এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  প্রথম পাঠ

  • বাজারের খোলা মাঠে গাছপালা, পশুপাখি আর আমরা

    অনিন্দিতা রায় সাহা
    পড়াবই | প্রথম পাঠ | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৮৫৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • জীববৈচিত্র্যের অর্থনীতি। নামটা বোধ হয় খুব পরিচিত নয়। অর্থনীতির ক্লাসে প্রথম দিন আসা কোনো ছাত্রকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এতে কী বিষয়ে পড়াশুনা হয় বলে মনে কর, তবে দশের মধ্যে নয়জনই বলবে বাজার, দাম, চাহিদা, যোগান, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর-ভর্তুকি, শেয়ার বাজার, সুদের হিসেব এইসব। ঠিক কথা। খবরের কাগজ থেকে শুরু করে অর্থশাস্ত্রের নয়া-ধ্রুপদী পাঠ্যবই, তাই তো বলে। উৎপাদন, ভোগ আর আর্থিক প্রগতি, মানুষের ভাল থাকার এই মাপকাঠিগুলো আমাদের মজ্জায় বসে আছে। প্রতিটি মানুষ তার যুক্তিবাদী মন দিয়ে জানে কিসে তার ভালো হয়, তাই সে সদাই নিজের সর্বাধিক ভালোর চিন্তায় উন্মুখ। আর এমনি সকলের সেরা অবস্থানগুলিকে যোগ করে দিলে সমাজের সম্মিলিত ভালো থাকাও সর্বাধিক। সংক্ষেপে এই হল নয়া ধ্রুপদী অর্থনীতির মোদ্দা কথা।

    বাজার নামে একটা জাদু আছে। সে একটি এমন অদৃশ্য হাত যে সব চাহিদা-যোগানকে মিলিয়ে দিতে পারে, ভারসাম্য এনে দিতে পারে, স্থিতিশীলতাও। সেখানে জিনিসপত্র আর পরিষেবার বেচাকেনা হয়। নানা প্রকারের বাজারের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে গোটা অর্থনীতি পৌঁছতে পারে একটি ভারসাম্য বিন্দুতে। সেখান থেকে ক্রমাগত বেড়ে চলতে পারে উৎপাদন, আয়, ভোগ, ব্যয়, ইত্যাদি। এরই নাম আর্থিক বিকাশ। এইভাবে অবিরাম ঘুরতে থাকবে আর্থিক প্রগতির চাকা, এডাম স্মিথের সময় থেকে এই সেদিন পর্যন্ত তাই ছিল ধারণা। উৎপাদনের উপাদানের এভাবে এই সীমাহীন বিকাশের পথে যে কখনো বাধা আসতে পারে তার ভাবনা এলো ষাটের দশকে। ‘ক্লাব অফ রোম’ তাদের ‘লিমিটস টু গ্রোথ’ তত্ত্বে সে বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করল। কেনেথ বোল্ডিং বললেন, পৃথিবী হচ্ছে একটি আশু মহাকাশযান যার সীমিত জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে তার উড়ান থমকে যাবে।

    সেই থেকে ভাবনার শুরু। সেই থেকে চিনতে পারা প্রাকৃতিক সম্পদকে। সত্তরের দশকে মধ্যপ্রাচ্যের ভূগর্ভস্থ খনিজ তেলের আবিষ্কার বিশ্ব রাজনীতি আর অর্থনীতির ভিত কাঁপিয়ে দিলো। শক্তি সম্পদ নিয়ে ভাবনাচিন্তা চললো গোটা আশির দশক জুড়ে। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্ত খোঁজার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ তেলের ওপর গুটিকয় দেশের একচেটিয়া অধিকার থেকে মুক্তি। এইসব আর্থ-রাজনৈতিক ওঠাপড়ার সাথে সাথে মানুষ উপলব্ধি করলো যে, এই নিরন্তর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের ফলে পরিবেশের অবনতি ঘটছে, আমাদের অস্তিত্বের সংকট ঘনিয়ে আসছে। এইভাবেই জন্ম হয়েছিল একের পর এক অর্থনীতির নতুন ক্ষেত্র, শক্তির অর্থনীতি (energy economics) আর পরিবেশের অর্থনীতি (environmental economics)। পরিবেশের অর্থনীতির ধারা বেয়ে এগিয়ে গেলে আমরা পাই আরো বৃহত্তর একটি ভাবনার ক্ষেত্র, পারিস্থিতিক অর্থনীতি (ecological economics)। বাংলাতে একটা পরিভাষাগত সমস্যা আছে। হিন্দিতে যদি বলা যায় প্রথমটি পর্যাবরণের অর্থনীতি আর দ্বিতীয়টি পারিস্থিতিক, তাহলে অর্থ স্পষ্ট হয়। বাংলায় আমরা দুটিকেই পরিবেশের সাথে জুড়ে দিই।

    পর্যাবরণের অর্থনীতির মূল ধারাটি নয়া-ধ্রুপদী পরম্পরায় নিহিত। সেখানে মানুষের অবস্থান কেন্দ্রীয় (anthropocentric), পরিবেশ রয়েছে সমাজ ও অর্থব্যবস্থার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে। সেখানে অর্থনীতির প্রচলিত ধারণা ও সূত্রগুলি, যেমন, পুঁজি, পুঁজির বিকল্প, সম্পদের দাম, কর-ভর্তুকি ইত্যাদি, সহজেই জায়গা করে নিয়েছে। অর্থব্যবস্থা সেখানে মুখ্য, সমাজ ও পরিবেশ গৌণ। অন্যদিকে, পারিস্থিতিক অর্থনীতি বলে, মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থান বৈশ্বিক পারিস্থিতিক ব্যবস্থা বা বাস্তুতন্ত্রের একটি সামান্য অংশমাত্র। এক্ষেত্রে সমাজ ও অর্থব্যবস্থাকেই বৃহত্তর পরিবেশ, পরিস্থিতি ও বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়। সেখানে অর্থনৈতিক লেনদেন, শক্তি ও সম্পদের ব্যবহার, দ্রব্য ও পরিষেবার গতায়াত চলতে থাকে বৃহত্তর পৃথিবী গ্রহের (biosphere) মধ্যে। সেখানে মানুষ জীবমন্ডলের লক্ষ কোটির মধ্যে একটি তুচ্ছ প্রজাতি মাত্র। গাছগাছালি, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ আর মানুষ সেখানে সকলে সমান জায়গায়।

    এই যে আমাদের নগন্য অস্তিত্ব, এই উপলব্ধির অভাবেই বুদ্ধিমান আমরা নির্বিচারে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে, উৎপাদনে ব্যবহার করে, অবশিষ্ট প্রকৃতির বুকেই জঞ্জাল হিসেবে ফেরত দিয়ে, মহাভোগের মহাযজ্ঞ বাধিয়েছি। তার ফল আজ আর কারো অজানা নেই। দেরীতে হলেও করোনাকালে আমরা বুঝছি যে, জীবের বৈচিত্র্যময় জগতে আমাদের অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে আছে সকলের সম্মিলিত ভালো থাকার ওপর। সেই সবাই মানে আম-জাম-কাঁঠালের বন, টিয়া-ময়না-কোকিলের বাসা, বাঘ-ভালুক-সিংহের অরণ্য কিংবা পিঁপড়ে-মশা-গুবড়ে পোকার ডেরা। অর্থনীতির আসল উদ্দেশ্য যদি হয় উন্নত মানের জীবন যাপন, তবে তাকে আজ চিনে নিতে হবে এদের সবার মাঝে। অর্থনীতির আলোচনায় প্রকৃতি, পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি যে আর উপেক্ষনীয় নয়, সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা আজ আর দ্বিমত হতে পারবেন না। জীববৈচিত্র্যের অর্থনীতি (economics of biodiversity) বাজারের ছোট সামিয়ানা খুলে দিয়েছে। খোলা মাঠে এসে দাঁড়িয়েছে পোকামাকড়, জীবজন্তু, খেচর, উভচর, জলজ প্রাণী। মানুষের উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, জীবন, এক কথায় ভালোভাবে বেঁচে থাকা, শুধু যে বাজারের নীতি মেনে আর ব্যক্তিস্বার্থে চলে না, তা অতিমারী আরো স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে। ঘন্টা বেজেছে, এখন প্রয়োজন আমাদের সচেতন হওয়া, সঠিক নীতি প্রণয়ন করা আর উপযুক্ত অর্থনৈতিক-সামাজিক কার্যকলাপকে চিহ্নিত করে সেই দিশায় এগিয়ে চলা। তার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক আলোচনা আর নীতি প্রণয়নের সময় এসে গিয়েছে।

