এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  গান

  • জনাব কবীর সুমন সমীপেষু,

    প্রবুদ্ধ বাগচী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | গান | ১৩ মে ২০২৩ | ৭৫৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • (গত ২৫শে বৈশাখ সকালে Tv9 নামের একটা টেলিভিশন চ্যানেলে কবীর সুমন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে ঘন্টাখানেক কথা বলেছেন, গান গেয়েছেন৷ সেটা শুনে আরও অনেকের মতো আমিও  আপ্লুত ৷ তার একটা বড়ো কারণ হলো, সুমনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কী, তা প্রায় কেউই জানেন না ৷ আজকের প্রজন্ম তো নয়ই। সেই বিষয়েই এটি একটি ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া । উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ‘কলামন্দিরে’ অনুষ্ঠিত কবীর সুমনের একটি মঞ্চ অনুষ্ঠানের ভিত্তিতে বন্ধু পার্থ দাশগুপ্ত একটি প্রতিবেদন লেখেন, তাঁর অনুমতিক্রমে এই লেখায় সেই রচনাটির কাঠামো ও তার কিছু কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে)  

    জনাব কবীর সুমন সমীপেষু,

    প্রিয় কবীরদা,

    পঁচিশে বৈশাখ সকালে যে আপনি টিভি নাইন চ্যানেলে রবীন্দ্রনাথের গান গাইবেন এই খবরটা আমি সত্যিই জানতাম না । ইদানিং ফেসবুকের সঙ্গে আমার আড়াআড়ি চলছে, হয়তো তাই এই খবরটা না জেনে “পিছিয়ে পড়েছিলাম” , পরে ফেসবুকের সূত্রেই খবর পেয়ে তা শুনলাম সাতাশে বৈশাখ, তাতে কিছু এসে যায় না । এমন হতেই পারে অনেকেই আমার মতো খবর পেয়ে হয়তো তাঁরা আপনার অনুষ্ঠান পরেই শুনলেন, ইউ টিউবের কল্যাণে। আমারই মতো তাঁরাও সুমনে পাওয়া, রবীন্দ্রনাথে পাওয়া। কিংবা সবাই তা নন। ঠিক জানি না।

    আপনি একটা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরে টিভি স্টুডিওয় বসেছিলেন। আপনার সামনে শুধু একটা মাইক্রোফোন, আর ক্রমাগত সুরের রেশ টেনে যাচ্ছে আপনার ইলেক্ট্রনিক তানপুরাটি ---- সেই লকডাউন পর্বে আপনি যখন বাড়িতে বসে বসে মাঝে মাঝে ফেসবুক লাইভ করতেন তখনও আপনার এই বিশ্বস্ত সঙ্গীটির শব্দ আমরা শুনতে পেতাম। সত্যি বলতে কি, আজকালের রবীন্দ্রসঙ্গীতের “শিল্পীরা” এত বিপুল পরিমাণ বাজনা-বাদ্যি নিয়ে মঞ্চে নামেন যে মাঝে মাঝে আমার বেশ ভয় করে ! মনে হয় যেন ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’ ।  অথচ আবছা সুরের একটা তানপুরার সংগত বা এস্রাজের মসৃণ আবহে এই গানের মধ্যে যে একটা নতুন বিভা সঞ্চারিত হয় তা তেমনভাবে আমরা আর ভেবে দেখার সময় পাচ্ছি কই ? আপনার সেইদিনের উপস্থাপনা পুরোটাই ওই একটি তানপুরার অনুষঙ্গে ---- কই কোথাও তো বেমানান লাগল না ! তবে কি যারা ওইসব ফিসন ফিউশন বা ‘হুলাল লালা আঃ / হুলাল লালা আঃ’  করে গান করেন তাঁরা কি কিছুটা বুঝেশুনেই অপমানিত করেন রবীন্দ্রনাথকে ? উত্তরটা যিনি ঠিক ঠিক দিতে পারেন তিনি আপনি।

     আপনি এখন মাথায় আর চুল রাখেন না। যেটুকু গজায় তা শেভ করে ফেলেন। হালকা দাড়ি আগে রাখতেন, ইদানিং তাও নেই ।আপনার বয়স হচ্ছে। এখন পচাত্তর । রবীন্দ্রনাথেরও অনেক বয়স হল। একশো তেষট্টি । সেদিন টিভির পর্দায় আপনাকেই শুধু দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু আমি ওই সাজানো টিভি স্টুডিওর আশেপাশে ওই বৃদ্ধের পুরো শরীরের কাট আউটের মধ্যে ওই বৃদ্ধটিকেও দিব্যি দেখতে পেলাম। তাঁর গায়ে, ছবিতে যেমন দেখা যাচ্ছিল, ঠিক সেরকম জামাজোব্বা নেই। পরিবর্তে তিনি পরে আছেন বুকখোলা আস্তিন গোটানো একটা পাঞ্জাবী। দুটো ভারবহ হাত বুকের কাছে জড়ো করা --- যে বাহু সারাজীবন ধরে বহন করেছে বহু ন্যায্য ও অন্যায্য ভার । তাঁর মোটা ফর্সা আঙুলগুলো পরস্পরকে জড়ানো। ফিনফিনে পাঞ্জাবীর ভেতরে সুবর্ণ রঙিন সুগঠিত শরীরটা দেখা যাচ্ছে। ইনি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ, রক্তমাংসের রবীন্দ্রনাথ। ইনি গুরু নন, গুরুদেব নন, 'তুমি আমাদের পিতা' নন। এই রবীন্দ্রনাথের খিদে পায়, ঘুম পায় অথবা নির্ঘুমে রাত কাটে, প্রেমে উদ্বেল হয় তাঁর মন, জেগে ওঠে শরীর । কোনও এক অদেখা নারীর অঞ্চলছায়ার খোঁজ এই রবীন্দ্রনাথের দুচোখে। উনি আঙুলে আর পায়ের পাতায় তাল দিচ্ছিলেন। ওঁর বিরাট শরীরটা দুলছিল। আপনি আসলে আমাদের সঙ্গে এই লোকটার পরিচয় করিয়ে দিতে এসেছিলেন ওঁর একশো তেষট্টির জন্মদিনে।

    আপনি কবীর সুমন। কত কী দিয়েছেন আমাদের। কিন্তু আপনিও আকাশের শূন্যতায় জন্মাননি। ‘এ মোহ আবরণ’--- আপনি এই গান দিয়ে শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথ টপ্পা ভেঙে এই গান বানিয়েছিলেন তেইশ বছর বয়সে। আমার মনে হল, খুব নিরুচ্চারে রবীন্দ্রনাথের সেই যৌবনকে আপনি আলিঙ্গনে জড়িয়ে দিলেন। বার বার আপনি সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়-এর কথা বলছিলেন। আপনার বাবা। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁকে গান শিখিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন আপনার বাবা এসে ভার নিন শান্তিনিকেতনের সংগীতশিক্ষার। অভাবী সুধীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবিত বেতনে রাজি হতে পারেননি তাই ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। কিন্তু তাতে কী ? ওই শিক্ষার সূত্রেই তো তিনি গান শিখিয়েছিলেন আপনাকে, রীতিমতো মেরেধরে। আপনার শেখা প্রথম গান : আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে ----- গান গাইছেন আপনি, কিন্তু তখনো আপনি জানেন না আসলে রবীন্দ্রনাথ জিনিসটা কী এবং কেন। পরে সবটাই বুঝেছেন বলেই টের পেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে চিনতেন। সেই বাঙালি যারা তাঁকে প্রথম দিন থেকে অপমান আর উত্যক্ত করে গেছে ---- জমিদারের ছেলে পায়রা না-উড়িয়ে, বাঁধা মেয়েমানুষের ঘরে রাত না কাটিয়ে পদ্য লিখছে, গান বাঁধছে এসব তাঁদের সহ্য হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। তাই সেই বাঙালি চিতার আগুনেও তাঁকে সম্মানের সঙ্গে দাহ করতে দেয়নি। হয়তো কথাটা আপনার ক্ষেত্রেও সত্যি। আপনি যে বাংলা গানকে এত কিছু দিলেন ঠিক তার কতটা আমরা আপনাকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি ? এখন রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন নিয়ে বটতলার কেচ্ছা ভাল কাটে, আপনার বিবাহের সংখ্যাও বাঙালির মুখস্থ --- অথচ আপনি একদিন যে লিখেছিলেন ‘সারারাত জ্বলেছে নিবিড়’ এর মতো গান, সেকথা না মনে রাখলেও চলে। তবু রবীন্দ্রনাথ নামক লোকটি ওই বাংলা ভাষাতেই লিখে গেল হাজার দুয়েক গান।  

