সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ইয়াস সুন্দরবন অঞ্চলকে তছনছ করে দিয়েছে। পাশের জেলায় দিঘা, মন্দারমনি, তেজপুরের উপকূলবর্তী এলাকাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করা আর ত্রাণবণ্টন ব্যবস্থার খতিয়ান নেওয়ার কাজ জোরকদমে চলছে। প্রভাবিত অঞ্চলের বাসিন্দাদের দিনযাপনের দুর্দশা, জীবিকার সংকট, নদীবাঁধের ভাঙন, চাষের জমির ক্ষতি ইত্যাদি মিলিয়ে সংকটের তালিকাটি অতি দীর্ঘ। এইসব প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলির সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিষয় আমাদের মনে উঁকি দিতে পারে যে, এই ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলি পশ্চিমবঙ্গের অতি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র, ঘরের কাছে চট করে ঘুরে আসার পক্ষে মধ্যবিত্ত বাঙালির আদর্শ জায়গা। যদিও অতিমারীকালে মানুষের বেড়ানো এখন সীমিত বা প্রায় বন্ধ, তবু ভবিষ্যত আশঙ্কা হিসেবে বলা যেতে পারে ইয়াসের বিধ্বংসী প্রভাব পর্যটন শিল্পের ওপরেও ব্যাপকভাবে পড়বে। ফল, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বহু মানুষের জীবিকা ও জীবনযাপনের সংকট। বর্তমানে পর্যটন শিল্প আমাদের জাতীয় আয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে ভারতবর্ষে পর্যটন শিল্পের আয়তন ছিল ১৯৪ বিলিয়ন ডলার, যা জাতীয় আয়ের ৬.৮%। সে সময়ে এই শিল্পে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ছিল ৩৯.৮ মিলিয়ন, অর্থাৎ মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮%। এই হারে বৃদ্ধি পেলে পর্যটন শিল্পের আয়তন ২০২৮ সালে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে, যা জাতীয় আয়ের প্রায় ৯.৯%।
পর্যটন সংক্রান্ত এইসব সংখ্যা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে এই প্রশ্নটা আমাদের মাথায় আসতে পারে যে, আমাদের অতি পরিচিত, পুরাতন ও প্রিয় ‘দেশভ্রমণ’ ব্যাপারটা ‘শিল্প’ হয়ে উঠলো কবে থেকে আর কেমন করে। ছোটবেলায় রচনা-বিচিন্তা জাতীয় বইতে ‘দেশভ্রমণের উপকারিতা’ বিষয়ে প্রবন্ধ পড়েননি এমন বাঙালি আমাদের প্রজন্মে বিরল। নানা দেশ দেখা আর নানান মানুষকে জানা ছিল দেশভ্রমণের মূল টান। বদ্ধ ঘরে না থেকে জগৎটাকে দেখার উদ্দেশ্য ছিল জানতে চাওয়া, ‘কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে’। সেই ভ্রমণে ছিল কৌতূহল, সেই যাত্রায় ছিল অনিশ্চয়তা আর কষ্টসাধন। আমাদের শৈশব-কৈশোরের পাঠে হাতছানি দিত হিমালয়, পালামৌ কিংবা অনেক দূরের চাঁদের পাহাড়। মহাভারতের শেষ পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে নানা লেখকের হাত ধরে অতি দুর্গম যাত্রায় আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি দেবতাত্মা হিমালয়ের পথে পথে, বিগলিত করুণা জাহ্নবী-যমুনার স্রোত ঘেঁষে, মায়াবতী আশ্রমের পাকদণ্ডী ধরে। এমনি করেই জেনেছি সমুদ্রের গল্প, রামায়ণের সূত্রে সেতুবন্ধ রামেশ্বর, কিংবা বিহারী দত্তের বাণিজ্য যাত্রায় সমুদ্রে ঝড়ের বর্ণনা। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ বলতে বলতে অনুভব করেছি জঙ্গলের গন্ধ। দিবাবসান, অরণ্য-প্রকৃতি ধরনের সহায়িকা পাঠের ভেতর থেকে উঁকি দিয়েছে আরণ্যক আকর্ষণ। আরো চিনেছি পর্বতগুহায় চিত্রময় অপরূপা অজন্তা, মরুভূমির দেশের সোনার কেল্লা। সে দেখার তালিকা অন্তহীন। এরা সবাই মিলে গল্প বুনে গেছে স্বপ্নের দেশের। বাবা-মায়ের সাধ্য সীমিত, সুযোগ অপ্রতুল, বেড়াতে যাওয়া তখন বিরল। অথচ ভ্রমণকাহিনির সাহচর্যে সেই ছবিগুলি আঁকতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি। অনেক পরে চিনেছি জেফরি আর্চারের কল্পনায় সেই হাঙ্গেরিয়ান প্রফেসর-কে, যিনি কোথাও না গিয়েও বহু শহরের অনুপুঙ্খ বর্ণনা নির্ভুল দিয়ে দিতে পারেন। বিদেশের নাম জানার শুরু শিশু পত্রিকার পাতায়। তারপর ধীরে ধীরে দেব সাহিত্য কুটিরের অনুবাদ সাহিত্যে। একের পর এক দেশের ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠেছে, মনে মনে ডানা মেলে ঘুরে বেড়িয়েছি সারা দুনিয়া।
পর্যটনের আনুকূল্যে সারা পৃথিবী আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। একদিকে পরিবহণ ব্যবস্থায় যুগান্তর, অন্যদিকে মধ্যবিত্তের আর্থিক সাচ্ছল্য বৃদ্ধি। সেই থেকে তৈরি হয়েছে ট্রেন-প্লেন-হোটেলের চাহিদা, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে জোগান। বাজারে উৎপাদন, বিক্রি আর ভোগ যখন চলছে তখন বেড়ানোকে শিল্প বলতে তো আর বাধা নেই। বৃহৎ পুঁজি লগ্নি হচ্ছে এই শিল্পে। বৃহৎ কর্মসংস্থান। কতদিন আগে এই বদলের শুরু হয়েছে? বলা যেতে পারে মোটামুটি নয়ের দশক থেকে, মানে প্রায় বছর তিরিশেক। নানারকম আর্থ-সামাজিক বদলের মধ্যে দিয়ে এসেছে ভ্রমণের প্রতি প্রবল আগ্রহ। পারিবারিক কাঠামো ছোট হয়ে গিয়েছে, আত্মীয়স্বজনের সম্পর্ক ক্রমশ ক্ষীণ হয়েছে, বেড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। এলটিসি-জাতীয় সুযোগসুবিধা আমাদের সাধ্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সঙ্গে রয়েছে নানান এজেন্সি, তাদের আকর্ষণীয় ‘প্যাকেজ’ সম্ভার নিয়ে। কাছে-দূরের জায়গায়, ছোট-বড়ো হোটেলে, বাস-ট্রেন কিংবা প্লেনে চেপে বেড়াতে যাওয়া এখন আমাদের নিয়মিত বিনোদন। হ্যাঁ, বিনোদন শব্দটা অনেক ভেবেই ব্যবহার করলাম। এই বেড়ানোগুলোতে ভ্রমণ কতখানি, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা কত তীব্র আর আমোদ-আহ্লাদ কতখানি, তা বলতে পারি না। চতুর্দিকে বিলাসবহুল রিসর্ট থেকে শুরু করে অগুনতি ছোট ছোট হোটেল গজিয়ে উঠছে। দিঘা মন্দারমণিতে অসংখ্য হোটেল, পর্যটন ব্যবসার রমরমা। এ কথা সত্য যে, এই সুযোগসুবিধাগুলো আছে বলে সাধারণ মানুষ স্বল্প ব্যয়ে বেড়াতে যেতে পারেন, দৈনিক একঘেঁয়েমির থেকে মুক্তি পেতে পারেন। এও বললে হয়তো ভুল হবে না যে, আগেকার যুগে দেশভ্রমণে একটা লিঙ্গবৈষম্য