আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের দুর্নাম নেহাৎ কম ছিলো না। ঠিক হোক বা বেঠিক, সেসব না বললে 'ক্রিটিকালি' দেখা হবে না! সিধে একবগগা দৃষ্টিভঙ্গির এখন মোটেই কদর নেই। প্রশংসার যোগ্যকে প্রশংসা করলেও লোকে ভাবে স্তাবকতা। আর সম্মানিতের কাছা খুলে দিলে সেটা হয় আধুনিকতা। অতএব খুঁজেপেতে দেখতেই হবে, আমার ঢাকাইয়া পিতামহীর জবানে, কোথায় কোন 'গু লাইগ্যা আছে' ( তাঁর ভাষা হুবহু তুলে এখানে তুলে ধরবার হিম্মত আমার নেই)।
মুশকিল হলো যে মানুষটা সারাজীবন ব্রিটিশ পুলিশের নেক নজরে থাকলেন, যাঁর নামে ঢাউস ফাইল তৈরি হলো আইবি দপ্তরে, তাকে ইংরেজের পোষ্য বললে ঠিক হয় কি? তবু শুনি তিনি নাকি বেঙ্গল কেমিক্যালসে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় নাইট্রিক এসিডের উৎপাদন অব্যাহত রেখে ইংরেজ সরকারকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তা খালি ইংরেজ সরকার বলা হচ্ছে কেন, ভাই? মিত্রশক্তি বলে একটা কিছু ছিলো না তখন? নাইট্রিক এসিডের আকালে ভারত থেকে, এই কলকাতা থেকে নাইট্রিক এসিড যোগানো হয়েছে, তা ইস্তেমাল করে মিত্রশক্তি জিতেছে। ভালো হয়েছে। আপনার আমার গ্রেটার, লেসার ইভিল বেছে নেবার স্বাধীনতা আছে, আচার্যের নেই? তিনি কাইজারের তুলনায় ইংরেজকে লেসার ইভিল ভেবেছেন, সেই অনুযায়ী কাজ করেছেন। এতে এতো আপত্তির কী আছে? নাকি ক্রিটিকালি দেখতে হবে বলেই যা খুশি তাই বলে দেওয়া যায়!
আইবি রেকর্ডস ঘাঁটলে দেখতে পাচ্ছি তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কোন ভাষণে কী বললেন সব পুলিশের নখদর্পণে। সেখানেই থামা নেই। অবিনাশ চন্দ্র ঘোষ নামে এক বিপ্লবীর পরিচয়ে লেখা হচ্ছে, এ কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্সি কলেজের ডঃ পি সি রায়ের কাছে গ্লাস তৈরি করতে শিখেছে। এসিড নিয়েও এ কাজ করে। তাইতে পুলিশ প্রফুল্ল চন্দ্রের এই ছাত্রটির ওপর কড়া নজর রাখছে। আর একদিনের রেকর্ডে লিখে রাখছে ৩০০ ছাত্রকে নিয়ে তিনি এলবার্ট হলে সভা করছেন সিরাজগঞ্জের ইস্মাইল হোসেন সিরাজির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করবার জন্য।
অনেকে তাঁর নাইটহুড প্রাপ্তিকে স্তাবকতার ফল ভাবেন। এই মণিহার তিনি কখনো আপন করে নেননি, ঢাউস আত্মচরিতে কোথাও খেতাবপ্রাপ্তির উল্লেখ অব্দি করেননি। সেটাও অবশ্য অতিবাম মতে লুকিয়ে যাওয়া। যেন উনি না বললে কেউ জানতেই পারবে না। উপরন্তু যে বছর তাকে নাইটহুড দেওয়া হয়, সে বছরেই তিনি প্রকাশ্যে রাউলাট আইনের তীব্র নিন্দা করে টাউন হলে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। আমরা কিন্তু ইউএপিএ-র বিরুদ্ধে মুখর হই না, স্ট্যানস্বামীকে জেলখানার ভেতর তিলে তিলে মরতে দিই। দেশপ্রেমের পুরস্কার আচার্য তো সেদিনই পেয়েছিলেন নকশাল আমলে যেদিন তাঁর মায়ের মাস্টারমশাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে একই দিনে তার মাথা ধুলায় গড়ায়।
