

আমার বাপ যে পাখি বানাইতে পারত সেইটা আপনারা জানেন না। সেই পাখি আপনারা কোনোদিন দেখছেন বইলা মনেও হয় না। আপনারা তো রহনপুরের সোমবারের হাটে কোনোদিন আসেন নাই.. নাকি আসছেন?
রহনপুরের হাটে আমার বাপে যাইত নয় মাইল ধুলা ভাইঙা। মাথায় থাকত ডালি। ডালির ভিতর পাখি। লাল পাখি, নীল পাখি..। সবুজ পাখিও থাকত। সবুজগুলা কী যে সুন্দর! মনে হইত এইমাত্র ডাইকা উঠবে। ডাকলে পাখি কেমনে ডাকবে তা চিন্তা কইরা আমার সুনসান সময় কাটত দাওয়ায়.. বাপ তখন হাটের ভিতর পাখি নিয়া বইসা থাকত। কেউ কিনত না পাখি… জ্যাতা পাখির তাও তো মাংস আছে, মাটির পাখির কাম কী?
১৯টা পাখি নিয়া গিয়া বাপ আমার ফিরত ১৯টা পাখির সাথেই। আমি কইতাম, আব্বা, আইজও কেউ নেয় নাই?
বাপের আমার এমন সরল হাসি। বলে, নিছে না আবার। পিঁয়াজপট্টির আকবর… সকাল থেইকা বইসা ছিল আইসা.. তিনটা পাখি নিছে সে…মনে মনে তিনটা পাখি নিছেরে.. একটা সবুজ একটা নীল আর একটা টুকটুকাটুক লাল!
বাপে আমার মন বুঝত মানুষের। আকবর প্রায়ই বাপের কাছ থেইকা পাখি কিনে। মনে মনে কিনে। বাপে বলে, আকবরের কাছে ম্যালা পাখি হইছে। অর বুকের ভিতর পাখিগুলা ফড়ফড়ায়.. সক্কালবেলা দ্যাশের পাখি জাগার আগে অর বুকের পাখি কিচিরমিচির করে।
আমি বাপের কথা ধুন ধইরা শুনি। এমন আশ্চর্য কথা শুধু আমার বাপেই কইতে পারে।
পাড়ার খালায় বলে, তোর বাপের মাথায় ছিট আছে। তুইও কি ওই রকম ছিটাহি হইবি? খাওন দাওনের ঠিক নাই। বয়স হইতাছে কত খিয়াল আছে? তর ফ্রকে যে উড়না দেওন লাগে সেই চোখও নাই কি তর বাপের?
বাপরে আমি বলি, আমারে উড়না দিতে কয় কুসুম খালায়..
বাপ হাসে। বলে, এইবার পাখি বেইচা তর জইন্য জরির উড়না আনুম।
আমি বলি, আইচ্ছা। লাল দেইখা আইনো কিন্তুক।
কিন্তু বাপের পাখি বিক্রি হয় না। ১৯টা পাখি নিয়া বাপে যায়, ১৯টা নিয়াই ফির্যা আসে। বলে, আকবর আইজ চাইরটা পাখি নিছেরে। এত্ত পাখি অর... বুকের ভিতর খালি খলবলায় আর খলবলায়...
খালা বলে আমার বুকও নাকি খলবলায়। আমার তাই দৌড়াইতে মানা। পানার জলে ডুবতে মানা। কিতকিত খেলতে মানা। খালা তার আঁচল খুইলা দেয়। আমি চাদর জড়ায়া একটা শীতের সকাল হইয়া যাই। আর সেই সকাল ভাইঙা আসে মন্তাজ মাস্টার। বলে আমার পড়ায় মন নাই। আমার নাকি খালি উড়ার শখ।
বাপে কিছু বলে না তারে। আমারেও কিছু বলে না। তাও আমি শুনি, বাপে কারে যেন কয়... বনবিড়াল বনবিড়াল...
আমার মনে হয় বাপে এইবার বোধহয় পাখি বানানি ছাইড়া দিবে। কে জানে, হয়তো বনবিড়াল বানানি ধরবে। কিন্তু বাপে পাখিই বানায়া যায় খালি।
১৯টা পাখি ২৯টা হয়।
২৯টা হয় ৩৯...
এই দিকে আমাদের খড়ের বেড়ায় দায়ের কোপ পড়ে রাইতের বেলা। বাপ চিল্লায়--কে? কে রে?
দায়ের কোপ ওই রাইতে বন্ধ হয়। কয়দিন বন্ধ হয়। কিন্তু আবার পড়ে কোপ। আবার এক রাইতে। আবার কোনো রাইতে...
বাপে চিল্লায়। কোপ থাইমা যায়। বাপে সকালে উইঠা খড়ের ভিত্রে খড় গুঁইজা দিতে থাকে। মাস্টার আসে। বাপ তারে দাওয়ায় ডাকে না। তাও সে আসে।
বাপে তারে কিছু বলে না। বাপে আমারেও কিছু বলে না। বাপে তাও কাউরে জানি বলে, বনবিড়াল বনবিড়াল!
বাপের পাখি শুকাইতে শুকাইতে কাঠ হইয়া যায়। বাপ তাও হাটে যায় না। বাপের চোখ লাল হইয়া যায় বাপ তাও ঘর ছাড়ে না। দাওয়ার মাটি খুঁইড়া বাপে ঘরের কোনায় জমায়। ক্যান জমায়, বাপে কিছুই কয় না!
যেই রাইতে বাদলা আসল খুব, যেই রাইতে মেঘ নাইমা আসে মাথার এই এক হাতের উপর, সেই রাইতে ঘরের চালে ফিরসে পড়ে কোপ। বাপে এইবার চেচায় না। বাপে এইবার চাইয়া থাকে শুধু। বাপে আমারে ধইরা থাকে হাতে। কোপ পড়ে কোপের উপর শুধু।
বিষ্টি ঢোকে ঘরে। ঝমঝমায়ে পানি। দায়ের ভিতর দিয়া একটা মানুষ যেই না ঢোকে ফিনকি দিয়ে একটা আওয়াজ শুধু।
ঘরের ভিতর অচেনা এক ছায়া। ঘরের ভেতর মাটির একটা বাঘ। বাঘে ছায়ায় ছপাত ছপাত খুব... দায়ের ফাঁকে আছড়ে পড়া টুকরা টুকরা মেঘ। মেঝের মাটি ভাইসা যায় ঢলে।
ভোরের বেলা ডোবার ধারে বাঘে খাওয়া মাস্টার... মইরা গেছে ভূতের মতন চোখ...
ঘরের ভেতর একটা মাটির বাঘ... ধ্বকধ্বকে তার চোখ...
গাঁয়ের সবাই কয় হায়রে হায়! এমন বাঘ আসছে নাকি দ্যাশে? দেখে সবাই অনেক অনেক পাখি উড়ছে আমার বাপের বুকের উপর দিয়া--লাল নীল আর সবুজ রঙের পাখি।
আর বাপের হাতে লুকানো এক বাঘ। মাটির বাঘ তাও জ্বলজ্বলা তার চোখ।
ওঃ কী লেখা! আরও পড়ব।
swati ray | 117.194.***.*** | ০৪ নভেম্বর ২০২০ ১৫:০৩99616দারুণ লাগল .
খুব সুন্দর লেখনী। কলম দীর্ঘজীবী হোক।
মেঘ | 103.77.***.*** | ০৪ নভেম্বর ২০২০ ২২:০০99631দুর্দান্ত
সহজ সরল আর বহুমাত্রিক ! ভালো লাগল।
অনেকদিন বাদে হীরকের ছটা পাওয়া গেল। :D
মৃণাল শতপথী | 115.187.***.*** | ০৫ নভেম্বর ২০২০ ১১:৪৮99658এমন লেখার জন্যই অপেক্ষা থাকে।
অনুরাধা | 2409:4061:61c:9644:3d48:40b4:11e3:***:*** | ০৫ নভেম্বর ২০২০ ১৫:১৮99662খুব ভালো