১
আবাসনের গেট দিয়ে গাড়ি করে বেরোনর সময় সুবীর দেখতে পেলেন লোকটাকে। গেটের ঠিক বাইরে। জিন্স আর রঙচটা জামা পরা, মুখে দাড়ি, চোখে একটা হিংস্র ভাব। কালকেও ছিল। কে লোকটা? কী চায়? সুবীর ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ির কাচ নামিয়ে হাত দিয়ে সিকিউরিটির ছেলেটাকে ডাকলেন। বাইরের গরম হাওয়া ঢুকে পড়ল খানিকটা। ছেলেটি কাছে আসতে সুবীর একটু চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “এই লোকটাকে দেখছি রোজ ঘুরঘুর করছে। কে লোকটা জানো? এখানে কী করছে?” সিকিউরিটির ছেলেটি একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোন লোকটা স্যার?” সুবীর গেটের দিকে তাকিয়ে দেখেন সেখানে কেউ নেই। বোধহয় সুবীরকে সিকিউরিটি ডাকতে দেখে সরে পড়েছে। ব্যাপারটা আরো সন্দেহজনক। “এখানেই ছিল। পালিয়েছে মনে হয়। তুমি নজর রেখো। ব্যাপারটা সন্দেহজনক”। সুবীর গাড়ির কাচ তুলে দেন। গাড়ি চলতে শুরু করে। বাইরের গরম হাওয়া ঠান্ডা হতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। গাড়ি চলতে শুরু করলে সুবীর আই-প্যাড খুলে অফিসের একটা জরুরি ফাইল দেখতে থাকেন। কিন্তু গ্রাফ, চার্ট আর নম্বরের জঙ্গল ভেদ করে বার বার লোকটার মুখ ভেসে উঠতে থাকে। লোকটার চোখে একটা অদ্ভুত শূন্যতা ছিল। যেন মনে হয় লোভ বা ভয় দেখিয়ে লোকটাকে কিছু করা যাবে না। সুবীর কোনদিন সিরিয়াল কিলার দেখেন নি। কিন্তু মনে হয় লোকটা হয় পাগল নয় সিরিয়াল কিলার। ওরকম চোখ স্বাভাবিক মানুষের হয় না। চলন্ত গাড়ির মধ্যেও ভয় লাগতে থাকে সুবীরের। নানারকম খবর মনে পড়তে থাকে তার। খুন। খুন তো প্রায়ই হয় আজকাল ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে। বাইরের লোক এসে মেরে রেখে যায়। শুধু একটা লাশ পড়ে থাকে, রক্তের দাগ। তারপর খুনি ধরা পড়ে কখনও কখনও – ক্যানিং, ডায়মন্ডহারবার বা মুম্বই থেকে। কখনও সেসব খুনের কিনারা হয় না। লোকে ভুলে যায়। সুবীর কি লাশ হয়ে যেতে পারেন? বা তার স্ত্রী? মেয়ে? সুবীর নিজের বুকের ধুকপুক শুনতে পান। ভয় লাগতে থাকে। ক্যামাক স্ট্রীটের ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি দাঁড়ালে সুবীর খেয়াল করেন একটা লোক লাল কাপড় বিক্রি করছে। কলকাতার রাস্তার সাধারণ দৃশ্য। সুবীর জানেন ট্যাক্সিওয়ালারা কেনে সেই কাপড়। আজ মনে হল লোকটা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে সোজা। যেন ইশারায় কিছু বোঝাতে চায়। কিছু একটা বিপদ আসছে। সুবীরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাঁকে সতর্ক করে। কিন্তু পরিত্রাণের পথ জানেন না সুবীর। আই-প্যাড সরিয়ে রেখে চিন্তায় ডুবে যান সুবীর।
