মাণ্ডি ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই সরকার আর ফসল কিনবে না। যে ফসল কিনে রেশন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বণ্টন করত সরকার, তার দায় থেকে অব্যাহতি পেতে চাইছে তারা। যে দেশে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে বা বিশ্ব ক্ষুধার সুচকে যে দেশ ১০২তম স্থানে দাঁড়িয়ে, যা বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশেরও পিছনে, সেই দেশে রেশন ব্যবস্থা থেকে সরকার হাত তুলে নিলে খাদ্য সুরক্ষার বিষয়টি তো সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হবেই। বলছিলেন মোহিত রণদীপ। শনিবার বইচিত্র সভাঘরে ছিল 'আমরা এক সচেতন প্রয়াস'-এর এক কর্মসূচি।
একদিকে যখন নয়া উদারনীতিবাদী উন্নয়ন এবং হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা সামনে রেখে সম্প্রীতি ও মানবিকতার পরিবেশকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে দেশ জুড়ে তখন নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পটভূমিকায় গড়ে ওঠা সংগঠন 'আমরা-এক সচেতন প্রয়াস'-এর বন্ধুরা সেই সব জায়গায় প্রতিস্পর্ধী এক চেতনাকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে যান।
সাম্প্রতিককালে আমাদের এই রাজ্যে বেশ কিছু অঞ্চলে যখন সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে, তখন সেখানে তথ্যনিষ্ঠ তথ্যানুসন্ধানের পাশাপাশি আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে 'আমরা-এক সচেতন প্রয়াস'। তাঁরা পৌঁছেছেন দিল্লির উপকণ্ঠে ঐতিহাসিক এই আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করার তাগিদে। সিংঘু, গাজিপুর এবং টিকরি বর্ডারে পৌঁছেছে তাঁদের একটি দল।
বইচিত্র সভাঘরে তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন আন্দোলনে অন্নদাতা নামের এক কর্মসূচির মাধ্যমে। আমরা এক সচেতন প্রয়াসের সেই টিমে থাকা শুভঙ্কর আন্দোলনের চেহারাকে তুলনা করে বললেন, “এ মহাকুম্ভের থেকেও বড় কুম্ভ। কৃষকদের সঙ্গে ধর্মীয় কুম্ভ, গ্রামীণ মেলার পরিবেশ অনেককাল ধরে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। কিন্তু কর্পোরেট-বিরোধী অর্থনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে তা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সেখানে তৈরি হয়েছে এক সমান্তরাল ব্যবস্থা।”
তিনি নির্দিষ্ট করে বলছেন "সংস্কার শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা সংস্কার বলছে যে বদলে ফেলতে হবে, পুরনো কৃষি ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে হবে, আর তার প্রতিরোধী ব্যবস্থা বলছে সেই সংস্কারের ধারণা এই কৃষি চেতনা। বাঙালি বাম কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের পরিচিত আবহের সঙ্গে তুলনাটা আমাদের দিগন্তকে প্রসারিত করবে। এই আন্দোলন সেই দিক থেকে অনেকটাই আলাদা। এই আন্দোলনে পাঞ্জাবের কৃষকদের ও বিদেশে বসবাসকারী পাঞ্জাবিদের মিলিত সামাজিক সংহতি এবং মিলিত অর্থনৈতিক শক্তি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। মুসলিমদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম হলেও সেনাবাহিনীতে শিখদের উপস্থিতি একটা বড় ফ্যাক্টর। এ প্রসঙ্গে আমাদের বন্ধুদের অভিজ্ঞতা হল যে সেনাবাহিনীর লোকেরা জল কামান ছুঁড়ে দমন করার চেষ্টা করেছে তাঁরাই আবার "জয় জওয়ান জয় কিসান" স্লোগান তুলছে, বলছে-"আমাদের প্রত্যেকের রক্তে চাষির রক্ত আছে।"
দিল্লি গমনকারী প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ফারুক, শিখ ধর্মীয় ও কৌম চেতনা, জাত্যাভিমান ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। বাঙালিদের মধ্যে তার অভাবের কথা বলেছেন। তবে এ প্রসঙ্গে বাঙালিদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনের একটা দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে যা মাথায় থাকা জরুরি।
অমিতাভ, ফারুক ও অন্যরা হিন্দুত্ববাদের একমাত্রিক ক্ষমতাতান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক আস্ফালনের প্রেক্ষিতে এই আন্দোলনে আগ্রাসী রাষ্ট্রীয় ধর্মকে মোকাবিলায় সংহতি ও সেবার ধর্ম দিয়ে প্রতিস্পর্ধার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
কৃষক আন্দোলন আজ কার্নিভালের চেহারা নিয়েছে।প্রায় পনের লক্ষ মানুষের এই সুশৃঙ্খল, উদ্দীপনায় ভরপুর এই আন্দোলন আমাদের দেশের গণআন্দোলনের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় রচনা করছে! একটা গোটা ফ্লাইওভার দখল করে কৃষকরা তাঁবু খাটিয়ে বসে আছেন, অথবা শহরের ফুটপাথে ঘোড়াদের আস্তাবল তৈরি করেছেন নিহাং শিখেরা, এই ধরনের দৃশ্যগুলো বহুদিন চোখে লেগে থাকার মতো। এই আন্দোলনে আমাদের পুরনো অভিজ্ঞতার চেনা ছবিটা আমরা দেখতে পাব না। এখানে ধর্মের প্রশ্ন আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। একদিকে আমরা যেখানে দেখছি ধর্ম বিভেদ-দাঙ্গা হানাহানির অনক হয়ে কাজ করছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে গোটা দেশে বিশেষ একটি সংগঠিত সাম্প্রদায়িক শাসক শক্তির প্রত্যক্ষ মদতে, সেখানে এই দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী আন্দোলনটির ক্ষেত্রে ধর্ম যেন অন্য চেহারা নিয়েছে। আদ্যন্ত ধর্মীয় প্রভাব থাকলেও তা বিভেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি শাসকের নানা ধরণের উস্কানি সত্ত্বেও। ৪৬-এর শিখ দাঙ্গার স্মৃতি উস্কে দেবার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু শিখ এবং মুসলিমরা সচেতনভাবে সম্প্রীতির সুরকে তুলে ধরতে পারছে। ধর্ম এখানে শাসকের ধর্ম নয় বরং প্রতিবাদের হাতিয়ার এবং অবলম্বন।
এই প্রসঙ্গটিকে এত জোর দেওয়ার কারণ এর আগে গণ আন্দোলনের ময়দানে বিশেষত বাংলার রাজনীতির আঙিনায় চেনা ছবি হল ধর্মকে রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে বাদ রাখা বা আন্দোলনকারীদের সেকুলার ভাবধারার প্রাধান্য। এখানে একেবারে বিপরীত একটি নির্মাণ চোখে পড়েছে, ধর্ম প্রতিবাদীর অবলম্বন হয়ে উঠছে অথচ এখানে ধর্ম সহাবস্থানের, হানাহানির নয়। আন্দোলনে ধর্মীয় এই বাতাবরণ একটা দিক, কিন্তু আন্দোলনের চালকের ভূমিকায় আছে কীর্তি কিষাণ ইউনিয়ন, ক্রান্তিকারী কিষাণ ইউনিয়ন, বিকেইউ একতা (উগ্রাহাঁ), বিকেইউ (ক্রান্তিকারী), কিষাণ সংঘর্ষ সমিতি, কিষাণ মজদুর সংঘর্ষ কমিটির মত সংগ্রামী ধারার সংগঠনগুলি। আন্দোলনের হার না মানা মনোভাব এবং আপোসহীন সংগ্রামের অঙ্গীকার এবং সাধারণ কৃষকদের সচেতন রাজনৈতিক ভাষ্যে কোথাও খামতি নেই। আন্দোলনের মধ্যে দাঁড়িয়ে কৃষকদের মুখে বার বার উঠে আসছে খোলা বাজারের হাতে দেশ বিক্রির বিরোধিতা, কর্পোরেট বিরোধিতা। আদানি-আম্বানি যেভাবে টেলিকম থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্ষেত্রে থাবা বসাচ্ছে এবং কব্জা করছে সেভাবেই কৃষিক্ষেত্রকেও কব্জা করবে সে নিয়ে আশঙ্কাতেও রয়েছেন তাঁরা।
ন্যাশনাল হকার্স এসোসিয়েশনের দীপক ব্যাপারী তাঁর অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বললেন, দিল্লির আন্দোলনকারীরা বাংলা থেকে কৃষকদের সমর্থনে আসা বন্ধুদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে আপন করে নিয়েছেন। তিনি জানালেন, এটা বামপন্থীদের সংগঠিত আন্দোলন নয়, পরিচিত বাম প্রকরণ নয়। পঞ্জাবে সেনা-কৃষক-অভিবাসী সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে একই পরিবারের বা একই ব্যক্তি নানা সময়ে এই ভূমিকায় অবতীর্ণ। আদানি-আম্বানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে "জিও-ফরচুন" বয়কটের ডাক দিয়েছেন কৃষকরা; শুধু তাই নয় দিল্লির মধ্যেই ১৫০০ জিও-র টাওয়ার অচল করেছেন তাঁরা। মোদীর পাশাপাশি আদানি-আম্বানির কুশপুতুল পোড়ানো হচ্ছে আন্দোলনের ময়দানে।
প্রান্তিক কৃষক বা খেতমজুররাও এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন বড় কৃষকদের নেতৃত্বে এবং তাঁদের সঙ্গেই। লড়াইয়ে জেতার চাবিকাঠি হিসেবে যে শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের উপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে, তার কিছু ছবি ফুটে উঠছে জনপ্রিয় স্লোগান #kisanmajdoorektazindabad-এর মধ্যে দিয়ে। এই স্লোগান ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছেন আন্দোলনকারীরা। একদিকে যেমন খালসা এইড বা গুরুদুয়ারা লঙ্গর চালিয়ে প্রত্যক্ষ সাহায্য করছে অন্যদিকে রেলশ্রমিকদের সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করেছে, সম্পূর্ণভাবে শামিল হয়েছে আন্দোলনে।
মোহিত রণদীপ বলছিলেন, এটা শুধু কৃষকদের নয়, সকলের আন্দোলন। আজও যদি তা উপলব্ধি না করা যায়, তাহলে যথেষ্ট দেরি হয়ে যাবে। ফ্যাসিস্ত শক্তির বিরোধিতার প্রসঙ্গে তিনি বলছেন- "আমরা এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে ফ্যাসিস্ত শক্তি আমাদের সমস্ত স্বনির্ভরতার জায়গাগুলোকে ধ্বংস করতে চাইছে এবং কর্পোরেটের হাতে সমস্তটা তুলে দিতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর, যাদের এর বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলনে নামার কথা ছিল, তাদের দিক থেকে তেমন করে সাড়া মেলেনি। তাঁর কথায়, কৃষকদের এই আন্দোলন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে, একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করল শাহিনবাগের পর, যা সরকারকে খানিকটা পিছনে সরতে বাধ্য করল। কৃষি বিল বিরোধী এই আন্দোলনকে তাই ফ্যসিবিরোধী আন্দোলনেরই একটা অংশ বলে মনে করছি।"