    আর 'কবিগুরু'-র কবিত্বে মগ্ন বাঙালি মুঠো মুঠো গান পেয়ে ভুলেই গেল যে, এগুলো কবিতা নয়, গান। রবীন্দ্রনাথ গান নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর অবিশ্বাস্য সাংগীতিক মেধার ছেনি বাটালি দিয়ে। আর এই গানের নির্মাণের প্রসঙ্গেই এল সুর দিয়ে আলো-কে ধরার নতুন এক প্রসঙ্গ। আপনি নিশ্চিত, পাশ্চাত্য তার মেজর আর মাইনর দিয়ে প্রকৃতির আলো-কে সুরে অনুবাদ করতে পারেনি। পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম’ গানের ভিতর দিয়ে ছোঁওয়া যায় সেই মেঘলা আকাশের বিষণ্ণ আলো, আকাশ নিচু হয়ে নেমে আসছে মাটির দিকে, আলো কমছে ---- ‘সজল মেঘের ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’ ---- এইসব অচেনা প্রান্তগুলো আপনি এমনভাবে হাতে- গলায় না চিনিয়ে দিলে আমরা কি পেতাম? ‘আলোর অমল কমলখানি’ গানে আ থেকে লো--- পর্যন্ত যে যাত্রাপথ সেও তো এক শরতের আলোকে ফুটিয়ে তোলবার সার্থক প্রয়াস। আসলে এটা কিছুটা ঠিক যে রবীন্দ্রনাথের গানে ‘সুর সঞ্চার’ ও তার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা হয় নিতান্তই কম। কম্পোজার রবীন্দ্রনাথের সেই দিকটা ওই জন্মের শুভক্ষণে আপনি বারবার আমাদের চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রশ্ন করছিলেন, ;মরি হায়, চলে যায়’ এর সুর কোথায় কেমন করে পেলেন রবীন্দ্রনাথ ? ওই যে ‘দূর শাখে পীক ডাকে’ র সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল আপনার দেখা সেই সুনীল আকাশের এক নিঃসঙ্গ চিলের ছবি ( ভুলে যাচ্ছি না, আপনি নিজেও ‘চিল’ নামে একটা গান করেছেন) ---- আর সঞ্চারীতে এসে ‘পুলকিত আম্রবীথি ফাল্গুনেরই তাপে’ র সুরটা কীভাবে বয়ে এল পরের প্রজন্মে বটুকদার ‘নব জীবনের গানে’ ----‘উঠেছে যে জীবনেরই লক্ষ্মী/ মৃত্যু সাগর মন্থনে’ ---- এই সব এই সব আপনার একেকটা পথে আলো জ্বালতে জ্বালতে যাওয়া। আপনি জানেন এই সুর তৈরি করতে কী জাতীয় সাংগীতিক জিনিয়াস লাগে। আর সেটাকে রেন্ডারিং-এ জাস্টিস দিতে গেলে কী ধরনের জিনিয়াস দরকার হয়। যিনি বুঝছিলেন তিনি টিভি স্টুডিওতে আপনার আশেপাশে ঘুরঘুর করছিলেন।গানের আত্মা তার সুর, আসলে যা নিজেই এক বিমূর্ত সত্ত্বা ।   

    আর এই সূত্রেই আপনি সেদিন তুলে আনলেন প্রয়াণের মাত্র পাঁচ বছর আগে লেখা ধূর্জটিপ্রসাদকে তার চিঠি ----- যখন তিনি নিজের ভাবকে গানে আর ‘প্রকাশ’ করতে চান না, চান তাকে ‘রূপ’ দিতে --- এই রূপ দেওয়া মানে এক নিপুণ নির্মাণ---- যা জীবনের শেষ দিকে তাঁর গানকে নিয়ে গেছে এক ‘অতিলৌকিক’ উচ্চতায়। কী গভীর তাঁর আত্মপ্রত্যয় আর কী অসম্ভব তাঁর বলিষ্ঠতা ! সেই যে গভীর সমুদ্রে তাঁর জাহাজ প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে দুলে দুলে উঠছে, যাত্রীরা প্রাণভয়ে ভীত অথচ অচঞ্চল রবীন্দ্রনাথ সংক্ষুব্ধ ডেকে বসে গান বাঁধছেন --- ‘ভুবন জোড়া আসনখানি’ ---অবিশ্বাস্য বললেও ঠিক বলা হয় না, কিন্তু সত্যি। এই দার্ঢ্যের কথা আপনি সেদিন তুলে দিলেন ‘বিরস দিন বিরল কাজ’ নিয়ে--- ‘এসেছ প্রেম এসেছ আজ কী মহাসমারোহে’ – এই ‘সমারোহ’ র জন্য চাই পৌরুষ ! আর পৌরুষ কথার ব্যুৎপত্তি যাই হোক এই পৌরুষের উচ্চতায় যেতে গেলে তাঁকে এসেনশিয়ালি পুরুষ হতে হবে তার কোনো মানে নেই।

    ধরুন, ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো’ তে ‘তাহারে দেখি না যে দেখি না/ তবু মনে মনে … অংশে যে মাঝ-খাম্বাজের আলতো ছোঁয়া আপনি আমাদের চিনিয়ে দিলেন এবং জানালেন এই রাগ নাকি আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের তৈরি --- অথচ আগেই তো রবীন্দ্রনাথ তার গানে সেই ইশারা দিয়ে রেখেছেন--- কী বিচিত্র সব বিষয়।  আপনি বার বার বলছিলেন, আপনি খুঁজে চলেছেন। যার হাত ধরে খুঁজছেন, তিনিও তো সারাজীবন খুঁজেই গেলেন, হেঁটেই গেলেন - 'পান্থ তুমি পান্থজনের সখা হে, পথে চলাই তাই তো তোমায় পাওয়া'। যাত্রাপথের আনন্দগানে বিশ্বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বাস করতেন, 'দুয়ার খুলে সমুখ-পানে যে চাহে, তার চাওয়া যে তোমার পানে চাওয়া'। তিনি দুয়ার খুলেই রেখেছিলেন। সুর-তাল-লয় নিয়ে কোনও ছুৎমার্গ রাখেননি, বেড়ার এ-পার ও-পার করেছেন অক্লেশে, ইচ্ছেমতো। যা দরকার তা দুহাত ভরে নিয়েছেন, যা ফেলে দেওয়ার, নিষ্ঠুরভাবে বর্জন করেছেন। গানে রবীন্দ্রনাথ যেরকম নির্মম, মেদহীন, ছিপছিপে, অমোঘ, তেমন আর কোনও রচনায় নন। শান্তিদেব লিখেছেন ‘গান রচনার সময় গুরুদেব যেন এক আব্রুহীন নগ্ন মানুষ’ ----- এই রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনতে চাই না, চিনলে আমাদের অসুবিধে হবে। আমি দেখলাম, আপনি গাইছেন, ‘মুখখানি করো মলিন বিধুর’ আর ওই লম্বা ফর্সা মানুষটা আপনার চারদিক দিয়ে ঘুরে ঘুরে আপনাকে দেখছেন, আর শুনছেন।
     
    টিন-এজার রবীন্দ্রনাথের লেখা বাল্মীকিপ্রতিভার গান 'ব্যাকুল হয়ে বনে বনে ভ্রমি একেলা শূন্যমনে' আপনি যখন শুরু করলেন, আমার মনে পড়ে গেল প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এই শূন্যতা কাটল না রবীন্দ্রনাথের। 'মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন তব চরণতলে, শুভলগন গেল চলে, প্রেমের অভিষেক কেন হল না তব নয়নজলে' যখন লিখছেন, উনি তখন সাতাত্তর। আমি নিশ্চিত নই, উনি কি তখনও সেই মেয়েটিকে খুঁজে চলেছেন, নাকি বেহাগের আরও কোনও নতুন রাস্তা। বা বাষট্টি বছর বয়সে লেখা 'খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি'তে কী চূড়ান্ত vulnerable ওই প্রবল পুরুষটি। কেদার-খাম্বাজ মিশিয়ে বাঁধছেন 'যা আমার সবার হেলাফেলা যাচ্ছে ছড়াছড়ি, পুরনো ভাঙা দিনের ঢেলা, তাই দিয়ে ঘর গড়ি'। আটষট্টির রবীন্দ্রনাথ লিখছেন 'অতিথিরে ডাকবি যবে, ডাকিস যেন সগৌরবে', আর আটাত্তরে পৌঁছে অভিমান করে বলছেন, '.. দূরে যাব যবে সরে তখন চিনিবে মোরে, আজ অবহেলা ছলনা দিয়ে ঢেকো না...ডেকো না আমারে ডেকো না, চলে যে এসেছে মনে তারে রেখো না'। এই গানগুলো আপনি সেদিন গাননি। গাইতেই পারতেন। কারণ আপনার মধ্যেও সেই খোঁজ এখনও জ্যান্ত। নইলে কি আর সেই প্রতীক্ষিত কারোর আসবার সঙ্কেত নিয়ে বাঁধতে পারতেন খেয়ালের সঞ্চারী ?

