তেমন খুশির কোনো বিষয় ছিল না; ঈদ ছিল— কিন্তু সেটিও তো চলে গিয়েছে পরশু দিন। তবু যে বৃষ্টি হলো, সন্ধ্যাটা ভেজা আর দূরের আলোগুলো মুগ্ধকর হয়ে উঠল, ফলে আমাদের মনে হলো একটা সেলিব্রেশন হওয়া দরকার। আমরা মানে আমি আর আমার তিন বছরের বিয়ে করা বউ জেনি। জেনি বলল, পরোটা ভাজতে পারি আমি। তুমি কি কাবাব আনবে? কাবাব আনতে যাওয়া মানে সেই বনানী যাওয়া। দূর আছে। তবু যেতে ইচ্ছা করল। বৃষ্টি যেহেতু হয়েছে, একটু দূরেও এখন যেতে পারি। জেনি টাকা বের করে দিলো। তিন হাজার। কাবারের জন্য একটু বেশিই। জেনি বলল, চান রাতে চেয়েছিলে, দিই নি। এখন নাও। আমি হাসি। বৃষ্টি যেহেতু হয়েছে, জেনি একটু যে রহস্যময়ী হয়ে উঠবে, এই স্বাভাবিক।
কাবাব নিতে বেশি দেরি করি না। ক্ষিরি কাবাব দুই স্টিক, এক স্টিক গুর্দা। তাওয়া ঝাল ফ্রাই। একটা বিফস্টিক নেবো কি নেবো না ভাবতে ভাবতেই বিল হয়ে গেল। বিফ এখন আর মাংস হয়ে নেই; কেমন একটা অপরাধবোধ হয়ে গেছে। রিকশাওয়ালাকে ছাড়ি নি। ফিরতিপথে তাকে নিয়েই… একটু ঘুরপথে গেলাম। জেনি তিন হাজার টাকা দিয়েছে। কেন দিয়েছে আমি জানি, রিকশাওয়ালা তো আর জানে না! ফলে-- ‘সার, এইদিক দিয়া তো ঘুরা হইব!’ ‘ঘুরাই ঠিক আছে। চলেন।' বারটা ফাঁকা পড়ে আছে। রাত নাহয় একটু হয়েছেই; কিন্তু বৃষ্টিও যে হয়েছে। বৃষ্টি হওয়ার পরও, এই শহরের বার, এমন ফাঁকা কেন থাকবে? প্রিয় বস্তুটা প্যাকেটে এল। টাকা ওরা আগেই নিয়ে নেয়। বকশিসসহ। ফলে আবার রিকশায় উঠে কাবাব আর মদ ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরা। কিন্তু তার আগে...পেপসি! পেপসি কিনতে দোকানে নামতেই শরীরে একটা টোকা। ফিরতেই দেখি ইউনিফর্ম। পুলিশ-- ‘আপনি কি মেহেদি?’ ‘না তো ভাই।' ‘আচ্ছা এইটা কি মেহেদির দোকান?’ ‘না। ঠিক জানি না। আমি আসলে কিনতে আসছি।' ‘আচ্ছা আচ্ছা। কাস্টমার।' পেপসি নাই। কোকাকোলাও নাই। মহল্লার দোকান থেকে নিলেই হবে। রিকশায় চেপে বসি। পুলিশের সাথে বার্তালাপ পছন্দ করে নি সাবকনসাস। সে বলছে, বাসায় চলো…! রিকশা স্টার্ট নিতেই পেছন থেকে পুলিশের হাঁক—ওই ব্যাটারি, সামনে দাঁড়া! আমি আর রিকশাওয়ালা, দুজনেই, ঘাড় ঘুরিয়ে, পুলিশটাকে দেখে, যেন দেখিই নি এমনভাব করে, গতি না বাড়িয়ে না কমিয়ে, চলতে থাকি। সাবকনসাস টোকা দিতে থাকে--বাসায় চলো! কিছু এগিয়ে এলেই একটা মোড়। মোড়ের আগে অন্ধকার। আলোর কাছে পৌঁছানোর আগেই মোটর সাইকেল। পুলিশ। ‘ওই ব্যাটা, তোকে না দাঁড়াইতে কইলাম!’ রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে যায়। আমি নেমে যাই। ‘হাতে কী?’ ‘কাবাব।' ‘আর?’ ‘মদ।' ‘কী মদ?’ ‘কেরু।' ‘লাল না সাদা?’ ‘লাল।' ‘আপনি তো ভালো মানুষ। কোনো যাতনা ছাড়াই সব বইলা দিলেন। নাম কী আপনার?’ ‘অর্ণব।' ‘কী নাম?’ 'অর্ণব।' ‘কিছু মনে করবেন না… আপনার ধর্ম কী?’ আমি উত্তর দিই না। কিন্তু সাবকনসাস জবাবটা নামিয়ে ফেলে। বলে, হিহিন্দু। পুলিশটার এই উত্তর ভালো লাগে না। একটু থেমে বলে, কাগজ আছে? ‘না। কাগজ করা হয় নি।' ‘মদ কই নেন?’ ‘বাড়িতে...বাসায়।' ‘সবাই মিল্যা খান আপনারা, না?’ আমি কিছু বলতে পারি না। চুপ করে থাকি। পুলিশ বলে, ‘বৃষ্টি হইছে আর অমনি আইসা পড়ছেন… সেলিব্রেশন, নাকি? ‘মাফ কইরা দেন ভাই।' ‘মাফ ক্যান, আপনারা তো কইবেন ক্ষমা করেন… নাকি ক্ষেমা দেন…! কিন্তু সেইটা দিতে পারব না। ওপরের খুব চাপ। কাজ দেখাইতে হবে। দশটায় ওয়াকি-টকি জমা দিবো। তার আগে কাউকে তো দেখাইতে হবে। আপনি থানায় চলেন। আমাদের স্যারের সাথে অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে নেবেন… কাগজের ব্যাপারে কথা বলবেন…’ থানায় যেতে আমার খুব আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু মুশকিল হয়েছে অন্য জায়গায়। থানায় গেলেই আমার নাম-ধামের প্রশ্ন আসবে। এনআইডি আসবে। এনআইডিতে তো আমার নাম অর্ণব রায়হান। মুসলিম। পুলিশের কাছে সাবকনসাস যে মিথ্যাটা বলেছে সেটা মদ নিয়ে রেহাই পাওয়ার মিথ্যা। থানায় গেলে পুরো ব্যাপারটা অন্য একটা জায়গায় চলে যাবে। আমি আবার বলি, ভাই, বাদ দেন, ভুল হয়ে গেছে। এরপর কাগজ করিয়ে নেব। পুলিশ হাসে। সুন্দর হাসি। চোখ পর্যন্ত হাসি পৌঁছায়। বলে, আপনি বললেন কাগজ করে নেবো আর আমি সেই ভরসায় আপনাকে ছেড়ে দিবো… এইটা হওয়া তো মুশকিল, তাই না? তাছাড়া আপনার জন্য ইনফরমারেরা কাজ করছে… তাদের কী জবাব দিবো? পকেটে খুচরা পাঁচশ টাকা ছিল। তিনশ বের করে দিই। পুলিশ আরো হাসে। আগেরটার মতো সুন্দর না। এই হাসিতে লোভ থাকায় তা কুৎসিত দেখায়। বলে, ইনফরমারদেরই এক হাজার দিতে হয়। আর আমারও তো কিছু লাগে। দুই হাজারের নিচে করা যাবে না! জেনি ফোন দেয় এর মধ্যেই। বা, এমনও হতে পারে, আমিই হয়তো জেনিকে ফোন দিই। পুলিশের কথা জানাই। জেনি চুপ করে যায়। অথচ বৃষ্টি হওয়ার পর জেনি কখনো এত চুপ থাকে না। ওর মুখে খই ফোটে। জেনিকে বলি এক হাজার টাকা রেডি রাখতে! আমরা বাসার দিকে যাই। পুলিশ পুরো গলিতে ঢোকে না। দয়পরবশত। এদিকটায় যেহেতু আমাকে অনেকে চেনে। আমি টাকা আনতে যাই; পুলিশের কাছে মদ জমা রেখে। ফিরতে নাও পারতাম, কিন্তু ফিরি। বারোশো টাকা দিয়ে ফয়সালা হয়। ব্যাগ আমাকে ফেরত দেয় পুলিশ। হাসে। এই হাসিটা প্রথম হাসির মতো সুন্দর। তৃপ্তির। আমি বাসায় ফিরে আসি। মদ ও কাবার থাকার পরও আমাদের সেলিব্রেশন হয় না। জেনি বলে, আমাদের অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়া উচিত। আমি তেমন কোনো দেশের কথা মনে করতে পারি না। মদ পড়ে থাকে-- অথচ সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়ে গেছে।
পরের দিন দুপুরের দিকে বৃষ্টি হয়। খুব বেশি না— তবু তো বৃষ্টি। না হয়ে তো শুধু ঝড়ও হতে পারত। হয় নি। বৃষ্টি হয়ে গেছে। ছিমছাম। বিকালেই আমি বাদাম বের করি। ব্যাগ থেকে বোতলটাও। জেনিকে বলি, এসো… আজ তো আগাম বৃষ্টি হয়েছে। সেলিব্রেট করি। আমরা মদ ঢালি আর মদ খাই। কপকপ করে খাই। কিন্তু আমাদের সেলিব্রেশন হয় না। আমরা শুধু পুলিশের কথা বলতে থাকি। আবার বৃষ্টি শুরু হয়। আমাদের মদ ফুরিয়ে যায়। শুধু পুলিশের কথাগুলো থেকে যায়। ঘুরপাক খেতে থাকে। লজ্জার ভেতর দিয়ে কোনো সেলিব্রেশন উঁকি দিয়ে উঠতে পারে না।
অন্যরকম লাগলো। ভালো লেগেছে।
ভালো লাগল। ব্যক্তি জীবনে দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রের কালো হাত স্বাভাবিক আনন্দকে মাটি করে, স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়।