    মানব সভ্যতার ইতিহাস প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ ও ব্যবহারের ইতিহাস। আদিম মানব ধীরে ধীরে পৃথিবী গ্রহের অধীশ্বর হয়ে উঠেছে। কৃষি-উদ্বৃত্ত থেকে জন্ম নিয়েছে মালিকানা, রাজত্ব আর তৎসংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো। পরের পর্বে শিল্প বিপ্লব, কয়লা, বাষ্প ইত্যাদি দিয়ে চলেছে অগ্রগতির রথের চাকা। সেই থেকে চলতে চলতে আজ আমরা যে জায়গায় পৌঁছেছি, সেখানে আমাদের চাহিদা মেটাতে হলে ১.৭ গুণ বড় একটি পৃথিবীর প্রয়োজন। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আর অর্থনৈতিক কার্যকলাপের চাপে আমাদের জৈবিক পদচিহ্ন (ecological footprint) এতো বেশি হয়ে পড়েছে যে তা পৃথিবীর ধারণ ক্ষমতা (carrying capacity) এবং জৈব ক্ষমতা (biocapacity) ছাপিয়ে গেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে তৈরি হয়েছে ঘাটতি (ecological deficit)। শতাব্দী প্রাচীন ম্যালথুসিয়ান ধারণা আবার সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। তাঁর ধারণা অনুযায়ী জনসংখ্যা গুণোত্তর প্রগতিতে আর খাদ্যশস্য সমান্তর প্রগতিতে বাড়ার ফলে ঘাটতি তৈরি হতে বাধ্য। কিন্তু একের পর এক বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি আবিষ্কারের ফলে মানুষ জয় করছিল পৃথিবী, তাঁর তত্ত্ব ভুল প্রতীত হচ্ছিল। একবিংশ শতাব্দী আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে যে প্রকৃতিকে জয় করার ক্ষমতা আদতে আমাদের নেই।

    The Economics of Biodiversity: The Dasgupta Review সেই সচেতনতা শিক্ষণের পাঠ নিয়ে এসেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রকাশিত এই রিপোর্টটি জীববৈচিত্র্যের অর্থনীতি বিষয়ে একটি পথপঞ্জী। প্রথম যে বইটি হাতে নিয়ে পরিবেশের অর্থনীতি শিখতে শুরু করেছিলাম, তার নাম The Control of Resources, লেখক পার্থ দাশগুপ্ত। তারপর ওঁর অনেক লেখা পড়েছি, বক্তৃতা শুনেছি। ইংল্যান্ডবাসী স্যার পার্থ দাসগুপ্ত পরিবেশের অর্থনীতি চর্চায় একটি অনিবার্য নাম। ব্রিটিশ সরকারের জন্য তৈরি এই রিপোর্টটি তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও অসীম মনীষার স্বাক্ষর বহন করে। বর্তমান সংকটের মুহূর্তে এই রিপোর্টটি দিগ্দর্শন করে, মানবজাতিকে এগিয়ে চলার পথ দেখায়।