চামচাগিরি করতে হলে তো কতো সুযোগ ছিলো। গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পেয়ে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট হাসিল করে দেশে না ফিরলেই হতো। সেখানেও তো সাদা প্রভুদের তোয়াক্কা না করে সিপাহি বিদ্রোহকে সমর্থন করে প্রবন্ধ লিখেছেন, সেটা ছাপিয়েছেন। দেশে এসে একবছর বেকার, ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সমান কোয়ালিফিকেশনে সমান মাইনে দেয়নি তাঁকে। জগদীশ চন্দ্র বসুকেও সেই কম মাইনে নিতে হয়েছিলো। তবুও প্রেসিডেন্সি ল্যাবরেটরিতে সোনার টুকরো ছাত্রদের খুঁজে বার করে তাদের দিয়ে গবেষণা করানো, প্রেসিডেন্সিতে কর্মসীমার ২৮ বছরে, মাত্র দুটি বছর বাদে, প্রত্যেক বছরে ছাত্রদের নিয়ে এক বা একাধিক উচ্চ মানের গবেষণা পত্র প্রকাশের গৌরব তাঁর, এসব আমরা যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ারাম গয়ারাম, তাদের মনেই থাকে না। গবেষণা শুধু কলেজে নয়, বাড়িতেও চলতো। ১৯১, আপার সার্কুলার রোডের ভাড়া বাড়িতে কলেজ থেকে এসেই বেঙ্গল কেমিক্যালসের কাজে লেগে যেতেন। হ্যাঁ, তখনও মাণিকতলায় জমি কেনার সামর্থ্য হয়নি, কারখানা তো দূর অস্ত। নিজের থাকবার ঘরেই তখন চলছে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধ তৈরি। নামটি তখন থেকেই খুব পছন্দ, বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস।
তারও আগে প্রফুল্ল চন্দ্র ফসফেট অব সোডা আর সুপার ফসফেট অব লাইম নিয়ে পরীক্ষা শুরু করলেন। নিজেই নিজেকে তুলনা করতেন স্যামসন ডেলাইলা আখ্যানের স্যামসনের সঙ্গে যার শক্তির প্রধান উৎস ছিল নিজের মাথার চুল। তেমনি রসায়নবিদ আর পরীক্ষাগার এই দুই ছিল প্রফুল্ল চন্দ্রের কাছে পারস্পরিক শক্তির উৎস। এককে ছাড়া অন্যে নেই। যাই হোক, ওঁর গাত্রদাহ কেন এই জিনিস গুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে, কেন আমরা স্বয়ংভর হবো না। সব সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্ট উনি যে স্টাইলে করেছেন, এখানেও তার কোনো ব্যত্যয় হলো না। মানে একেবারে দেশজ পদ্ধতিতে, দেশজ উপাদান ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। উনি প্রথমেই ভাবলেন যে উপাদান থেকে এইসব জিনিস তৈরি হয়, তা তো চারপাশে এতোই অঢেল যে বিদেশে রপ্তানি হয়। তাহলে চেষ্টা করতে দোষ কী! যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সেখানে থেকে রাজাবাজার কাছে। পশুমাংস
বিক্রেতাদের কাছ থেকে কয়েক বস্তা কাঁচা হাড় প্রফুল্ল চন্দ্র সংগ্রহ করলেন। নিজের ঘরের ছাদে শুকোতে দিলেন। তখন জানুয়ারি মাস, কিন্তু প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় ১৫ দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চারপাশ দুর্গন্ধে ভরে গেল। পোকা হল এবং ঝাঁকে ঝাঁকে কাক মহাভোজ শুরু করলো। প্রতিবেশীদের তুমুল আপত্তিতে সেগুলো সরাতেই হলো। কিন্তু কাজ থামলো না। দূরে এক খন্ড জমিতে সেই হাড়ে আগুন লাগিয়ে সালফিউরিক এসিডের সাহায্যে সুপার ফসফেট অব লাইম তৈরি হলো এবং ছাত্রদের দেখিয়ে দেখিয়ে আচার্য হাড়ের ছাই ক্যালসিয়াম জ্ঞানে চিবিয়ে খেতে শুরু করলেন এবং ছাত্রদেরও খেতে উৎসাহিত করলেন।
