
আপনি কখনো হুমায়ুনপুর গেছেন?
হৌজ খাস ডিয়ার পার্কের পাশ দিয়ে সোজা সফদরজং এনক্লেভের এনসিসি গেটের দিকে চলে যান, তারপর বাঁ দিক নিলেই একটা সরু গলি। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা, একটা বিশাল ময়লার ভ্যাট, অনেক সবুজ-হলুদ অটো, একজন নাপিত, একটা ছোট্ট ডিডিএ-র পার্ক। আশেপাশে সফদরজং এনক্লেভের একেকটা আলিশান বাংলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এইগুলো পার করে সোজা গিয়ে যেখানে ধাক্কা খাবেন, সেটাই হচ্ছে হুমায়ুনপুর ভিলেজ, রাজধানী দিল্লীর অন্তর্গত বহু জাট গ্রামগুলোর একটা।
হুমায়ুনপুরের ইতিহাস নিয়ে অনেক গল্প আছে। শোনা যায় ১৬৭৫ সালে রূপা রাম আর রতিয়া সিং টোকাস এই গ্রাম স্থাপন করেন। আরও একটি কাহিনী বলে ১৬৭৫ নয়, ১৬৮৩ সালে চৌধুরী দেবী সিং ফোগাট এই গ্রামের পত্তন করেন। আরেকটা গল্প আছে, সে তো আরও রোমাঞ্চকর — বাদশা ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে জাট বিদ্রোহের নায়ক গোকুলা জাট স্বয়ং নাকি এই গ্রামের পত্তন করেন! তবে এ নেহাতই কিম্বদন্তী, লড়াকু জাট নেতা গোকুলা দিল্লীতে তাঁর জীবদ্দশায় কোনোদিন পা রাখেননি। ইতিহাস বলছে যে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ার পরে আগ্রাতেই বাদশা ঔরঙ্গজেবের আদেশে তাঁকে হত্যা করা হয়। মূল ধারার ইতিহাসের বইয়ের পাতায় দিল্লী শহরের অলিগলির এ হেন লোকশ্রুতি-মিশ্রিত ইতিহাস কমই উঠে আসে।
হুমায়ুনপুরের জমির মালিক আজও কিছু জাট পরিবার। নগরায়নের কবলে পড়ে এক এক করে তাঁদের জমি চলে গেছে সফদরজং এনক্লেভের দখলে — বড় বড় অট্টালিকা উঠেছে, দক্ষিণ দিল্লীর অভিজাত মানুষজনের ঠাঁই হয়েছে সেখানে। পাশে গড়ে উঠেছে আরকে খান্না টেনিস স্টেডিয়াম, হৌজ খাস ডিসট্রিক্ট পার্ক, হৌজ খাস ডিয়ার পার্ক, অভিজাত দিল্লীবাসী সেখানে হাওয়া খেতে আর শরীরচর্চা করতে আসেন। কখনো কখনো ইতিহাসপ্রেমী কেউ হয়তো চলে আসেন হুমায়ুনপুরের পুরাতন ঐতিহ্যের টানেও, হৌজ খাসে ঘুরতে ঘুরতে ডিয়ার পার্কের ভিতরে কালি গুমটি বা বাগ-এ-আলম গুম্বদটাও দেখে যান। এইসবের মাঝে হুমায়ুনপুর গ্রামের এঁদো গলি বড় বেমানান, যেন অন্য একটা জগৎ। সন্ধ্যাবেলা গেলে এখনো দেখতে পাবেন খাটিয়ায় বসে হুঁকো টানছেন বিশাল পাগড়ি পরা একেকজন প্রৌঢ় চৌধুরী।
এ ছাড়াও হুমায়ুনপুরের একটা অন্য পরিচয় আছে, বিশেষ করে আমার কাছে : অভিজাত, কসমোপলিটান দক্ষিণ দিল্লীর বুকে এক টুকরো উত্তর পূর্ব, এই আমার হুমায়ুনপুর।
* সত্যি বলতে কী, উত্তর পূর্বের জগতের সাথে আমার সত্যিকারের আলাপ হয় নেহাতই বাঙালিসুলভ উপায়ে, অর্থাৎ কিনা পেটপূজার মাধ্যমে।
