বুরহান ওয়ানির হত্যা 'বিচার-বহির্ভূত' ও তার তদন্তের প্রয়োজন - এই আপাতদৃষ্টিতে 'বিতর্কিত' আর 'শকিং' মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মিডিয়ার অনেকেই আমাকে এই বিষয়ে বিশদে বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করেছেন, অতএব এই প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক।
বুরহান ওয়ানির হত্যা 'আসল' কি 'সাজানো' এনকাউন্টারে হয়েছে তাতে হয়তো বেশিরভাগ কাশ্মীরি মানুষেরই কিছু এসে যায় না। তাঁদের কাছে বিষয়ের মূল এই, যে বুরহান ওয়ানির হত্যার জন্য দায়ী ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা - ঠিক যেরকম ভাবে আরও অনেক কাশ্মীরি তরুণ-তরুণীর হত্যা হয়েছে, এবং হয়েই চলেছে। তাঁদের ক্ষোভ, তাঁদের শোক, এগুলোর সাথে এই এনকাউন্টারের সত্যমিথ্যা জড়িত নয়। তাঁরা ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে যথাযথ প্রক্রিয়া বা ন্যায়বিচার আশা করেন না। সাধারণত আমাদের মতন সামাজিক অধিকারের লড়াইয়ে সক্রিয় কর্মীরাই এই দাবি তুলে থাকেন - যথাযথ প্রক্রিয়ার দাবি, ভারতীয় সংবিধান-ব্যবস্থার সম্মানরক্ষার দাবি, সংঘর্ষপ্রবণ এলাকাগুলিতে সেনাবাহিনিকে দায়িত্ব এড়াতে না দেওয়ার দাবি। (অনেক সময় আমার মনে হয় এই পুরোটাই একটা ক্লান্তিকর, অনর্থক প্রচেষ্টা।)
মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট বহুবার আদেশ দিয়েছেন যে প্রতিটি এনকাউন্টারের ক্ষেত্রে এফআইআর করতে হবে, ম্যাজিস্টেরিয়াল এনকোয়ারি করতে হবে, ক্রিমিনাল তদন্ত এবং মামলা করতে হবে। এফআইআর ও মামলার অর্থ কি? অর্থ এই, যে যে কোন এনকাউন্টারের ক্ষেত্রে প্রথমে এটাই ধরতে হবে যে সেই এনকাউন্টার আইনসংগত নয়, এবং তারপর প্রমাণ করতে হবে যে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কাছে আত্মরক্ষার কারণে সরাসরি হত্যা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা। সুপ্রিম কোর্টের ২০১৪ সালের রায়ে এই বিষয়ে খুব পরিষ্কার কিছু নির্দেশ আছে। ৮ জুলাই ২০১৬-এ মণিপুর থেকে আফস্পা সরানোর বিষয়ে এক শুনানিতে (যেখানে ১৫২৮টা 'সাজানো' বা 'ফেক' এনকাউন্টার-এর কথা উঠে আসে) সুপ্রিম কোর্ট আবার এই অনস্বীকার্য সত্যের পুনরাবৃত্তি করেন - 'বিচার-বহির্ভূত' হত্যাকাণ্ড ন্যায়সংগত নয়, তা সে যতই কিছু রাজনীতিবিদ ও টেলিভিশন অ্যাংকর দাবি করুন না কেন, তা সে মৃত ব্যক্তি নিশ্চিন্তভাবে 'আতঙ্কবাদী', 'ক্রিমিনাল' বা জঙ্গি হোক না কেন। এক বার থেমে একটু ভাবুন - ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে ১৫২৮টি হত্যা, শুধু মণিপুর রাজ্যে! এমন একটা সংখ্যা যা মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের কোনভাবে রং চড়ানো বা অভাবনীয় মনে হয়নি! এই সংখ্যা থেকে আমরা একটা জিনিস পরিষ্কার দেখতে পাইঃ এ দেশে 'সাজানো' এনকাউন্টার - 'বিচার-বহির্ভূত' হত্যাকাণ্ড - মোটেই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এতে রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রকদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এই প্রকারের হত্যাকাণ্ড পলিসির অঙ্গ। এই পরিস্থিতিতে আমরা যদি জানতে চাই বুরহান ওয়ানির হত্যা 'সাজানো' ছিল কি না, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজন কি সত্যি খুব আশ্চর্য হবেন? তাঁরা কি ভাবে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন যে এই বিশেষ এনকাউন্টারটি কোনভাবেই আইনবহির্ভূত নয়?
এরপর একটু বুরহান ওয়ানির হত্যা-পরবর্তী ঘটনাবলি দেখা যাক, বুরহান ও তারপরে কাশ্মীরের কিছু সাধারণ মানুষের হত্যার রাজনৈতিক ফলাফলের একটু বিশ্লেষণ করা যাক। এই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে হাজারে হাজারে কাশ্মীরি মানুষ বুরহানের মৃত্যুর শোকে রাস্তায় নেমেছিলেন, এবং হয়তো আরও সহস্র মানুষ নীরবে নিজের বাড়ির ভিতরে তার জন্য শোকপালন করেছেন। তাঁদের উপর গুলি চালানো হচ্ছে, তাঁদের হত্যা করা হচ্ছে - মৃতের সংখ্যা এই লেখার সময় ২১, এবং তা বেড়েই চলেছে। এই ঘটনাবলি সম্পর্কে আমরা ভাবতেই পারি যে বুরহান ওয়ানির হত্যায় শোকাক্রান্ত এবং 'আজাদির' দাবী রাখা যে কোন কাশ্মীরি 'সন্ত্রাসবাদী', এবং তাঁদের রাস্তায় 'কুকুরের মতন' মৃত্যুর বেশি কিছু প্রাপ্য নয়। @ggiittiikkaa নামে একটি টুইটার হ্যান্ডেল লিখেছেন,
"জঙ্গি বুরহানের শেষকৃত্যে ২০ হাজার লোক গেছে। এই ২০ হাজার শুয়োরের উপর বোমা মেরে এদের আজাদি দেওয়া উচিত ছিল।" (20k attended the funeral of terrorist Burhan. Should have dropped a bomb and given Azadi to these 20k pigs.)
ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীও এই টুইটার হ্যান্ডেলটি ফলো করেন। এখন আপনিও যদি এই মনে করেন যে গোটা একটা জাতির মানুষকে আতঙ্কবাদী শুয়োর বলে দেগে দেওয়া যায় ও তাঁদের গণহত্যা হওয়া উচিত বলে দেওয়া যায়, তাহলে আপনাকে আমার কিছু বলার নেই। শুধু এটুকুই বলতে পারি যে আপনার কথাগুলো হয়তো আপনার পরিচিত মহলে কিছু শ্রোতার খুব ভালো লাগতে পারে, কিন্তু বাকি পৃথিবীর চোখে এটা ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার হাতে কাশ্মীরিদের অত্যাচারের আরেকটা নমুনা হয়ে থাকবে, ব্যস। যদি ভারতবাসীর চোখে কাশ্মীরিরা মানুষ না হন, যদি ভারতবাসীর চোখে তাঁরা নেহাত শুয়োরের ন্যায় কিছু প্রাণী যাঁদের কোন ন্যায্য রাজনৈতিক বিচার ও দাবীদাওয়া থাকতে পারে না, যদি তাঁদের শোক-হতাশা কিছুই ধর্তব্যের মধ্যে আসে না, তাহলে তাঁরা ভারতবর্ষের অঙ্গ হয়ে কেন থাকতে চাইবেন?
তবে আমি তাও আশা করবো যে এখানে কিছু পাঠক রয়েছেন যারা প্রথমেই কাশ্মীরিদের 'আতঙ্কবাদী' ধরে না নিয়ে একটু জানতে চান কেন কাশ্মীরের মানুষ আজ শোকগ্রস্থ, কেন তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন আজ প্রতিবাদ-মুখর হয়ে।
আপনিও যদি সেই পাঠক হন, তাহলে আসুন প্রথমে জিজ্ঞেস করি বুরহান ওয়ানি তার বেছে নেওয়া এই ভয়ংকর পথে কেন হেঁটেছিল।
কাফিলাতে শুদ্ধব্রত সেনগুপ্ত 'Kashmir Burns, Again’ নামক একটি লেখায় লিখেছেন,
২০১০ সালের অক্টোবর মাস। বুরহান ওয়ানি - তখন ১৬ বছরের - তার বড় ভাই খালিদ ওয়ানি ও আরেক বন্ধুর সাথে বাইকে চেপে ঘুরতে বেরিয়েছিল তাদের ট্রাল এলাকায়, যেমন এই বয়সী ছেলেরা করেই থাকে যে কোন জায়গায়। জম্মু আর কাশ্মীর পুলিশের স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের একটা পিকেটে তাদের আটকানো হয়, এবং বলা হয় সিগারেট নিয়ে আসতে। খালিদ যায় সিগারেট আনতে, বুরহান ও তাদের অপর সাথী অপেক্ষা করে থাকে। সিগারেট দেওয়ার পর কোন কারণ ছাড়াই ট্রুপের লোকজন ছেলে তিনজনের উপর চড়াও হয়। তাদের মারধোর করা হয়, খালিদের প্রিয়তম বাইকটা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। খালিদ এরপর অজ্ঞান হয়ে যায়। সেদিন হয়তো সবথেকে বেশি আহত হয়েছিল ১৬ বছরের বুরহান, তবে সেই আঘাত অদৃশ্য - এমন এক আঘাত যেটা হয়তো যে কোন সেলফ-রেসপেক্টিং তরুণই বোধ করবে যদি তাকে অকারণে মার খেতে হয়।
পাঠক মনে রাখবেন যে ২০১০ সালে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে কাশ্মীরে অন্তত ১১২ জন সাধারণ মানুষের হত্যা হয় একের পর এক অবান্তর কারণে। ১৬ বছরের বুরহান ওয়ানির মনে এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডগুলি গভীর ছাপ ফেলে গেছিল নিঃসন্দেহে, ঠিক যেমন তার বাইকসফরের শেষের দুঃস্বপ্ন, হেনস্থা ও অত্যাচার তার মনে দাগ কেটে বসে। শুদ্ধব্রত লিখেছেন, "হয়তো কিশোর বুরহানের সেইদিনই মৃত্যু হয় যেদিন তার দাদার বাইকটা খুব সহজে, খুব অবহেলার সাথে মাঝরাস্তায় থামানো হয়। হয়তো 'জঙ্গি' বুরহান, যে কিনা বড় হয়ে 'জঙ্গি কমান্ডার' বুরহান হয়ে ওঠে, সেইদিনই জন্মগ্রহণ করে। ... কমান্ডার বুরহান ওয়ানির জন্ম ও মৃত্যু ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে, সেই ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা যা বুরহানের মতন বুদ্ধিমান, তরতাজা এক তরুণের সামনে অস্ত্র তুলে নিয়ে তার হৃত আত্মসম্মান ফিরিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো রাস্তা রাখেনি।"
এই মুহূর্তে কাশ্মীরে আরও মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। তাঁদের হেনস্থা করা হচ্ছে, অন্ধ বা বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের মধ্যে কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। আহতদের ফেরি করা অ্যাম্বুলেন্সকে আক্রমণ করা হচ্ছে। এক মিনিট একটু সময় নিয়ে ভাবুন। একবার মনে করুন শেষ কবে আপনি নিজে - আপনি, সাধারণ দেশপ্রেমী ভারতীয় নাগরিক - এমন কোনো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন যাকে সরকার বা পুলিশ অন্যায্য বলে মনে করেছে। যেমন ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের আন্দোলন, যেখানে হাজার হাজার মানুষ ইন্ডিয়া গেটে উপস্থিত হন ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে। যদি আপনি তাঁদের সাথে পথে নেমে থাকেন, বা যদি আপনার তাঁদের প্রতি সামান্য সহানুভূতিও থেকে থাকে, তাহলে একবার মনে করুন - সরকার যখন তাঁদের উপর লাঠি চার্জ করে, কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করে, তখন আপনার কতটা রাগ হয়েছিল? একবার কল্পনা করুন যদি সেখানে লাঠির বদলে বুলেট চলত, যদি আন্দোলনকারীরা আহত বা নিহত হতেন - আপনার কেমন লাগতো? ভাবুন কেমন লাগতো যদি মিডিয়া তাঁদের সেই আন্দোলনকে ন্যায্য মনে না করতো, যদি পুলিশের হিংস্র ব্যবহারের নিন্দা না করে তাঁদের মৃত্যুকে 'দেশের' বিজয় হিসাবে দেখত। ভাবুন যদি এটা নেহাত একবারের বিচ্ছিন ঘটনা না হয়ে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ঘটতে থাকা এক হিংস্র হত্যালীলা হত, যাতে বারবার সাধারণ মানুষের রক্তপাত ঘটে। কল্পনা করুন যদি এমন হত যে এই বিষয়ে আপনি কোন সেমিনার করার অধিকার রাখেন না, কোন স্লোগান তোলার অধিকার রাখেন না। আপনি মুখ খুললেই আপনার হেনস্থা হবে, আপনি অ্যারেস্ট হবেন, আপনার উপর অত্যাচার করা হবে। আপনার ওপর এরকম একটা ঘটনার প্রভাব কি হত? আজকের তরুণ কাশ্মীরিরা কি করবেন? আর কত বুরহান জন্মাবে, আর কজন বুরহানের হত্যা হবে?
(চলবে)
মূল লেখাটি কাফিলায় প্রকাশিত ও লেখিকার অনুমতিক্রমে অনূদিত।