এটাই চলেছে ওঁর সারা জীবন ধরে। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় যা চর্চা করেছেন, হাতে কলমে করেছেন আর তার শেকড় সবসময় প্রোথিত থেকেছে সমাজজীবনে, মানুষের যাপনে। তাতে গ্ল্যামারে হয়তো টান পড়েছে, কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিকেও জোর পড়ায় উপকার হয়েছে সাধারণ মানুষের। তেল ও ঘি-তে ভেজাল দেওয়া, অলঙ্কার প্রস্তুতিতে সোনার অপচয়, চালের গুণাগুণ, সব তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো। আর একটা কথা। দেশের যুবশক্তিকে যখন তিনি স্বনির্ভরতার রাস্তা দেখিয়েছেন, তখন কিন্তু তাদের চা চপ বেচে দিন গুজরান করার উপদেশ দেননি। স্বদেশী ভাবধারায় উদ্দীপিত হয়ে দেশজ উপাদান ও বর্জ্য পদার্থ কাজে লাগিয়ে রাসায়নিক কারখানা প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেছেন ও তাকে সাকার করেছেন। বেঙ্গল কেমিক্যালসে সাধারণ ঘরের বাঙালি ছেলেরা সম্মান নিয়ে কাজের সুযোগই শুধু পায়নি, নিজেদের মধ্যকার বিজ্ঞান চেতনাকে শীর্ষে নিয়ে যাবার সুযোগও পেয়েছে। এই কারখানায় শুরু হয়েছিলো লোহার পাতের ওপর সিসার প্রলেপ লাগাবার পদ্ধতি, সালফিউরিক এসিড তৈরিতে যা অবশ্যপালনীয়। করলেন হাতেকলমে কাজ করা মিস্ত্রিরাই। রাজশেখর বসু এলেন, যেন সোনায় সোহাগা পড়লো। কারখানাতেই তৈরি হলো দেশের প্রথম অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, মেডিকেটেড তুলোর ব্যান্ডেজ, গ্যাস বার্ণার, নিখুঁত তুলাযন্ত্র। বাঙালি ছেলেরাই তৈরি করছিলো এগুলো। ছড়িয়ে যাচ্ছিলো সারা দেশে। একসময় তিন হাজারের বেশি কর্মী ছিলো।
ওর সবটা জানতে হলে যেতে হবে মাণিকতলায় বেঙ্গল কেমিক্যালসের চত্বরে। ভেতরে ঢুকলেই ওকে দেখতে পাবেন চত্বরের পেছনদিকের সবুজ ঘাস খাচ্ছে ঘুরে ঘুরে। বুড়ো বেতো সাদা ঘোড়া আমাদের!
দেশের মধ্যে সেরা ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি ছিলো এই বেঙ্গল কেমিক্যালস। তাও দেশ তখন বিদেশি শক্তির উপনিবেশ। সাহেবি কম্পানিগুলির সঙ্গে এঁটে ওঠা দুষ্কর ছিলো তখন। এখানকার তৈরি এলকোহলের চাহিদা অনেকদিন ধরেই কলকাতার স্কুল কলেজ ল্যাবোরেটরি হাসপাতালে এক নম্বরে। রমরমিয়ে প্ল্যান্ট চলছে। কিন্তু কিছুদিন পর আধুনিকীকরণের দরকার দেখা দিলো। প্ল্যান্ট বন্ধ করে দিয়ে টাকার জন্য ধর্ণা দেওয়া শুরু হলো স্বাধীন দেশে। সেই টাকা স্যাংশন হয়ে যখন এলো তখন প্ল্যান্টের জমিটাই হাপিশ হয়ে গেছে। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা ১৩ একর জমিতে। এখন যদি ঢোকার সুযোগ পান, আন্দাজ করার চেষ্টা করবেন কতো জমি আছে। খুব হতাশ হবেন।
তেমনিই প্রতিষ্ঠাতার আমল থেকে রমরমিয়ে চলছিলো এন্টি ভেনম সিরাম প্ল্যান্ট। প্রতি বছর সাপের কামড়ে কতো লোক মরে তা জানার খুব দরকার পড়ে না, কারণ আমরা শহরের আলোকোজ্জ্বল রাস্তায় গাড়ি হাঁকানো গর্বিত নাগরিক বৃন্দ! কিন্তু যখন শুনি এই বিশাল গ্রামপ্রধান দেশে সর্পাঘাতে বাৎসরিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান ৪০,৯০০ জন, তখন মনে হয় ছিল যে আমাদের বেঙ্গল কেমিক্যালস, সাপে কাটার ওষুধ বানাতো। তার কী হলো?
