যগ্রন্থের ভাঁজ খুলে ধুলো ঝেড়ে কুড়িয়ে নিতে হবে একটা দুটো স্পর্ধা। দুর্গম অরণ্য, গভীর সমুদ্র, নির্জন পাহাড় — এসব ধ্যানগম্য ছবি বড় একটা আঁকা হয় নি তাঁর কবিতায়। সেখানে বরং বিক্ষুব্ধ মিছিলে হেঁটেছিল উলোঝুলো প্রতিবাদী। ঘাম শ্লেষ্মা রক্তে লেখা অল্প পরিসরের মহাকাব্যে জায়গা করে নিয়েছিল গুটিকতক নিষিদ্ধ ইশতেহার।
নজরুল এসেছিলেন একবারই। উত্তপ্ত নিশ্বাস, রক্তচক্ষু, আর বাঁধ না মানা তেজ নিয়ে। যেভাবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসে উন্মত্ত ঝর্ণা, যেভাবে কক্ষপথ ছেড়ে ধেয়ে আসে উল্কা, কিংবা কামানের শরীর ঝাঁকিয়ে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে নিক্ষিপ্ত গোলা। জ্যৈষ্ঠের নিদাঘে এসেও শ্রাবণের মহাপ্লাবনই ছিল তাঁর ভবিতব্য। আগুন ডানায় পাক খেতে খেতে তীক্ষ্ণ চিলের মতই নেমে এলেন তিনি। ঔদ্ধত্য, স্পর্ধা আর রুক্ষতার মিশেলে। সভ্যতার আকাশে এভাবেই তো আসেন ধূমকেতুরা।
পুরো একটা জাতির শিরদাঁড়া তিনি। যন্ত্রণার ধারাবাহিকতার মধ্যেও বাজারী চাহিদাকে রদ্দা মেরে, সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যের পিঠোপিঠি পঙক্তি সাজিয়ে চলা এক মগ্ন কারিগর। ব্যক্তি বয়ানকে পিছনে ঠেলে ধারালো থুতনি উঁচু করে থাকা এক বিরাট সমষ্টির কণ্ঠ। গতিশীল জনপ্রিয়তা আর দার্শনিক কৌলীন্য এই দুইয়ের একটাকেও অর্জন করার দিকে, কী আশ্চর্য, তিনি ঝুঁকলেনই না মোটে! সব বিতর্ক পেরিয়ে , যাবতীয় বিবাদ বাঁচিয়ে তাঁর যেমন জনপ্রিয় হওয়ার দায় ছিল না কোনও, তেমনই বিনম্র হৃদয়ের বাবুটি বনাতেও ঝোঁক ছিল না বিশেষ। বরং তাঁর রক্তকণিকায় ফুটছিল বেপরোয়া আর বাউণ্ডুলে হওয়ার উপকরণ। কোন মহল কোন শিবিরে তাঁর সৃষ্টি বিরূপ প্রতিচ্ছবি ফেলছে, কেই বা তাঁকে টেনে তুলছে পরিণতি বোধের দাঁড়িপাল্লায়, এসব আলোচনায় তাঁর হাই উঠল বরাবর , শরীর মুচড়ে আড়মোড়া ভাঙলেন কবি। জনপ্রিয়তাকে ধাওয়া করলেন না, তবুও তিনি লোকপ্রিয় হলেন।
প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা যেভাবে প্রত্যাঘাত করেছে, সেটাকেই নজরুল শব্দের স্বচ্ছন্দ গতিতে রূপান্তর ঘটিয়ে গেছেন বরাবর, কিছুটা একবগগা এবং ছেলেমানুষের মতই। গূঢ় দর্শন তাঁর লেখার বাঁধনহারা উচ্ছলতায় খাদ মেশায় নি কখনও, তেমনই পুনরাবৃত্তিও পিছু ছাড়েনি। নজরুল ঠিক এখানেই স্বেচ্ছাচারী অসংযমী অসচেতন, এবং তাঁর সৃষ্টির অনেকাংশই গভীর ভাবলোকে অনুত্তীর্ণ। তবে ওই ঐচ্ছিক খামতিগুলোই কি তাঁকে অনন্য করেনি? তিনি তো একাই হয়ে উঠেছেন একটা ঘরানার আদি ও অন্ত। পূর্ব ও উত্তরসূরি না থাকা এক অদ্বিতীয় ধারা। এমনই এক তেজস্ক্রিয়তা, অর্ধ জীবনকালের সূত্র মেনে যার ফুরিয়ে যাওয়াটা নির্ধারিত। সেই ফুরিয়ে যাওয়াতেও অবশ্য তাঁর মস্ত সাফল্য।
নেহাত উত্যক্ত করতে চাওয়া ঘোর সমালোচকরাও তাঁকে লুকিয়ে পড়ার সময়ও গায়ে কাঁটা খেতেন, শিরদাঁড়ায় চমক খেয়ে সোজা হয়ে বসে চেটে নিতেন শুকনো দু-ঠোঁট। তারপর শনিবারের চিঠিতে খ্যামটা নেচে বিষ ঢালতেন নিয়মমাফিক, হয়ত কিছুটা সাম্প্রদায়িক ঝাল থেকেই। কবির কানে উঠত সবই , তবে মনে দানা বাঁধত না নতুন কোনও উষ্মা। পুরনো কোনও তিক্ততাকেও পুষে রাখতেন না অনর্থক। কবি জানতেন অশালীন রুঢ়তা মোটের উপর ক্লীবতার সূচক , তা কখনই দৃঢ়তার প্রতীক হতে পারে না। এমন কি নজরুল তাঁর জীবনের সেরা, তথা বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যদৃষ্টান্ত ‘বিদ্রোহী’ লেখার পরেও তাঁকে সমস্ত দিক থেকে অপদস্থ করার করার কাজটা প্রবল উদ্যম ও উৎসাহে চলেছিল। তাঁর সেই কালজয়ী কবিতাও কিনা হয়ে উঠেছিল নিদারুণ মস্করার খোরাক।
শুধুই কি অশালীন ভাষায় বিরুদ্ধ শিবিরের গাজোয়ারি সমালোচনা, কট্টর নজরুল ভক্তরাও কি তাঁর কীর্তি ও কৃতিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে নি! স্বাচ্ছন্দ্যের ঘেরাটোপ এবং পরিস্থিতির অনুকূলতা এলে তাঁর আরও একঝাঁক সৃষ্টি কালোত্তীর্ণ হতে পারত — একথা যারা বলে , তারা কবি ও তাঁর কাজকে অনুভব তো করেই নি, বরং অবমূল্যায়ন করেছে। খুব সম্ভবত সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়িই তাদের এই ‘কী হত যদি’-র অনুপ্রেরণা। নজরুল সৃষ্টির রসাস্বাদন না করে , তাঁর এক বিবর্ধিত মনগড়া প্রতিচ্ছবি দাঁড় করিয়ে রবীন্দ্র সৃজনের সাথে তুলনা করাটা নেহাতই বালখিল্য ঈর্ষাপরায়ণতা — একথা আর কবে বুঝবেন তারা।
দারিদ্র্য, নজরুলের কাব্য প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটায় নি, এই চলতি ধারণার কোনও চিন্তাসুলভ ভিত্তি নেই। অনেকেরই হয়ত জানা নেই , একটা সময়ে নজরুল কলকাতার সবচেয়ে ব্যয়বহুল মোটর গাড়ি চড়তেন, তাঁর সদর পাহারা দিত নেপালি দারোয়ান, প্রথম শ্রেণীর কামরা রিজার্ভ করে দু একবার ভ্রমণেও গিয়েছেন সপরিবারে। এই স্বাচ্ছন্দ্য দীর্ঘমেয়াদী না হলেও, ঠিক এই সময়টাতে সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে তিনি ছিলেন তুলনামূলক অনুর্বর। সৃষ্টির ধ্রুপদীআনা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা এক স্বেচ্ছা নির্বাসিত। যতটুকু যা আঁচড় কেটেছেন তা অন্যান্য সৃষ্টির তুলনায় রয়ে গেছে নেহাতই খেলো, তুচ্ছ , নগণ্য হয়ে। বরং একথা বললে বাড়াবাড়ি হয় না যে, অপ্রতুলতার সাথে তুমুল সংঘর্ষই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল এক অপ্রত্যাশিত উচ্চতায়। কবি ছুঁয়ে ছিলেন সৃজনশীলতার অনুল্লেখিত অস্পর্শিত বিন্দুকে। অসংকুলানের স্রোতধারাকে তিনি ক্রমাগত চালিত করলেন সৃষ্টির অবিশ্বাস্য উদ্যানে। ব্যক্তি যন্ত্রণাকে ক্যানভাসে আঁকলে হতে পারত বড়জোর একখান তৈলচিত্র, নজরুল জানতেন — সমষ্টির ঐক্যেই তা হয়ে উঠবে প্রকাণ্ড এক ফ্রেস্কো , তাতেই নিজেকে সঁপে দিলেন। যন্ত্রণার ফরমায়েশে লিখতে বসেও মানুষের আনন্দঘন জয়গান দিয়ে শেষ করলেন। শুধুই নালিশ জানানো নয়, মানুষকে উদযাপনও করলেন সমান একাগ্রতায়। বিক্ষোভের ভিড়েও পুঁতে দিলেন রোমান্সের ঝাণ্ডা।
