কলকাতা সেজে উঠছে দুর্গাপুজোর সাজে, মন্ত্রী-সান্ত্রীরা পুজো উদ্বোধনে মত্ত; এদিকে হকারদের রক্ত-ঘাম-চোখের জল দিয়ে জোগাড় করা হাজার হাজার টাকার পসরা অন্যায়ভাবে আটকে রাখছে রেল পুলিশ। ৫০ হাজারের ওপর টাকার মাল বাজেয়াপ্ত। আর পি এফের নির্মম অত্যাচারে অনেক হকার আজও অসুস্থ। মাথার ওপর কেস সাম্লানোর বোঝা। লড়াকু এক সাথী বলছিলেন ২৫ জনকে মার খেয়ে জেলে যেতে হয়েছে, জামিনে খরচ হয়েছে ৫৮,০০০ টাকা, তবু এ লড়াই থেকে তাঁরা এক পাও পিছু হটবেন না।আজ রেল হকারদের এবং বস্তিবাসীদের জীবন জীবিকা রক্ষার স্বার্থে এক অসাধ্য সাধন করল জাতীয় বাংলা সম্মেলন। আজ আর তারা একা নয়। মাটি কামড়ে পড়ে থেকে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছে রেল হকার আন্দোলন এখন সময়ের দাবি। আজ ১৬ টি ট্রেড ইউনিয়ন সহ একাধিক সংগঠন রেল হকারের এই লড়াইয়ে পাশে দাড়িয়েছে। কিছুদিন আগে কালনা, শেওড়াফুলি, শ্রীরামপুর সহ পশ্চিমবঙ্গের ৩৭ টি স্টেশন সংলগ্ন বস্তিতে এসেছিল উচ্ছেদের নোটিশ। সঙ্গে "অমৃত ভারত স্টেশন প্রকল্প"-এর নামে মধ্যবিত্তের সামনে উন্নয়নের মুলো ঝোলানো। বাজেটের ঘোষণা অনুযায়ী মোট ১৩০৯ টি স্টেশনে এই প্রকল্প চালু হবে। এতে নাকি আন্তর্জাতিক মানের পরিষেবা সম্পন্ন স্টেশন তৈরি হবে। তৈরি করবে কারা? এখনও ধোঁয়াশা। সার্বিকভাবে রেলকে যেভাবে বেসরকারীকরণের দিকে ঠেলা হচ্ছে এটা কি তারই অঙ্গ? হকারদের বাজার কে গিলে নিতে অনেকদিন আগেই স্টেশনে স্টেশনে ঢুকেছে কাফে কফি ডে, কে এফ সি, ডমিনোজ পিজা, ম্যাকডোনাল্ডসের মতো বহুজাতিক। তাই অনেকেই আশঙ্কা করেন আম্বানি-আদানির মতো কোনও বড় কর্পোরেটের কাছেই বেচে দেওয়া হবে রেলের জমি। মনে পড়ে গেল ১ জুলাই, ২০২০তে রেলপথ মন্ত্রক ঘোষণা করেছে যে ১০৯ জোড়া রুটে ১৫১ টি ট্রেন বেসরকারী সেক্টর দ্বারা পরিচালিত হবে। এ সামগ্রিক ভারতীয় রেল পরিষেবার ৫%।
চিরাচরিত প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম মেনেই, ভদ্রলোকদের মনভোলানো বিলাসব্যসনের ব্যবস্থা আর আধুনিকীকরণের খোয়াব দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ খেটে খাওয়া মানুষকে উচ্ছেদ করাকেই ওরা উন্নয়ন বলে। ৪৭-এর পর থেকে আজ অবধি এ হেন উন্নয়নের বলি হয়েছেন প্রায় ২০ কোটি মানুষ। বিলিয়নেয়ারেরা প্রায় বিনা পয়সায় আমাদের জল-জঙ্গল-জমি দখল করার এবং লুঠ ছাড়পত্র পাবে, বিদেশে সম্পদ পাচার করবে আর দেশের সরকার তার দালালী করবে-এটাই দস্তুর। হকাররা কিন্তু আজ প্রশ্ন তুলেছে এই উন্নয়ন কার স্বার্থে? যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্রের সরকার সেখানে হকারদের-বস্তিবাসীদের আজ উচ্ছেদের নোটিশ পাঠাচ্ছে কেন? এদের জীবন-জীবিকা সুরক্ষিত করার দায়িত্ব তাহলে কার? রেল হকাররা দীর্ঘদিন ধরেই আইনী স্বীকৃতির দাবী করছে। ২০১৪ সালে হকার আইন মোতাবেক হকারি বৈধ পেশা, অথচ রেল হকাররা সেই আইনী রক্ষা কবচ পাননি! কেন? ইউনিয়ন সরকার রেল বিক্রি করে দিচ্ছে, হকারদের বাজার গিলে খেতে চাইছে কর্পোরেট পুঁজি! রেল হকারদের আন্দোলন তাই আজ মর্যাদার লড়াই, অধিকার অর্জনের লড়াই। ওঁদের এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো সময়ের দাবী।
বাংলার বুকে বহুদিন বাদে গণআন্দোলনের ময়দানে খেটে খাওয়া মানুষের এই বিপুল অংশগ্রহণ এত দিনের নৈশব্দ ভেদ করে সকলের কাছেই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে জীবিকা নির্বাহ করার লড়াইয়ের পাশাপাশি কেন্দ্রের আগ্রাসী হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান প্রকল্পের বিরোধিতা ধারাবাহিকভাবে করে এসেছে জাতীয় বাংলা সম্মেলন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। অর্থনৈতিক দাবীদাওয়া এবং মর্যাদার প্রশ্নে লড়াইয়ের পাশাপাশি এই আন্দোলনের আরও দুটো দিক রয়েছে। একটি হল ৯৬ সালের অপারেশন সানসাইন বিরোধি আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০০৬-২০০৭-এর উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কর্পোরেট উন্নয়নের এই মডেলকে চ্যালেঞ্জ করার প্রশ্ন। বাংলার বুকে হকার আন্দোলনের ঐতিহ্যকে মনে রেখে এখানে কয়েকটা কথা বলি। ১৯৯৬ সালে হকার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিল বামফ্রন্ট সরকার। সে প্রকল্পের নাম ছিল 'অপারেশন সানশাইন'। যুক্তিটা প্রায় একই রকম ছিল। আজ যেমন বলা হচ্ছে স্টেশনকে উন্নত করা হবে, স্টেশনটা যাত্রীদের, হকারদের নয়। সেদিনও বলা হয়েছিল ফুটপাথে হকার বসলে তা শহরের সৌন্দর্যের পক্ষে হানিকারক এবং সেই দৃশ্য মহানগরীর অন্ধকার ছবি তুলে ধরে। তাই এল অপারেশন সানশাইন। অর্থাৎ হকারদের পেটে লাথি মেরে 'বাবুদের' জন্য আলোকিত শহর পরিকল্পনা সাজালো তথাকথিত বামপন্থী সরকার। বেশ কিছু জায়গায় বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিল হকারদের স্টল। তবে অতটা সহজ হল না বিষয়টা। একজোট হলেন হকাররা। সংহতি জানালেন, পাশে দাঁড়ালেন ছাত্র-ছাত্রী বুদ্ধিজীবিদের একাংশ, নাগরিক উদ্যোগ এবং অধিকার রক্ষার সংগঠন গুলোও। জোরদার আন্দোলন করে উচ্ছেদকে রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল সেদিন। হকার আন্দোলনের সাফল্যে গড়ে উঠেছিল উচ্ছেদ বিরোধী যুক্ত মঞ্চ। এই উচ্ছেদের রূপরেখা কেবল '৯৬-এই আসে তা কিন্তু নয়। পিছনে ফিরে গেলে দেখব, ১৯৫২ সালে বিধান রায়ের আমলেও মিউনিসিপালিটি নোটিশ পাঠিয়ে জানায় রাস্তা কেবল পথচারীদের; ফলে হকার উচ্ছেদ করতে হবে। ১৯৭৫ সালে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমলেও কিন্তু হকার উচ্ছেদের এই ধারাবাহিকতাই বজায় থাকে। এর উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে বাংলার মাটিতে উচ্ছেদ বিরোধী লড়াই বারে বারেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে এই উন্নয়নের মিথকে। হকারদের সংগঠিত আইনি লড়াইয়ের একটি বড় সাফল্য ২০১৪ সালে পাশ হওয়া "Street Vendors (Protection of livelihood and regulation of street vending) Act of 2014. এই আইন লাইসেন্স দিয়ে হকারদের এক ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক ছাঁচে নিয়ে আসল। তবে কর্পোরেট আগ্রাসনের অক্টোপাসকে এভাবে আদৌ রোখা গেল কী? প্রশ্নটা রয়েছে। কারণ নানা কায়দায় এই বিকেন্দ্রিভুত ব্যবস্থাটিকে ভেঙে ফেলার- হকার এবং ছোট-ছোট উৎপাদকদের কোনায় ঠেলে একচেটিয়া কর্পোরেটরাজ প্রতিষ্ঠার চক্র ভীষণ রকম ক্রিয়াশীল। ২০০০ সালের পর থেকেই সব সরকারই ক্রমাগত সওয়াল করেছে খুচরো ব্যবসায় বিদেশী বিনিয়োগকে সম্পূর্ণ ছাড় দেওয়ার জন্য। প্রায় ৪ কোটি মানুষকে খাদের কিনারে ঠেলে দিতে পারে এই পলিসি। ধারাবাহিক প্রতিরোধের মুখে আইন করে আনতে না পারলেও ইতিমধ্যে বহু কর্পোরেট রাঘববোয়ালরা ঢুকে পড়েছে খুচরো বাজারে। পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে আই টি সি বা রিলায়েন্স রিটেল খুচরো ব্যবসায় ঢুকে পড়ায় ৩০% মতো লোকসান হয়েছে হকারদের।
এই আন্দোলনের আরেকটি দিক অবশ্যই বাঙালি জাতির আত্মসম্মান আর অধিকারের প্রশ্ন। জাতির অধিকারের লড়াইয়েও আজ হকারদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ভবিষ্যতে অনেক বড় সম্ভাবনার জন্ম দিতে পারে। পার্টিশনের ক্ষত বুকে নিয়ে বাংলা ঐতিহাসিকভাবেই এমন একটা পরিস্থিতিতে রয়েছে যেখানে হিন্দি-হিন্দুত্বের আগ্রাসন যেকোনো সময় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এই সম্ভাবনা প্রকট হয়েছিল এনআরসি থেকে শুরু করে একাধিক ইস্যুতে। আজ নতুন সংসদ ভবন হবার পর শোনা যাচ্ছে ডিলিমিটেশন হবে এবং তার ফলে বেশী জনসংখ্যার ডিভিডেন্ড পেয়ে উত্তর ভারত সংখ্যাগুরুর রাজনৈতিক আধিপত্যে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিনে যেমন উত্তর ভারতের আধিপত্য বিরোধী আওয়াজ উঠেছে, তেমনই অধিকারের প্রশ্নে, নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ভাষার বিকাশের প্রশ্নে বাঙালি জাতির আওয়াজও জোরালো হওয়া দরকার। বিএসেফের ৫০ কিমি অধিগ্রহণ করে বসে থাকা, অমৃত ভারত স্টেশন প্রকল্পের নামে বস্তির জমিগুলোর ওপর কেন্দ্রের দাপাদাপি ইত্যাদি প্রত্যেকটি আগ্রাসনের বিরোধিতা করা বাঙালির কর্তব্য। রেলের সমস্ত ক্ষেত্রটিতে যেভাবে হিন্দির আগ্রাসন বাড়ছে, রেল রুটের ব্যবসা ক্ষেত্রে অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীর আধিপত্য যেভাবে বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে জিএসটি-লকডাউন বা শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রের দাদাগিরি এবং দমন মূলক, বঞ্চনামূলক প্রকল্পের মুখে বাংলার রুখে দাঁড়ানোর সময় আজ। এই সমস্ত প্রশ্নে জাতীয় বাংলা সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। উলুবেড়িয়া শাখার হকারদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম রেল পুলিশের অত্যাচারের পাশাপাশি অবাঙালি ব্যবসাদারদের আধিপত্যের বিরুদ্ধেও তাঁরা সোচ্চার। ৬ মাস ধরে এই লাইনে হকারি করছেন অভিজিৎ সিং। তিনি পানীয় জল বিক্রি করেন। তিনি বললেন যে তাঁদের রোজকার আজ বিপদের মুখে পড়ছে কারণ স্টেশনে কিছু নতুন নতুন বড় স্টল গজিয়ে উঠছে, যারা অন্যায় ভাবে অনেক লোককে নিযুক্ত করছে শুধু স্টেশনে নয়, রেলগাড়িতে উঠে হকারি করার জন্য। এই সব বড় স্টলের বরাত পাচ্ছে বাইরে থেকে আসা কিছু অবাঙ্গালি ব্যবসায়ী রেল পুলিশ এবং আইআরসিটিসির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে- এমনটাই আশঙ্কা করছেন দীর্ঘদিনের এই লাইনের হকাররা। অভিজিৎ সিং ছাড়াও এই একই অভিযোগ করলেন জল বিক্রেতা শ্যাম ব্যানার্জি এবং মোরসালেম মোল্লা। কিন্তু তাদের দাঁতে দাঁত চিপে লড়ে যাওয়ার স্পিরিটটাই উৎসাহ জোগাবে বাংলার মানুষকে। বিভিন্ন শক্তি সংহতিতে এগিয়ে আসছে এটা খুবই আশাব্যঞ্জক।সকল গণতান্ত্রিক মানুষ আজ কর্পোরেটের আগ্রাসন, হিন্দি-আগ্রাসন, তাদের দালাল প্রত্যেকটি সরকার আর কেন্দ্রের যে কোনও খবরদারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তা গণ আন্দোলনকে একটি আলাদা মাত্রা দিতে পারে ।