১৯৪৭ এর অগাস্টে যে বাটোয়ারার হাত ধরে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, সেই বাটোয়ারায় শুধু মাটিই ভাগ হয় নি ভাগ হয়েছিল নদীনালা, সৈন্য সামন্ত, পুলিশ এবং সবরকম সরকারি কর্মচারী, গ্রন্থাগার, মায় জেলবন্দী, হাসপাতালে ভর্তি রোগী, মানসিক চিকিৎসালয়ে আশ্রিত রোগীরাও। উপরোক্ত মানুষ ভাগাভাগির সময়ে সরকারি কর্মচারী, ডাক্তার ও রোগীরা কে কোন দেশে যেতে চায় এই বাবদে তাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল বাদে একদল। ওই যারা মানসিক চিকিৎসালয়ে রোগী, পাগল তারা আর কীইবা বোঝে, কীইবা বলবে? তাই তাদের খাতায় লেখা নাম ও ধর্ম পরিচয় অনুযায়ী ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল দুটো দেশের মধ্যে। লাহোর, পেশাওয়ার আর হায়দ্রাবাদের (পাকিস্তান) সমস্ত হিন্দু ও শিখ রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে আর ভারতের হাসপাতালের সমস্ত মুসলমান রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লাহোর। অথচ রাঁচির কাঁকে মানসিক চিকিৎসালয়ের কোন কোনও রোগীর হয়ত যাওয়া উচিৎ ছিল ঢাকায়। জলজ্যান্ত মানুষগুলো স্থাবর সম্পত্তির মত ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেল দুই দেশের মধ্যে।
ডঃ অনিরুদ্ধ কালা, পেশায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পারিবারিক ও কর্মসূত্রে খুব কাছ থেকে দেখেছেন দেশভাগের শিকারদের। দেখেছেন দেশভাগ কী গভীর ক্ষত রেখে গেছে মনোরোগীদের মধ্যে। ডঃ কালা মাতৃগর্ভে সীমান্ত পেরিয়েছিলেন, স্বাধীনতার কয়েক মাস পরে জন্ম তাঁর, বড় হওয়া ‘রিফিউজি বাচ্চা’ হিসেবে। ছোটবেলায় দাঙ্গা সম্পর্কে জিগ্যেস করলে তাঁর মায়ের বাঁধা উত্তর ছিল ‘আমাদের গ্রামে ওসব হয় নি, অন্য গ্রামে হয়েছে’। এলাকার অন্য বাচ্চাদের মায়েরাও একই কথা বলতেন তাদের। ঐতিহাসিক পার্থ চ্যাটার্জি যাকে বলেছেন একটু সরে সরে বলা। বড় হয়ে বুঝেছেন এ আসলে ভয়াবহ আতঙ্ক ও মানসিক আঘাত থেকে বাচ্চাদের এবং নিজেদেরও সরিয়ে রাখার জন্য বলা। অনেক পরিবারেই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা ওই পারে তো বটেই, এপারে আসার পরেও সক্রিয়ভাবে দাঙ্গায় অংশ নিয়েছেন। পেশাগত কারণে লাহোর মানসিক চিকিৎসালয়ে গিয়ে লেখক দেখেছেন দেশভাগের ঠিক আগে লাহোরে থাকা রোগীর সংখ্যা আর দুই দেশের রোগী বিনিময়ের পরের মোট সংখ্যায় বড়সড় গরমিল। স্পষ্ট বোঝা যায় হতভাগা পাগলগুলো মরল কি বাঁচল তার তোয়াক্কাও করে নি, খবরও রাখে নি কেউ।
নিজ অভিজ্ঞতা সঞ্জাত উপেক্ষিত অবহেলিত এইসব রোগীদের বাস্তব কাহিনীই ডঃ কালা তুলে এনেছেন ‘দ্য আনসেফ অ্যাসাইলাম – স্টোরিজ অব পার্টিশান অ্যান্ড ম্যাডনেস’ বইতে। সেই বইয়ের বাংলা অনুবাদ ‘নিরাপত্তাহীন আশ্রয়’, করেছেন ডঃ অনিরুদ্ধ দেব, প্রকাশক অনুষা পাবলিকেশান। জানুয়ারি’২০২২ এ প্রকাশিত বইটায় মোট তেরোটা কাহিনী, ডঃ কালার ভাষ্যমতে প্রতিটাই সত্য কাহিনী শুধুমাত্র সর্বসমক্ষে কাহিনী পেশের স্বার্থে দুই একটা চরিত্র আমদানি বা কথাসূত্র দিয়ে গেঁথে তোলার বেশি কিছু করেননি তিনি। অ্যাসাইলাম বা আশ্রয় শব্দটার মধ্যে যে স্বস্তি আর নিরাপত্তার আভাস থাকে তা বিলকুল ছিঁড়েখুঁড়ে যায় তার ঠিক আগের আনসেফ শব্দটা পড়লে। উনিশশো সাতচল্লিশের সেই ক্রান্তিকালে র্যাডক্লিফ লাইনের দুই পাশ বরাবর প্রায় সব আশ্রয়ই হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিরাপত্তাহীন। কিন্তু তার মধ্যেও মানসিক চিকিৎসালয়ের আশ্রয়ের ভঙ্গুর নিরাপত্তাহীনতার কাহিনী আমাদের স্তব্ধ হতবাক করে দেয়। পার্টিশান লিটারেচার, সেই সময়ের বীভৎস সব বিবরণ এই প্রথম পড়ছি না, তবু ১৮৬ পৃষ্ঠার নিতান্ত পাতলা এই বইটা একবসায় পড়ে ফেলা সম্ভব হয় না। রুলদা, ফাত্তু, ওম, ফিরদৌসরা এসে বুকের ওপরে চেপে বসে যেন।
বই শুরু হয় সাতচল্লিশের জুনমাসে লাহোরে একজন মুসলিম মনোরোগ চিকিৎসকের এক শিখ আর্মি অফিসারের হাতে খুন হওয়া দিয়ে। হিংস্র জনতার হাতে সন্তানকে খুন হতে দেখে এই শিখ অফিসার প্রতিজ্ঞা করেন ১০ জন মুসলমানকে খুন করার। করে উঠতে পারেন একজনকেই, ওই ডাক্তার। বহু বছর পরে সেই ডাক্তারের ছেলে, যিনি নিজেও বড় হয়ে মনোচিকিৎসকই হয়েছেন, ভারতে আসেন ক্রিকেট ম্যাচ দেখার বাহানায় আসলে তাঁর পিতার হত্যাকারীর মুখোমুখি হতে। না কোনোরকম বিদ্বেষ থেকে প্রতিশোধ নিতে নয়, নিছকই - হ্যাঁ ব্যাপারটা এইভাবেই হয়েছিল এই স্বীকৃতি ও নিষ্পত্তির জন্যই। এই কাহিনী পড়তে পড়তে মনে পড়ে সলমন রশিদের ‘আ টাইম অব ম্যাডনেস - আ মেমোয়ার অব পার্টিশান’ বইটার কথা, প্রায় একই রকম ঘটনা। পুরো বইয়ের মেজাজ এইখানেই স্থির হয়ে যায়। এক উন্মাদ সময়ের আক্রান্ত মানুষের কাহিনী। কোনও কাল্পনিক পর্দার আড়াল দিয়ে নয় সরাসরি স্পষ্ট, স্মৃতিচারণ, ডায়েরির পাতা, আপনমনে বলে যাওয়া স্বগতোক্তি দিয়ে পরম মমতায় কালা বলে গেছেন গল্পগুলো। কোথাও অতি নাটকীয়তা নেই, নেই কারো প্রতি বিদ্বেষ।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এক চুক্তির ভিত্তিতে অ্যাবডাক্টেড উয়োম্যানস রেকভারি অ্যান্ড রেস্টোরেশান অ্যাক্ট চালু হয় ১৯৪৯ সালে। এই আইন চালু হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন সম্প্রদায় দ্বারা লুণ্ঠিত নারীকে উদ্ধার করে তার নিজ সম্প্রদায় ও গৃহে ফেরানো। আইনের দেবীর দুইচোখ তো বাঁধা তাই দৃষ্টিহীন আইন ভারতে যে সমস্ত হিন্দু পুরুষের মুসলিম স্ত্রী ছিল তাদের ‘উদ্ধার’ করে পাকিস্তানে পাঠায়, পাকিস্তানে যে সমস্ত মুসলিম পুরুষের হিন্দু স্ত্রী ছিল তাদের উদ্ধার করে ভারতে পাঠায়। অন্ধ আইন শোনে না উদ্ধার হওয়া মেয়েটার কোনও কথাই, সে প্রেমের বিয়ে অথবা প্রাণ ও মান বাঁচানোর কৃতজ্ঞতায় ভালবাসায় করা বিয়ে যাই হোক না কেন তাকে ‘উদ্ধার’ করে প্রশাসন তুলে দেয় অন্য দেশটার প্রশাসনের হাতে। পাগলদের যেমন কোনাও নিজস্ব মত থাকতে পারে না তেমনি মেয়েদেরও নিজস্ব মত থাকতেই পারে না এ ত সবাই জানে। ধার্মিক হিন্দুরা তো আবার মুসলমান ছোঁয়ার দূরতম সম্ভাবনা দেখলেও সে মেয়েকে আর ঘরে নেয় না, সর্বতোভাবে অস্বীকার করে তার অস্তিত্ব। মৃদুলা সারাভাই এই মেয়েদের মত শুনতে চেয়ে মানবিক হতে চেয়ে অত্যন্ত অপ্রিয় হয়েছেন একথা পড়েছি আনিস কিদওয়াইএর স্মৃতিকথায়।
এই অ্যাক্ট কীভাবে ধ্বংস করে দেয় হরপ্রীত ওরফে ফিরদৌস চিমার জীবন তার নির্লিপ্ত বিবরণ পড়ে আরেকবার নিষ্ফল ক্ষোভে হতাশায় দীর্ণ হতে হয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলা কালেক্টিভ ট্রমার শিকার হয়ে একটা গোটা পরিবারের সদস্যরা একের পর এক ফলি আ ফ্যামিলি বা ফলি-আ-দ্যুতে আক্রান্ত হয়ে শেষ হয়ে যায় তার বিবরণ পড়ে বারবার শিউরে উঠতে হয়। আর ফাত্তু আর রুলদা, লাহোর মানসিক চিকিৎসালয় থেকে রুলদাকে আসতে হয়ে ভারতে প্রাণের বন্ধু ফাত্তুকে লাহোরেই ফেলে রেখে। ভারতেও তো রুলদার কেউই নেই, যেমন লাহোরেও ছিল না। তবু বাটোয়ারায় ভাগ হয়ে যাওয়া রুলদাকে আসতেই হয় আর তারপর? বই থেকেই তুলে দিই। “দুটো লোক মোটরসাইকেলে গর্জন তুলে পাশ দিয়ে গেল। পেছনের লোকটার হাতে একটা জেরিক্যান। আতঙ্কে রুলদা আবার দৌড়াতে শুরু করল। পা কাঁপছে। একটা চওড়া রাস্তা, অনেক আলো, হু হু করে গাড়ি যাচ্ছে। রুলদা কী করবে না বুঝে অনেকক্ষণ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রইল। শেষে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল সামনে। ড্রাইভার কাচ নামিয়ে জিগ্যেস করল কোথায় যেতে চায়।
রুলদা বলল ‘এ শহরে কোন মেন্টাল হসপিটাল আছে?'
গল্পগুলো সবই একটা অন্যটার সাথে যুক্ত এক উন্মাদ হিংস্র সময়ের কথামালা। মূলত দুটো কেন্দ্রবিন্দু ধরে এগিয়েছে বইটা, একদিকে শিখ রুলদা ও মুসলিম ফাত্তুর বন্ধুত্ব, যখন বাইরে শিখ আর মুসলিম একে অন্যের গলা কাটছে; অন্যদিকে প্রকাশ কোহলির চণ্ডীগড়ে বেড়ে ওঠা, মানসিক চিকিৎসক হিসেবে ভারত ও পাকিস্তানের পার্টিশান ট্রমায় আক্রান্ত মানুষদের মুখোমুখি হওয়া। একদিকে চণ্ডীগড় যার কোনও ইতিহাস নেই, বাটোয়ারার পরে তৈরি শহর আর একদিকে অতি প্রাচীন লাহোর, সীতাপুত্র লব যে শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলে কথিত। ফাত্তু, মহম্মদ ফতেহ আলি খানের পাগল ভবিষ্যতদ্রষ্টা হয়ে যাওয়া আর রাম অবতার মিশ্রর জাফর আলি খান বার অ্যাট ল (লাহোর হাইকোর্ট) হয়ে যাওয়া দুইই দেশভাগের মার খেয়ে। দিন মাস বছর যত গড়ায়, দুইদেশের সম্পর্ক ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে। যে প্রকাশ ছোটবেলায় সীমানার ওপারের কমলালেবু গাছের লেবু খেয়ে ও সঙ্গে এনেছে কোনরকম প্রশাসনিক বা সামাজিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই, সেই প্রকাশের লন্ডনবাসী পুত্রবধূর পাকিস্তানে বাপের বাড়ি এসে সেখান থেকে ভারতে শ্বশুরবাড়ি আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় প্রশাসনিক জটিলতা ও সামাজিক নজরদারীর ঠ্যালায়।
এতদিনে উচিৎ ছিল দুই দেশের মধ্যে ভিসাবিহীন এক সহজ যাতায়াতের পথ গড়ে ওঠার অথচ বেড়ার পরে আরো শক্ত বেড়া, দেওয়ালের উপরে কাঁটাতারের বোঝা বেড়েই চলেছে কেবল। বইয়ের শেষ কাহিনী, গুপ্তচর গোপাল পাঞ্জাবীর অংশটা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় মনে হল। প্রকাশ কোহলির বয়ান কোনও কাহিনীতে উত্তম পুরুষে আবার কোথাও প্রথম পুরুষে লেখা। গল্প হিসেবে পড়তে গেলে একটু অস্বস্তি লাগার কথা, তবে এও সত্যি যে পার্টিশান বা বাটোয়ারার কাহিনী কোনোভাবেই একমাত্রিক নয়, একভাবে বলাও সম্ভব নয়। বাংলা অনুবাদ যথাযথ মূলানুগ। এই বইয়ের কোনাও ভাল মন্দ হয় না, পার্টিশান সাহিত্যের পাঠকের পড়া উচিৎ। লেখকের ব্যক্তিগত পক্ষপাতশূন্য মনঃচিকিৎসকের চশমা দিয়ে দেখা চরিত্রগুলো এই বইয়ের সম্পদ।