২০০৭ সালেই ঐ একই আধুনিকীকরণের অছিলায় প্ল্যান্টটি তুলে দেওয়া হয়েছে, যদিও সাপে কাটার ওষুধের বড়ই আকাল। আরো কী গেরো, তামিলনাড়ুর এন্টি ভেনম বাংলার সাপে কাটায় তেমন কার্যকরী হয় না। ওষুধের অভাবে চিকিৎসক এবং পরিজনদের সামনেই বিষে নীল হয়ে দংশিত ঢলে পড়ে, এরকম কেস প্রচুর। বাজারে চাহিদা যোগানের বেসিক সূত্রটি কার্যকর হলে এন্টি ভেনম প্ল্যান্টটি আরো বড় হবার কথা ছিলো। জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সর্পাঘাত থেকে বাঁচাবার জন্য এইটুকুও করে না!
কাহিনীর এইখানেই ঢুকে পড়ে বেঙ্গল কেমিক্যালসের বুড়ো বেতো ঘোড়া। ২০০৭ সালে ওদের মস্ত আস্তাবলে থাকতো ১০০ টির মতো ঘোড়া। এটিও তাদের মধ্যে একটি। বিষে বিষক্ষয় মেনে ওদের শরীরে ঢোকানো হতো স্বল্প পরিমাণ সাপের বিষ। ওদের শরীরের ভেতরেই তৈরি হতো সেই বিষের প্রতিষেধক। তখন সিরিঞ্জে রক্ত টেনে নিয়ে তৈরি হতো এন্টি ভেনম সিরাম।
প্ল্যান্টই যখন বন্ধ হয়ে গেল, ঘোড়া পুষে কী হবে! ওদের দেখভালের জন্য তুলে দেওয়া হলো এক এনজিও-র হাতে। সবাই লক্ষ্মী হয়ে ট্রাকে উঠে গেল, এই ঘোড়াটি ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে। জেদি, একবগগা, কিছুতেই ও কারখানা চত্বর ছেড়ে যাবে না। ছুটে ছুটে চলে যাচ্ছে বোর্ডরুমের পেছনে, যেখানে দেওয়াল-জোড়া প্রতিষ্ঠাতার তৈলচিত্র, সারাক্ষণ আলো জ্বলে তাঁর মর্মর মূর্তির সামনে। ওর জেদের সামনে কর্তৃপক্ষ হার মানলো, ও থেকে গেলো একাই একশ হয়ে। সারাদিন চরে বেড়ায়, রাতে নিঃসঙ্গ আস্তাবলে নিঝুম বাতাসে ভাসিয়ে দেয় হ্রেষাধ্বনি।
মনুষ্যেতর প্রাণীটি কি আশ্রয় চেয়েছিলো? ও কি জানতো কে এখানে আশ্রয় দেবার চূড়ান্ত অধিকারী? কেন্দ্রীয় সরকার বিলগ্নিকরণের লিস্টে উঁচুর দিকে বেঙ্গল কেমিক্যালসের নাম রেখে হাজার কর্মীকে উৎখাত করতে চাইছে, বেঘর করতে চাইছে, তাদের কি ওর আচরণ থেকে কিছু শিক্ষণীয় আছে? কর্মীরাই বা নাছোড়বান্দা হয়ে কেন গড়ে তুলবে না সংঘবদ্ধ আন্দোলন, কামিয়াব হবে না ঐ ঘোড়াটির মতো?
