সেবার মেজো মাসি গঙ্গাসাগর বেড়াতে গিয়েছিলেন, ননদ জা সবাই মিলে। মধ্যবিত্ত পরিবার, মাঝারি সঙ্গতি, মেসোমশাই এই ঘরের কাছের ছোট্ট ভ্রমণের খরচটুকু দিতে আপত্তি করেননি। মাসি ভরপুর খুশি মনে ফিরে এসে মাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, “আসছে বছর তুইও ঘুরে আয়। সারাজীবন তো চ্যাপটা লুচি খেলি, দু দিন কুণ্ডু স্পেশালের সাদা সাদা ফুলকো লুচি খেয়ে আয়।” তা একটু মনে করে দেখুন তো দেখি, মায়েরা কি কেবল রবিবার সকালের জলখাবারের লাল হয়ে যাওয়া আর চ্যাপটা লুচিগুলোই খেতেন? নাকি ছোট মাংসের টুকরোটা, একটু পিত্তি গলে যাওয়া মাছের পেটিটা, দাগ লেগে যাওয়া ফলটা, এমনই আরো অগুনতি খুঁতযুক্ত খাবার দাবার তাঁদেরকে খেতে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম! যা সুস্বাদু, যা পুষ্টিকর, কোনোটাই আমাদের মায়েরা নিজের পাতে বেড়ে নিতেন কি? আজকের দিনেও ছবিটা খুব বদলেছে বলে মনে হয়? হয়তো আমি আপনি লেখাপড়া শিখে, চাকরিবাকরি করে একটু ভালো আছি। ভালোমন্দ খাই, সেজেগুজে বেড়াতে যাই, মায়েদের মতো হেঁশেল-বন্দিনী হয়ে থাকি না। কিন্তু আমাদের মতো গরিব দেশের অগণিত সাধারণ মেয়েদের জীবন কি এরকম, আজকের একুশ শতকে পৌঁছেও?
খাওয়া নিয়ে বেশি কথা বলাটা বিষম নির্লজ্জতা। আর মেয়েদের মুখে এ সব আলোচনা মানে তো কেলেঙ্কারি! সেবাময়ী সুশীলারা নিজেরা ভালো খাওয়ার জন্য লোলুপ, পরিবারের সকলের মুখে সেরা খাবারটা তুলে দেওয়ার মতো পবিত্র কাজটুকুও আর করতে চায় না। তবু এই প্রসঙ্গটা তুলছি, চোখের মাথা খেয়েই তুলছি। কারণ এই খাদ্য-অপুষ্টির দুষ্টচক্র হচ্ছে মেয়েদের দীর্ঘকালীন অনগ্রসরতার দৈনন্দিন ভিত। আমাদের মধ্যবিত্ত মা-মাসিদের ছেড়ে যদি একটু এগিয়ে যাওয়া যায় নিম্ন-মধ্য আর নিম্নবিত্তের দিকে, তাহলে সেখানে পুষ্টিহীনতার গল্পটা অনেক বেশি প্রবল, আরো তীব্র লিঙ্গ-বৈষম্যের সুতোয় বোনা। উন্নয়নশীল দেশে মহিলাদের স্বাস্থ্য চিরকালই একটা অবহেলিত বিষয়। বৈজ্ঞানিক সূচকগুলির ভিত্তিতে পরিমাপ করলে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মহিলা খুব বেশি পাওয়া যাবে না। অথচ এ বিষয়ে সচেতনতা বা আলোচনা তেমন কোথায়! গরিব দেশের অনগ্রসরতার একটা অনিবার্য প্রতিরূপ মহিলাদের স্বাস্থ্য নিয়ে অজ্ঞতা আর উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাব। আমরা সব মেয়েরাই কিছু না কিছু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার শিকার। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক স্তরে তার বিন্যাস বদলে যায় মাত্র। ভারতবর্ষের সমগ্র মহিলা জাতির পরিস্থিতি বুঝতে হলে একটু পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করতে হবে। আসুন, এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলি একটু নেড়েচেড়ে দেখি।
প্রতি পাঁচ বছরে জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (National Family Health Survey বা NFHS) করা হয়ে থাকে। এর প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি সংখ্যা আমাদের দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সম্পর্কে অনেক কথা বলে। আর সেইসব ঘোষিত পরিসংখ্যান ও হ্রাস-বৃদ্ধির হারগুলির ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে মেয়েদের গল্প, মায়েদের গল্প। বিগত বছরের সমীক্ষা গুলো থেকে মেয়েদের খাওয়াদাওয়ার একটা ধারণা করে নেওয়া যেতে পারে। সেই অনুযায়ী ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মহিলা ও পুরুষ, যাঁদের উৎপাদনশীল বা কর্মক্ষম বলে গণ্য করা হয়, তাঁদের খাদ্যাভ্যাসের একটা তুলনামূলক পরীক্ষার ফলের দিকে নজর দেওয়া যাক। যে খাদ্যদ্রব্যগুলি এতে বিবেচনা করা হয়েছে তা হল দুধ/দই, ডাল, সবুজ শাক-সবজি, ফল, ডিম, মাছ, মাংস। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শতকরা হিসেবে মহিলারা অনেকখানি পিছিয়ে। অবশ্য এমন নয় যে পুরুষেরা সকলেই নিয়মিত এইসব খাবার খান। তবু তাঁরা যা খান বা যা তাঁদের খেতে দেওয়া হয়, মহিলারা তাও পান না বা সামাজিক অভ্যাসবশত নিজেরা নেন না। যেমন, সপ্তাহে অন্তত একদিন দুধ/দই খান ৬৭.২% পুরুষ আর ৫৫% মহিলা; মাংস খান ২৮% পুরুষ আর ২২% মহিলা; মাছ/মুরগি খান ৪০% পুরুষ আর ৩৫% মহিলা, এই রকম সব হিসেব আর কী! স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সবেতেই মেয়েদের পুষ্টিকর খাদ্যের ভাগ কম। ডাল আর সবজি খাওয়ার মোট শতকরা হিসেব মোটামুটি ভালো হলেও পার্থক্য থেকেই যায় (যথাক্রমে ৯১% ও ৮৯%)।
এবার চলে আসি এই খাদ্যাভ্যাসের আরেকটু সূক্ষ্ম বিন্যাসে। কতজন পুরুষ ও মহিলা উপরোক্ত খাবার গুলো রোজ খান আর কত শতাংশ কোনোদিনই খান নি। এখানেও লিঙ্গ বৈষম্যের চিত্রে খুব ফারাক নেই। ৪৭% পুরুষ যদি প্রতিদিন দুধ/দই খান, তবে তেমন মহিলাদের ভাগ ৩৯%; ডিমের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৫% ও ৩%; মাছ-মাংসের ক্ষেত্রে তার মান ১.২% ও ০.৫%। অন্যদিকে রয়েছে একেবারেই না খাওয়ার হিসেব। ৩২% মহিলা কোনোদিন মাছ-মাংস খান নি। তার তুলনায় মাছ-মাংস না খাওয়া পুরুষের হার অনেক কম, ২৩%। কখনো ভাগ্যে একটিও ডিম জোটেনি ২৩% পুরুষ ও ৩৫% শতাংশ মহিলার। আবার দেখা যায় ৭% পুরুষ আর ১১.৫% মহিলা কোনোদিনই পান নি দুধ/দই।
এই সমষ্টিগত অপুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে আলাদা করে পড়ে নেওয়া যায় মহিলাদের আরো বেশি পুষ্টিহীনতার ছবিটা। এই দুর্বল-শরীর মায়েরা সন্তান-জন্মের সময়েও যে সমস্যার সম্মুখীন হবেন, তা সহজেই বোঝা যায়। রিপোর্টে তারও বিস্তারিত হদিশ মেলে। সন্তান জন্মের আগে-পরে চিকিৎসা ও শুশ্রূষার অভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, প্রতি চারজনে একজন মহিলা এর আওতার বাইরে। স্বাস্থ্যের বঞ্চনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরো অনেক প্রশ্ন- আয়-ব্যয়ের ওপর অধিকার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জ্ঞান, স্বামীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মসংস্থান ইত্যাদি অনেক কারণ। ঘরের ভেতরে খাদ্যদ্রব্যের বণ্টনে বৈষম্য আর মহিলাদের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা আসলে গভীরতর অনুন্নয়নের একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
সদ্যপ্রকাশিত পঞ্চম (২০১৯-২০) জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষাতে প্রচলিত পরিমাপ ছাড়াও কতগুলি নতুন সূচকের কথা পাওয়া যাচ্ছে। টেঁকসই উন্নয়নের লক্ষ্যগুলির (Sustainable Development Goals বা SDG ) মূল্যায়ন ছাড়াও তাতে যুক্ত হয়েছে কিছু নতুন ধারণা - শিশুদের সীমিত বৃদ্ধি (child stunting), শিশু অপচয় (child wasting), কম ওজনের শিশু (underweight children ) এবং অবশ্যই শিশুমৃত্যর হার (child mortality)। এগুলির প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী, শারীরিক ও মানসিক দুভাবেই। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে গত পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতবর্ষের অনেক রাজ্যেই এই সূচকগুলির হার কমার বদলে বেড়ে গিয়েছে। এক কথায়, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে জন্মানো শিশুরা তাদের আগের প্রজন্মের থেকে বেশি দুর্বল। রাজ্য ভিত্তিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যে ২২টি রাজ্যে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল তার মধ্যে ১৩টিতে স্টান্টিং বেড়েছে। ১৮টি রাজ্যের মধ্যে ১১টিতে অপুষ্টির হার বেড়েছে, ২২টির মধ্যে ১২টিতে চাইল্ড ওয়েস্টিং বেড়েছে আর কোনো কোনো রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে প্রতি হাজারে ৩৪ থেকে ৫৬ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে, ১ বছরের মধ্যে এবং ৫ বছরের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার অনেক রাজ্যেই ঊর্ধ্বমুখী। হিসেব বলছে ৬০% শিশুমৃত্যুর কারণ অপুষ্টি। সাধারণভাবে বলা হয় দেশে গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা স্থিতিশীল হলে শিশুদের বৃদ্ধি হয়, প্রতি প্রজন্ম তার আগের প্রজন্মের থেকে শুধু লম্বা নয়, সামগ্রিকভাবে এগিয়ে চলে। অথচ আমাদের সবই উলটপুরাণ।
আমাদের নবীনে ভরা দেশ, যেখানে মধ্যমান বয়স মাত্র ২৭ বছর, সেখানে শিশুরা ‘কমপ্লান-বয়’ আর ‘কমপ্লান-গার্ল’’ হয়ে উঠছে না। সমীক্ষা আরো দেখাচ্ছে পাঁচটি রাজ্যে লিঙ্গ-অনুপাত ৯০০-এর নীচে, যা অনভিপ্রেত সর্বভারতীয় মানের (৯৫২) থেকেও অনেক কম। শিশু-কন্যার বিয়ের সংখ্যাও গত পাঁচ বছরে বেড়েছে বিভিন্ন রাজ্যে। সঙ্গে বেড়েছে ১৯ বছরের কম বয়সী গর্ভবতী মহিলাদের (teenage pregnancy) সংখ্যা। মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার মাত্রা বিপজ্জনক। দেখা যাচ্ছে, ২২টির মধ্যে ১৩টি রাজ্যেই অর্ধেকের বেশি মহিলা এবং শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে। রিপোর্টে বলা প্রতিটি লক্ষণের পিছনের গল্পের সুর কিন্তু একটাই- মায়েদের অপুষ্টি, মায়েদের পিছিয়ে থাকা, যার অর্থ পুরো সমাজের পিছিয়ে থাকা, পুরো দেশের পিছিয়ে থাকা।
ওপরে বলা সবটাই কি কেবল নিন্দুকের সমালোচনা মনে হচ্ছে? রিপোর্টে তো দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে বেশ কিছু সূচকের উন্নতিও হয়েছে। যেমন ধরুন, মহিলা পিছু সন্তান জন্মের হার কমেছে, বাড়ির পরিবর্তে হাসপাতালে জন্মের হার বেড়েছে, জন্ম নিয়ন্ত্রণের হার বেড়েছে, শিশুদের টীকাকারণ বেশি হচ্ছে ইত্যাদি। তবে সমস্যাটা কোথায়?
অস্বাচ্ছন্দ্য এইখানে যে, আগের তুলনায় উন্নতি হলেও এই সূচকগুলির প্রকৃত মান কতখানি সেটা বিচার করা জরুরি। অর্থাৎ পরীক্ষায় একশোতে পাঁচ নম্বর পেলে আর পনেরো নম্বর পেলে দুজনেই তো ফেল, নাকি! নির্দিষ্ট লক্ষ্যের থেকে, মানে টেঁকসই উন্নয়নের লক্ষ্য ৩ (সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য) আর লক্ষ্য ৫ (লিঙ্গ-সাম্য), এখনো যে আমাদের মহিলারা বহু দূরে। আবার দেখুন, লক্ষ্য ৬ (পরিস্রুত জল ও পরিচ্ছন্ন নিকাশি ব্যবস্থা) আর লক্ষ্য ৭ (সস্তা ও পরিচ্ছন্ন শক্তির যোগান)- এগুলো কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহিলাদের সমস্যা সমাধানের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে ঋতুকালীন অপরিচ্ছন্নতার কথা, উপযুক্ত শৌচালয় ও স্নানাগারের অপ্রতুলতার কথা। উন্নত দেশে এটা কোনো আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশে যে কোনো সময়েই এটি একটি বড়ো প্রশ্ন হওয়া উচিত। আশা করতে ইচ্ছে করে, অক্ষয় কুমারের বিজ্ঞাপনে আর প্যাডম্যানের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় কিছু বদল আসছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও কারিগরি চেষ্টাও শুরু হয়েছে। যেমন, কলাগাছের তন্তু থেকে তৈরি জৈব স্যানিটারি প্যাড আজকাল পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তার দাম খুব বেশি, সাধারণের আয়ত্তের মধ্যে আনতে হলে আরো অনেক দাম কমাতে হবে। তাছাড়া, এর উদ্দেশ্য প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো যতটা, মহিলাদের জন্য পরিচ্ছন্নতা কি ততটা? জানি না, তবে দুদিকেই উপকার হলে মন্দ কি! আসলে, উন্নয়নশীল সমাজে এইসব বিষয় তো তেমন গুরুত্ব পায় না, তাই বিশ্বাস করতে মন চাইলেও ভরসা হয় না। যেমন, আমফানের পর বাংলাদেশে যে রেপিড জেন্ডার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের সময় অধ্যুষিত অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক মহিলা সন্তানধারণের বয়ঃসীমার মধ্যে ছিলেন আর এক-চতুর্থাংশ আসলেই গর্ভবতী ছিলেন। এ ছাড়া রজঃস্বলা মহিলা তো থাকবেনই। তার হিসেব কে রাখে, তাদের পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা কে করে! জেন্ডার রিপোর্ট একথাও জানিয়েছে যে আমফানের তাৎক্ষণিক কোপ পড়েছে মহিলাদের খাদ্যের যোগানের ওপরেও। দুর্যোগে যখন খাদ্য অ-সংকুলান, তখন মহিলারা খাবার তুলে দেন পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মুখে। ধুকঁতে থাকা পুষ্টিহীন শরীর অধিকতর অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়।
এবার যদি খুঁটিয়ে দেখি টেঁকসই উন্নয়নের লক্ষ্য ৭, তবে বোঝা যাবে পরিচ্ছন্ন শক্তি আর মহিলাদের স্বাস্থ্য কী নিবিড়ভাবে যুক্ত। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নোংরা জ্বালানির ব্যবহার ক্রমশ কম হতে থাকে- কাঠ, কয়লা, ঘুঁটে, গোবর থেকে সরতে সরতে কেরোসিন, গ্যাস, বিদ্যুৎ। এই শক্তির সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে ওঠা আমাদের দেশের মেয়েদের পক্ষে এক কঠিন পর্বতাভিযানের মতো। তার অনিবার্য প্রতিরূপ হেঁশেল-বন্দি অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করার ফলে চরম স্বাস্থ্যহানি। বাইরের প্রদূষণের মতোই ভয়ঙ্কর ভেতরের প্রদূষণ। সারাদিন বদ্ধ ঘরের ভিতরে নিম্নমানের জ্বালানি দ্বারা চালিত পুরোনো ধাঁচের চুলা থেকে জন্ম নেয় নানা রকমের প্রদূষক কণা। সেই ধূলিকালি আর ঘরের হাওয়ায় জমে থাকা সালফার আর কার্বনের অক্সাইড মহিলাদের হৃৎপিণ্ড আর ফুসফুসে পৌঁছায় অনায়াসে। তাছাড়াও আছে বেনজিন, ফরমালডিহাইড, বেনজিল অ্যামিনো পিউরিন ও অন্যান্য অনেক রকমের ক্ষতিকর যৌগ। এই অনবরত বিষাক্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রভাব পড়ে মহিলাদের স্বাস্থ্যের ওপর। এর ফলে নানা ধরনের ক্যান্সার, চোখের অসুখ, হৃৎপিন্ড ও শ্বাসনালীর রোগ থেকে শুরু করে প্রজনন ও সন্তান ধারণ সংক্রান্ত জটিলতা- সব কিছুই দেখা দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ দ্বারা প্রভাবিত মহিলারা মৃত শিশু অথবা কম ওজনের শিশু প্রসব করতে পারেন। স্বাস্থ্য সমীক্ষায় পাওয়া ফলাফলের একটা সম্ভাব্য কারণ পাওয়া গেলো কি! গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কাঠের চুলার ব্যবহার থেকে প্রায় একশো রকমের জৈব যৌগ তৈরি হয়, যার মধ্যে ১৪টি ক্যান্সারের কারণ, ৫টি ক্যান্সার বাড়িয়ে দেয় আর ৬টি ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করে। নিঃশব্দ ঘাতকের আঘাতে হতে থাকে দীর্ঘকালীন ক্ষয় ও প্রতিরোধ শক্তি হ্রাস। বিভিন্ন সমীক্ষায় আরো জানা গিয়েছে যে ভারতবর্ষের গ্রাম ও শহরের নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রায় ৮০% মহিলা ব্যাপক হারে COPD-এর (Chronic Obsessive Pulmonary Disease) শিকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই জাতীয় আভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের প্রভাব দৈনিক প্রায় ২০ প্যাকেট সিগারেটের সমান। অপরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহারের নিরিখে ভারতবর্ষ আফ্রিকার পাপুয়া নিউ গিনি আর কেনিয়ার মতো দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট তেমনই দেখিয়েছে। গবেষণার ফল বলছে, অনুন্নত দেশে মহিলা ও শিশুদের অকাল মৃত্যুর মধ্যে বার্ষিক প্রায় ৪.৩ থেকে ৫.৭ লক্ষের পরোক্ষ কারণ আভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ। তাবৎ পৃথিবীর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের এই চালচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের দেশের মেয়েরাও।
ফুলকো লুচি নয়, বাচ্চার বেড়ে ওঠার জন্য ‘তেইশটি একান্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যগুণ-যুক্ত’ কমপ্লান নয়, এঁদের প্রয়োজন কিছু ন্যূনতম পুষ্টি আর একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, যা দিয়ে বেঁচে থাকা যায়, যা দিয়ে উপার্জনের জন্য জরুরি কর্মক্ষমতাটুকু বজায় রাখা যায়। সেটুকু পুষ্টি মেয়েদের অধিকার, যা তাঁদের নিজেদের সুস্থ রাখবে, তাঁদের সন্তানদের সুস্থ রাখবে, গোটা পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বিশ্বব্যাপী ঘোষিত টেঁকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের জীবনে আসুক সম্মানের সাথে উন্নয়ন, সেটাই উন্নয়নের অর্থনীতির মূল কথা।
এতক্ষণ ধরে এই সব কথাবার্তা আর পরিসংখ্যান নিয়ে বকবক কেন করছি বলুন তো? আসলে এটা যে মার্চ মাস। আজ নারী দিবস। তাই মনের মধ্যে উথাল পাথাল। মহিলাদের গোলাপ ফুল, চকোলেট আর কার্ড পাওয়ার সময়। সামাজিক মাধ্যমে শুভেচ্ছাবার্তার বন্যা বয়ে যাবে। বিভিন্ন বিপণন সংস্থা মেয়েলি জিনিসে ভারী রকমের ছাড় ঘোষণা করবে। আপনার আপিসে বিশেষ অনুষ্ঠানও হতে পারে। সেই ফুলের তোড়া আর উপহারের প্যাকেট হাতে নিয়ে যখন চকোলেটে কামড় দেবেন, তখন কি মনে পড়বে আপনার বাড়িতে কাজ করা মেয়েটির কথা? তার চারটে বাচ্চা, কারণ সে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে জানতো না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা তার ছিল না। সে রোজ একটু দুধ পায় না, অনেকদিন শুধু ধনেপাতা-বাটা চাটনি দিয়ে রুটি খায়। তার দুর্বল শরীরে জন্ম দেওয়া একটা ছেলে জন্ম থেকেই দৃষ্টিশক্তিহীন। মেয়ে দুটি বড়ো হচ্ছে, এগিয়ে চলেছে সেই চক্রাকার পথের দিকেই। আজ নারী দিবস ওদেরও। আরো পেছনে তাকাই না, ওদের গ্রামে রয়ে যাওয়া মা, বোন, বৌদি আর মাসি-পিসিদের দিকে। কাঠকুটো জোগাড় করে আর ঘুঁটে-কয়লা-গোবরের চুলায় রান্না করে যাদের সারাটা দিন কাটে, যারা জানেও না কোন রোগ বাসা বাঁধছে শরীরের মধ্যে। আজ সকলেরই নারী দিবস। ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে, সারা দুনিয়ার সব দেশের মতোই আমাদের উন্নয়নশীল সমাজের সব মেয়েদের জন্যই চিহ্নিত এই বিশেষ দিনটি। আসুন, আজ আরেকবার আমাদের সেই দুর্ভাগিনী বোনেদের কথা ভাবি। আরেকবার মনে করি যে উন্নয়ন সকলকে নিয়ে, উন্নয়ন সকলের জন্য। শুধু পরিবেশ বা অর্থনীতি নয়, ‘টেঁকসই উন্নয়ন’ মানে সামাজিক উন্নয়নও বটে, যার অর্ধেক অধিকার মেয়েদের। নারী দিবসে সেই শুভ বোধ আমাদের ঘিরে থাকুক। একটা প্রতীকী দিনের উৎসব উদযাপন ছাপিয়ে এক সার্বজনীন উজ্জ্বল ভবিষ্যত চিরায়ত হোক।