ছিল। অজানাকে জানতে বা অদেখাকে দেখতে নিরুদ্দেশে যাওয়া একজন একাকী পুরুষ বেশ রোমান্টিক নায়কের মতো। অন্যদিকে মেয়েদের বেড়ানো আদৌ যদি হয়, তার ভিত্তি মূলত ছিল তীর্থ কিংবা বাপের বাড়ি। সে দিন পাল্টেছে, এখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেড়াতে যাওয়া অনেক সহজ ব্যাপার। এক কথায়, সকলের জন্য ভ্রমণ এখন সহজসাধ্য ও সুলভ। সে কারণেই পর্যটন একটি বৃহৎ ও বর্ধমান শিল্প। পর্যটন ও আতিথেয়তা পরিষেবাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, প্রশিক্ষণপ্রণালী এবং কর্মসংস্থান। এর পরিমাণ যে আগামীতে আরো বাড়বে তার অনুমানিক হিসেব আগেই দেওয়া হয়েছে।
পর্যটন ও আতিথেয়তা পরিষেবার মূল উপাদানগুলি হল রাত্রিবাসের জায়গা, খাদ্য ও পানীয়, বিনোদন, পরিবহণ, মনোরঞ্জক অনুষ্ঠান, আকর্ষণীয় এবং সাহসিক পর্যটন। এই তালিকার উপাদানগুলি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, এর মধ্যে প্রকৃতিপ্রেম কতখানি হতে পারে আর এইসব ক্রিয়াকলাপের প্রভাব প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর কীরকম হতে পারে। দিঘার সৈকতে ঝাউবন নির্বিচারে কাটা হয়েছে হোটেল তৈরি করতে। সমুদ্রতীরের এই অপরিকল্পিত ও বেআইনি নির্মাণশিল্প ক্ষতি করছে স্থলভূমির, ত্বরান্বিত করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গাছের শেকড় যে ভূমিক্ষয় রোধ করে, সে তো কোন ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে পড়া আছে। মন্দারমনি, তাজপুরের ছবিও প্রায় একই রকম। সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অন্য মাত্রায়। তবে মনে রাখা যেতে পারে, পর্যটনের থাবা সেখানেও বাদ পড়েনি। আজ যদি এই অঞ্চল ডুবে যায়, তাহলে কী ভয়াবহ পরিণাম হতে পারে, তা আমরা সবাই জানি। এই অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ হল প্রকৃতিদত্ত প্রাচীর। নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ কাটা মানে উন্নয়নের নামে ধ্বংসের ডাক। এই অঞ্চল ডুবে গেলেও তার জীববৈচিত্র্য জলের তলায় থেকে নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রের দ্বারা প্রাকৃতিক বৃত্ত ও ভারসাম্য বজায় রাখবে। তাই একে রক্ষা করা আমাদের নিজেদেরই স্বার্থ। প্রাকৃতিক পুঁজি-সম্পদকে পর্যটনকেন্দ্র বানিয়ে আরো দ্রুত ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়ার অর্থ নিজেদের অস্তিত্বের সংকট ডেকে আনা। অনেক জায়গা ভ্রমণ বা বিনোদনের জন্য ব্যবহার না করে কেবল তাকে রাখার জন্যই টিঁকিয়ে রাখতে হয়, যাতে তার প্রাকৃতিক গুণগুলি রক্ষা পায়। সেটাই ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা (intergenerational equity)। যেমন, আমাজনের ক্রান্তীয় অরণ্য কেবল পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবেই বাঁচিয়ে রাখা দরকার। যে কোন প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করার সময় তার ব্যবহারিক মূল্যের (use value) সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্বের মূল্যকে (existence value) গণ্য করতে হয়। এই যে প্রকৃতির অস্তিত্বকে গুরুত্ব দেওয়া, একে টিঁকিয়ে রাখা, এটা এক ধরনের ভবিষ্যৎমুখী নেতৃত্ব (stewardship), যা টেঁকসই উন্নয়নের (sustainable development) বিবেচনার মধ্যে পড়ে।
সমস্যার বিপদসংকেত শোনা যাচ্ছে পাহাড়েও। পুরো হিমালয় অঞ্চল আজ বিপদের মুখে। ধ্বস, ভূমিকম্প হয়ে উঠেছে নিয়মিত ঘটনা। অথচ তার মধ্যেই গড়ে তোলা হচ্ছে আরো পর্যটনকেন্দ্র যার অর্থ আরো বিলাস ব্যসন আর দেদার ফুর্তির মোচ্ছব। সম্প্রতি উত্তরাখণ্ডের সাততালে এমনই এক পর্যটনকেন্দ্র তৈরি করার প্রকল্প ঘোষিত হয়েছে। সাততাল একটি অতি নিরিবিলি জায়গা, পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গ। প্রতিবাদ হচ্ছে, যদিও জানা নেই শেষ পর্যন্ত এই পাখিরালয়টিকে পর্যটকের ভিড় থেকে বাঁচানো যাবে কিনা। সম্প্রতি লাক্ষাদ্বীপে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাবটি অন্যান্য রাজনৈতিক কারণগুলির সংগে যুক্ত হয়ে একটা বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেছে।
ভরতপুরের কেওলাদেও ঘানা পক্ষী অভয়ারণ্যে লক্ষ করে দেখা গিয়েছে, ভ্রমণার্থীদের চাপে পাখিরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। পর্যটনের মরশুমে মানুষ কাছে এলে এদের উড়ে যাওয়ার দূরত্ব (flight distance) প্রচুর বেড়ে যায়। কী দেখতে যায় মানুষ! সবাই পক্ষীপ্রেমী! সচ্ছল শহুরে ভ্রমণার্থীদের নিছক আমোদ প্রমোদ, হুজুগ নয় তো কী! পাখি দেখা এখন শহুরে ধনাঢ্যদের একটি কেতাদুরস্ত শখ। করবেট কিংবা বান্ধবগড়ে গিয়ে বাঘ দেখা, কাজিরাঙায় হাতি চড়া, হ্যাভলক দ্বীপে সমুদ্রে ডুব কিংবা জয়সলমিরে উটে চড়ে মরুভূমির বুকে তাঁবু গাড়া, প্রকৃতিপ্রেমের নমুনাই বটে। সমস্ত প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ওলোটপালোট করে আমাদের আজকের দেশভ্রমণ আর অপার আনন্দ। এ কথা না মেনে উপায় নেই যে পরিবেশ ধ্বংসের দায় সম্পূর্ণই আমাদের। আমাদের দায়িত্ব কি কেবল পরিবেশ-পরিবেশ বলে চারটি বক্তৃতা দেওয়া আর ব্লগ লেখা? এ প্রসঙ্গে ইকো ট্যুরিজম নামের সোনার পাথরবাটিটির কথা না বলে পারছি না। এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ধ্বংসের মুখে পড়া পরিবেশ ও জীবজন্তুর সংরক্ষণ। সেই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের জন্য টেঁকসই জীবন ও জীবিকার সংস্থান। কিন্তু বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এতে পরিবেশের ক্ষতি বেড়েছে বৈ কমেনি। আগে থেকেই ভঙ্গুর ভূমির ওপর পর্যটকের চাপে আরো ক্ষয় বাড়ছে, পশুপাখির শান্ত জীবনে ব্যাঘাত ঘটছে, এমনকি স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে পর্যটক-প্রিয় স্মৃতিচিহ্ন তৈরি করার কাজও একটি প্রচলিত পেশা। প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আদিবাসী সমাজের মাঝে অনুপ্রবেশ করে আমাদের শৌখিন ‘পভার্টি ট্যুরিজম’ করা মানেও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা, তাদের প্রথাগত টেঁকসই জীবনযাপনকে বিপজ্জনক করে তোলা। বারাটাং দ্বীপে দ্রষ্টব্য বস্তু হিসেবে জারোয়া প্রদর্শনকে প্রকৃতির প্রতি ও মনুষ্যজাতির প্রতি চরম অপরাধ।
আমাদের দেশে পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে পরিবেশ রক্ষার নিয়মাবলি কতখানি পালন করা হয় তা আলাদাভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। সবচেয়ে বেশি বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন করে যে দুটি ভোগের ক্ষেত্র, তা হল পর্যটন ও আতিথেয়তা পরিষেবা। বার্ষিক প্রায় ২৮৯,৭০০ টন বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয় হোটেল থেকে। তার মধ্যে প্রায় ৭৯,০০০ টন শুধু খাদ্যদ্রব্যজাত। ভারতে মোট বর্জ্য পদার্থের প্রায় ২১% আসে পর্যটন ক্ষেত্র থেকে। গড়ে দৈনিক ১৩৪ মেট্রিক টন বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন করে আমাদের দেশের রিসর্টগুলি। বিভিন্ন দ্বীপে সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের তুলনায় পর্যটকরা প্রায় দ্বিগুণ প্রদূষণ ও বর্জ্য উৎপন্ন করে। তর্ক হতে পারে, ভারী শিল্প অনেক বেশি বর্জ্যপদার্থ তৈরি করে। ঠিক, কিন্তু তার কারণ, মাত্রা ও ধরন আলাদা। সে আলোচনা অন্য পরিসরে করা যেতে পারে। পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে গোটা ব্যাপারটাই ভোগকেন্দ্রিক। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা আমাদের আচরণ ও জীবনযাত্রা পরিবর্তনের (behavioural and lifestyle change) কথা খুব জোর দিয়ে বলছেন। তাই এই প্রশ্নগুলি সুধী পাঠকের সামনে রাখা। জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা মূলত মনুষ্যকেন্দ্রিক (anthropocentric)। তাকে শোধরানোর দায় তাই মানুষেরই। পর্যটনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রধান সমস্যা পরিবেশের মান (environmental standard) বজায় না থাকা, অতিরিক্ত ভ্রমণার্থীর চাপ (footfall), বেআইনি ও অপরিকল্পিত বিস্তার ইত্যাদি। উন্নত দেশেও পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি অর্থকরী। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বভ্রমণ যেভাবে বেড়েছে, তাতে আল্পসের চূড়ায় গেলেও চেনা ভাষায় কথা শোনা যায়। বিপুল অর্থব্যয় করা আমাদের ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ এখন সেসব দেশের আয়ের একটি বড় সূত্র। কিন্তু পরিচ্ছন্ন বিদেশেও যে পর্যটন থেকে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা হচ্ছে, তা গত বছর লকডাউনের সময় ভেনিসের স্বচ্ছ খালের ছবি দেখে আমরা সবাই জেনে গেছি। এ ছাড়া লম্বা পাড়িগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। আলাদা করে হিসেব করা যায় এই পুরো কার্যকলাপের কার্বন পদচিহ্ন (carbon footprint)। সে সংখ্যা দেখলে ভয় বাড়বে বৈ কমবে না।
সারা বিশ্ব এখন ঘুরছে, তবে কিসের ঘূর্ণিপাকে তা জানা নেই। পরিবেশ বাঁচানো নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে, অনেক চাপানউতোর, নানা রকমের দোষারোপ। পরিবেশ ভাবনার প্রসঙ্গ এলে পর্যটন শিল্প নিয়েও ভাবতে হবে বই কি! সীমিত ও দায়িত্বশীল পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া সমাধান নেই। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, বহু মানুষের জীবিকা ও কর্মসংস্থান এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। ঠিক কথা। কিন্তু শুধু পরিষেবা-নির্ভর অর্থনৈতিক বিকাশ আদৌ কতখানি দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, সে একটা মৌলিক প্রশ্ন। পর্যটনের মতো একটি পরিষেবা-ভিত্তিক শিল্পে বিনিয়োগ করে অর্থনৈতিক প্রগতি পরিকল্পনা হিসেবে সঠিক কিনা তা নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। অন্যদিকে পরিবেশকে বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যে সম্পূর্ণ অর্থহীন, তা নিয়ে আজ কোনো দ্বিমত নেই। প্রাথমিক ভূমিকা এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের। পরিবেশ সমস্যার সমাধান করার জন্য অনুশাসন ভিত্তিক (command and control) নীতি নির্ধারণ করা যায়, আবার কর-ভর্তুকির মতো অর্থনৈতিক (economic instruments) নীতিও ব্যবহার করা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুয়ের মিলিত নীতিই বেশি কার্যকরী হয়। পরিবেশ সংক্রান্ত নানারকম সমস্যার সমাধানে এগুলি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তেমনি ভাবে পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে কড়া নিয়ম আর অর্থনৈতিক হাতিয়ার যুগ্মভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সঠিক নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব যদি হয় সরকারের, ব্যবহারিক দায় অবশ্যই নাগরিকের। নাগরিক সমাজের সচেতনতা আর সরকারি সদিচ্ছা একসঙ্গে থাকলে পরিবেশ রক্ষা দুরূহ হলেও হয়তো অসম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে বেড়ানো যদি সীমিত হয়, আবার যদি গল্পবইয়ের পাতায় ডুব দিতে হয়, যদি মনে মনে ছবি এঁকে দেখতে হয় অজানা সুদূরকে, তাতে খুব কি ক্ষতি হয় আমাদের?
অরণ্যদা :-) আমার সিস্টেম ফলো করলে তো আমি নিজেই ঘুরতে যেতে পারবো না! শুধু মিলিওনেয়াররা ঘুরতে যেতে পারবে, বাকিরা য়ুটুবে তাদের ভিডিও দেখে শখ মেটাবে। আর যদি এখনকার মতোই টুরিজম সহজলভ্য আর সুবিধেজনক থাকে তাহলে আমার মতো আম আদমিরা দীঘা, পুরী, আগ্রা, আর মুন্নার, সর্বত্র ঘুরে বেড়াবো আর রাস্তার ধারে প্লাস্টিকের বোতল ফেলবো। পরিবেশ টরিবেশের আমি থোড়াই কেয়ার করি :-)
ঘোরার ইচ্ছেটা খুবি কামড়ায়, এটা ঠিক @ডিসি
দেশের বাইরে বেরোতে না পেরে ক্ষেপে গিয়ে আমি আবার স্মোকি মাউন্টেন যাচ্ছি। ওটা খুবি প্রিয় জায়গা যদিও, কতবার যে গেলাম
"একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভ্রমণার্থীকে ঢুকতে দেবার কিথা বলা হচ্ছে"
দ দি সেটা বুঝতে পেরেছি, এরকম পারমিট সিস্টেম তো কয়েকটা জায়গায় এখনই আছে। কিন্তু পৃথিবীব্যাপি টুরিজম ইন্ডাস্ট্রি আর লাখ লাখ টুরিস্টকে কি পারমিট সিস্টেম দিয়ে নিয়ন্ত্রন করা যাবে? এমনিতেও পারমিট সিস্টেম চালু করা যায় শুধু কয়েকটা জায়গার জন্য যেগুলোর এন্ট্রি আর এক্সিট পয়েন্ট আছে। এমনি খোলা জায়গার জন্য পারমিট সিস্টেম কিভাবে হবে? সেশেলস, ফিজি আইল্যান্ড, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ ইত্যাদির জন্য কি পারমিট দেওয়া যাবে? অথচ এসব জায়গাও টুরিজমের ঠেলায় খুব ক্ষতিগ্রস্ত।
(ডিঃ আমি নিজে টুরিস্টদের দলে পড়ি, সুযো পেলেই ঘুরতে যেতে রাজি)
তবে নিজে ঘুরে বেড়ানোর প্রবল সাধ সত্বেও আমি পরিবেশ-টরিবেশ নিয়ে কিছুটা কেয়ার করি :-)
তাই চাই যে সরকার অনেক বেশী কন্ট্রোল করুক, দীঘা মন্দারমণির মত বা উত্তরাখন্ডে পাহাড়ের ওপর ব্যাঙের ছাতার মত রিসর্ট, হোটেল তৈরী বন্ধ হোক। তাতে আমার থাকার জায়গা কমবে, অনেক জায়গায় হয়ত যেতেও পারব না, তাও চাই
অরণ্যদা, কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষ তো অন্যরকম চায় মনে হচ্ছে! সারা পৃথিবীতে টুরিস্ট সংখ্যা আর টুরিস্ট ডেস্টিনেশান তো ক্রমে বেড়েই চলেছে।
বেশির ভাগ লোক - ঠিকই বলেছ , পরিবেশ এখনো লো প্রায়োরিটি বিষয়
অনিন্দিতা দি, খুব প্রয়োজনীয় লেখা। পরিবেশ নিয়ে যতটা কথা হওয়া উচিত/ প্রয়োজন, ততটা কখনোই হয় না। এবং পরিবেশ বিষয়ে আমাদের ignorance এত গভীর, যে অসহায়তাও পাহাড়প্রমাণ। এরকম লেখা আরও আসুক, কামনা করি।
এই যে আলোচনা আর ভাবনাচিন্তা , এ অবশ্যই সচেতন নাগরিকতার বহিঃপ্রকাশ। সামান্য লেখার প্রয়াসের মাধ্যমে এইসব প্রশ্ন জাগিয়ে তুলতে পেরে আমি উৎসাহিত , সম্মানিত। আপনাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
উত্তরের খোঁজ জারি থাকুক আগামী দিনে , এমনি আরো নানা প্রশ্নে।
আমার মতে পর্যটন সমস্যা সমাধান হওয়ার নয়। অবশ্যই বিভিন্ন দেশের সরকার রেগুলেটরি রোল প্লে করছে, করা উচিতও। এমনকি কোন কোন দ্বিপ কয়েক বছরের জন্য একেবারে বন্ধও করে দেওয়া হয়েছে যাতে সেখানকার ইকোসিস্টেম কিছুটা সেরে ওঠে। কিন্তু এসবে কিছু হবে না কারন ডিম্যান্ড ক্রমে বাড়ছে। সাধারন লোক ঘুরতে বেরোচ্ছে, প্রতি বছর টুরিস্টের সংখ্যা বাড়ছে। সাপ্লাই সাইডে নানারকম রেগুলেশান আনলেও ডিম্যান্ড সাইডে কিছু করা অসম্ভব। পরিবেশ নিয়ে এক লাখ সেমিনার করলেও আর এক কোটি লিফলেট বিলি করলেও কি নৈনিতাল, মুন্নার, সুন্দরবন আর দীঘায় টুরিস্টের সংখ্যা কমানো যাবে?
এখানে কিছুদিন আগে পর্যটন নিয়ে কথা হচ্ছিল। এবার এই খবরটা পড়ুনঃ
তো এই লাখ লাখ টুরিস্টদের কি সরকার কন্ট্রোল করতে পারবে? নাকি শুভচেতনার বাণি শুনিয়ে টুরিস্টদের ঘোরা বন্ধ করা যাবে? দাম বাড়িয়ে টুরিস্ট সংখ্যা কমানো যায়, আর সেটা সম্ভব না হলে অন্য কোন সমাধান নেই।