অফিসে পৌঁছেও সুবীর লোকটাকে ভুলতে পারেন না। লোকটাকে মনে করার চেষ্টা করেন। মাথায় এলোমেলো চুল, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল আর কাঁধে একটা ব্যাগ। সাধারণত ভবঘুরে টাইপ লোকেরা নানারকম প্লাস্টিকের প্যাকেট টেনে বেড়ায়, সুবীর আগে দেখেছেন। কিন্তু এই লোকটার কাঁধে একটা ব্যাগ ছিল, ডাফল ব্যাগের মত। চোখ বুঁজে ভাবার চেষ্টা করেন সুবীর। লাল রঙের ব্যাগ, তার ওপর নাইকির ছাপ মারা – নাইকির জিম ব্যাগ। একটা ভবঘুরে, পাগল এরকম একটা ব্যাগ পাবে কোথা থেকে? কিছু একটা গোলমাল আছে ভাবতে ভাবতে সুবীর বুঝতে পারেন এসির ঠান্ডাতেও তিনি কুলকুল করে ঘামছেন। ঠিক এই সময় কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন অমিত – সুবীরের সহকর্মী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভেতরের টেনশন হয়ত সুবীরের মুখে প্রকাশ পেয়েছিল, অমিত ঢুকেই প্রশ্ন করলেন, “কী ব্যাপার? কী হয়েছে?” নানারকম ছোটখাট বিষয়ে সুবীরের টেনশন করার অভ্যেস আছে বলেই হয়ত অমিত প্রশ্নটা করেছিলেন হাসিমুখে কিন্তু সুবীরের কোঁচকান ভুরু ঠিক হচ্ছে না দেখে তাড়াতাড়ি হাসি মুছে, চেয়ার টেনে বসলেন। সুবীর ঘটনাটা বলার পর অমিতও গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঘটনাটা উপেক্ষা করার মত নয়। আবাসনে বাইরের লোক এসে ডাকাতি বা খুন করে রেখে যাচ্ছে এরকম খবর অমিতও পড়েছেন কাগজে। যদিও অমিত বা সুবীর যে ধরণের আবাসনে থাকেন তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ কড়া তাহলেও তার মধ্যে যে ফাঁক নেই তা তো বলা যায় না। “ব্যাপারটা অবহেলা কোর না সুবীর। একটু লক্ষ্য রাখো। যদি লোকটাকে বার বার দেখা যায় তাহলে তোমাদের হাউসিং-এর কমিটির মিটিং ডেকে কথা বল”। কাজে ফিরে যাওয়ার আগে মতামত দিয়ে যান অমিত।
সুবীর ফ্লাস্কে করে কফি আনেন। সেটাই কাপে ঢেলে চুমুক দিতে দিতে তাঁদের আবাসনের নিরাপত্তার দিকটা ভাবতে থাকেন। অন্য সব আবাসনের মতই তাঁদের আবাসনেও সিকিউরিটি গার্ড আছে, সিসিটিভি আছে। বাইরে থেকে লোক এলে সিকিউরিটি গেট থেকে তাঁদের ফোন করে, ভেতরের লোক ক্যামেরাতে দেখে ছাড়লে তবে তারা ভেতরে আসতে পারে। কিন্তু মূল সমস্যা, সুবীর ভেবে দেখেন, তাঁদের আবাসনের পেছনের বস্তি। প্রোমোটার বলেছিল কিছুদিনের মধ্যে ওই বস্তি উঠে গিয়ে আরেকটা ফ্ল্যাট হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। নিশ্চয়ই বস্তিতে সব পার্টির গুন্ডারা থাকে তাই তাদের কেউ তোলার সাহস দেখাবে বলে মনে হয় না। ভাবতে ভাবতে সুবীর উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তাঁর মনে পড়ে যায় তাঁদের বাড়িতে যে মেয়েটি রান্না করে সেও ওই বস্তি থেকে আসে। সবাই জানে যে মেয়েটি তাদের বাড়িতে কাজ করে তাই তাকে কেউ আটকাবে না। এমন তো হতেই পারে যে মেয়েটাই বস্তির অন্য লোকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তাদের বাড়িতে ডাকাতি করল। মেয়েটি যদি ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় বাইরের লোককে, তাহলে? খবরের কাগজে তো এরকম কতই বেরোয়। সুবীরের মনে পড়ে গত সপ্তাহে গড়িয়াহাটে যে খুনটা হয়েছে তাতে পুলিশ কাজের মেয়েটিকে ধরেছে। পুলিশের বক্তব্য যে সেই মেয়েটিই নিশ্চয়ই এর মধ্যে রয়েছে। সুবীর রান্নার মেয়েটিকে ছাড়িয়ে দিয়ে অন্য এলাকার লোক রাখতে পারেন। কিন্তু সিকিউরিটির ছেলেগুলো? তাদের তো আর সুবীর ইচ্ছে করলেই তাড়াতে পারবেন না। যত ভাবতে থাকেন তত সুবীরের ভেতরটা অস্থির,অস্থির করতে থাকে। আজ বাড়ি ফিরেই বাজোরিয়ার সাথে কথা বলতে হবে। বাজোরিয়া ওদের আবাসন কমিটির প্রেসিডেন্ট, সুবীর সেক্রেটারি। তবে তার আগে একবার আনন্দকে ফোন করা দরকার। আনন্দ, সুবীরের স্কুলের বন্ধু, আইপিএস। এখন কলকাতা পুলিশের এসি বা ডিসি কিছু একটা হবে। সুবীর ফোন বের করেন।
২
এখন বেশ রাত। সুবীর একটা গ্লাসে স্কচ নিয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে পুরো দিনটা ভাবার চেষ্টা করেন। ছ’তলার জানলা দিয়ে দেখে্ন কিছুদুর দিয়ে আলোর নদীর মত বাইপাস বয়ে যাচ্ছে। আনন্দকে ফোন করে খুব যে লাভ হয়েছে এমন নয়। ক্রাইম হওয়ার আগে আনন্দর পক্ষে কিছু করা মুশকিল। তাছাড়া ওই বস্তির ছেলেরা পার্টির হয়ে খাটে, মারামারি করে। কিছু না ঘটলে আনন্দর পক্ষে কিছু করা মুশকিল। কথাটা খুব ভুল নয়, কিন্তু কেউ খুন হলে খুনি অবশ্যই ধরা পড়বে এই আশ্বাসবাক্যে স্বাভাবিক কারণেই সুবীর স্বস্তি পান নি। বাইরে থেকে একবার ঘরের ভেতরের দিকে চোখ ফেরান সুবীর। বিছানায় সরমা ঘুমে অচেতন। পাশের ঘরে তাদের একমাত্র মেয়ে, কলেজ পড়ুয়া অন্তরা। সে বোধহয় এখনও ঘুমোয়নি। কলেজে ওঠার পর থেকে সে অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। সুবীরের বেড়ে ওঠা কলকাতার বাইরে মফস্বলে। অনেক পরিশ্রম আর মেধার জোরে তিনি আজ এখানে পৌঁছেছেন – বাইপাসের ধারের ছ’তলার ফ্ল্যাটে। বাইরের পৃথিবী আর তার অবিরাম অনিশ্চয়তা থেকে অনেক উপরে এই বাড়ি তাঁর পরিবারের সুরক্ষা বলয়। সরমা আর অন্তরার জীবনকে নিরাপদ করার জন্য একের পর এক ইনস্যুরেন্স কিনেছেন সুবীর যাতে সুবীর মারা গেলেও ওদের অসুবিধে না হয়। শহরের বাইরে আবাসনে ফ্ল্যাট কিনেছেন কোটি টাকা দিয়ে। কিন্তু এর পরেও যে এই ধরনের বিপদ আসতে পারে সুবীর ভাবেন নি কোনদিন। সরমা বা অন্তরাকে এখনও কিছু বলেন নি সুবীর। যদিও ওনার ভয় অন্তরাকে নিয়েই বেশি। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে পুরোটাই তাঁর কল্পনা? ছেলেটা হয়ত সত্যি ভবঘুরে, সেরকম কোন খারাপ মতলব হয়ত তার নেই। সমস্যা হল এটা নিশ্চিত ভাবে জানার কোন উপায় নেই। কিন্তু সুবীর সবসময় সাব্ধানের মার নেই নীতিতে বিশ্বাস করে এসেছেন। নাহ, কাল একবার বাজোরিয়ার সাথে কথা বলতে হবে। সুবীর ব্যালকনিতে বেড়িয়ে আসেন। এখান থেকে আবাসনের গেট স্পষ্ট দেখা যায়। এই রাতেও দেখলেন সিকিউরিটির ছেলেগুলো জেগে বসে আছে, গেটের সামনে দিয়ে হাঁটাচলা করছে। খানিক নিশ্চিন্ত হন সুবীর আর তারপরেই খেয়াল করেন গেটের পাশের দিকে নীল জামা পরা একটা সিকিউরিটির ছেলে সকালের সেই লোকটার সঙ্গে কথা বলছে।
৩
সকালের যোগব্যায়ামের ক্লাসে সুবীর, বাজোরিয়াকে ধরলেন। সবার সামনে সুবীর আধুনিক রীতি মেনে ইয়োগা বললেও, নিজের মাথার ভেতরে যোগব্যায়াম শব্দটা রয়ে গেছে। কিছু পুরোন অভ্যেস থেকেই যায়। বাজোরিয়া অর্থাৎ নিরঞ্জন বাজোরিয়া, বাজোরিয়া ইন্টেরিয়রসের মালিক এবং সুবীরদের আবাসনের প্রেসিডেন্ট। পদবিতে মারোয়াড়ি হলেও বাজোরিয়ারা বহুদিনই কলকাতার বাসিন্দা, নিরঞ্জন বাংলাও খুব ভালো বলেন। সুবীরের থেকে বয়সে একটু বড় হলেও বাজোরিয়ার সঙ্গে সুবীরের একটা চমৎকার বন্ধুত্ব আছে। সুবীর বাজোরিয়াকে বাজোরিয়াজি আর বাজোরিয়া সুবীরকে দাদা বলে ডাকেন। দুই পরিবারের মধ্যে দিওয়ালি আর পূজোতে উপহারও বিনিময় হয়। বাজোরিয়া সুবীরের কথা মন দিয়ে শুনলেন এবং বললেন তিনি নিজেও খুব সন্দেহজনক কিছু লোককে আবাসনের চারপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন। তিনি নিশ্চিত এই লোকগুলোর সঙ্গে তাঁদের আবাসনের সিকিউরিটির ছেলেদের অনেকেরই যোগাযোগ আছে। সুবীর আর বাজোরিয়া অনেকক্ষণ এই নিয়ে আলোচনাও করলেন যে কী করা যায়। ঠিক হল তাঁরা সিকিউরিটি এজেন্সির সঙ্গে কথা বলবেন যাতে তারা লোকাল ছেলে না দিয়ে একটু দুরের ছেলে দেয়। বাজোরিয়া ফোন করলেন সিকিউরিটি এজেন্সিকে। সুবীর দাঁড়িয়ে রইলেন উদ্বিগ্ন মুখে। ফোন নামিয়ে হতাশ ভাবে মাথা নাড়লেন বাজোরিয়া। “সরি দাদা, কিছু করা গেল না। ওরা বলছে আমাদের এখানকার বেশিরভাগ সিকিউরিটি গার্ডই নাকি ওই বস্তি থেকে আসে। কিন্তু তাদের ছাঁটাই করা যাবে না, কারণ পলিটিক্যাল প্রেশার আছে। আমাদের বিল্ডিং হওয়ার আগে এই ছেলেদের অনেকের ফ্যামিলিই এই জমিতে থাকত ঝুপড়ি বানিয়ে। ইল্লিগ্যাল ঝুপড়ি, কিন্তু বোঝেনই তো ব্যাপার। যখন আমাদের হাউসিং তৈরি হয়েছিল তখন তাদের জমি থেকে তোলার জন্য লোকাল পার্টি, প্রোমোটার সবাই মিলে ঠিক করে ওই সব ফ্যামিলির একটা করে ছেলেকে এখানে সিকিউরিটির চাকরি দেবে। সেই অনুযায়ী সিকিউরিটি এজেন্সি লোকাল ছেলেদেরই এখানে রাখে। এজেন্সি বলল ওরা চেষ্টা করছে ওদের অন্য জায়গায় বদলি করে এখানে অন্য লোক দিতে। তবে মনে হচ্ছে না কিছু হবে”। সুবীর জানেন কিছু হবে না। অন্য সমাধান ভাবতে হবে।
৪
সমাধানটা বেরোল অভীকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে। অভীক, সুবীরের ভায়রা ভাই এবং স্টেটস নিবাসী ইঞ্জিনিয়ার। অভীক বলল, “আরে সুবীরদা, এই টেকনোলজির বাজারে এসব কোন ব্যাপার হল? অটোমেটেড গেট বসিয়ে দাও! তোমাদের থেকে কোড না পেলে গেট খুলবে না। এমনও করা যেতে পারে নতুন কোড জেনারেট হবে ঘন্টায়, ঘন্টায়। কোন রেসিডেন্ট চাইলে অ্যাপ থেকে কোড জেনারেট হবে, অনেকটা ওটিপি’র মত আর সেই কোড দিলে তবেই দরজা খুলবে। তবে হ্যাঁ, একটু খরচা আছে”। খরচা সুবীরদের আবাসনের কারো কাছেই খুব একটা সমস্যা না। তাছাড়া আবাসিকদের অনেকেই দেখেছে যে উটকো লোকজন হকার সেজে যখন তখন ঢুকে পড়ছে। তাই আবাসিকদের মিটিং-এ প্রস্তাব পাশ করাতে অসুবিধে হয় নি। তবে সিকিউরিটির ছেলেদের এক্ষুণি চাকরি ছাড়ানোর দরকার নেই। তাহলে এলাকায় গোলমাল হতে পারে। ঠিক হয়েছে আপাতত নতুন ব্যবস্থায় অটোমেটেড গেট আর সিকিউরিটি দু-ই থাকবে। সিকিউরিটির ছেলেরা গেটের বাইরে বসে যারা আসছে তাদের নাম ঠিকানা লিখবে। এছাড়া আবাসনের অন্য অনেক ধরনের মেরামতির কাজ তদারকির জন্যও সিকিউরিটির ছেলেদের দরকার হয়। আপাতত ওরা সেইসব কাজও করবে। কয়েকমাস গেলে, অবস্থা বুঝে এজেন্সিকে বলা হবে ধাপে ধাপে কম কম ছেলে পাঠাতে। এরপরের ধাপ হল দেশে কারা এরকম গেট বানায় তার খোঁজ নেওয়া। সেরকম চারটে কোম্পানি পাওয়া গেল। তাদের লোক এসে একদিন আবাসনের কমিটির সামনে প্রেজেন্টেশনও দিল। সেটা বড়দিনের পরের দিন ছিল। তাদের মধ্যে থেকে সুবীররা একটি কোম্পানিকে বেছে নিলেন। তাদের গেট এতই পোক্ত যে গ্রেনেড দিয়েও তাকে ওড়ানো যাবে না। এর পাশাপাশি, তাদের সফটওয়্যার একদম স্টেট অফ দি আর্ট, কোন ভাবেই কেউ হ্যাক করতে পারবে না। অনেক বড় শিল্পপতি আর রাজনৈতিক লোকজনের বাড়িতে তাদের সিকিউরিটি সিস্টেম বসানো আছে।
সরস্বতী পূজোর দুদিন পর থেকে গেট বসানোর কাজ শুরু হল আর তার উদ্বোধন হল ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। সুবীরদের আবাসন এখন কলকাতার সবচেয়ে সুরক্ষিত আবাসনের একটা। সুবীর খেয়াল করে দেখেছেন সেই দাড়িওয়ালা লোকটাকেও গেট বসানো শুরু করার পর আর দেখা যায় নি। এর কিছুদিন পরেই আবাসনের হোলির পার্টি । অনেকেই এসে সুবীরকে ধন্যবাদ দিয়ে গেল এত চমৎকার একটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্দোবস্ত করার জন্য। কাবাব আর স্কচের সঙ্গে সঙ্গে একটা বোধ চাড়িয়ে যেতে থাকল সুবীরের মাথার মধ্যে, সেটা নিরাপত্তা আর তৃপ্তি্র একটা মিশেল। তাঁদের গেট বাইরের সমস্ত ক্যাওস, কোলাহল আর ক্রাইমকে বাইরেই রেখে দেবে এরকম একটা বিশ্বাস সুবীরকে আরো ফুরফুরে করে তুলছিল। এমন সময় সুবীর খেয়াল করেন যে দূর থেকে বিভাস আসছে, সঙ্গে একজন মধ্যতিরিশের ভদ্রমহিলা। দুজনের হাতেই পানপাত্র। বিভাস উকিল, থাকে সুবীরদের আবাসনেই । বিভাস এসেই বললেন, “সু্বীর, তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দিই। এ’ হল আমার শ্যালিকা সুরঙ্গমা। আর সুরঙ্গমা, এ’ হল সুবীর। আমাদের হাউসিং-এ যে নতুন গেট আর সিকিউরিটি সিস্টেম দেখছ, এই সব সুবীরের পরিকল্পনা”। সুরঙ্গমা মুখ খোলে এবার, “সুবীরবাবু, আমি রাজারহাটের অ্যাটলান্টিস এ থাকি। আপনাদের এই সিকিউরিটি সিস্টেম আমার দারুণ লাগল। আমাদের হাউসিং-এর সিকিউরিটি নিয়ে আমরা খুব চিন্তায় থাকি। আপনার থেকে সব ডিটেইলস নেব কিন্তু”। “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই”। উৎসাহের সঙ্গে বলে সুবীর। নিজের ফোন নাম্বার দেয়। সুবীর অ্যাটলান্টিসের নাম জানে। খুব বড় আর দামী আবাসন। অনেক নামকরা লোক থাকে সেখানে। অ্যাটলান্টিস যা পারেনি সেটা সুবীর করে দেখিয়েছে এই ভাবনাটা সুবীরকে যে কিকটা দেয় সেটা খুব দামী স্কচেও পাওয়া যায় না। সুবীরের মুখে একটা হাসির রেখে ফুটে ওঠে, গর্বের হাসি। চারপাশের হই-হল্লার মধ্যে হাসিটা জেগে থাকে। অনেকটা চেশায়ার বেড়ালের হাসির মত।
সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে স্কচের গ্লাস নিয়ে জানলার ধারে দাঁড়ান সুবীর। বাইরে নদীর মত বয়ে যাচ্ছে বাইপাস, যেমন যায় বহুদিন ধরেই। তফাৎ হল সে নদীর জল আর গায়ে লাগবে না সুবীর বা তার পরিবারের। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখেন সরমা ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে। পাশের ঘরে অন্তরা হয়ত বা জেগে। আজ সুবীর নিশ্চিন্ত। সরমা-অন্তরার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন তিনি। নিজেকে দুর্ভেদ্য মনে হতে থাকে সুবীরের। অনেকদিন আগে পড়া দুটো লাইন ঘুরে ঘুরে আসে মনের মধ্যে “এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন/ শরীর দিয়েছ শুধু বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে”। সুবীর আজ বর্ম পেয়ে গেছেন।
৫
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ধোঁয়ার গন্ধে। প্রথমে মনে হয়েছিল ন্যাড়া পোড়ার ধোঁয়া। পেছনের বস্তিতে কেউ পোড়াচ্ছে হয়ত। তারপর মনে হল এটা তো মে মাস! ন্যাড়া পোড়ানোর সময় তো এটা নয়। ঘুম থেকে উঠে বসে সুবীর দেখলেন ঘরের মধ্যে ধোঁয়া আর অন্ধকার। সরমাকে ডেকে তুলতে গিয়ে মনে হল আজ দুদিন হল সরমা আর অন্তরা দুর্গাপুর গেছে, অন্তরার মামার বাড়ি। প্রাথমিক ঘোর কাটিয়ে মোবাইলটা খুঁজে বের করলেন। মোবাইলের আলোয় ব্যালকনি তে বেরিয়ে দেখলেন বাইরেটা একটা হলুদ আলোতে ভরে গেছে। আগুন লেগেছে তাঁদের টাওয়ারে। আস্তে আস্তে দেওয়াল তেতে উঠছে, ধোঁয়াতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হয় বেশ কিছুক্ষণ আগেই লেগেছে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে ছিল বলে টের পায় নি। ঘুম ভেঙ্গেছে আগুন অনেকটা ছড়িয়ে যাওয়ার পরে। সুবীর মাথা ঠান্ডা করে ফোন করেন বাজোরিয়াকে। বাজোরিয়া জানান দমকলে ফোন গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনটে ইঞ্জিন চলে আসবে। ফোন রেখেই সুবীর শুনতে পান দমকলের গাড়ির আওয়াজ। পরপর তিনটে দমকলের গাড়ি এসে দাঁড়ায় গেটের সামনে। কিন্তু গেট খোলে না। দমকলের লোক গাড়ি থেকে নেমে বোঝার চেষ্টা করে কীভাবে গেট খুলবে। গেটে থাকা সিকিউরিটির ছেলেটা চেষ্টা করে, কিন্তু গেট খোলে না। এই সময় বাজোরিয়ার ফোন বাজে। “সর্বনাশ হয়ে গেছে দাদা। গেটের অপারেটিং সিস্টেম আগুনে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন গেট খুলছে না আর গেট না খুললে তো দমকলের গাড়ি ঢুকতে পারবে না”। সুবীরের দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। তাহলে উপায়? সুবীর ফ্ল্যাটের দরজা খুলে নিচে নামার চেষ্টা করেন কিন্তু আগুন আর ধোঁয়া ততক্ষণে সিঁড়িকে গ্রাস করে নিয়েছে। ওদিক দিয়ে নামা যাবে না। সুবীর আবার ব্যালকনিতে ফেরেন। বাইরে থেকে একটা দুটো লোক জমা হচ্ছে গেটের বাইরে। এরা সব পেছনের বস্তির লোক। সংখ্যাটা বাড়তে থাকে ক্রমশ। তাদের হাতে শাবল, কোদাল, কুড়ুল, লোহার রড জাতীয় ছোটখাট যন্ত্রপাতি। তারা সেইসব নিয়ে গেটের ওপর মারতে থাকে। সেই সমবেত আঘাতে গেট একটা গম্ভীর গর্জন করে ওঠে। কিন্তু ১০ ইঞ্চির রিইনফোর্সড স্টীলে টোলও পড়ে না। সুবীর দেখেন আরো লোক জমা হচ্ছে শাবল, কুড়ুল নিয়ে। ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা গেটের ওপর। ধোঁয়ায় ভাল বোঝা যায় না, তবু সুবীরের যেন মনে হয় সেই দাড়িওয়ালা লোকটাও আছে সে ভিড়ে, একটা হাতুড়ি নিয়ে পাগলের মত ঘা মেরে যাচ্ছে গেটটার ওপরে। দেখতে দেখতে প্রায় একশ’ লোক জমা হয়েছে গেটের সামনে। তাদের সন্মিলিত আঘাতে কেঁপে, কেঁপে ওঠে গেট। কিন্তু ভেঙ্গে পড়ে না। তাদের সন্মিলিত আঘাতে কেঁপে, কেঁপে ওঠে গেট। কিন্তু ভেঙ্গে পড়ে না, দাঁড়িয়ে থাকে দুর্ভেদ্য বর্মের মতই। গেট তার প্রথম পরীক্ষাতেই পাশ করল ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে। নিজের অজান্তেই সুবীরের মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে, তৃপ্তির হাসি। আগুন, কান্না, কোলাহল আর পোড়া গন্ধের মধ্যেও হাসিটা জেগে থাকে। অনেকটা চেশায়ার বেড়ালের হাসির মত। আগুন এগিয়ে আসে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।