    আজ আপনি স্বয়ং পচাত্তর। এখনও প্রবল। হাত কাঁপে, ব্যারিটোন গলা সবসময়ে স্ববশে থাকে না, কিন্তু টানা সোয়া একঘণ্টা স্টুডিওতে বসে গান আর কথার যুগলবন্দী নিয়ে স্থির বসিয়ে রাখতে পারেন শ্রোতাকে । দমে একটু আধটু টান পড়ে কিন্তু স্মৃতি স্পষ্ট ---- গানের কথা থেকে ব্রেখটের কবিতা থেকে রবীন্দ্রনাথের চিঠি মায় তাঁকে নিয়ে কার্টুনের ভাষা অবধি ফুরোয় না । উচ্চারণে প্রত্যেকটা বর্ণ স্পষ্ট, সপাট হয়ে আসে, একটাও ফলস নোটে গলা সরে যায় না। তাই অভিমান আপনাকে সাজে না। আপনার স্বজাতি আপনাকে বোঝেনি। বুঝতে চায়ও না। তার দরকারও নেই। তাদের ক্ষমতাও নেই। তারা আপনার কথামতো সেই 'তব অঞ্চলগরু বন্ধনদড়ি' দিয়ে খোঁটায় বাঁধা। তাদের জানার কথা নয় কীভাবে 'উধাও' শব্দটা উচ্চারণ করলে মল্লার রাগটা খাট পেতে দেয়, ভাত বেড়ে দেয়, বা ‘শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে’ তে একটা স্বর আসলে ওই ‘শেষ গানের রেশ’ টুকু ধরে থাকে । রবীন্দ্রনাথ, বাংলা সংস্কৃতির যা কিছু ভালো আর সুরুচির উত্তরাধিকার তার মধ্যে আপনি একলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন । ক্যাসাবিয়াঙ্কা ---- The boy on the burning deck.

    আপনি আরও কিছুদিন থাকুন। এভাবে। আমাদের মতো গুটিকয় লোকের জন্য। নইলে খুব অন্যায় করবেন। অন্তত রবীন্দ্রনাথ আপনাকে ক্ষমা করবেন না।

    ইউ টিউবে অনুষ্ঠান দেখার একটা ‘নেসেসারি এভিল’ হল তাঁদের বেরসিক বিজ্ঞাপনের মিসাইল হানা যা অন্তত গানের অনুষ্ঠানের ‘রসভঙ্গ’ বললে খুব নরম করে বলা হয় আসলে বলা উচিত ‘হারামিপনা’ । তবু নব্য প্রযুক্তি বিপ্লবে এসব হারামিপনা থেকে মুক্তি পেতে অনুষ্ঠান  ডাউনলোড করে নিলে এর থেকে নিষ্কৃতি । আমি অনুষ্ঠান শুনেছি ডাউনলোড করেই, ওই শ্রবণ অভিজ্ঞতার ঘোর আমি চাই না তা সহজে কাটুক।

    অনেক আদর, ভালোবাসা আর প্রণাম। সুরে থাকুন, সৃজনে থাকুন, রবীন্দ্রনাথে থাকুন।

    প্রবুদ্ধ

    যারা এই অনুষ্ঠান টি দেখতে চান তাঁদের  জন্য লিংক  

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৩ মে ২০২৩ | ৭৫৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন