নন্দীগ্রাম দিবস, ১৪ মার্চ, ২০২১। আজ আর এক অসম্ভব কঠিন পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে আজকের এই বিশেষ দিনটিতে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার মহাপঞ্চায়েত আজ অনুষ্ঠিত হল জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র সিঙ্গুরে। ৫০০ সংগঠনের যৌথ মঞ্চ 'সংযুক্ত কিষাণ মঞ্চ'-এর নেতৃত্ব বাংলার নির্বাচনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাংলায় বিজেপি-কে একটিও ভোট না দেওয়ার আবেদন করছেন, তাঁরা বলছেন এই ভোটে বিজেপি-কে উচিৎ শিক্ষা দিন। সিঙ্গুরে অনুষ্ঠিত কৃষকদের এই মহাপঞ্চায়েতের সভা পরিচালনা করেন পশ্চিমবঙ্গ কৃষি কো-অর্ডিনেশন কমিটির আহ্বায়ক তেজেন্দ্র সিং বল। সভায় উপস্থিত ছিলেন সিঙ্গুর কৃষি জমি রক্ষা কমিটির কর্মী-সমর্থকেরা। গোটা আয়োজনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন তাঁরাও।
শুরুতেই বক্তব্য রাখেন দিল্লি কৃষক আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ প্রতিনিধি অভীক সাহা। তিনি কৃষক আন্দোলনের শুরুর দিকে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। করোনার অজুহাতে তাঁদের দিল্লিতে পোর্ট ক্লাবে ঢোকার আবেদনকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অমিত শাহ। সেই ছিল শুরু। দীর্ঘ সাত মাসের বেশি জারি আছে কৃষক আন্দোলন। ইতিমধ্যে মারা গেছেন প্রায় ৩০০ জন, তবু কৃষকরা অনড় তাঁদের দাবিতে। আম্বানি-আদানি-র মত দেশি-বিদেশি বড় পুঁজিপতির স্বার্থে মোদী সরকার যে তিনটে কৃষি আইন লাগু করেছে, তা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। লাঠি চালিয়ে, জলকামান দিয়ে, ব্যারিকেড আর কাঁটাতারে ঘিরে ফেলে — শত চেষ্টা করেও তাঁদের থামাতে পারেনি সরকার। অভীক সাহা তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিলেন, কোনও দলের হয়ে প্রচার করতে তাঁরা আসেননি। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত এই মহাপঞ্চায়েত। তাঁদের মানুষের কাছে একটাই আবেদন- ' বিজেপিকে ভোট দেবেন না।' তিনি মনে করিয়ে দিলেন নরেন্দ্র মোদী অর্ডিন্যান্স জারি করে কৃষি জমি কেড়ে নেওয়ার এই আইন আনেন।
মোদী সরকারের রেল-বিমান-বিমা বেচে দেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পেট্রোল-ডিজেলের মুল্যবৃদ্ধি, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্ত বিষয়কে তাঁদের বক্তব্যে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরলেন কৃষক নেতারা। একে একে মঞ্চে বক্তব্য রাখেন বলবীর সিং রাজেওয়াল, গুরনাম সিং চাডুনি, প্রফেসর মনজিৎ সিং, হিমাংশু তিওয়ারি, রাজা রাম, মেধা পাটেকর প্রমুখ। বিহারের কৃষক নেতা রাজা রামজী বলেন, আজ দ্বিতীয়বার তিনি এলেন সিঙ্গুরে। ২০০৬-২০০৭ এর কৃষি জমি রক্ষার আন্দোলনের সময়ে এসেছিলেন তিনি। পূর্ব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন গর্বের সঙ্গে। যে দেশে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে বা বিশ্ব ক্ষুধার সুচকে যে দেশ ১০২তম স্থানে দাঁড়িয়ে, যা বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশেরও পিছনে, সেই দেশে কৃষি ক্ষেত্রে কর্পোরেট থাবা বসালে রেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। যার ফলে খাদ্য সুরক্ষার বিষয়টি তো সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে রাজা রামজী বলেন, এই আইন শুধু কৃষক বিরোধী নয় বরং সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষের বিরুদ্ধে। কৃষক নেতারা তাঁদের বক্তব্যে আজও বারবার তুলে আনেন স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা এবং পাঞ্জাবের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা। ভগৎ সিং, সর্দার অজিত সিং, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর কথা তাঁদের বক্তব্যে স্মরণ করেন।
পূর্ব উত্তরপ্রদেশের কৃষক নেতা হিমাংশু তিওয়ারী বলেন, ঐতিহাসিক সিঙ্গুর আন্দোলন কৃষকদের কাছে গর্বের। মোদী সরকারকের "বেচনেওয়ালা সরকার" আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন "লড়াই দু'তরফের — একদিকে দেশ বেচনেওয়ালা, অন্যদিকে দেশ বাঁচানেওয়ালা।"
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিশিষ্ট সমাজকর্মী মেধা পাটেকর বলেন— "ভোটের থলি ভর্তি করার কাজ আমরা করি না, কিন্তু কেউ যদি বিভাজনের রাজনীতি করে ভোটবাক্সে ভরতে চায় তাহলে তাঁকে রুখে দিতে হবে।" তাঁর বক্তব্যে রাজকুমার ভুল, তাপসী মালিকের শাহাদাতের কথা মনে করিয়ে দিলেন মেধা পাটকর। BSNL, BPCL, LIC বেচে দেওয়ার বিরোধিতা থেকে শুরু করে চুক্তিচাষের বিরোধিতা করতে গিয়ে গুজরাটে Pepsico-র মতো কর্পোরেট কিভাবে কৃষকদের ফাঁসিয়েছিল তা মনে করিয়ে দেন তিনি। তিনি বলেন হিন্দু-মুসলিম-শিখ ভাগাভাগি চলবে না - সকলেই আমার দেশের মানুষ। ৪০,০০০ মহিলা শামিল হয়েছেন, অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন এই আন্দোলনে, সে কথা মনে করিয়ে তিনি স্লোগান দেন-"হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ইসাই, আপস মে হ্যায় বহেন-ভাই।" স্লোগানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গলা মেলান অনেকেই। জয় কিষাণ, কিষাণ আন্দোলন জিন্দাবাদ, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা জিন্দাবাদ স্লোগানের পাশাপাশি সিঙ্গুর কৃষিজমি রক্ষা কমিটি জিন্দাবাদ স্লোগান এবং জয় বাংলা স্লোগানেও মেতে ওঠেন উপস্থিত জনতা।
আন্দোলনের পরবর্তী পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞেস করলে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে রাজারাম বলেন, সারা দেশের অনেকগুলি রাজ্যে কৃষক প্রতিনিধিরা যাচ্ছেন, দেশের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলন। আগামী ১৬ তারিখ দিল্লিতে মোর্চার বৈঠক এবং সেখানেই স্থির হবে পরবর্তী কার্যক্রম।