বেঙ্গল কেমিক্যালসে এখন কর্মীদের তিনটে ইউনিয়ন। দুটো বর্তমান শাসক দলের দুই নেতার অনুগামী আর একটি বামপন্থী ইউনিয়ন। এরা নিজেদের বিভেদ ভুলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আন্দোলন করেছেন কি? আমি জানি না। ঠিক তেমনই জানি না, রাজ্য সরকারের কাছে এরা দরবার করেছেন কিনা অন্তত সরকারি হাসপাতালে গুণগত ভাবে উচ্চমানের বেঙ্গল কেমিক্যালসের ওষুধ কেনা বাধ্যতামূলক করার জন্য। অথচ এ ছাড়া এই কারখানা বাঁচাবার আর কি উপায় আছে?
ভাবা গেছিলো, করোনাকালে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের উৎপাদন সোনার দিন ফিরিয়ে আনবে। দেখা গেল সেই ওষুধের কার্যকারিতাই নেই। কিন্তু তবুও অলাভজনক বলে বেঙ্গল কেমিক্যালসকে দেগে দেওয়া অযৌক্তিক। একথা ঠিক, যে প্রতিষ্ঠাতার সযত্ন তত্ত্বাবধানে প্রচুর লাভের মুখ দেখলেও অনেক দিন কম্পানি ক্ষতিতেই চলেছে। কিন্তু ইদানীং পর পর তিনটে আর্থিক বছরে লাভের মুখ দেখেছে, তবুও কম্পানিকে লাটে তুলে দেবার চেষ্টা অব্যাহত আছে। ২০১৩-১৪ সালে সর্বমোট আয় হয়েছিল ৩৬.৬৩ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ তে সেটা দাঁড়ায় ১১১ কোটি টাকায়। একটা ঘুরে দাঁড়ানো লাভজনক সংস্থাকে দেশের কেমিক্যালস এন্ড ফার্টিলাইজার মন্ত্রক বিক্রি করতে চায় কোন সাহসে?
সুদিনে বেঙ্গল কেমিক্যালসের উড়ান হয়েছিল মুম্বাইয়ের প্রভাদেবী থেকে লাহোর অব্দি। পাণিহাটিতেও একটি বড় কারখানা এখনো চলছে। মাণিকতলা তো আছেই। সব মিলিয়ে বিক্রি বাটা সেরে কতো টাকা আসবে কেন্দ্রীয় কোষাগারে? আন্দাজ দেবার জন্য বলি, শুধু প্রভাদেবীর সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য ১০০০ কোটি টাকা।
ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে যিনি দেশবাসীকে স্বয়ংভর করবার স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিজ্ঞান কলেজের উন্নতির জন্য নিজের সমস্ত পেনশন দান করে দিয়ে ঐ কলেজেরই ছোট্ট একটি কুঠুরিতে আজীবন কাটিয়ে গেলেন, আগামী ২রা আগস্ট তাঁর জন্মদিবস। নিজেদেরই একটু মনে করাই এইরকম মানুষও একদিন আমাদের মধ্যে ছিলেন, যিনি অনাড়ম্বর জীবন চেয়ে বিজ্ঞান কলেজের ঐ ছোট কুঠুরিতে একটি পাখা অব্দি লাগাতে দেননি।
যাঁর হবার কথা ছিলো যুব সমাজের আইকন, তিনি হারিয়ে গেলেন বিস্মৃতির অন্ধকারে। এখন হারাতে বসেছে তার আত্মজা, যাকে তিনি আমার মেয়ে বলতেন, সেই বেঙ্গল কেমিক্যালস। একটা গণ আন্দোলনের জন্য আর কতো অপেক্ষায় থাকতে হবে! মাঝে মাঝে মনে হয় কে বেশি দুর্ভাগা, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, না আমরা!
প্রফুল্লচন্দ্রের নাম করে কাকে বা কাদের একহাত নিলেন বুঝলাম না। অতিবাম মত সৈকতবাবু পাইদেবীরাও ফলো করেন বলেই ত দেখেশুনে মনে হয়।
ইয়ে মানে চা-চপ ভেজে দিন গুজরান করা মানুষজনদেরও একহাত নিয়েছেন! দেখেননি?
এই ধরণের লেখা পড়ার একটা দারুণ সুখ আছে।
আচার্য আর রাজনীতি লঘু চালের লেখায় মিলে মিশে কেমন যেন গুরুত্ব হারিয়ে ফেললো। আলোচনাটি আচার্য্যের সম্মান অনুযায়ী আরেকটু গভীর হতে পারতো।
এলবেলকেও একহাত নিয়েছেন ত!! কাছা খোলা, কাদা লেপায় উনি ম্যাস্টর। খ্যাক খ্যাক।
আরে না না। কাউকে এক হাত নেব বলে কিছু লিখিনি। সত্যিই আচার্যকে নিয়ে এইসব বলা হয়। নকশাল আমলে মূর্তিও ভাঙা হয়েছিল। যদিও স্রটা নকশাল না কংশাল কারা করেছিলো ঠিক জানিনা। তবে অতিবাম নেতার লিখিত বিরোধিতাও আছে।
গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ অনেক আছে। আমি নিজেকেই ধাক্কা দিতে, জড়তা কাটাতে চাই। ওঁর সঠিক মূল্যায়ন এখনো হয়নি।
আর লঘুচাল আচার্যের প্রিয় ছিলো। ওঁর আত্মচরিতে তার অনেক প্রমাণ আছে। আমরা দেবতা জেনে দূরে দাঁড় করিয়ে রাখি, তাই হয়তো...
যাক নিশ্চিন্ত হলাম! তবে নিয়েছিলেন আর কি!!
শব্দ গুনেচেন? ভুলে যাবেন না মাইরি!
লেখাটি একটি আত্মজিজ্ঞাসা ।
কে কী ভাবে নেবে , তার ভাবনা।
তাঁর ছাত্র, আমার পিতামহের থেকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র সম্বন্ধে নানা মূল্যায়ণ শৈশব থেকে শুনে এসেছি। তাঁর গায়েও ব্রিটিশ পুলিশের এঁকে দেওয়া 'দাগ' ছিলো। যথেষ্ট 'উপযুক্ত' হওয়া সত্ত্বেও কলকাতায় সরকারি চাকরি পাননি। টাটাবাবা আদর করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। গুরুর প্রতি তাঁর আনুগত্য শেষ পর্যন্ত অম্লান ছিলো।
এই লেখায় যেসব প্রশ্ন বা অনুভবের কথা এসেছে , পাঠক হিসেবে তার সঙ্গে একাত্ম বোধ করছি।
১
জয়তু পিসি রায়! বেতো ঘোড়ার বিদ্রোহ যেন কালের চাবুক!
এই গুণীজনকে চিনিয়ে দেওয়ায় অনেক ধন্যবাদ প্রতিভা দি।
২
এপারে খুলনা, বাগেরহাট ও যশোর জেলায় পিসি রায়ের অনেক কীর্তি এখনো ছড়িয়ে আছে।
৩
তাকে নিয়ে এক অনলাইন নিউজে প্রকাশিত একটি লেখা এখানে :
প্রতিভার লেখাটি বাঙালির এক বিরল সংগ্রামী প্রতিভাকে বিস্মরণের অন্ধকার থেকে আলোকবৃত্তে ফিরিয়ে আনার পরিশ্রমী চেষ্টা।
Khub valo laglo Pratibha .
ঋদ্ধ হলাম আচার্য্যকে নিয়ে মূল্যবান লেখাটি পড়ে৷ ওনাকে শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই
চমৎকার লাগলো, প্রতিভা।
দারুণ লাগলো লেখাটা....দুর্ভাগ্যের ব্যাপার আম বাঙালি চিন্তা ভাবনা শিকেয় তুলে কাল বিকেলে আবার সিরিয়াল আর ঘন্টা খানেক দেখতে বসবে। নিজের থেকে বেরিয়ে এসে ভাবার অবকাশই নেই। খুব রাগিয়ে দিলো লেখাটা।
প্রফুল্লচন্দ্রের জীবন এমনিতে নারীবর্জিত/ তাঁর জীবন বা কাজ নিয়ে আলোচকদের মধ্যেও নারীদের দেখা মেলে না বললেই চলে / প্রতিভাদেবী ব্যতিক্রমী ভাবে প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে যা যেভাবে লিখেছেন তা একজন মহিলার দৃষ্টিতে তুলে ধরা দিগ্দর্শী বিশ্লেষণ / তাঁকে কুর্নিশ /
বাঃ, সুন্দর লেখা !
প্রতিভা সরকার একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী লেখা উপহার দিয়েছেন। অনেকে অনেকখানে মন্তব্য করেছেন যে সরকারের কাজ ব্যবসা করা নয়,লোকসানের ব্যবসা তো অবশ্যই করা উচিত নয়। ফলে এরূপ ব্যবসা বিক্রি করে দেওয়াই উচিত। আচার্যের জন্মের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আর যে সব লেখা বেরিয়েছে, তার মধ্যে এই লেখাতেই অধিগ্রহণের বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য এখানে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন মনে করছি।
এই ধারণাটি কর্পোরেট মানসিকতার অনুবর্তী। যে কোনো কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হয় জনকল্যাণকামী ব্যবসা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। তাই এরূপ সমাজে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার প্রাধান্য বেশি থাকে। এই যুকতিতে বেঙ্গল কেমিক্যাল অধিগ্রহণ একেবারে সঠিক কাজ ছিলো। উপনিবেশিক ভারতে দেশি যে কটি প্রতিষ্ঠান মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছিল প্রয়োজনে তাদের অধিগ্রহণ লাভ-ক্ষতির সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়, বরং উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এইসব প্রতিস্পর্ধী ঐতিহ্য রক্ষা করা আরো বেশি করে দরকার। কারণ উপনিবেশ বিরোধিতার গৌরবময় সংগ্রামের স্মৃতি পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে এবং তা নিয়ে অহংকার করতে শেখায় এই পদক্ষেপ। অথচ পরিহাস এটাই যে কর্পোরেট দাসত্বে অভ্যস্ত সরকার ঠিক তখনই বেঙ্গল কেমিক্যালকে বিক্রি করে দেবার উদ্যোগ নিয়েছে যখন এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রচেষ্টায় কম্পানিটি লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে।
পরিতাপের বিষয় এটাই যে যখন বেসরকারিকরণের উদ্যোগকে ধিক্কার দেওয়া উচিত তখন গুরুচন্ডালীর ব্লগে অনেকেই বিলগ্নিকরণের পক্ষে সরকারি যুক্তিগুলি অনুসারী মন্তব্য করে চলেছেন।
এই বিষয়ে আমার বক্তব্য এখানেও পেশ করলাম
একটা জিনিস বোঝার দরকার আছে, ব্যবসার আকারে চললেও সবকিছু ব্যবসা নয়। কিছু কিছু জিনিস সার্ভিস। এই যেমন আমেরিকার কথাই বলি। কিছু দিন আগেই কথা উঠছিল usps বা মার্কিন পোস্টাল সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হোক কারণ সেটি লসে চলছে। যেহেতু এরা বিভিন্ন কাজ প্রতি চার্জ করে থাকে কেউ কেউ ওটাকে ব্যবসা ভাবতে পারেন। কিন্তু এটা ভীষন এসেনশিয়াল সার্ভিস যার সুবিধা নিউ ইয়র্কের লোকেরা ততটা না পেলেও আমেরিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য এটা ডেলিভারি র একটা বিশাল মাধ্যম। এই দূর দুরান্তে ডেলিভারি করা মোটেও সস্তা হয় না সরকারের পক্ষে তবুও করে কারন প্রাইভেট প্লেয়ারদের খেলতে দিলে তারা আইদার ওই মাঠে খেলতে যাবেই না বা ভীষন টাকা চার্জ করবে যা এফোর্ড করা মুশকিল যার ফলশ্রুতিতে ওইসব জায়গায় ডেলিভারি বন্ধ হওয়ার সামিল হবে।
তেমনি bsnl ও একটা সার্ভিস, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যংক গুলোও একটা সার্ভিস। ওই ব্যংক গুলো না থাকলে যে সব জায়গায় ব্যবসা করা লাভ জনক না, সেখানে কেউ ব্যবসা করতে যাবে না। তেমনি বেঙ্গল কেমিক্যাল একটা সার্ভিস হতে পারে যেখানে ন্যায্য মূল্যে সঠিক জিনিস পেতে পারে মানুষ, নকল স্যানিটাইজার, ফেক আয়ুর্বেদিক ফিনাইল এসব কিনে না ঠকে সঠিক জিনিস স্বচ্ছ ভাবে কিনে ক্রেতা উপকৃত হবে।
রমিতবাবুকে ধন্যবাদ। আমার লেখাটিকে প্রাঞ্জল করেছে ওর মন্তব্য। বেশির ভাগ মন্তব্যকারী আমেরিকা সিঙ্গাপুর ইত্যাদি বলে দৃষ্টি পশ্চিমমুখী করার চেষ্টায় আছেন। এটাই কর্পোরেট মানসিকতা। তবু যদি পাশ্চাত্য দেশগুলোর কথাই ধরি তাহলে ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অথবা ফ্রান্সের পরিবহন ব্যবস্থার কথাও বলা দরকার, যেগুলো কল্যাণমুখি রাষ্ট্রের সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রায় আদর্শ উদাহরণ। ভারতের ক্ষেত্রটি অনন্য কারণ ভারতকে স্বাধীনতা পেতে উপনিবেশের জোয়াল ভাঙতে হয়েছে। সেই গৌরবজনক অধ্যায়টির ঐতিহ্য আমরা কি পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দেব না?
আমেরিকার নিরলস প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গোটা লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে জনকল্যাণমুখী সরকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে জনতার রায়েই। উদাহরণ দেবার বেলায় উচ্ছিষ্টভোগী আমরা এদের কথা ভুলে যাই।
যে সময়ে মূর্তি ভাংগার বিষয়টা চলছিলো, তখন শহর জুড়ে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মূর্তি সংগত কারণেই ছিল অনেক কটা। দুই মেট্রোপলিটান স্কুলে, কলেজ স্কোয়ারে, উত্তর কলকাতার, বিশেষত কলকাতা ৬, ৯ এবং মধ্য কলকাতার বেশ কয়েকটি পার্ক এবং গলির মোড়ে। ১৯৭০ সালে সার্ধ শতবর্ষের জোয়ারে। তুলনায় প্রফুল্লচন্দ্রের মূর্তি ছিলো না বলাটাই সংগত। বেংগল কেমি ক্যালের ভেতরে ছিল একটা, যত দূর মনে পড়ছে গোটা দুই স্কুলে চেনার অযোগ্য অখাদ্য গোটাদুই ঝুলনের পুতুল ছিল। বেংগল কেমিক্যালের মূর্তিটি সেদিনের মটো আজও অটুট। তাহলে কে বা কারা, কবে কোথায় ভাংচুর করলো? তথ্যটি অবশ্যই প্রামাণ্য নয় এবং আশংকা করি হাত ফেরতা তথ্য।
মূর্তি ভাংগা বিতর্কে সবচেয়ে বেশি সমালোচক ছিলেন ঐ আন্দোলনের নেতারা নিজেই। এই বিষয়ে সুশীতল রায় চৌধুরী, সুনীতি কুমার ঘোষের লেখা আছে, লিখেছেন সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে অভ্যন্তরীণ বিতর্ক থাকলে এবং তা প্রকাশ্য এসে গেলে তার দায়ভাগ পুরো আন্দোলনের গায়ে চালান করে দেওয়া চূড়ান্ত অনৈতিহাসিক। লেখিকাকে এই দিকে নজর করতে অনুরোধ করি। এই বিতর্কের ফলেই বিনয় ঘোষ মতামত বদল করেছেন, বিদ্যাসাগর রামমোহনের দেবতুল্য চরিত্রে মনুষ্যচিত সীমাবদ্ধতা দেখতে পেয়েছেন রমেশ মজুমদার মশাই, এই গুলো না এলে মূর্তি ভাংগা প্রসংগের অবতারণা বিভ্রান্তিই ছড়াবে। লেখিকাকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।