হস্টেলে থেকেছি দীর্ঘ নয় বছর, দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষজনের সাথে। মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত গন্ধে সারা হস্টেল ম-ম করতো, বুঝতে পারতাম না কী বস্তু — শুধু দেখতাম কেউ কেউ মুখ বেঁকিয়ে ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে দিত। তারপরে একদিন পরিষ্কার হল, জানতে পারলাম সেটা আসলে ব্যাম্বু শুটের গন্ধ, উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোয় অতি জনপ্রিয় খাদ্য বস্তু। তারও অনেক পরে ব্যাম্বু শুট রাঁধতে শিখলাম, রান্না করার পর সারাদিন বাড়িতে-হাতে গন্ধ লেগে থাকবে, এই ব্যাপারটা উপভোগ করতে শিখলাম — কিন্তু সে আমার হুমায়ুনপুর-উত্তর জীবন, সে কথায় পরে আসছি।
পাঠক হস্টেলে কখনো থেকে থাকলে সহজেই বুঝতে পারবেন যে পেটপূজা ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তা সহজে হয়ে ওঠেনা। অতএব পাশের ঘরের মেচনি — নাগাল্যান্ডের মেয়ে — যখন ভালোবেসে শুয়োরের মাংসের আচার খাওয়ায়, তাতে না বলি কেমন করে? টক-টক ঝাল-ঝাল, তার সাথে মাংসের ছোট ছোট টুকরোর অসামান্য মিশ্রণ, বিশ্বাস করুন তার সাথে হস্টেলের ট্যালট্যালে অড়হর ডালও অমৃতসমান।
অথবা বন্ধু দীপ — বাড়ি আসামে — যদি বলে, চল তোদের স্মোকড শুয়োর রান্না করে খাওয়াই, তাতেই বা কেমন করে আপত্তি করা যায়? দৃশ্যটা কল্পনা করে নিন : প্রাগৈতিহাসিক কয়েল হিটারে চড়ানো প্রেশার কুকার ও দেড় কিলো শুয়োর, তার সাথে নানান সবজি এবং লঙ্কা, অনেক অনেক লঙ্কা। প্রথমে শুকনো লঙ্কা, তারপরে সবুজ কাঁচা লঙ্কা, আর তারও পর, সবার শেষে, আমার ক্রমাগত শুকিয়ে যেতে থাকা মুখ দেখে একটাই ভূত জোলকিয়া, যার আরেক নাম নাগা মিরচি বা রাজা মিরচি।
তারপরের দৃশ্য? নাক-চোখ-মুখ সব দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, তাও হাভাতের মতন খেয়েই চলেছি, আর পাশ থেকে রাঁধুনি রান্নায় “ঝালের লেয়ার” সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা করছে সুবীরের সাথে।
তারপর ধরুন এরম্বা। বাবা বলে এক মণিপুরী ছেলে — তার আসল নাম কে জানে কী, সবাই তাকে বাবা বলেই ডাকতো — পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে গাঁজায় দম দিতে দিতে এমন এরম্বা বানাত মাঝে মাঝে যে আমাদের সেরকম আলাপ না থাকা সত্ত্বেও আরেক বন্ধুর ঘরে বসে দিব্য সোনামুখ করে খেয়ে নিতাম। কখনো তাতে শুধুই শুঁটকি আর আলু সেদ্ধ, কখনো শুঁটকি, ব্যাম্বু শুট, এবং আলু সেদ্ধ। সব সময়েই সেটা ঝাল, ভীষণ ঝাল। সব সময়েই সেটা অসম্ভব উপাদেয়, কবে যে ভূত জোলকিয়ার ঝাল খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে নিজেও বুঝতে পারিনি।
অথবা সোনালির রান্না করা শুঁটকি ( ত্রিপুরায় মানুষ), তাতেই বা না বলি কেমন করে? হস্টেলে, তারপর মুনিরকা ভিলেজের ছোট্ট একটা ঘরে বসে বহুদিন পরম উপাদেয় রান্না খেয়েছি, তার সাথে উত্তর পূর্বের শুঁটকির সাথে দক্ষিণ ভারতের শুঁটকির ফারাক জেনেছি, জেনেছি কেমন করে আগরতলার রাস্তায় বাঁশের ভিতরে পুরে ভাত রান্না হয়, আর সাথে শুয়োর । কেভির মায়ের পাঠানো স্মোকড শুয়োর (রান্নার উনুনের ধোঁয়ায় তৈরি, বাড়িতেই) খেতে খেতে নাগা উপজাতি আইন ও তার সমস্যা নিয়ে অবহিত হয়েছি, কেভি আর কৌস্তুভের বিয়ে নিয়ে চার্চ আপত্তি করায় তাদের সাথে সাথে আমিও ক্ষুব্ধ, বিরক্ত হয়েছি।
এরকমভাবেই কেমন করে যেন প্রবাসী জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে জড়িয়ে গেছে উত্তর পূর্ব ও তার অসংখ্য মানুষ। শিক্ষা ও কর্মের দায়ে ঘর ছেড়ে বহু দূরে রুখাশুখা রাজধানী শহরটায় কোনভাবে নিজেদের জায়গা নিয়েছি আমরা সকলেই।
* কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় ক্লাসে প্রেরণা, পূজাদের 'চিঙ্কি' বলা হত — আর সবার মতন আমিও বলতাম। ওদের বাড়ি কোথায় কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি, শেরপা বা রোকা যে আমারই মতন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হতে পারে, এটা জানারও চেষ্টা করিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিশাল সবুজ ক্যাম্পাস আর লাল বাড়িগুলোয় ঢোকার পর এ হেন মুর্খামি আর করিনি কখনো, কিন্তু শিক্ষা অনেক বাকি ছিল তখনো। সেই ২০০৭ সালে দিল্লী পুলিশ যখন উত্তর পূর্বের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ বুকলেটে উপদেশ হিসেবে ছোট জামা পরতে আর দুর্গন্ধযুক্ত খাবার-দাবার রান্না করতে বারণ করলো, আমি বিরক্ত হয়েছিলাম মনে আছে। অল্প বয়স তখন, মরাল জেঠুগিরিটা ভালো লাগেনি। আর পাঁচটা ছাত্র সংগঠনের মতন যখন উত্তর পূর্বের সংগঠনগুলো প্যাম্ফলেট বার করতো, শুকনো রুটি আর আলু-করেলার বিস্বাদ তরকারি চিবোতে চিবোতে সেগুলোও মন দিয়ে পড়তাম। তবে কিনা যেখানে জীবনের অঙ্গ অ্যাডভেন্ট ক্রিসমাসের গান আর চন্দ্রালোকে থাবাল চংবার নাচ, যেখানে তামিল শিক্ষক ইস্টারিন কিরের ভক্ত, যেখানে সুবীরের ডুমডুমায় বড় হয়ে ওঠার গল্প শুনে কেটে গেছে অনেক সন্ধ্যা, যেখানে মৌসুমির রুমমেট মাপুই আর প্রিয়াঙ্কার রুমমেট মেচনি, যেখানে কনফ্লুএন্সে সবার সাথে গুঁতোগুঁতি করে খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে মনোজের কাছ থেকে একটু বেশি মাংস আদায় করে নেওয়াটাই আনন্দ, সেখানে খুব বেশি ভাবার অবকাশ হয়নি।
২০১২ সালে ব্যাঙ্গালোরে গুজব ছড়িয়ে রাজ্যছাড়া করা হল প্রায় হাজার ছয়েক উত্তর পূর্বের বাসিন্দাকে, ততদিনে অনেকটাই বয়স বেড়েছে। খবরের কাগজের পাতায় যে মাঝে মাঝেই উত্তর পূর্বের কারো না কারো ধর্ষিত, আহত, নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা উঠে আসে, এটুকু খবর রাখি তখন। কিন্তু আমাকে — আমাদেরকে — ধাক্কা দিয়ে গেলো নিডো টানিয়া। ১৯ বছরের যুবক, অরুণাচলের নিডো টানিয়া! ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস। লাজপত নগরের বহু পরিচিত রাস্তায় এক বচসার সূত্রে পিটিয়ে মেরেই ফেলা হল তাকে, নাকি তার চুলের ছাঁট নিয়ে বচসার সূত্রপাত! এই বয়সের অনেকগুলো ছেলেমেয়েকে আমি পড়াই সেই সময়, ওর মতই কেতামারা চুলের ছাঁট আর 'চিঙ্কি' চেহারা তাদের অনেকের — হিন্দি তেমন বোঝেনা বলে পাশের ক্লাসে হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে পড়াতে হয়, আর সব কটা ছেলে-মেয়ের মতন তাদেরও নানা রকম আশা আকাঙ্ক্ষা।
হয়তো নিডো টানিয়ার বাবা অরুণাচল প্রদেশের এমএলএ ছিলেন বলেই সরকার বাহাদুর তড়িঘড়ি মাঠে নামলেন, বেজবরুয়া কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হল উত্তর পূর্বের প্রবাসী বাসিন্দাদের নানান সমস্যা বিচার করে তার কিছু সমাধান সূত্র বার করবার। ২০১৪র জুলাই মাসে এমপি বেজবরুয়া তাঁর ৮২ পাতার রিপোর্ট জমা করলেন, সাথে এক গুচ্ছ রেকমেন্ডেশন।
সমস্যা কত রকমের? সমস্যা অসংখ্য, বলছেন বেজবরুয়া কমিটি। প্রথমত, উত্তর পূর্বের অধিকাংশ মানুষের চেহারা (আসাম ও ত্রিপুরার কিছু মানুষকে বাদ দিলে) মঙ্গলয়েড। তাঁদের মধ্যে অসংখ্য ভাষা ও জনজাতি থাকা সত্ত্বেও তার কোনো স্বীকৃতি তো নেই-ই, উল্টে তাঁদেরকে 'উত্তর পূর্ব' বলে একটা হোমোজিনাস শ্রেণীতে ফেলে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয়ত, উত্তর পূর্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক দৈন্যর কারণে চাকরির সুযোগ সীমিত, সীমিত নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও। তাই বছর বছর অগণিত মানুষ শিক্ষা ও চাকরির সন্ধানে ভারতবর্ষের বাকি অংশে, বিশেষত মেট্রো শহরগুলোয়, ছড়িয়ে পড়েন। তাঁদের সব থেকে পছন্দের গন্তব্যস্থল রাজধানী দিল্লী। তথ্য বলছে যে ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে উত্তর পূর্ব থেকে চার লক্ষেরও উপর মানুষ দিল্লী আসেন নানান কারণে। এর মধ্যে প্রতি বছর প্রায় দশ হাজার ছাত্রছাত্রীই থাকে।
এই বহুভাষী, বহু জাতির মানুষদের হিন্দি ভাষার জ্ঞান ও বাকি ভারতবর্ষের সাথে পরিচয় সীমিত, অর্থনৈতিক অবস্থাও যে বেশির ভাগের খুব ভালো, তা নয়। তাঁরা নানা 'ওরিয়েন্টাল' রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করে, বিউটি পার্লারের কর্মী হয়ে, রাস্তার ধারে মোমোর স্টল দিয়ে বা খুব বেশি হলে বিপিওতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের স্থান হয় এমন সব পাড়ায় যেখানে ঘরভাড়া অপেক্ষাকৃত ভাবে সস্তা, এবং বাড়িওয়ালা ঘোরতর আমিষ-বিরোধী নন — ভিলেজ অঞ্চলগুলোয় বিশেষ করে। যেমন মুনিরকা, যেমন খিড়কি, যেমন কিষেণগড় বা হুমায়ুনপুর।
অপরিচিতি, যোগাযোগ ও কথোপকথনের অভাব, এই সব মিলিয়ে স্থানীয় মানুষজনের সাথে একের পর এক ভুল বোঝাবুঝি হতে থাকে। কখনো বা আপত্তি ওঠে রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে, কখনো বা কথা ওঠে মেয়েদের খোলামেলা পোশাক, গান বাজনা নিয়ে, কখনো অভিযোগ ওঠে নেশা করার। কখনো আবার শুধুই রান্নার গন্ধ নিয়ে আপত্তি জানানো হয়। শুধু কী তাই? এর সাথে আছে ঘর ভাড়ার সমস্যা — ভিলেজ অঞ্চলে ঘর ভাড়া অনেক সময়েই হয় লীজ বা কনট্র্যাক্ট ছাড়া। ভাড়া দিতে হয় নগদে, আর বাড়ির মালিক আপনাকে দু দিনের নোটিশে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলতেই পারেন, আপনার কিচ্ছুটি বলার নেই। পুলিশও আপনার জন্য কুটোটি নাড়বেনা, উল্টে আবার কিছু উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দিতে পারে। কর্মস্থলে ও দৈনন্দিন জীবনে জাতিভিত্তিক হেনস্থা তাঁদের নিত্যসঙ্গী, লাঞ্ছনা ও ভয় তাঁদের রোজকার অভ্যাস। এরকম ভাবেই তাঁদের অভিবাসী জীবন কাটে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, শুধু মাঝে মাঝে কয়েকটা নিডো টানিয়া হারিয়ে যায়।
এই সকল সমস্যার সমাধান সূত্র হিসেবে বেজবরুয়া কমিটি অনেকগুলো রেকমেন্ডেশন প্রস্তুত করেছেন। তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভবত জাতিগত বৈষম্য-বিরোধী আইন নিয়ে আসার দাবি, যা উত্তর পূর্বের আরও অনেক সংগঠন বহুদিন ধরে করে এসেছে। কমিটির ভাষাতেই বলা যাক : "আমরা মনে করি যে আমাদের সাংবিধানিক পরিকাঠামোর মধ্যে একটি বর্ণ/জাতিগত বৈষম্য-বিরোধী আইনের তাত্ত্বিক, কৌশলগত, ও আইনি দিকগুলো বিবেচনা করে আলোচনা করা উচিত, এবং ভবিষ্যতে এই নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।"
পুলিশি অকর্মণ্যতার বিরুদ্ধেও সরব বেজবরুয়া কমিটি। যতদিন এই বৈষম্য-বিরোধী আইন নিয়ে আলোচনা চলে, ততদিন উত্তর পূর্বের অভিবাসীরা যেন আইনের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার পান, এই প্রসঙ্গে রিপোর্টে অনেক রকম বক্তব্য আছে। স্থানীয় মানুষের সাথে অভিবাসীদের যাতে যোগাযোগ বাড়ে, সেই নিয়েও আছে অনেক সমাধান সূত্র।
অবশ্য বেজবরুয়া কমিটির রিপোর্ট যতদিনে জমা পরে, ততদিনে নয়া দিল্লীর মসনদে পালাবদল হয়ে গেছে। শাসক দলের আগ্রাসী "লুক নর্থ ইস্ট" পলিসি সত্ত্বেও বেজবরুয়া কমিটির রিপোর্ট, আরও অনেক বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টের মতন, রাইসিনা হিলের কোনো ক্যাবিনেটে তালাচাবি বন্ধ হয়ে পরে আছে, ফাইলে ধুলো জমছে।
২০১৪ থেকে ২০১৭র মধ্যে দিল্লী শহরে উত্তর পূর্বের মানুষদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে ৭০৪টি কেস রেজিস্টার করা হয়। সেই তিন বছরে হুমায়ুনপুর অনেক বদলেছে ঠিকই, অনেক দোকানপাট উঠে গিয়ে নতুন দোকান খুলেছে, অনেক জাট চৌধুরীর বাড়ি আরও বড় হয়েছে, তাও হুমায়ুনপুর আছে হুমায়ুনপুরেই।
* প্রথমবার হুমায়ুনপুর পৌঁছেছিলাম আচারের সন্ধানে।
যে সে আচার নয় কিন্তু, ব্যাম্বু শুট আর ভূত জোলকিয়ার সংমিশ্রণে তৈরি সেই আচার। পাঠককে আগেই বলেছি, হস্টেলে থেকেছি দীর্ঘ নয় বছর। ট্যালট্যালে অড়হর ডাল/কালি ডাল, শুকনো রুটি আর আলু-করেলা/আলু-টিন্ডার বিস্বাদ তরকারি যিনি টানা কয়েক বছর অন্তত না খেয়েছেন, ব্যাম্বু শুট আর ভূত জোলকিয়ার আচারের মাহাত্ম্য হয়তো তাঁকে বলে বোঝানো সম্ভব না।
হৌজ খাস ডিয়ার পার্কের পাশ দিয়ে সোজা সফদরজং এনক্লেভের এনসিসি গেট, সেখান থেকে বাঁ দিক নিলেই একটা সরু গলি। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা, একটা বিশাল ময়লার ভ্যাট, অনেক সবুজ-হলুদ অটো, একজন নাপিত, একটা ছোট্ট ডিডিএ-র পার্ক, এই সব কিছু পার করে হুমায়ুনপুরের এঁদো গলি। সেই গলি ধরে চলে গেলে — গাড়ি নিয়ে না ঢোকাই বাঞ্ছনীয়, যদিও জাট সুপুত্ররা যে সেখানে তাদের ইনোভা নিয়ে যায়না তা নয় — এক সময় বাঁ হাতে পড়বে আশার দোকান : আশা টাংখুল স্টোর।
দোকান নয় তো সে, যেন খাদ্য বা রান্নাপ্রেমী মানুষের জন্য তৈরি একটা ছোটখাটো স্বর্গ। ব্যাম্বু শুট পেয়ে যাবেন, ফারমেন্টেড এবং ফ্রেশ, যেরকমটি চাই। শুঁটকি পাবেন অনেক রকমের, কোন মাছ চাই? এর সাথে বাস্কেট ভর্তি আখুনি (ফারমেন্টেড সয়াবিন), আনিশি (ফারমেন্টেড কচু পাতা এক রকমের), এবং অবশ্যই লাল রঙের রাজা মিরচি, শুকনো, ফ্রেশ, দুটোই। বাড়িতে তৈরি ব্লাড সসেজ? সেটাও আছে, তার সাথে সারি সারি আচারের কৌটো, ইলিশ থেকে গো মাংস (বাফ বলে চালানো হয়), সবই পাবেন। তামুল চাই? নাগা আর অহমীয়াদের বড় প্রিয় এই পান সুপুরি, একদম সামনেই, ক্যাশ কাউন্টারের উপরে, রাখা থাকে। সন্ধ্যাবেলায় গেলে ডেকচি ভর্তি রান্না করা খাবারও পাবেন — উটি (এক রকমের সেদ্ধ ডাল), শুয়োর, বাফ, নাড়িভূরির এক সুস্বাদু ভাজা, কপাল ভালো থাকলে গেঁড়িগুগলির ঝোলও পেয়ে যেতে পারেন। ভারতবর্ষ আর বর্মার বর্ডারের কাছে আশার বাড়ি, টাংখুল উপজাতির বেশির ভাগ মানুষের বাড়িই সেখানে। মাঝে মাঝেই দোকান বন্ধ করে সে দেশে চলে যায়, ফিরে আসে নতুন জিনিসপত্রের সাপ্লাই নিয়ে।
উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকুন, এক কোণায় পাবেন ব্যাংকক থেকে সস্তায় আমদানি করা জামা কাপড় আর জুতোর দোকান। আরেক কোণায় হয়তো পেয়ে গেলেন মিজো মহিলার ছোট্ট দোকান, পেট ভরে সোচিয়ার — সেদ্ধ ভাতের সাথে শুঁটকি মাছ ভাজার এক অদ্ভুত মিশ্রণ, ভারতের উত্তর পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের প্রিয় খাদ্য — খেয়ে আসলেন তাঁর দোকানে, আইজলের রাস্তাঘাট নিয়ে একটু গল্পও হয়ে গেল। নেপালি থালি চাই? এই তো পাশের দোকানেই পেয়ে যাবেন, খোঁজ করলে জানবেন মালিকের বাড়ি কালিম্পং-এ। তার পাশের দোকানে আবার নানা রকম গান বাজনার সরঞ্জাম পেয়ে যাবেন। মণিপুরের রান্না চাই? তাড়াতাড়ি ইট ফ্যাম নামক রেস্তোরাঁটায় ঢুকে পড়ুন, রাত দশটার সময় বন্ধ হয়ে যায়। ভুটানের বিখ্যাত রান্না, এমা ডাশি খাওয়ার শখ হয়েছে? সেটাও পেয়ে যাবেন, ফ্রীডম কর্নারে চলে যান। এরই মাঝে কিছু তিব্বতের মানুষও কেমন করে যেন এসে পড়েছেন, ঝাল ঝাল লাফিং আর গরম মোমো পেয়ে যাবেন অনেকগুলো দোকানে, কোন মাংসের মোমো খাওয়া পছন্দ করবেন? এ ছাড়াও নাগা রান্না হুমায়ুনপুরের অলিতে গলিতে, অধুনা জোমাটো-খ্যাত হর্নবিল থেকে শুরু করে এই কদিন আগে খোলা ডাউন আন্ডার বা বেলি গিগলস, কোনো একটায় ঢুকে পড়লেই হল। ঝাল কেমন খাবেন বলে দিতে হবে, তারপর কেল্লা ফতে। আরও একটু হাঁটলে, কয়েকটা একেবারে উত্তর ভারতীয় মুদীর দোকানের পাশে, পেয়ে যাবেন কোরিজ — কোরিয়ান রেস্তোরাঁ! সস্তায় মন ভালো করা কিমবাপ বা রকমারি ডোসিরাক (কোরিয়ান থালি) খেয়ে আসবেন, সাথে ওদের বানানো অনবদ্য কফি।
আশার মতন বহু উদ্যমী মানুষ এসে পড়েছেন হুমায়ুনপুরের এই গলিঘুঁজিতে, জাট বাড়িওয়ালাদের সাথে কেমন করে যেন মানিয়েও নিয়েছেন। হুমায়ুনপুরের রাস্তায় তাই একটু হাঁটলেই আপনার কানে আসবে পাঁচ রকমের ভাষা, উত্তর পূর্বের একেকটা কোণা থেকে আসা নানান জাতি-উপজাতির মানুষকে পেয়ে যাবেন এই স্বল্প পরিসরের মধ্যেই। ঝামেলা যে একেবারেই লাগে না তা নয় — এই তো কদিন আগে পুলিসের কাছে চিঠি গেলো হুমায়ুনপুর কল্যাণকারী সমিতির তরফ থেকে, অনেক রাত অবধি আওয়াজ ও গান-বাজনা নিয়ে। চিঠির ভাষা পড়ে আপনার এম পি বেজবরুয়া কমিটির রিপোর্ট মনে পরে যেতে বাধ্য, যেখানে বেজবরুয়া নিজেই লিখছেন যে বাড়ি থেকে দূরে থাকার কারণে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা অনেক সময় জোরে জোরে রাত অবধি গান বাজনা করে, আড্ডা মারে, তাতে অন্য লোকজনের অসুবিধা হয়। ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়, তৈরি হয় সংঘাত। সেই সংঘাতের সমাধানসূত্র বেজবরুয়া কিছু ভেবে থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। হুমায়ুনপুর স্বর্গ নয়, আধুনিক নাগরিক জীবনের কসমোপলিটান আদর্শ নয়, নেহাতই দিল্লী শহরের বুকে এক ছোট্ট অভিবাসী গ্রাম, ইংরেজিতে যাকে 'ঘেটো' বলা হয়।
* আসবেন কখনো হুমায়ুনপুরে।
ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে, যখন রাজধানী দিল্লীর রুক্ষ ধোঁয়াশাময় রূপটা চাপা পরে যায় মায়াবী আলোয়, সেই সময়টা। চৌকে পৌঁছে মাতা রানীর মন্দিরটা বাঁ হাতে রেখে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাবেন, পাশেই সবজিওয়ালা রকমারি সবজি নিয়ে বসেছে। চৌধুরী সাহেব বাড়ির সামনের সরু রাস্তাটাতেই চেয়ার পাতছেন, হুঁকোর আগুন গরম হচ্ছে। একটু পরেই আড্ডা বসবে। আশা ও তার বাড়ির বাকি মেয়েরা তখন ভীষণ ব্যস্ত, সব রান্না শেষ করে ফেলতে হবে সময় মতন, সিংজু বানানোর জন্য সব সবজি কেটে ফেলতে হবে। ডাউন আন্ডারের মালিক ছেলেটি সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করেছে ল্যান্ডলাইনের কানেকশন নেওয়ার চক্করে, বিএসএনএল বারবার ঘুরিয়ে মারছে। তার দুই রাঁধুনি সহকর্মী গিটার নিয়ে বসেছে, গান হবে। এখনো তেমন কাস্টমার আসেনা তো, সদ্য খুলেছে তাদের দোকান। তার পাশের বাড়িটায় তখনো মিস্তিরিদের কাজ চলছে, নতুন চার তলা উঠছে, সাথে বিশাল কাঁচের দেওয়াল। মুদী দোকানে ডেভিড সুপুরি কাটছে। এক কোণায় দেওয়ালে কে যেন গ্রাফিত্তি এঁকে গেছে, "ফাক আফস্পা"। দু একটা কুকুর দৌড়াদৌড়ি করছে। ঘোমটা দেওয়া জাট রমণী দুধের ক্যান হাতে বাড়ি ফিরছেন, তারই পাশে পশ্চিমা ফ্যাশনে ধোপদুরস্ত দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসিখুশি ছাত্রী, বাড়ি তার মিজোরাম, অস্থায়ী ঠিকানা হুমায়ুনপুর।
Rajarshi Basu | unkwn.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:৫২82081
ddt | unkwn.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৭:৫৯82082
Du | unkwn.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৮:২৭82083
Sourav | unkwn.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৪:৩৬82084
প্রতিভা | unkwn.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৫:১৩82085
Amitayu | unkwn.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৫:১৭82089
অভিজিৎ | unkwn.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৭:২৩82086
অভিজিৎ | unkwn.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৭:৩৫82087
de | unkwn.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৯:০৩82088
i | unkwn.***.*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০২:০৫82090
শেখর | unkwn.***.*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৫:৫৬82091
সিকি | unkwn.***.*** | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:২১82092
সোম | unkwn.***.*** | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৫:১৫82093
শঙ্খ | unkwn.***.*** | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৫:৪২82094
I | unkwn.***.*** | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:৫৪82095
স্বাতী | unkwn.***.*** | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৫:০০82096
তথাগতা বসু | unkwn.***.*** | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৮:১৪82097
Parimal Ghosh | unkwn.***.*** | ০৩ অক্টোবর ২০১৭ ০৩:৩৭82098