নজরুল প্রতিভা সমতলে নেমে এসে স্থিতধী লাভ করেনি কখনো, ছন্দের চপলতা ঘন হয় নি জীবন দর্শনের গভীরতায়। পাহাড়ি খাতের উচ্ছলতায় শুরু করেছেন, শেষও হয়েছে সেখানেই। তবেই না, আর্তের অভিযোগ তাঁর কাব্যে রূপান্তরিত হয়েছে প্রতিবাদে, আর ক্ষোভ জমাট বেঁধেছে বিপ্লবে। নিরুপদ্রব নিরাপদ পরিবেশে থাকার মত মানুষ তিনি ছিলেন না। বরাবরই তিনি ছিন্ন শিকড়, মুক্তবিহঙ্গ , পিছুটানহীন। সব চুরমার করার স্পর্ধা ছিল বলেই গাঁটছড়া বাঁধেন নি স্থিতিশীলতার সাথে এ ব্যাপারে তিনি স্বভাব নিরুপায়। চারদিকে যা ঘটছে , যা তাকে বিব্রত ,বিক্ষুব্ধ করে তুলছে, তার সবটা অবহেলা করে নিজের কাজ চালিয়ে গেলে তিনি উৎকর্ষতার পরাকাষ্ঠাকে ছুঁতে পারতেন কী? স্রেফ কাব্যচর্চার উন্মাদনায় তিনি লিখতে বসেন নি । কবিতা তাঁর কাছে ছিল আর্থসামাজিক বক্তব্যের একটা জোরালো মাধ্যম, আর সেটাতেই ওঁর উৎকর্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়, প্রতিদ্বন্দ্বীহীন।
বোঝাই যায়, সচ্ছলতা কোনোভাবেই ইন্ধন হত না তাঁর বিক্ষুব্ধ সত্তার, বরং হিতে বিপরীত হয়ে আগুনকে নিভিয়ে দিতে পারত আরও দ্রুত। প্রত্যেক সৃষ্টিশীলতার কিছু উৎস মুখ থাকে, থাকে কিছু অন্তর্নিহিত অনুপ্রেরণা। নজরুল তাঁর সমস্ত উদ্দীপনা খুঁজে পেতেন অপ্রতুলতা এবং অপ্রাচুর্যের সাথে লড়াই করে। জীবন নিয়ে দার্শনিক মতাদর্শ রচনায় তাঁর আগ্রহ ছিল না বিশেষ। আর ঠিক সেই ছিদ্রটা দিয়েই কাতারে কাতারে ঢুকে পড়া সমালোচকরা নজরুলকে প্রবল উৎসাহে আক্রমণ চালিয়ে কোণঠাসা করে আজও। তাদের অবশ্য উপলব্ধিতে আসেনা যে, ব্যক্তিগত অনুভূতির স্পর্শকাতর চত্বরে কবি একটানা সময় ব্যয় করেন নি — এ ছিল তাঁর সিদ্ধান্ত , সীমাবদ্ধতা নয়। আর এমনিতেও পৃথিবীর সব বিপ্লবী খুব অল্প দিনেই জনমানসে একঘেয়ে হয়ে ওঠেন। কাজেই দোষটা বিপ্লবীর নয় , জনমানবে বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতায়। নজরুলের হুহুঙ্কারের মেয়াদ অবশ্য ছিল মাত্র কয়েকটা বছর। পূর্ণচ্ছেদ পড়েছিল অচিরেই। তবে বক্তব্যের আয়তন যতটুকুই হোক,ওজন ছিল যথেষ্ট, তারপর আর কোনও কথা চলে না, বলে যাওয়া শব্দের নাছোড় প্রতিধ্বনিরাই লক্ষ্যভেদে কেবল বুলেটের মতো ছুটে যায়।
প্রচলিত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সংশ্রব ছাড়াও দুখু মিয়ার নজরুল হয়ে ওঠার এই অবিশ্বাস্য জার্নি কী সহজে বিস্মৃতির পাতালে চলে গেল ! তিনি নির্বিবাদে চাপা পড়ে রইলেন অবহেলার আস্তাকুঁড়ে। বিভ্রান্তি আর সংশয়ের পাহাড়প্রমাণ জঞ্জালের আড়ালে। যে শিরদাঁড়া এককালে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সটান খাড়া ছিল, যে কণ্ঠ ক্ষমতাকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার স্পর্ধা জাগাল, যে কলম তরতরিয়ে এগোল মানুষকে সচেতন করবে বলে, হালের এই সম্প্রদায়সর্বস্ব হিড়িকেও তাঁর সে বক্তব্য তাৎপর্যহীন হয়ে গেল! তিনিই বা অবলুপ্ত হলেন কী করে! এ শুধু আশ্চর্যেরই নয়, বিপদ সংকেতেরও বটে।