এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

  • এ ভাবেও ভুলে থাকা যায় ( সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কে নিয়ে)

    বাঙালির বিজ্ঞান চর্চা 
    আলোচনা | বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি | ১৭ মার্চ ২০২৫ | ২৭ বার পঠিত
  • ১৯২৪ সালে বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অন্যতম পথিকৃৎ বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের একটা ‘ভুল’-এর উপর ভিত্তি করে অসামান্য একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেললেন। নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার স্ট্যাটিসটিক্সের। নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যা ও শক্তি-শূন্য ভরকণার একটি নতুন তত্ত্ব বেরিয়ে এল। গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ নিবন্ধ লিখে পাঠিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাত একটি বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকায়। কিন্তু নিবন্ধটি প্রকাশ পেল না। প্রত্যাখ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ নিবন্ধটি সরাসরি অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আইনস্টাইন নিবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে, সঙ্গে নিজের একটি নোট সংযুক্ত করে জার্মানিরই এক বিখ্যাত বিজ্ঞান-দর্শন পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন।

    নিবন্ধটি প্রকাশ হতেই দিকে দিকে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জগতে তৈরি হল ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’ নামে কোয়ান্টাম ফিজিক্স-এর এক নতুন দিগন্ত। তারই সুবাদে সত্যেন্দ্রনাথ বসু দুই বছর ইউরোপে থেকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন-সহ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেলেন। উদ্ভব হল ‘বোসন কণা’, ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেন্সেট’ তত্ত্ব ইত্যাদি। অনেক পরে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার উপর কাজ করে হিগস-বোসন কণা নাম দেন। ২০১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান এই কাজের সুবাদে।

    সত্যেন্দ্রনাথের সেই চার পৃষ্ঠার গবেষণাপত্রের মূল ধারণাটিকে কেন্দ্র করে স্বয়ং আইনস্টাইন অন্যত্র পর পর তিনটি প্রবন্ধ লেখেন। বিজ্ঞান-লেখক জন গ্রিবিং তাঁর শ্রয়েডিঙ্গার’স কিটেনস-এ সত্যেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অংশটির শিরোনাম দেন ‘দ্য ম্যান হু টট আইনস্টাইন টু কাউন্ট ফোটনস’। বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়নের গুরুত্ব এতখানিই। পদার্থের সঙ্গে আলোক বিকিরণের পারস্পরিক ক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক আলোককণার ধারণা পেশ করেছিলেন ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। ওঁর মতে, আলো শোষিত বা বিকিরিত হয় একটানা নয়, খণ্ডে খণ্ডে। আলোর ওই কণারূপ তার তরঙ্গাকারের (যা পরীক্ষিত সত্য) পরিপন্থী। সত্যেন্দ্রনাথ আলোকে গ্যাসের মতো পুরোপুরি কণার সমাবেশ হিসেবে তিনি ধরে নেন এবং নতুন সংখ্যাতত্ত্ব প্রয়োগ করেন। ফলে অসঙ্গতি থেকে প্লাঙ্ক-সূত্রের মুক্তি এবং কোয়ান্টাম সংখ্যাতত্ত্বের জন্ম।

    ১৯৭৪ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে পর্যন্ত জাতীয় বিজ্ঞান আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিজ্ঞান গবেষণা করে গেছেন। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের আজকের প্রাসঙ্গিকতায় সত্যেন্দ্রনাথের যুগান্তকারী উপলব্ধি গবেষণালব্ধ কাজগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্পেস সায়েন্স, আন্তর্জাতিক ও বিশ্বময় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রায়োগিক বা ফলিত বিভিন্ন দিক-সহ আধুনিক বিজ্ঞানের বহু ক্ষেত্রে তাঁর কাজ আজ অপরিহার্য।

    সত্যেন্দ্রনাথের একশো ত্রিশ পূর্ণ হল গত বছর। তাই নিয়ে বিশ্বের বেশ কিছু জায়গায় চলল কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিক্সের উপর সিম্পোজিয়াম, সেমিনার ও প্রাসঙ্গিক ভাবনার আরও উন্মেষ। সদ্য তেমনই আলোচনা করে গেলেন বিশ্বের বিজ্ঞানীরা, আন্তর্জাতিক উদ্যোগে ঘটে গেল কলকাতার ‘এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস’-এ। কিন্তু সেই বৃত্তের বাইরে এ দেশে, এই বাংলায় কি কোনও আলোড়ন হল তাঁকে নিয়ে? তিনি গবেষণাগুলো করেছিলেন বঙ্গভূমেই— ফরিদপুরের কলেজে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ ক্যাম্পাসে, বা বিশ্বভারতীতে। আইনস্টাইনের ডাকে তিনি কাজ করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন ডাকসাইটে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বসে।

    বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা ও পঠনপাঠনের জন্য তাঁর ছিল অনলস প্রচেষ্টা। তাঁর উদ্যোগেই ১৯৪৮ সালে কলকাতায় গড়ে উঠেছে ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’। ১৯৬০ সালে বিজ্ঞানের শুধুমাত্র মৌলিক গবেষণা মূলক নিবন্ধ নিয়ে ‘রাজশেখর বসু সংখ্যা’ প্রকাশ করে তিনি প্রমাণ করেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাও মাতৃভাষায় করা সম্ভব। সত্যেন বসু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতেন “যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা অসম্ভব তাঁরা হয় বাংলা জানেন না নয়তো বিজ্ঞান বোঝেন না।”

    বিশ্বের নানা ভাষাভাষী বিজ্ঞানীরা তাঁকে মনে করছেন। কিন্তু আধুনিক বাঙালি তাঁকে ব্রাত্য করে দিয়েছে। না সরকারি উদ্যোগে, না বিজ্ঞান ক্লাবগুলিতে, অথবা স্কুল কলেজে, কোথাও এই মহান বিজ্ঞানীর মহত্তর কীর্তির উল্লেখমাত্র আমরা খুঁজে পেলাম না। তাই আজ নাহয় কিছু বিজ্ঞান-অজ্ঞ কিন্তু বিজ্ঞানপ্রেমীদের ব্যর্থ আক্ষেপই ঘুরে বেড়াক এই বাংলার হাওয়ায়।
     
    ( লেখক : শেখর দত্ত, লেখাটি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় )  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন