আমরা বুঝেছি যারা পথঘাট মাঠের ভিতর
আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা;
চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির:
পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;
–মৃত্যুর আগে, জীবনানন্দ দাশ
***
‘অপরাজিত’-র অপু মাঝে মাঝেই কলকাতার রাজপথে-অলিতে-গলিতে হেঁটে বেড়ায়। কখনও তার সাথে সঙ্গী প্রণব অথবা অনিল, যৌবনের দাপটে তারা রাজপথে নিমচাঁদ সেজে চেঁচায়, “Hail, Holy Light! Heaven’s First born!” কখনো সে একা, ক্ষুধা অথবা মানসিক হতাশার তাড়নায় একা একাই পথে হেঁটে বেড়ায় উদ্ভ্রান্তের মতন, মাথায় কতরকমের চিন্তা। হঠাৎ করে তার জীবনে সঙ্গিনী জোটে, অপর্ণা। হঠাৎ করেই তাদের সেই পথচলা শেষ হয়ে গেলে অপু উদ্দেশ্যহীন ভাবে পথ হেঁটে যায়, পথ হেঁটে যায়। আবার সেই পথই তাকে নিয়ে যায় কাজলের কাছে, রাণুদির কাছে, নিশ্চিন্দিপুরে। যে পথ হাঁটা তার শুরু দিদির হাত ধরে, গ্রামবাংলার মায়াজগতে, সেপথই তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় নিশ্চিন্দিপুরে তার পিতৃপুরুষের ভিটায়।
অপুর কাহিনি আক্ষরিক অর্থেই একটি bildungsroman, সাহিত্যচর্চার ভাষায় যাকে গঠনের কাহিনি বলা যেতে পারে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ভাষায়, “Bildungsroman, [is a] class of novel that depicts and explores the manner in which the protagonist develops morally and psychologically. The German word Bildungsroman means ‘novel of education’ or ‘novel of formation’ ”। পথহাঁটার মোটিফ ঘুরে ফিরে আসে দুটো উপন্যাসেই। নায়কের বাল্য-কৈশোর-যৌবনের পথ হাঁটার শেষে যখন পথ তাকে নিশ্চিন্দিপুরে এনে দাঁড় করায়, তখন পরিণত অপু জানে যে এ ফিরে আসা অন্যরকম। যে যাত্রার প্রথম থেকেই এক এক করে পথ হাঁটার সঙ্গী সে হারিয়েছে, সে যাত্রা বাঁক নিয়ে পরিচিত রাস্তায় ফিরে আসলেও সে মানুষ, সে সময়, আর নেই।
‘পথের পাঁচালি’ ও ‘অপরাজিত’-তে দারিদ্র্য, হতাশা, মৃত্যু, সবই রয়েছে। রয়েছে শ্রেণি, রয়েছে মানুষের শঠতা, নিষ্ঠুরতা। রয়েছে যুদ্ধ। এসকল কিছু সত্ত্বেও বিভূতিভূষণের আখ্যায়ক বড়োই স্নেহশীল। কাহিনির শেষে যখন কাজল হেঁটে যায় তার ঠাকুরদাদা ভিটায়, আখ্যায়ক বলেন, “খোকার বাবা একটু ভুল করিয়াছিল। চব্বিশ বছরের অনুপস্থিতির পর অবোধ বালক অপু আবার নিশ্চিন্দিপুরে ফিরিয়া আসিয়াছে।” পৃথিবী পরিবর্তনশীল, মৃত্যু অমোঘ। গ্রামবাংলার প্রকৃতি ক্ষমাশীল, ভালোবেসে হাত বাড়িয়ে দেয় বারবার নতুন অপুদের জন্য।
***
গঠনের সাহিত্য যদি bildungsroman হয়, তাহলে ভাঙনের সাহিত্য কী? আজকের আলোচনার ভাষায় যেটাকে অনেকেই বলেন ‘reverse bildungsroman’, ভাঙনের উপন্যাস কি সেরকম কিছু? ‘পথের পাঁচালি’ ও ‘অপরাজিত’ যদি পথের বাঁকে বাঁকে বেঁচে থাকার উপাদান নিয়ে অপুর বড়ো হওয়া, পরিণত হওয়ার কাহিনি হয়, তাহলে পথ হাঁটতে হাঁটতে সব শেষ হয়ে যাওয়ার কাহিনিকে কী বলা যায়? ইমতিয়ার শামীমের ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ পড়তে পড়তে এসমস্ত প্রশ্নই মাথায় আসে।
পথ চলার মোটিফ এ কাহিনিতেও শুরু থেকেই, জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ থেকে তোলা শিরোনামেই,
আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;
শামীমের উপন্যাসের শিরোনামে মৃত্যুর ইঙ্গিত। বেশি দূর যেতে হয় না, উপন্যাসের প্রথম পাতায় তথাগতর পথ হাঁটা শুরুই হয় রক্ষীবাহিনীর কড়া নাড়বার হাড় হিম করা শব্দে। নিমখুন-গুমখুন-গুলির আওয়াজ-গলা কেটে ফেলা, সবই পরিচিত বালক তথাগতর জীবনে, রাতবাহিনী-রক্ষীবাহিনী সকলকেই চেনে সে। “আমি বা আমরা কিছু মনে করি না,” তথাগত জানায় পাঠকদের, “কেননা খুব সহজেই এক’দিনে আমি বড় হয়ে গেছি।” একদিনের মধ্যে, একটা ঘটনার মধ্যে বড়ো হয়ে যাওয়াই যে নায়কের ভবিতব্য, সেখানে আর bildungsroman উপন্যাসের গঠনের প্রসঙ্গ আসে কেমন করে?
তথাগতর এক নিশ্চিন্দিপুর ছিল। সেই নাম-না-জানা নিশ্চিন্দিপুরে সে বাবার হাত ধরে শিশির ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটে, গ্রামের নাম নদীর নাম চেনে। তার বাবা নানা কথা বলে, সেসব তথাগত যে বোঝে তাও নয়, কিন্তু সে হেঁটে চলে বাবার হাত ধরে, শিশির ভেজা পথে। তথাগতর কল্পনায় তার বাবা রবিনসন ক্রুসো, নির্জন দ্বীপের একাকী রাজা তার ছোট্ট সাম্রাজ্যে। কখনও সাথে আসে সৎ-বোন মনীষা, বাবা পথে হাঁটতে হাঁটতে আর্কাদি গাইদারের লেখা চুক আর গেকের কাহিনি শোনায় তাদের। সে কাহিনির আবেশে তারাই কখনও হয়ে যায় চুক আর গেক, কখনও তারা গেওর্গি আর জেনিয়া। বাবা বলে ওঠে গাইদার মানে পথদেখিয়ে। বলশেভিক সেনাদের সাথে গাইদারের দেখানোর পথে এগিয়ে চলে তথাগতও, স্বপ্ন দেখে সবার জন্য ধোঁয়া-ওঠা ভাতের লড়াইয়ের। আর তারপর তথাগত বড়ো হয়ে যায়: “আমি বড় হলাম হঠাৎ করে, মাত্র এক রাতের অন্ধকারে”।
মুজিবহত্যা-পরবর্তী অশান্ত বাংলাদেশে কি সত্যিই নিশ্চিন্দিপুর থাকা সম্ভব? রাতের অন্ধকারে রাতবাহিনী এসে নামিয়ে ফেলে একের পর এক বই, লাল বই বাদে জ্বালিয়ে দেয় সব প্রতিক্রিয়াশীল আবর্জনা। এরপর, মাস্টারমশাইদের বেতের বাড়ি। এরপর, ক্ষুধা। এরপর, কচুর লতি তোলবার নেশায় উত্তাল তথাগত আর মনীষা গা ভাসিয়ে দেয় গ্রামবাংলার সবুজে সবুজে, আর নালার মধ্যে কচুপাতার ফাঁকে পড়ে থাকে গলাকাটা লাশ। এরওপর রুদ্ধশ্বাসে তথাগত-মনীষার দৌড়, “দৌড়াতে দৌড়াতে অপু-দুর্গার রেলগাড়িকেও ছাড়িয়ে আসি আমরা।” ঘাসুড়ে হালিম নানার নির্বিকার কণ্ঠ, “শালারা দুনিয়ায় আর খেত পায়নি। আমার খেতে মা’রে রেখে গেছে।” রাতবাহিনী-রক্ষীবাহিনী-জলপাইবাহিনীতে জর্জরিত গ্রামবাংলায় বিস্ময় নেই, মায়াবাস্তব নেই, রয়েছে শুধু স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক মৃত্যু আর তথাগতর ভাঙন ও বড়ো হয়ে যাওয়া।
***
ভাঙনের উপন্যাসের পাঠক হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন, এরপরে ওপথের বাঁক তথাগত ও পাঠককে আশ্চর্য সুন্দর কিছুর সম্মুখীন করবে, হয়তো তথাগত অপুর মতোই পথের বাঁকে রাণুদি, কাজলদের খুঁজে পাবে। Reverse bildungsroman-এর কাঠামোয় এধরনের প্রত্যাশা থাকলে পাঠক কিছুটা হতাশই হবেন। যে উপন্যাসের শিরোনামে মৃত্যুর ইঙ্গিত, যে কাহিনির ছত্রে ছত্রে চরিত্র হিসেবে ১৯৭৫-পরবর্তী স্বপ্নভঙ্গের বাংলাদেশ, সেখানকার পথচলা কেমনই বা হতে পারে? বাহিনীতে-বাহিনীতে জর্জরিত ভ্রাতৃহত্যায় নিমজ্জিত দেশে পথচলার অর্থই লাশে ঠোক্কর খাওয়া। গাঁজার ধোঁয়ায় ডুবে গিয়ে হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেও তাই তথাগত মানুষ-তাড়ুয়াদের ভুলতে পারে না কখনও। আধুনিক সমালোচকরা একে বলবেন trauma, অর্থাৎ তীব্র মানসিক আঘাত।
তথাগতর trauma, তার সুতীব্র মানসিক আঘাত, কেবলমাত্র তার একার আঘাত নয়। এই আঘাত সমষ্টির, যাকে সমালোচনার ভাষায় বলা যায় collective trauma। স্বাধীন বাংলাদেশের সাহিত্য বার বার ঘুরে-ফিরে গেছে এই সমষ্টিগত, জাতীয় আঘাতে, বার বার চেষ্টা করেছে তার ব্যাখ্যা করবার। কখনও এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, এসেছে যুদ্ধকালীন গণহত্যা, এসেছে রিফিউজি ক্যাম্প, এসেছেন বীরাঙ্গনারা। কখনও এসেছে এরশাদের সামরিক শাসন, জলপাই বাহিনীর তাণ্ডব (যা তথাগতর মুক্তিযোদ্ধা পিতাকেও ছেড়ে কথা বলে না)। এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের গকাটা-বাহিনী আর রাজপথে রক্ত, ছাত্রদের স্লোগান, “একদফা একদাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি?” ‘আমরা হেঁটেছি যারা’-র পটভূমিকা মূলত মুজিব-হত্যা পরবর্তী অন্ধকার সময়টা হলেও শামীমের উপন্যাসের ক্যানভাস এই নিরবচ্ছিন্ন collective trauma-কে ধরবার চেষ্টা করে, হালকা কলমের আঁচড়ে বুঝিয়ে দেয় কত গভীর সেই আঘাত। সে আঘাত একভাবে স্পর্শ করে তথাগতর বাবা, মা, সৎমা-কে। আবার তথাগত, মনীষা, মামুন, মারিয়া—নতুন প্রজন্মের কারও শৈশবও নিস্তরঙ্গ নয়, কোনো না কোনো ধাক্কায় এক রাতের মধ্যে বড়ো হয়েছে তারা সকলেই। এহেন আঘাতের বীভৎস ছোঁয়াতে গ্রামবাংলার স্নেহশীল চরিত্র—বিভূতিভূষণ-সহ বাংলাভাষী সাহিত্যে যা বহুবার মোটিফ হিসেবে ফিরে আসে—বদলে যায় মরীচিকার ন্যায়। শামীমের আখ্যায়ক নিষ্ঠুর নন—তিনি একই সাথে সহানুভূতিশীল ও নিঃস্পৃহ। অসামান্য গদ্যের মোচড়ে সময়ের ধারাবাহিকতা ভেঙে যায়, তথাগত ও বাংলাদেশের ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান এক হয়ে যায়।
যাত্রার শেষে যখন হঠাৎ করে বড়ো হয়ে যাওয়া তথাগত শৈশবের স্বপ্ন দেখে, জীবনানন্দর লাইনগুলি মনে পড়ে যায় আবার,
আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখিপাখালির ডাক
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!
কিছু কাহিনির উপসংহার এরকম ধূসরই হয়ে থাকে। পড়ে থাকে একরাশ বিস্ময়চিহ্ন।
বইয়ের প্রকাশক কারা, কোথায় পাব, পড়া বইতে তার উল্লেখ থাকলে ভাল হয়।
লেখকের নাম ইমতিয়ার #শামীম হবে, মোটেই #শমীম নয়, প্রিয় লেখকদের একজন। ছোটগল্পেও তিনি সমান দক্ষ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও গবেষণা করেছেন কিছু। তার মনে রাখার মতো আরেকটি গল্প সংকলন "ডানাকাটা হিমের ভেতর"।
প্রতিভা দি, প্রযুক্তির যুগে এপার-ওপারের বই প্রাপ্তি খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। তুমি " উজান'এর সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারো, তারা গুরুচন্ডালীর বাংলাদেশ এজেন্ট হলেও ভারত-বাংলাদেশের অর্ডারি বই বেচাকেনায় খুবই পেশাদার বলে জানি।
আচ্ছা সত্যি তো এই লেখায় 'শমীম' করে দেওয়া হয়েছে কেন? স্বাতী মৈত্রর আসল লেখায় শামীম-ই ছিল, সঙ্গে দেওয়া প্রচ্ছদ -এ শামীম লেখা আছে। সেক্ষেত্রে একাধিকবার শমীম করা কেন? প্রপার নাউনে এরকম খুশীমত বদলানো যায় নাকি?
আর কিছুদিন আগে বুলবুলভাজা বা ভোটবাক্স কিছু একটায় একজনের লেখা দেখেছি, লেখাকের নাম 'সৌরব' । আমরা জানি সৌরব ভুল শব্দ আসলে সৌরভ, কিন্তু যেহেতু নামবাচক বিশেষ্য কাজেই সেখানে ঠিক করে দেবার কারিকুরি করা হয় নি।