২০২২-এর মে মাসে ৮০ বছর হল শ্রী মাধব গ্যাডগিলের। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস্তুতন্ত্রে পিএইচডি করা এই মানুষটি পরে ওখানেই পড়িয়েছেন বটে, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বোধহয় বিদেশের সব প্রলোভন জলাঞ্জলি দিয়ে এই দেশে পরিবেশ চিন্তার প্রসারে ঝাঁপিয়ে পড়া। তরুণ বিজ্ঞানীদের নিয়ে ব্যাঙালোরে সেন্টার ফর ইকোলজিকাল সায়েন্সেস প্রতিষ্ঠা করে পরিবেশ বিজ্ঞানকে সিরিয়াস চর্চার বিষয় হিসেবে যথোচিত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা।
নিজের ক্ষেত্রে যতই এগিয়েছেন মাধব, ততই সরে এসেছেন শুধুমাত্র গাণিতিক বাস্তুতন্ত্রের চর্চা থেকে। সংখ্যাভিত্তিক কাগুজে তথ্যকে শিকেয় তুলে রেখে বিশাল দেশের সর্বত্র ছুটে বেরিয়েছেন তিনি, বিশ্বাস গচ্ছিত রেখেছেন প্রকৃতির নৈকট্যে বাস করা সাধারণ মানুষের যাপনলব্ধ জ্ঞানে আর বিস্তৃত এবং প্রত্যক্ষ ক্ষেত্র সমীক্ষায়। ইন্সটিউটের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের চাইতে তার প্রিয় হয়ে উঠেছিল এ দেশের জনজাতিদের খুব কাছে থেকে দেখা। কিভাবে এই মানুষগুলি সহজ সরল জীবনযাত্রায় বনস্থলী লব্ধ জ্ঞানে পূরণ করে চলে প্রকৃতির সব সহজাত শর্ত, বস্তুত তাদের জীবনের মূল ভিত্তিই হল পরিবেশ প্রতিবেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, এইসব খুঁটিয়ে দেখাই পরিবেশ বিজ্ঞানীর কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল। শুধু পুঁথিগত জ্ঞান বিতরণ না করে সরেজমিনে খুঁটিয়ে দেখা এবং পুঁথিতে যে তথ্য মেলে না তার উপলব্ধিই মাধব গ্যাডগিলের বৈশিষ্ট। রামচন্দ্র গুহ জানিয়েছেন কিভাবে বান্দিপুর ন্যাশনাল পার্কে দিনের পর দিন পড়ে থেকেছেন এই বিজ্ঞানী এবং হস্তিযূথের জীবন পরিক্রমা খুঁটিয়ে দেখে সে সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল আলোচনা করবার জন্য ছুটে এসেছেন দেহরাদুনে ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিউটে।
এই শুকনো পাণ্ডিত্যের প্রতি অনীহা, প্রকৃতি এবং প্রাকৃত মানুষের কাছ থেকে শেখার আগ্রহই মাধবকে আমার প্রিয় পরিবেশবিজ্ঞানী করে তুলেছে। পশ্চিম ঘাট নিয়ে গ্যাডগিল কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়িত হলে আজ ফি বছর কেরালা, গোয়া বন্যায় ভেসে যেত না। রাজনীতি এবং কর্পোরেটের স্বার্থে পরিবেশের ইস্যুগুলিকে হালকা করে দেবার যে প্রচেষ্টা এই দেশে বিদ্যমান, তার প্রকট রূপ আমরা এখন দেখলেও এই প্রবণতার শুরু অনেক আগে থেকেই।
গ্যাডগিল কমিশনের রিপোর্টের চাইতে আজ ৫ই জুন পরিবেশ দিবসে আমি অবশ্য জোর দিতে চাই মাধবের দেখার চোখটি এবং শেখার মনটির ওপর। কারণ এ দুটোই বড় দুর্লভ এবং এইভাবে দেখত ও ভাবতে শিখলে তবেই আমাদের প্রতিবেশ বাঁচবে, নইলে নয়।
পশ্চিমঘাটের বনস্থলীতে দাঁড়িয়ে বিদেশ প্রত্যাগত বিজ্ঞানীর প্রথমেই মনে হল দেশের অরণ্য নিয়ে ব্রিটিশ রাজের যথেচ্ছাচারের কথা। দেশ স্বাধীন হবার পরেও বুঝে না বুঝে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলতে লাগল,পন্ডিত নেহরু নদীপথের স্বচ্ছন্দ গতি আটকে দাঁড়ানো বিশাল বাঁধ গুলিকে বললেন ভারতবর্ষের আধুনিক দেবালয়। ১৯৭১-এই মাধব শুনেছিলেন পশ্চিম ঘাট পর্বতমালার সবচেয়ে পবিত্র,আর তথাকথিত সভ্যতার স্পর্শবিরহিত ছোট ছোট বনাঞ্চলগুলির (আমাদের পঞ্চবটির বড়সর সংস্করণ) অবস্থান হল পুণের কাছাকাছি ( এখন তার কী অবস্থা ভাবতেও ভয় করে। বন্ধু দময়ন্তী যে আবাসনে থাকে তা গড়ে উঠেছে পাহাড়ের পর পাহাড় প্রোমোটারকে বিক্রি করে, ডিনামাইট ফাটিয়ে, বুলডোজার দিয়ে সমতল বানিয়ে।), কারণ এই অংশটির আদিম পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত আছে ওখানকার আরণ্যক মানুষের কাঁধে। তারা ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ট্র্যাডিশন রক্ষার নামে এই কাজ করে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। মাধব ঠিক করলেন এই ভূমিজ মানুষগুলির কাছ থেকে পরিবেশ রক্ষার কাজটি হাতে কলমে শিখবেন।
ভেলহে পাহাড় আর পানশেট বাঁধের অববাহিকা অঞ্চল হয়ে দাঁড়াল কিছুদিনের জন্য তাঁর কর্মস্থল। রোজ সকালে উঠে ট্রেকিং শুরু হত, যে গ্রামগুলি এই পবিত্র বনখন্ড সমূহের কাছাকাছি সেগুলোতেই যেতেন তিনি, নোট করে নিতেন গাছের নাম, প্রজাতি, বৈশিষ্ট । সঙ্গে চলত ওখানকার জীবজন্তু, পরম্পরা এবং বাস্তুতন্ত্র নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা। এই পরিক্রমাতেই তিনি দেখেছিলেন গ্রামবাসীদের সঙ্গে রীতিমতো মিটিং করে ঘুষ নিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রবেশের অধিকার বিলোবার চেষ্টায় ব্যস্ত বনকর্মীকে।
গ্রামবাসীদের সঙ্গে এই প্রত্যক্ষ সংযোগের ফলেই মাধব ধরতে পেরেছিলেন শাইনিং শহুরে ইন্ডিয়ার এক বিরাট ভুল। আমাদের ভুল ভাবনা যে বনদপ্তরের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছে গ্রামবাসীদের লোভ আর বনধ্বংসের প্রবণতা। এখানেই তিনি দেখেন আম, আমলকি আর হরিতকি গাছ গ্রামবাসীদের কাছে এতো পবিত্র যে এদের কান্ডে তারা কুঠারাঘাত কিছুতেই করে না। এমনকি বনভূমি কেটে জ্বালিয়ে সাফ করে বসতি স্থাপনের ১৫ বছরের ইজারা পেলেও না। দেখেছিলেন যেই রাস্তা তৈরি হল,উন্নয়নের রথ পৌঁছল, অমনি সরকারি ইঞ্জিনিয়াররা কাঠ আর কয়লা মাফিয়াদের নিয়ে জায়গামতো পৌঁছে গেল। গ্রামবাসীদের বলা হল উন্নয়নের স্বার্থে তাদের এই এলাকা ত্যাগ করতে হবে, চাষের জমি পাবে ঠিকই, কিন্তু সে অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে। ফলে জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মহা বৃক্ষগুলিকে যৎসামান্য দামে হলেও বিক্রি করে দেওয়া আশু কর্তব্য। মাধব দেখেছেন অন্যন্যোপায় গ্রামবাসীকে বহু পাখির আবাস,ফলবান ছায়াময় বিরাট গাছকে মাত্র আট আনায় বিক্রি করে দিতে। এইভাবে রাজনীতি,দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের রথের চাকায় গুঁড়িয়ে যায় সমস্ত ঐতিহ্য। ফাঁকা হয়ে যায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিরাট এলাকা। আমরা ভাবি স্থানীয়রাই যতো নষ্টের গোড়া।
এরপরের অভিযান বান্দিপুর ন্যাশনাল পার্কে। হাতিদের মোট সংখ্যা নিয়ে দেশে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যেত না তখন, উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে উৎসাহিত মাধব ঠিক করলেন, বান্দিপুর ও নাগারহোলে হাতি নিয়ে কাজ করবেন। যে তিনটে হাতির পিঠে বান্দিপুরে ট্যুরিস্টদের ঘোরানো হত, সারা রাত তারা স্বাধীনভাবে বনে ঘুরে বেড়াত। গলার ঘন্টির আর পায়ের শেকল ছেঁচড়ে চলার আওয়াজে ভোর ভোর বেড়িয়ে পড়া মাহুতরা বুঝে যেত কোথায় চরে বেড়াচ্ছে জীবগুলো। সেখানে পৌঁছে তারা চটপট উঠে পড়ত হাতির পিঠে, তাদের ফিরিয়ে আনত ট্যুরিস্টদের সেবায়।
