এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  পরিবেশ

  • সকল গৃহ হারালো যার

    অনিন্দিতা রায় সাহা
    আলোচনা | পরিবেশ | ০৫ জুন ২০২২ | ১৫৭১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)

  • গোড়ার কথা

    পরিবেশের অবক্ষয়, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন, এইসব বিষয়গুলি এই সময়ে বহুচর্চিত। পৃথিবী গ্রহের ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে নানারকম রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক তর্কবিতর্ক, বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর কারিগরি বিশ্লেষণ চলছে। গরম হয়ে উঠেছে হাওয়া। কারণ গরম হচ্ছে পৃথিবী, বদলাচ্ছে জলবায়ু। এগিয়ে আসছে শেষের সে ভয়ঙ্কর সেদিন। তাই দেশবিদেশের তাবৎ নীতিনির্ধারকদের চোখে ঘুম নেই। উত্তর গোলার্ধের উন্নত বিশ্বে তোড়জোড় চলছে, কীভাবে ঠান্ডা করা যায় পৃথিবী, জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ কর, হরিৎ শক্তির দিকে এগিয়ে চলো। যেহেতু এই সমস্যাটা ‘আমি মরলে তুমিও বাঁচবে না’ জাতীয়, তাই সবাইকে একজোট করে পদক্ষেপ নিতে ধনী দেশের ভারী উৎসাহ।

    বহু সংগঠন, সরকারি ও বেসরকারি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, বহুদিন ধরে কাজ করছে, রিপোর্ট জমা দিচ্ছে। নীতি নির্ধারণ হচ্ছে, আইনকানুন লেখা হচ্ছে। তবু কেন মেটে না সমস্যা? তাবৎ বিশ্বের সব দেশ হাতে হাত রেখে চলতে কেন এতো অপারগ? কারণ, যেমন বাড়ির মধ্যে আমি আর আমার গৃহসহায়িকার দায়িত্ব আর ভূমিকা একরকম নয়, তেমনিই ধনী আর দরিদ্র দেশগুলির গপ্পোগুলোও আলাদা আলাদা। তার পিছনে রয়েছে মূলত আমাদের অবস্থানগত বৈষম্য। যখন আমার গৃহসহায়িকা মেয়েটিকে বলি বিদ্যুৎ অপচয় করো না, তখন আমার ঘরের বাতানুকূল যন্ত্রটি বন্ধ করতে হয়তো খেয়ালই করি না। ওর ঘরের একমাত্র পাখা আর বাতির দিকেই আঙ্গুল তুলি, যেটা ওর ঘুপচি অন্ধকার একটিমাত্র ঘরে সারাদিন ধরে চলে। তেমনই পশ্চিমা দেশগুলি যে নীতি প্রণয়ন করার জন্য সম্মেলন করে, তখন সবার সমস্যা এক ধরে নিয়েই যেন এগোতে থাকে। উষ্ণায়ন আর জলবায়ুর পরিবর্তন রুখতে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার, এটাই এখন প্রথম বিশ্বের প্রধান কাৰ্যসূচী। আমাদেরও তাই।

    কিন্তু আমাদের জন্য শুধুই কি তাই? আমার গৃহসহায়িকা সবিতা সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছিল বেশ কিছু বছর আগে, সব হারানো উদ্বাস্তু হয়ে। ওর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানির কালো ধোঁওয়া আর পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির সবুজ রং কি আদৌ কোনো বার্তা নিয়ে আসে? ওর ভাঙা ঘর আর ডুবে যাওয়া ধানজমির গল্পটা ওর কাছে অনেক বেশি বাস্তব। যে ত্রাণ শিবিরে ও আতঙ্কে দিন কাটিয়েছিল, তা ওর কাছে আজও দুঃস্বপ্ন। ওর বোকাসোকা মেয়েটা কীসের শিকার হয়েছিল সেখানে, সেটাই ওর কাছে সবচেয়ে নির্মম ইতিহাস। আশপাশের এলাকা আর দেশ থেকে আসা কিছু মানুষও ছিল ওদের সাথে, তারাই মিলেমিশে ছিল। পরিবেশের কারণে, জলবায়ু বদলের দাপটে বারবার স্থানচ্যূত হয়েছে এরা। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এই মানুষগুলিকে কোনোভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনকারী জীবনযাপনের অভিযোগে দায়ী করা যায় না। অথচ পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে এমন মানুষের ঢল। প্রতিদিন নতুন করে ঠাঁইনাড়া হচ্ছেন শত সহস্র মানুষ।

    ওলোটপালোট জলবায়ু আর স্থানচ্যুতি

    উন্নয়নশীল দেশের মানুষের ভিটে হারানোর সমস্যা কি গুরুত্ব পাচ্ছে বিশ্বের দরবারে? IPCC-র (Intergovernmental Panel for Climate Change) মতো দুনিয়া কাঁপানো রিপোর্ট কি বলছে কিছু এইসব অগণিত মানুষের দুর্দশার প্রসঙ্গে? ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র জন, নারী, শিশু, বৃদ্ধ আর প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্যবস্থার কথা কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতির মধ্যে গুরুত্ব পাচ্ছে কি ?