    রিভিউটির মুখবন্ধ লিখেছেন বিখ্যাত প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক স্যার ডেভিড এটেনবোরো। মানবজাতির বর্তমান বিপন্নতার একটি বিস্তারিত খতিয়ান দিয়েছেন তিনি। কীভাবে মানুষ তার ক্রিয়াকলাপ ও খাদ্যাভাসের দ্বারা জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে, কীভাবে ভেঙে পড়ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, বাড়ছে ব্যাধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি, তা একটু বিচার করলে আজকের সংকটের কারণ ও স্বরূপ উভয়ই বোঝা যায় । সমস্যার সমাধানের উপযুক্ত নীতি প্রণয়ন ও তাকে কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন স্তরে আলোচনা ও সংঘবদ্ধতা প্রয়োজন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই রিপোর্টটির গুরুত্ব অপরিসীম।

    রিপোর্টটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে দাসগুপ্ত সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে পৌঁছনোর ইতিহাস, কারণ ও গতিপ্রকৃতি। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্য ও জৈব পরিষেবা (ecosystem services) বিষয়ে আলোচনা রয়েছে প্রাথমিক পর্বে। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদের সঠিক মূল্যায়নের প্রশ্নটি। যেকোনো প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের যা দেয়, তার মধ্যে কিছু উপযোগিতা ও কিছু বিনিময়যোগ্যতা থাকে। যেমন, একটি গাছ থেকে আমরা ফল, ফুল, পাতা, কাঠ ইত্যাদি পাই, আবার বিশুদ্ধ বায়ু, প্রদূষণ রোধ, দর্শন শোভা, মনের আরাম এইসবও পেয়ে যাই। প্রথমটির বাজারে দাম আছে। পরেরটির সঠিক মূল্যায়ন নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে, যার তাত্ত্বিক নাম প্রাকৃতিক সম্পদের গণনা পদ্ধতি (natural resource accounting)। এখান থেকে আলোচনা স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক বিকাশ, বিশ্বের মোট আয়, উৎপাদন ইত্যাদির অনুসন্ধানে। দীর্ঘ অর্থনৈতিক ইতিহাস আর পরিসংখ্যান আমাদের বুঝিয়ে দেয় নয়া-ধ্রুপদী ধারার হিসেবনিকেশ, চোখে পড়ে তার ফাঁকগুলিও। অর্থনৈতিক বিকাশের প্রচলিত ধারার অ-টেঁকসই ধরণটি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আসে আরো কিছু বিষয়- বিশ্বের জনসংখ্যা, বিশ্ববাসীর ভোগপ্রবণতা এবং ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সম্পদ বন্টনের অসাম্য। দাসগুপ্ত হিসাব করে দেখাচ্ছেন প্রকৃতিকে নির্বিচারে লুন্ঠনের এই যুগে (anthropocene) তৈরি হওয়া জৈব ঘাটতি, ব্যাখ্যা করছেন কারিগরি উন্নতি আর পরিবেশের ক্ষতির মাত্রা ও ধরণ। প্রাকৃতিক সম্পদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে সম্মিলিত মালিকানার সম্পদের (common property resource) আলোচনাও এখানে এসেছে কারণ মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্কের এটি একটি বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

    বর্তমানের পরিবেশ সংকটকে বুঝতে হলে আমাদের আরো ভালোভাবে বুঝতে হবে দেশ, প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা। অর্থশাস্ত্র আদতে বলে জনকল্যাণের কথা। তত্ত্বের ভারে আর অঙ্কের ঝোঁকে সে কথা অনেক সময় চাপা পড়ে যায়। সকলে মিলেমিশে বেঁচে থাকা, উৎপাদন ও ভোগ ভাগ করে নেওয়া আর তার থেকে সমাজের সর্বোত্তম মঙ্গলসাধন, সেই আদি বাণীটিই আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে বর্তমান সময়। দাসগুপ্ত ভবিষ্যতের যে পথ দেখাচ্ছেন, তার মূল ভিত্তিটি এই ভাবনার দর্শনেই প্রোথিত।

    দ্বিতীয় পর্বে তিনি বলছেন পরিবর্তনের প্রয়োজনের কথা। আর্থিক হিসেবনিকেশ থেকে শুরু করে বিত্তীয় ব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থা, সবেতেই বাড়িয়ে তুলতে হবে অন্তর্ভুক্তির পরিসর। পরিবেশ সংক্রান্ত শিক্ষা, পরিবেশ রক্ষার জন্য বিনিয়োগ আর জীবন যাপন প্রণালী বদলানোর জন্য সচেতন প্রয়াস- এ এক ত্রিমুখী সমাধানসূত্র। সঠিক নীতি প্রণয়ন করলে একটি শিক্ষিত সচেতন নাগরিক সমাজ পরিবেশ-বান্ধব জীবনের দিকে অগ্রসর হতে পারবে। সেই সঙ্গে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে গড়ে তুলতে হবে একটি সম্মিলিত বিত্ত ব্যবস্থা। পরিবেশ বাঁচানোর জন্য বিনিয়োগ করতে হবে সব দেশকেই। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্থান কাল পাত্র মানে না। আমাজন অরণ্য পুড়ে গেলে গোটা পৃথিবীর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এল নিনোর প্রভাবে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে বহুদূরের তটভূমিতে। তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করা, উষ্ণায়ন সীমিত করার জন্য শিল্প ও যাতায়াত ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা, খনিজ উত্তোলন আর জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে আনা, কৃষিব্যবস্থাকে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখ থেকে বাঁচিয়ে সকলের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা, এই সমস্ত দায় সব দেশের, সব মানুষের। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন জীবনযাপন প্রণালী ও ব্যবহারের পরিবর্তনের (lifestyle and behavioural change) কথা। পরিবেশ বাঁচাতে হলে বদলাতে হবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারা। পরিবেশ ও প্রকৃতির সংরক্ষণ মানে পৃথিবীর বুকে আমাদের টিঁকে থাকা। দাসগুপ্ত রিভিউ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আর অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে সেই সহজ অথচ চরম সত্য কথাটি বলে আমাদের সচেতন করছে।

    পরিশেষে উল্লেখ করি, সদ্য প্রকাশিত Intergovernmental Panel for Climate Change-এর (IPCC) ষষ্ঠ মূল্যাঙ্কন রিপোর্টটি (Climate Change 2021: The Physical Science Basis) দাসগুপ্ত রিভিউয়ের পাশাপাশি পড়া যেতে পারে। বহু চর্চিত এই রিপোর্ট দুটি পরস্পর পরিপূরক। জলবায়ূ পরিবর্তন আর জীববৈচিত্র্য হ্রাস দুটিই মনুষ্যকৃত, দুটি মিলেই সৃষ্টি হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ানক সংকট। এই মুহূর্তে আগুন জ্বলছে গ্রীসে, ধ্বস নামছে হিমালয়ে। কিছুদিন আগেই বন্যায় ভেসে গেছে জার্মানি আর চীন, তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়েছে কানাডা। ভারতের তটভূমিতে আছড়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড়। বিপদের ঘন্টা বাজছে চারিদিকে। জেগে ওঠার দরকার ছিল গতকাল, আমরা নাহয় আজই জাগলাম, নিজেদের অস্তিত্বের জন্য, আগামী প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য।

    The Economics of Biodiversity: The Dasgupta Review
    February 2021
    পার্থ দাশগুপ্ত


    Final Report of the Independent Review on the Economics of Biodiversity led by Professor Sir Partha Dasgupta.
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৮৫৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন