“আমবাগানে আমগাছ আর ফুলগাছের সঙ্গে ছিল একটা অশ্বত্থ গাছ। অশ্বত্থ গাছের পাতার আকার পানপাতার মতো, আমরা হৃৎপিণ্ডকে যে আকার দিতে ভালোবাসি সেই আকার। যেন প্রেমের গাছ, পাতা ঝরিয়ে প্রেম বিলোয়। এমন একটা অশ্বত্থ গাছের তলায়ই তো বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিলেন আর শিষ্যদের সেই নির্বাণলাভের আলো বিলিয়েছিলেন। এইসব সাত পাঁচ ভাবতাম আর দেখতাম গাছের ছায়ায় ঘুমানো সৃজনদাকে।
সকাল-বিকেল খাটুনির শেষে মজুরি একটাই। দৃষ্টিসুখ। শুধু লতা, পাতা, ফুল দেখার দৃষ্টিসুখ নয়, আরও কিছু দেখা। সৃজনদাকে দেখা।”
কেন দেখে সে? কারণ, ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে’। ষোল’র স্বচ্ছ চোখে টলটল করে ভালবাসা। ভাব গোপন করার অভিজ্ঞতা-শাসন তখনও তার অনায়াস-আয়ত্ত নয়। সহজেই সে চোখের ভাষা পড়ে নিতে পারে উদ্দিষ্ট জন। একের মনে যে সুন্দরের তৃষ্ণা, তবে অপরজনের মনের সুরটি যদি অন্য তারে বাঁধা হয়? বেদনার অনিবার্যতা হেমন্তের আবছা হিমের মত জড়িয়ে থাকে সে সম্পর্কের গায়ে। অথচ মুর্শেদরা জানেন, বেসুর থাকে বলেই না আমাদের সাধনা জীবনে সুরকে ছোঁয়ার। বেসুরকে ছেঁটে দিলে সুরের সৌন্দর্যও ঝলক হারায়। তাই কখনো কখনো বেদনাকে আশ্রয় করেই লতিয়ে বাড়ে জীবন। আশায় আশায়। যেমনটা হয়েছিল মল্লারের।
একে অপরকে চিনে নেওয়ার অনির্দেশ্য সংলগ্নতার কাল পেরিয়ে গেল দ্রুত। সম্পর্ক নোঙর ফেলল দেহময়তার ঝোড়ো সমুদ্রে। কি পেল মল্লার সেখানে? পেল নিত্যসখ্যতা, অন্তরঙ্গতার অধিকার। আর সেই সঙ্গে একে অপরকে ভাল না বাসার কঠোর শর্ত। দয়িতর পাশে থেকে তবু ভাল না-বাসা – এ এক আশ্চর্য মাদারির খেলা! বাইরের লোকের কাছে মল্লারের পরিচয় সৃজনের ভাই-এর বন্ধু, ভাই-এর মত। যৌথতার উৎসবে যে রেকগনিশন সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে, তা মল্লারের অধরাই রয়ে গেল। তবে এ গল্প যতটা সৃজনের নিজের শর্তে বাঁচার, ততটাই মল্লারের নিজেকে খুঁজে পাওয়ার। তাই বই-এর প্রথমার্ধ যদি সৃজনের মল্লারের উপর দাদাগিরির হয়, পরের অংশ মল্লারের শর্তসাপেক্ষ ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে আত্মোপ্লব্ধির দরজায় পা রাখার।
আর কোনো চিহ্ন পড়ে নেই
আমারও মনের মধ্যে কোনো নীল রেখাপাত নেই। শুধু
তোমার কথাতে কোনো কষ্টের আঘাত পাইনি দেখে
অবিরাম কষ্ট হতে থাকে!
- শঙ্খ ঘোষের কষ্ট থেকে …
গল্পের বাকিটুকু আপাতত উহ্যই থাক। কৌতূহলী পাঠক বরং নিজেই পড়ে নিন ‘ভালো না-বাসার গল্প’, লেখক সুদীপ্ত পাল। প্রকাশক সৃষ্টিসুখ।
বইটা নিয়ে এখন দু’ চারটে কথা বলা যাক। বই-এর দুই প্রধান চরিত্র, সৃজন আর মল্লার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাড়ির সন্তান। পরবর্তী জীবনে, উত্তর-গ্লোবালাইজেশন জমানার গ্লোব-ট্রটিং চাকুরিজীবি। আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা এরকম রোল মডেলই কামনা করি। তবে এঁরা, পাঠক এতক্ষণে নিশ্চিত বুঝে গেছেন, আমাদের চারপাশের হেটেরোনর্মাটিভ পরিসরের বাইরে। ফলে কেউ কেউ হয়তো বলবেন, যে অন্য যৌনতার জগতের বাসিন্দা ছাড়া তথাকথিত “সাধারণ” পাঠক কী আর এই বই পড়ে সুখ পাবেন? কী করে চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখার সুখ পাবেন? পাঠের চরম সুখ তো চরিত্রের সঙ্গে আইডেন্টিফিকেশন থেকেই আসে। এই বই-এর ক্ষেত্রে এরকম মনে হওয়া ভিত্তিহীন বলেই মনে হয়। প্রবল রকমের সনাতনপন্থী না হলে, একমাত্র সন্তানজন্মই যৌনতার মূলে আর অন্য সব রকম যৌনতার অভিজ্ঞতা বিষবৎ পরিত্যজ্য – এই গোছের ধ্যানধারণা না থাকলে, এই বই-এর মূল সুরটি যে কোন পাঠকেরই চোখ এড়াবে না। সমপ্রেমের আধারে এ আসলে এক চিরন্তন জীবন পরিক্রমার গল্প। যে পথের শুরুতেও ভালবাসা, শেষেও ভালবাসা – শুধু মানুষগুলোই যে চিত্রনাট্যে জায়গা পালটে ফেলে।
গঠনবিচারে অবশ্য এই বই যত না উপন্যাসধর্মী, তার থেকেও বেশি ছোটগল্প অনুসারী। চরিত্রের স্বল্পতা, প্লটের একমুখী মাইক্রোস্কোপিক ঘনসংবদ্ধতা একে উপন্যাসের পরিসরের সীমান্তে ঠেলে দেয়। শুধুমাত্র মল্লার ও সৃজনের সম্পর্কের চিত্রণেই লেখক নিবিষ্ট থেকেছেন। একেবারে অর্জুনের চোখ, আর কোনোদিকে তার নজর নেই। অথচ সম্পর্ক ধারণ করে সমাজ, পরিবেশ। বিশেষত যে মফঃস্বলের পটভুমিকায় মল্লার আর সৃজনের বিচরণ, সেখানে সমাজ এখনও ততখানি ব্যক্তিতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি। ব্যক্তি-যৌনতার আলোচনায় সেই সামুদয়িক সমাজের আধুনিক চণ্ডীমণ্ডপের কি একেবারেই শূন্য-ভূমিকা? মনে হয় না। অথচ সে সম্পর্কে লেখক সম্পূর্ণ নীরব। নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে মল্লারের বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ না থাকা আর তারই পাশে পাশে সৃজনের নিজের বাই-সেক্সুয়ালিটিকে লুকিয়ে রাখার কারণ কোথায় নিহিত? পরিবেশ-পরিবারের সীমানার মধ্যে তার সন্ধান জরুরী। লেখক নিষ্করুণভাবে চরিত্রচিত্রণের সেই দিকগুলি এড়িয়ে গেছেন। এমনকি মল্লারের বন্ধু, সৃজনের ভাই নচিকেতার চরিত্রও যেন কিছুটা অসম্পূর্ণ সৃষ্টি। নচিকেতার সঙ্গে মল্লারের ঝগড়ার অংশটাও বড্ড সরল। সামাজিক কুটিল হোমোফোবিক প্রতিরোধের নখ-দাঁতগুলো যেন ভেলভেট গ্লাভসে ঢাকা। বৃহত্তর পরিবেশকে ক্যানভ্যাস থেকে সরিয়ে দেওয়ায় ঘটনার বহুমাত্রিকতা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে বইকি!
সৃজনের চরিত্রের জটিলতা অবশ্য কিছুটা সে দুঃখ ভোলায়। সে ভালবাসাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে, কিন্তু কোনো বন্ধনে নিজেকে জড়ায় না। এদিকে সৃজনের চরিত্রের এক চমকপ্রদ দিকের ইশারা রয়েছে গল্পে। সে কথা বলার সময় নিজের উল্লেখ করে ‘সৃজনদা’ বলে। কোনো কোনো সাইকোলজিস্ট বলেন, যারা এভাবে নিজেকে তৃতীয় ব্যক্তি বলে দেখে অভ্যস্ত – তারা আত্মরতিময়, আত্মনিমগ্ন হয়। তাহলে কি সে কারণেই সৃজন আর মল্লারের ভালবাসা একাকী গায়কের গান হয়েই রয়ে গেল? উভপাক্ষিক আবেগী ঘনিষ্ঠতার, পারস্পরিক নির্ভরতার জায়গা তৈরিই হল না? তবে শেষ অবধি সৃজনের জন্য চোখের কোণে মায়ার বাষ্পও জমে। ঠিক সময়ে নিজের মনকে চিনতে ব্যর্থ হওয়া বা বুঝেও মনকে গুরুত্ব নিতে না পারা একজন ব্যর্থ মানুষের জীবনের থেকে আর কী-ই বা পাওনা থাকে?
তবে সৃজন নয়, এ বই এর উজ্জ্বলতর চরিত্র মল্লার। গল্প থেকে যেটুকু আভাস মেলে, সে মফঃস্বলের মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে। স্কুলের ছাত্র। সে কিন্তু তার নিজের সমকামিতা নিয়ে সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন। স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ। নিজের যৌন ওরিয়েন্টেশন তার কাছে কোনো গ্লানির বিষয় না। তার নিজেকে নিয়ে সহজতা এ উপন্যাসের বড় সম্পদ। তার সেই সুবাদেই এই বই-এর মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ভালবাসা, যৌনতা উপস্থিত থেকেও মঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে ভালবাসাকে। এমন চরিত্র সৃষ্টির জন্য লেখকের অনেকখানি প্রশংসা প্রাপ্য। বাংলা সাহিত্যের অন্য যৌনতা বিষয়ের সাহিত্যের ক্ষীণতনু সম্ভারে শুধুমাত্র মল্লারের মত একটা চরিত্রের জন্য লেখকের একটা পাকা জায়গা হয়ে থাকা উচিত। হয়তো একটা বড়সড় সমাজবদলের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে মল্লারের সাবলীলতায়। মল্লাররা হয়তো বলতে চাইছে, দ্বিধা-ভরা কাম আউট এর যুগ এখন অতীত, নিঃসংকোচে নিজেদের জায়গা দাবি করার সময় এসে গেছে। এই বদলকে স্বাগত জানাতে আমরা প্রস্তুত তো?
ভালো না-বাসার গল্প
সুদীপ্ত পাল
প্রকাশক: সৃষ্টিসুখ