এই ফেরার পথটায় তারা মাথার ওপরে গাছের ঘন চাঁদোয়ায় ডুমুর জাতীয় শাখা প্রশাখা দেখলেই সেগুলো ভেঙে হাতির ঘাড়ের ওপর জড়ো করত। হাতিরা ডুমুর জাতীয় গাছের পাতা খেতে ভালবাসে। এই ফেরার পথটা প্রায়ই মাহুতের কোমর জড়িয়ে বসে থাকতেন মাধব গ্যাডগিল। একদিন এই নিরক্ষর মাহুতদের কথোপকথন বিস্ময় এবং শ্রদ্ধা জাগাল তাঁর মনে।
মাহুতেরা বলাবলি করছিল এই অরণ্য তো কেবল ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য নয়। এটা পাখি,বাদুড়, বাঁদর,কাঠবেড়ালি এবং অন্য অনেক প্রাণীর বসতি। ডুমুর গাছ খুবই উপকারি, কারণ বছরে অনেকবারই এতে ফল আসে আর যখন অন্য কোনও ফল পাওয়া যায় না, তখন শুধুমাত্র ডুমুর ফলে বেঁচে থাকে এমন প্রাণীও আছে। এই যে যথেচ্ছ এই গাছের ডালপালা ভাঙছি, এক মাহুত আরেক জনকে বলল, এতে কিন্তু বনের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের ভেবে দেখা উচিত এটা আমরা চালিয়ে যাব কিনা।
এই আরণ্যকেরা সেদিন যা বলেছিল, মাধব গ্যাডগিল অবাক হয়ে পরে ভেবেছিলেন, এক দশক বাদে যেন ঠিক সেই কথা নিয়েই লেখা হল জন টারবোরগার বিখ্যাত গবেষণাপত্র- আম্যাজনের অরণ্যে রিসোর্স হিসেবে ডুমুর জাতীয় বৃক্ষের ভূমিকা।
খুবই দুর্ভাগ্য, এইরকম একজন মাটির কাছাকাছি পরিবেশবিদ ও বাস্তুতন্ত্রবিদ, যিনি প্রকৃতির ও মানুষের মধ্যেকার বোঝাপড়াকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন, তার চোখের ওপরেই ঘটে যাচ্ছে পরিবেশ লুন্ঠন ও প্রকৃতি ধ্বংস। বোঝাপড়া একটা আছে বটে, কিন্তু সেটা কর্পোরেট এবং শাসকের মধ্যে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ধুঁকছে, হিমালয়েরই বা কী অবস্থা! ২০১৮ সালে কেরালার বিধ্বংসী বন্যার জন্য দায়ী মানুষের লোভ। মাধব গ্যাডগিল ২০১১ সালেই সতর্ক করেছিলেন যে উন্নয়নের নামে যত্রতত্র ভারী শিল্প স্থাপন, খোলামুখ খনি খনন চলবে না। বলেছিলেন তথাকথিত উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করতে হবে স্থানীয় জন সম্প্রদায় এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুমতি নিয়ে। অর্থাৎ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের জন্য পরিবেশ-বান্ধব উন্নয়ন। গুরুচন্ডা৯ প্রকাশিত হননকালে এইসবই বিস্তারিত লিখেছি। কিন্তু দুঃখ এই যে গ্যাডগিল-মডেল, কঠোর ভাবে যা বাস্তবায়িত না হলে পরিবেশ প্রতিবেশ শেষ হয়ে যাবে, তা এই দেশ প্রত্যাখ্যান করেছে।
হাসদেও খোলামুখ খনির কথা বলে এই ফুল্লরার বারোমাস্যা শেষ করি। ছত্তিশগড়ের বিশাল অরণ্য। তারই ছায়ায় আত্মগোপন করে আছে উৎকৃষ্ট কোল ব্লক। কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে চায় বহু নজরানার বিনিময়ে। সাধারণ মানুষ চায় না হারিয়ে যাক ১৭০,০০০ হেক্টর জোড়া সবুজ পাহাড়, নদী, অরণ্য। ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী জনমত জানতে চাইছেন। নিচে সেই লিংক রইল। আপত্তি জানান, প্রতিবাদ করুন। এইভাবেই পরিবেশ দিবসে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি শ্রী মাধব গ্যাডগিলকে, এ দেশের জনগণতান্ত্রিক পরিবেশ- ভাবনার জনককে।
https://forms.gle/oGrRNDZQnAvAmTJ69