    হ্যাঁ, IPCC ভবিষ্যৎবাণী করেছে। দক্ষিণ এশিয়া হবে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার। লক্ষ লক্ষ মানুষ হবে গৃহহারা, খাদ্যাহারা, সে কথাও বলেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়-এর পূর্বাভাস এখন নিয়মিত ঘটনা। সংবাদে শিরোনাম, দূরদর্শনে প্রতি মুহূর্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, সরকারি পরিদর্শন, ত্রাণ বন্টন। তারপর? তারপর যে তলিয়ে যাচ্ছে জলের তলায়। তাকে তুলে আনতে দেরি হয় কেন? কারণ উন্নয়নশীল দেশে নিত্য ঘটে চলা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুতি (climate induced displacement) আলোচ্য বিষয় হিসাবে এখনো যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না উন্নত বিশ্বে। জলবায়ু-শরণার্থী (climate refugee), জলবায়ু-পরিযান (climate migration) এইসব শব্দগুলো আজকাল নানা জায়গায় শোনা যাচ্ছে বটে, কিন্তু তার এলোমেলো ব্যবহার থেকে বেশ স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এর অর্থ এবং ব্যাপ্তি এখনো আমাদের কাছে তেমন স্বচ্ছ নয়। যদি এর মাত্রাগুলিই সঠিক বোঝা না যায়, তবে নীতি প্রণয়ন হবে কীসের ভিত্তিতে?

    জলবায়ুর ওলোটপালোট খেলা দু রকমের ছবি আঁকে। নানা রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চরম আবহাওয়ার দাপটে ঘটে থাকে (extreme weather events), যেমন, ঘূর্ণিঝড়, প্লাবন ইত্যাদি। যদিও এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মানুষের ওপরে পড়তে পারে, তবু এর প্রাথমিক অভিঘাত মূলত তাৎক্ষণিক। অন্যদিকে জলবায়ুর পরিবর্তনে ধীরে ধীরে হয়ে চলে অনেক দীর্ঘকালীন ঘটনাও (slow onset events), যেমন সমুদ্রস্তরের বেড়ে ওঠা, উষ্ণায়ন, হিমবাহ গলে যাওয়া ইত্যাদি। এই দুই জাতীয় প্রভাবই মানুষকে ঠাঁই নাড়া করে। কখনো তা সাময়িক, কখনো লম্বা সময়ের জন্য, কখনো চিরকালের। যেমন ডুবে যাওয়া সমুদ্রদ্বীপ এককালের লোকবসতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে নানা জায়গায়। ঝড়বৃষ্টি হয়তো কিছদিন পরে আবার ঘর গড়ার সুযোগ দেয়। আবার কখনো কখনো ফেরার অবস্থা থাকে না। মানুষ অনেক সময় বেঘর হয়ে দেশের মধ্যেই অন্যত্র চলে যায়, যাকে বলা হয় আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি (internal displacement), যা গ্রাম থেকে শহরে হতে পারে, কিংবা অন্য রাজ্যে। আবার দেশ ছেড়ে সীমানা পেরিয়ে চলে যেতে পারে দেশান্তরে, যার পোশাকি নাম পরিযান (transboundary migration). এদের সকলকেই মিলেমিশে ডাকা হয় পরিযায়ী, উদ্বাস্তু, স্থানচ্যূত, গৃহহারা, উৎপাটিত এইসব হরেক নামে।

    আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অপ্রতুলতা

    যত নামেই ডাকা হোক আর যত ভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক, জলবায়ুর কারণে স্থানচ্যূত মানুষের জন্যে সঠিক পুনর্বাসন নীতি আজও তৈরি হয় নি। সাময়িক ত্রাণ নীতি আছে, শিবির খোলা হয়, কিছু অনুদানও দেওয়া হয়। কিন্তু তার বেশি এগোয় না তেমন। দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের কোনো নীতি এইসব ঠাঁই নাড়া মানুষদের জন্য আজও লেখা হয় নি। সাম্প্রতিক কালে উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ সবাই উত্তাল। কিন্তু সেগুলি মূলত রাজনৈতিক। এছাড়া অর্থনৈতিক কারণে দেশান্তরে যাওয়া এক অতিপরিচিত পরিযান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্থানচ্যূত এখনো কোনো স্বীকৃত বা লিখিত শ্রেণীই নয়।

    সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ মানবাধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা ও প্রতিকারের যে রূপরেখা তৈরি করেছে, সেগুলি মূলত রাজনৈতিক উদ্বাস্তুদের ঘিরে, যাদের স্থানচ্যুতির কারণ স্থানীয় বা জাতীয় স্তরে সংঘর্ষ (conflict induced displacement). United Nations Human Rights Commission (UNHCR) তাদের রিপোর্টে জানাচ্ছে সারা পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ উদ্বাস্তু এবং প্রায় অর্ধেক সমস্যাক্রান্ত মানুষ (people of concern) বাস করে এশিয়-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে। অথচ এই অঞ্চলের বিশেষ সমস্যাগুলির ওপর নীতির আলো পড়েনি এখনো। ১৯৫১ সালের বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তু বিষয়ে যে সম্মেলন হয়েছিল, তাতে নির্ধারিত হয়েছিল যে সংজ্ঞা, তা এখনো বলবৎ আছে। কিন্তু তার পরিসরে সংঘর্ষ ছাড়া অন্যান্য কারণে বাস্তুচ্যুত আর স্থানচ্যুতদের এখনো জায়গা হয় নি। আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি, যার সংখ্যা বাড়ছে নিয়মিত, যার একটা বড় কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা ধীরগতি বাস্তুভূমির অবক্ষয়, তার সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতিতে এখনো নেই। উন্নত দেশে হয়তো এর প্রয়োজন কম। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে প্রবল হবে বলে ঘোষিত হয়েই গিয়েছে, সেখানেও মানুষের বাস্তুহারা, গৃহহারা হওয়া নিয়ে কোনো নীতিগত উদ্যোগ নেই, এ কথা মানতেই হবে।

    পরিসংখ্যান নাড়াচাড়া করলে দেখা যাবে যে জলবায়ু পরিবর্তন ও তৎসংক্রান্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের আধিক্য ও পৌনঃপুনিকতা সাম্প্রতিক কালে খুব দ্রুতগতিতে বাড়ছে। অতএব বাড়ছে প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যাও। আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (Internal Displacement Monitoring Centre বা IDMC ) গত দুই দশকের যে হিসেব দেখাচ্ছে, সে অনুযায়ী ২০২০ সালে পৃথিবীর ১৪৯ টি দেশের প্রায় ৪০.৫ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতির শিকার হয়েছেন। মনে রাখা ভালো যে একই মানুষ বারে বারে গৃহ হারাতে পারেন। এই বিপুল সংখ্যার মধ্যে রয়েছেন সংঘর্ষ জনিত কারণে ৯.৮ মিলিয়ন আর জলবায়ু জনিত কারণে ৩০.৭ মিলিয়ন মানুষ। আবার এই ৩০ মিলিয়নের মধ্যে বিভাজনতা মোটামুটি এইরকম: ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাত ০.৭ মিলিয়ন, ঘূর্ণিঝড় ১৪.৬ মিলিয়ন, প্লাবন ১৪ মিলিয়ন, দাবানল ১.২ মিলিয়ন, ধ্বস ১.০২ মিলিয়ন, তাপপ্রবাহ ০.০৪৬ মিলিয়ন এবং খরা ০.০৩২ মিলিয়ন। নতুন এবং পুরোনো সব মিলিয়ে ২০২০ সালের মোট স্থানচ্যুতের সংখ্যাটা আরো বেশি, ৫৫ মিলিয়ন।

    পৃথিবীর যে দেশগুলিতে জলবায়ু জনিত কারণে স্থানচ্যূত মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তারা হল চীন, ফিলিপিন্স, বাংলাদেশ আর ভারত। তাই আমাদের শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ক্রমশ ডুবতে থাকা সুন্দরবন অঞ্চল নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের সমস্যা সকলেরই জানা। আইলা-বুলবুল-আমফন-ইয়াস নিয়ে আমাদের বাস। তাই মানবাধিকারের খাতিরে জলবায়ু সমস্যার শিকার অগণন মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসন রাষ্ট্রের এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকেই ওঠা প্রয়োজন।

    দুখিনী সকিনা আর অন্ধ কুঞ্জভিখারী

    বাংলাদেশ থেকে আমফনের অব্যবহিত পরেই একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু মহিলারা। দুর্যোগ, বাস্তুচ্যুতি আর পরিযানের সময়ে কঠিনতম পরীক্ষা দিতে হয় প্রান্তিক মানুষদের, বৃদ্ধ-শিশু-নারীকে। এদের মধ্যে মহিলারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, কারণ পরিবারের সেবার অলিখিত দায় তো তাঁদেরই। খাবার আর রসদের যোগানের অপ্রতুলতার অর্থ তাঁদের অনাহার বা অর্ধাহার। ফল অপুষ্টির দীর্ঘস্থায়ী ভীত আরো মজবুত হওয়া। তাছাড়া মহিলাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অন্যদিকগুলি প্রায় পুরোটাই উপেক্ষিত। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আমফনের সময় প্রভাবিত মহিলাদের প্রায় ৫০% সন্তান ধারণের বয়ঃসীমার মধ্যে এবং ২৫% প্রকৃতই গর্ভবতী ছিলেন। এ ছাড়া রজঃস্বলা মহিলার সংখ্যা তো গোনাই হয় না। এইসব মেয়েলি সমস্যা স্বাভাবিক সময়েই গুরুত্ব পায় না। যেমন পায় না তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা। এর ওপরে আছে মেয়েদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রশ্ন। অনেক সময় ত্রাণ শিবিরগুলিই কমবয়সী মেয়েদের পক্ষে ভীতির কারণ হয়ে ওঠে। এইসব অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মেয়েদের দেহ ব্যবসায়ে যোগদানের ঘটনাও অজানা নয়। সুনামীর পরে তামিলনাড়ুতে এমন ঘটনার অনেক পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে।

    মহিলাদের স্বাস্থ্য ছাড়াও আছে শিক্ষাগত সমস্যা। যেমন দেখা যায়, বিপর্যয় মিটে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর যখন স্কুল খোলে, তখন প্রথমে পড়তে যায় বাড়ির ছেলেটি। ছোট মেয়েটি মায়ের সাথেই হয়তো রয়ে যায়। আর অন্য জায়গায় গিয়ে বাসা বাঁধলে হয়তো নতুন করে স্কুল খোঁজাই হয় না তার জন্য। লিখতে পড়তে না জানা মহিলারা অন্যভাবেও নিরুপায়। যেটুকু সরকারি সুযোগসুবিধা আছে, তাও সবসময় তাঁরা জানতে পারেন না, কাগজপত্র আর নিয়মকানুনের ভারে আবেদন করাই হয়ে ওঠে না।

    আমাদের মতো দেশে মহিলাদের অর্থনৈতিক মালিকানা কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা প্রায় নেই। দরিদ্র মানুষেরা বিপর্যয়ের ক্ষতি সামলাতে না পেরে অনেক সময়ই ছোটোখাটো জমিজমা, গরুছাগল ইত্যাদি বিক্রি করতে বাধ্য হন। একটু লক্ষ্য করলে লিঙ্গ বৈষম্যের চিত্রটি এ ক্ষেত্রেও দেখা যাবে। বর্তমান কালে এইসব পরিবারে মহিলাদের ওপর অর্থোপার্জনের দায় থাকে পূর্ণ মাত্রায়। অথচ দুর্দিনে সম্পত্তি বিক্রি করা বা অন্যান্য আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তাদের বিশেষ কোনো ভূমিকা থাকে না। বাংলাদেশে আমফন পরবর্তী সমীক্ষায় ৬৫% মহিলা সে রকম অভিজ্ঞতার কথাই জানিয়েছেন।

    জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশের সমস্যা, স্থানচ্যুতি বা পুরোপুরি স্থানান্তর, সবেতেই ভুক্তভোগী আমাদের অসহায় অগুনতি মহিলারা। তাই যখন “সর্বনাইস্যা ঘূর্ণি আইস্যা বিরান করল উড়ির চর, দুখিনী সকিনা কান্দে, কোথায় তাহার নতুন বর!” আমার গৃহসহায়িকা মেয়েটি এমনই এক সকিনা কিংবা সবিতা কিংবা সরলা।

    যে সমস্যাগুলি মহিলাদের জন্য বলা হলো, সেগুলির আরেক ভাগীদার গোষ্ঠী আছে, আমাদের প্রতিবন্ধী সহযাত্রীরা। মহিলাদের বিষয়ে কথাবার্তা আজকাল তবু শোনা যায়, বিভিন্ন নারী সংগঠন থেকে শুরু করে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মহিলা বিভাগ (UN Women) এই বিষয়ে সামান্য হলেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু যাঁদের কথা কোনো সরকারি দলিলে পৃথিবীর কোনো দেশেই পাওয়া যাবে না, তাঁরা হলেন প্রতিবন্ধী মানুষেরা। কোথায় যাবেন এঁরা, এঁদের ব্যবস্থা করবে কে, যখন দলে দলে মানুষ ঘর ছাড়েন? ভেঙে যাওয়া বাড়িঘর আর ভেসে যাওয়া ইস্কুল-কলেজ তাদের জীবনে শুধু সাময়িক নয়, অনেক সময়ই চিরকালীন। নতুন জায়গায় হয়তো আর তেমন ইস্কুল তৈরিই হবে না, যেমনটি ছিল আগের ভিটেয়। দুর্যোগের সময় কানে শুনতে না পাওয়া বা চোখে দেখতে না পাওয়া মানুষগুলোকে সরিয়ে নেওয়া কি গ্রাম পঞ্চায়েতের দায়িত্ব? আছে কি কোনো সরকারি লিখিত নিয়ম নির্দেশ? না। অন্ধ কুঞ্জ ভিখারীর বাস ছিল যে গ্রামের এক কোনায় জীর্ন ফাটল ধরা পোড়ো মন্দিরের গায়ে, সেটা নতুন জায়গায় তাকে খুঁজে দেবে কে? যারা নিজেরারই স্থিতি হারিয়ে দিশাহারা, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানহারা? হয়তো বা তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেই ভুলে যাবে পড়শীর দল। আর যদি এই প্রতিবন্ধীদের মধ্যে কেউ হন মহিলা, তবে তাঁর সমস্যা দ্বিগুণ।

    নীতিগত আর আইনী ব্যবস্থার দাবি

    আজ পর্যন্ত প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন নিয়ে কোনো পরিবেশ নীতি বা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নীতিতে কোনো ব্যবস্থা হয় নি। উন্নয়শীল দেশে এমনিতেই হাজারো সমস্যা। তার ওপরে আরো মাত্রা যোগ করলে দেশের পরিচালকরা সামলাবেন কী করে? তাই এই বিষয়টি উপেক্ষিত। সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে পরিবেশ বা জলবায়ু পরিবর্তন সম্বন্ধিত নীতিতে নারী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতি নেই। শুধু এই অঞ্চলেই নয়, পৃথিবীর তাবৎ দেশেই এমন নীতি তৈরি হোক, সোচ্চারে সেই দাবি জানাই। এর জন্য চাই সচেতনতা, হোক প্রচার, প্রয়োজনে হোক আন্দোলন। সরকারি নীতিনিয়ামকরা বাধ্য হোন নতুন নিয়ম গড়তে, যেখানে সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন মানে সব প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত। সেখানে লিঙ্গ আর প্রতিবন্ধীত্বের অবহেলিত মাত্রাগুলি যুক্ত হোক, তাদের নিরাপত্তা আর ভবিষ্যৎ পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা থাকুক। গরীব দেশের এই প্রয়োজন পৃথিবীর তাবৎ রাষ্ট্রের পরিবেশ নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হোক। জলবায়ু পরিবর্তনের অসহায় শিকার দরিদ্র জনসমষ্টির জীবনমরণ সমস্যার জন্য উপযুক্ত সমাধান তৈরি হোক। আর তাদের মধ্যে যারা আরো বেশি উপেক্ষিত, সেই নারী ও প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ জলবায়ু পরিবর্তন নীতি আশু নির্ধারিত হোক, আজকের পরিবেশ নামাঙ্কিত বিশেষ দিনটিতে এই দাবিটুকুই রইল।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৫ জুন ২০২২ | ১৫৭১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বাতী রায় | ০৫ জুন ২০২২ ১৬:১৩508516
  • বড্ড জরুরী কথা। Ableist সমাজ non ableist দের কথা বিপর্যয়ে ও ভাবে না এটাই বাস্তব। 
  • জয়ন্ত ভট্টাচার্য | 59.94.***.*** | ০৭ জুন ২০২২ ০৯:৪৯508569
  • ভালো লেখা! 
  • touhid hossain | ০৭ জুন ২০২২ ১৪:০৫508574
  • অনবদ্য লেখা❤
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন